ঠিক দশ মিনিটের মাথায় রায়ীনার ট্রাকিওশানটি তাকে সংকেত দিল, তার যাবার সময় হয়েছে। রায়ীনা উঠে দাঁড়াল, তার দুই বছরের মেয়েটির কাছ থেকে এখন তাকে বিদায় নিতে হবে। সে কী পারবে বিদায় নিতে?
রায়ীনা নরম গলায় ডাকল, “ত্রাতিনা, মা আমার।”
ত্রাতিনা ঘুরে তাকাল। তারপর তার দিকে ছুটে এলো। রায়ীনা দুই হাত বাড়িয়ে ত্রাতিনাকে জড়িয়ে ধরল। তাকে বুকে চেপে রেখে ফিসফিস করে বলল, “ত্রাতিনা, মা আমার। তুই ভালো থাকিস মা। তোর এই মায়ের ওপর কোনো রাগ পুষে রাখিস না মা। এই পৃথিবীতে তোরা যেন বেঁচে থাকিস, সে জন্যে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে সোনামনি।”
ত্রাতিনা তার মায়ের কথাগুলো বুঝতে পারল না। কিন্তু গলার স্বরের আকুতিটুকু বুঝতে পারল। সে অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল। রায়ীনার চোখে পানি টলটল করছে, সে খুব সাবধানে তার চোখ মুছে এবার ত্রাতিনাকে স্পষ্ট গলায় বলল, “যাও মা। তোমার ভাইবোনের কাছে যাও।”
ত্রাতিনা চলে গেল না। মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রায়ীনা আবার বলল, “যাও ত্রাতিনা। ওই দেখো, সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
ত্রাতিনা খপ করে রায়ীনাকে ধরে বলল, “না। না।”
রায়ীনা হতাশভাবে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে দেখল কাছাকাছি ডিরেক্টর ক্লারা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ীনা নিচু গলায় তাকে বলল, “তুমি কী আমার মেয়েটিকে ধরে রাখবে? আমার এখন যেতে হবে।”
ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “মাকে ছেড়ে দাও ত্রাতিনা, তোমার মায়ের এখন যেতে হবে।”
ত্রাতিনা তার মাকে ছেড়ে দিল। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
.
১.০৩
রায়ীনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মহাকাশযানের চেয়ারটিতে বেল্ট দিয়ে তাকে এমনভাবে বেঁধে রাখা আছে যে, সে নিচের দিকে দেখতে পাচ্ছে না। তার সামনে নীল আকাশ, সেখানে সাদা মেঘ। সে পৃথিবীটিকে আর কখনো দেখতে পাবে না, এই নীল আকাশ আর সাদা মেঘও কখনো দেখতে পাবে না। কিন্তু সে এই ধরনের ভাবালুতাকে তার চিন্তার মাঝে স্থান দিল না। মাথার ভেতর থেকে সব ধরনের চিন্তা সরিয়ে দিয়ে সে তার মিশনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
রায়ীনা সামনের প্যানেলটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কোয়াকম্পের সুইচ অন করল। জ্বালানি পরীক্ষা করল। কারগো বে’তে রাখা নিউক্লিয়ার বোমাটির নিয়ন্ত্রণ শেষবারের মতো দেখে নিল। মহাকাশযানের বাতাসের চাপ পরীক্ষা করল, বায়ু নিরোধক সিল পরীক্ষা করল। যোগাযোগ মডিউল চালু করল। তারপর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে কথা বলল, “আমি প্রস্তুত।”
রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পায়, “চমৎকার রায়ীনা। তোমার মিশন সফল হোক। আমরা কাউন্ট ডাউন শুরু করছি।”
“করো।”
প্রায় সাথে সাথেই আলোর ঝলকানির সাথে সাথে সে কাউন্ট ডাউন শুনতে পায়। ভরাট পুরুষ কণ্ঠে কোনো একজন গুনতে শুরু করেছে, “দশ, নয়, আট…।”
রায়ীনা একটা ঝাঁকুনি এবং তারপর একটা কম্পন অনুভব করে। তার মহাকাশযানটিকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বিশাল ক্ল্যাম্পগুলো ধীরে ধীরে দুই পাশে সরে যাচ্ছে। রায়ীনা টের পেলো, তার ইঞ্জিনটি চালু হতে শুরু
ত্রাতিনা করেছে। এক ধরনের ধাতব গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
“সাত…ছয়…পাঁচ…চার…”
পানি দিয়ে সিক্ত করে রাখা কংক্রিটের বেস থেকে ইঞ্জিনের উত্তাপে সাদা জলীয় বাষ্প চারদিক ঢেকে ফেলছে।
“তিন….দুই….এক…”
রায়ীনা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং হঠাৎ পুরো মহাকাশযানটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। রায়ীনা বাইরে তাকালো, মহাকাশযানটা ওপরে উঠতে শুরু করেছে। রায়ীনা তার সিটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণের ভেতরেই অদৃশ্য একটা শক্তি তাকে তার সিটের সাথে চেপে ধরবে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে বের হওয়ার সময় সব মহাকাশচারীদের এই অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। ট্রিটন রকেটের শক্তিশালী ইঞ্জিন প্রচণ্ড গর্জন করে তার ইলন শাটলকে মহাকাশে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। গতি বাড়তে শুরু করার সাথে সাথে রায়ীনা অনুভব করল, অদৃশ্য একটা শক্তি তার বুকের উপর চেপে বসেছে। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, মনে হয় চোখের সামনে একটা লাল পদা থরথর করে কাঁপছে। রায়ীনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে সমস্ত শরীরকে টান টান করে রাখে। সে বুঝতে পারছে, তার মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে বুঝি কিছু চিন্তা করতে পারছে না। রায়ীনা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। প্রতিবার মহাকাশ অভিযানে তাকে এই অদৃশ্য শক্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সে জানে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে পৃথিবীকে ঘিরে একটা কক্ষপথে ঢুকে যাবে। তখন হঠাৎ করে তার বুকের ওপর ভেসে থাকা জগদ্দল পাথরটি সরে যাবে। ইলন শাটলের ভেতর পুরোপুরি ভরশূন্য হয়ে সে ভেসে বেড়াবে।
রায়ীনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে এবং প্রায় হঠাৎ করেই তার মনে হয় তার বুকের ওপর চেপে বসে থাকা অদৃশ্য শক্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। নিজেকে মনে হয় হালকা এবং ভরশূন্য। রায়ীনা তার সিট বেল্ট খুলে নিজেকে মুক্ত করে নিল। তারপর ভেসে ভেসে জানালার কাছে এসে বাইরে তাকালো, নিচে নীল পৃথিবী। পৃথিবীটি কী সুন্দর, এটি মনে হয় শুধু মহাকাশে এলেই সত্যিকার অর্থে অনুভব করা যায়।