ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “রায়ীনা, তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। অমি কিছু জানতেও চাই না। একজন মা নিজে এসে তার সন্তানকে এই আশ্রমে দিয়ে গেলে আর কিছু করতে হয় না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তোমার মেয়ে ত্রাতিনা এখানে অন্য সব শিশুদের নিয়ে গভীর এক ধরনের ভালোবাসা নিয়ে একটা বিশাল পরিবারে বড় হবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। রায়ীনা।”
রায়ীনা খুব সাবধানে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তার চোখের কোনা মুছে নিয়ে ত্রাতিনার দিকে তাকালো। ত্রাতিনা তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা খেলনা ভালুকের মাথাটি ধড় থেকে টেনে আলাদা করার চেষ্টা করছিল।
রায়ীনা আবার ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকালো। তারপর পকেট থেকে ছোট একটা ক্রিস্টাল তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি জানি প্রথম প্রথম ত্রাতিনা আমাকে খুঁজবে, আমার জন্যে কাঁদবে। তারপর সে আস্তে আস্তে আমাকে ভুলে যাবে। বহুদিন পর সে যখন বড় হবে, তখন হঠাৎ একসময় হয়তো তার কৌতূহল হবে, সে জানতে চাইবে সে কোথা থেকে এসেছে। তার মা কে, বাবা কে, তার পরিচয় কী। তখন তুমি এই ক্রিস্টালটি ত্রাতিনার হাতে দিও। এখানে আমি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলেছি। আমার ধারণা, সে যদি এটা শোনে, তাহলে হয়তো তার মাকে সে ক্ষমা করে দেবে।”
ডিরেক্টর মহিলাটি হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টালটি নিয়ে বলল, “আমি এটা এখনই আমাদের সেফ ডিপোজিটে রেখে দিচ্ছি। ত্রাতিনা যখন পূর্ণ বয়সে পৌঁছাবে, তখন সেটি তার হাতে দেয়া হবে।”
“ধন্যবাদ তোমাকে।” রায়ীনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার হাতে সময় খুব কম। আমি কী ত্রাতিনাকে তোমাদের অন্য শিশুদের মাঝে রেখে আসতে পারি? তাহলে আমার বিদায় নেওয়া সহজ হবে।”
ডিরেক্টর মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অবশ্যই সেটি করতে পারবে। এসো আমার সাথে।”
রায়ীনা তখন হেঁটে ত্রাতিনার কাছে গিয়ে বলল, “এসো ত্রাতিনা, আমরা তোমার আপনজনের কাছে যাই।”
ত্রাতিনা কী বুঝল কে জানে, আপনজনের কাছে যাওয়ার জন্যে প্রায় লাফিয়ে রায়ীনার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রায়ীনা তাকে বুকে চেপে উঠে দাঁড়াল। ডিরেক্টর মহিলার পিছনে পিছনে সে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। করিডোরের শেষ মাথায় একটা বড় হলঘর। হলঘরের দরজা খুললেই দেখা গেল, ভেতরে অনেকগুলো নানা বয়সী শিশু হুটোপুটি করে খেলছে। তাদের ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন মাথা ঘুরিয়ে ডিরেক্টর মহিলা এবং রায়ীনার দিকে তাকাল। তাদের চোখ মুখ হঠাৎ আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠে এবং এক সাথে সবাই তাদের দিকে ছুটে আসে।
শিশুগুলো তাদের ঘিরে দাঁড়াল এবং অকারণে খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। রায়ীনা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ত্রাতিনাকে নামিয়ে দিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “ত্রাতিনা, এই যে, এরা তোমার ভাই বোন! তুমি যাবে তাদের কাছে?”
ত্রাতিনা একবার খানিকটা সন্দেহের চোখে মায়ের দিকে তাকালো, তারপর তাদের ঘিরে থাকা শিশুগুলোর দিকে তাকালো। তার চোখে মুখে দুর্ভাবনার একটা ছাপ পড়ল। সে বুঝতে পারছে না, হঠাৎ করে তার চারপাশে তার সমবয়সী এতোগুলো শিশু কোথা থেকে এসেছে।
একটি সোনালী চুলের মেয়ে ত্রাতিনার কাছে এসে সাবধানে তার হাতটি ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে চেষ্টা করল। ত্রাতিনা প্রথমে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। তারপর হঠাৎ কী মনে করে অন্য হাত দিয়ে মেয়েটির সোনালী চুলগুলো স্পর্শ করে দেখল। কী কারণ কে জানে কেন, হঠাৎ করে ত্রাতিনার মুখ থেকে দুর্ভাবনার চিহ্নটি সরে গিয়ে মুখটি হাসি হাসি হয়ে যায়। রায়ীনা নিচু গলায় বলল, “যাও ত্রাতিনা, যাও। তোমার ভাই বোনের কাছে যাও।”
ত্রাতিনা তখন খুব সাবধানে শিশুদের সাথে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যেতে থাকে।
রায়ীনা কিছুক্ষণ তার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কি কিছুক্ষণ এই ঘরটিতে থাকতে পারি?”
“অবশ্যই। তোমার বসার জন্যে একটা চেয়ার এনে দিই।”
“তার কোনো প্রয়োজন নেই।” রায়ীনা একটু পিছিয়ে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার হাতে একেবারে সময় নেই। দশ কী পনেরো মিনিটের ভেতর আমার ডাক পড়বে। তখন আমাকে যেতে হবে। যতক্ষণ আমাকে না ডাকছে, আমি ততক্ষণ এখানে বসে থাকতে চাই।”
ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “ছোট বাচ্চাদের চেঁচামেচি যদি তোমার নার্ভের উপর উঠে না যায়, তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা এখানে বসে থাকতে পার। তুমি সম্ভবত নিরিবিলি একা বসে থাকতে চাও। আমি তোমাকে একা থাকতে দিই?”
রায়ীনা একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আসলেই আমি একটু সময় একা বসে থাকতে চাইছিলাম।”
রায়ীনা দেওয়ালে হেলান দিয়ে একা একা বসে রইল। বড় হলঘরের এক পাশে ত্রাতিনা অন্য শিশুদের সাথে খেলতে শুরু করেছে। রায়ীনা বিচিত্র এক ধরনের লোভাতুর দৃষ্টিতে তার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। আর কোনোদিন সে তার এই সন্তানটিকে বুকে চেপে ধরতে পারবে না। এই শিশুগুলো যেন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে, সে জন্যে সে তার প্রাণটি দিতে যাবে। সেটি নিয়ে তার ভেতরে কোনো হতাশা নেই। কোনো জ্বালা কিংবা ক্ষোভ নেই। একটুখানি দুঃখ হয়তো আছে, কিন্তু সেরকম দুঃখ কার জীবনে নেই?