কমান্ডার মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমার মনে হয়, রায়ীনাকে আমরা তার টিমের অন্য দু’জন সদস্যকে বেছে নিতে দিই।”
রায়ীনা বলল, “আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই। এই মিশনটি সবচেয়ে ভালোভাবে শেষ করার জন্যে আমি একাই যথেষ্ট। আমার প্রয়োজন একটি ইলন শাটল, সেখানে থাকবে একটি অনবোর্ড কোয়াকম্প। পৃথিবীর মূল ডাটা সেন্টারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকবে প্লিক্সি নেটওয়ার্ক দিয়ে। ইলন শাটলকে উৎক্ষেপণ করে ট্রিটন রকেট দিয়ে, তাহলেই আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হবে না।”
কমান্ডার লী একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি একা যেতে চাও?”
“হ্যাঁ কমান্ডার। আমি একা গেলে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে পারব। আমাকে তাহলে অন্যের কাজকর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। অন্যের কাজকর্মের উপর নির্ভর করতে হবে না। অন বোর্ড একটা কোয়াকম্প থাকলে আমার কোনো মানুষের সাহায্যের দরকার হবে না।”
“কিন্তু এতো বড় একটা মিশনে শুধু একজনের উপর নির্ভর করা ঠিক হবে না।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “সেটি সত্যি। আমার মনে হয়, আমি রওনা দেয়ার পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এমনকি দরকার হলে চতুর্থ এবং পঞ্চম মিশনও প্রস্তুত থাকা দরকার। কোনো কারণে আমি যদি ব্যর্থ হই, একটির পর আরেকটি মিশন পাঠানোর প্রস্তুতি থাকতে হবে।”
কমান্ডার লী মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। সেটি আমাদের পরিকল্পনার মাঝে আছে।”
রায়ীনা এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, “আমার মিশনটি প্রস্তুত করতে মিশন কন্ট্রোলের খুব কম করে হলেও এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় দরকার হবে। আমি কী এই সময়টুকু নিজের জন্যে পেতে পারি?”
কমান্ডার লী বলল, “অবশ্যই পেতে পারো। মিশন শুরু করার আগে তোমার সাথে দশ থেকে পনেরো মিনিট সময় পেলেই চলবে।”
“ধন্যবাদ কমান্ডার। আমি কী এখনই বিদায় নিতে পারি?”
“অবশ্যই।”
রায়ীনা ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকা মহাকাশচারীদের দিকে এক নজর তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “তোমাদের সাথে সম্ভবত আমার আর দেখা হবে না। তোমাদেরকে বলছি তোমরা হচ্ছ আমার সত্যিকারের পরিবার। আমাকে চমঙ্কার একটা আনন্দময় জীবন দেওয়ার জন্যে তোমাদের ধন্যবাদ।”
মহাকাশচারীরা মাথা নাড়ল। একজন বলল, “আমাদের বেঁচে থাকার অর্থ শেখানোর জন্যে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা রায়ীনা। আমাদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি যাও রায়ীনা। যার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে, তুমি তার কাছে যাও।”
রায়ীনা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পিছনের সারিতে বসে থাকা একজন তরুণ তার পাশের তরুণীকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “রায়ীনা কার কাছ থেকে বিদায় নেবে?”
“তার দুই বছরের মেয়েটির কাছ থেকে।”
.
অনাথ আশ্রমের গেটে বাইভার্বালটি থামিয়ে দরজা খুলে রায়ীনা নেমে এল। সে তার বাম হাত দিয়ে তার দুই বছরের মেয়েটিকে আলগোছে ঝুলিয়ে রেখেছে। মেয়েটিকে দেখে মনে হতে পারে, তাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার কারণে সে বুঝি খুব অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, সে মোটেও অস্বস্তিতে নেই এবং এভাবে ঝুলে থাকায় সে খুবই অভ্যস্ত। মেয়েটি ঝুলন্ত অবস্থায় অনেকটা আপন মনে নিজের হাত দুটি নিয়ে খেলছে।
রায়ীনা কয়েক পা অগ্রসর হতেই অনাথ আশ্রমের দরজা খুলে এর ডিরেক্টর ক্লারা–হাসিখুশি মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা বের হয়ে এল। দুই হাত ওপরে তুলে আনন্দের একটা ভঙ্গি করে ক্লারা বলল, “আমাদের কী সৌভাগ্য, একজন সত্যিকারের মহাকাশচারী আমাদের দেখতে এসেছে। আমার বাচ্চারা আনন্দে পাগল হয়ে যাবে!”
রায়ীনা হাসিমুখে বলল, “তারা যদি মহাকাশচারী দেখতে চায়, আমাদের সেন্টার থেকে ডজন ডজন মহাকাশচারী পাঠাতে পারব। আজকে আমি একটা কাজে এসেছি। সেই কাজটুকু আগে সেরে নেই।”
“অবশ্যই। অবশ্যই। চলে এসো।”
আশ্রমের ডিরেক্টর ক্লারার অফিসটা খোলামেলা। এখানে নিশ্চয়ই অনেক শিশু আসে। অফিসটিকে শিশুদের জন্যে আনন্দময় করে রাখা আছে। রায়ীনা তার বাম হাতে ঝুলিয়ে রাখা মেয়েটিকে মেঝেতে নামিয়ে দিল। মেয়েটি সাথে সাথে ঘরের কোনায় স্কুপ করে রাখা খেলনাগুলোর দিকে ছুটে গেল। রায়ীনা এক নজর সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা চেয়ার টেনে বসে ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার হাতে একেবারে সময় নেই। যে কথাটি বলতে এসেছি, আগে বলে নিই?”
রায়ীনার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। আশ্রমের ডিরেক্টর ক্লারার হাসি হাসি মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য নেমে এলো। সে মাথা নেড়ে বলল, “অবশ্যই রায়ীনা।”
রায়ীনা কোনোরকম ভূমিকা না করে বলল, “আমি আমার মেয়ে ত্রাতিনাকে তোমার হাতে দিতে এসেছি। আমার ইচ্ছা, সে এই আশ্রমে তার মতো আরো অনেকের সাথে বড় হোক।”
ডিরেক্টর ক্লারার চোখে এক ধরনের বিস্ময়ের ছায়া পড়ল। কিন্তু সে কোনো কথা বলল না। রায়ীনা শান্ত গলায় বলল, “তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন করো না। কারণ প্রশ্ন করলেও আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”
ডিরেক্টর ক্লারা কোনো প্রশ্ন করলো না। একদৃষ্টে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে রইল। রায়ীনা শান্ত গলায় বলল, “আমি মায়ের দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা করিনি। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আনন্দময় সময় ছিল ত্রাতিনার সাথে কাটানো সময়টুকু।” রায়ীনা হঠাৎ করে থেমে গেল। রায়ীনার ইস্পাতের মতো শক্ত নার্ভ, কিন্তু সে আবিষ্কার করল, সে আর কথা বলতে পারছে না। তার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে পড়ছে।