রায়ীনা শান্তভাবে বলল, “হ্যাঁ আমি জানি। কিন্তু আমার কাছে এই কারণটি এতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে এই মিশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সঠিকভাবে করা না হলে পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষকে বাঁচানো যাবে না। আমি এই দায়িত্বটি নিতে চাই।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী রায়ীনার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “রায়ীনা, তুমি বিষয়টাকে যেভাবে দেখছ, আমরা সবাই ঠিক একইভাবে দেখছি। কাজেই আমরা কি সবাই মিলে এটা নিয়ে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না?”
রায়ীনা বলল, “অবশ্যই পারি। কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব কম, প্রত্যেকটা সেকেন্ড মূল্যবান। তাই আমি একটু সময় বাঁচানোর চেষ্টা করছি, আর কিছু নয়। তা ছাড়া আমার ধারণা, আমরা সবাই মিলে আলোচনা করলে তোমরা আমাকেই দায়িত্বটা দেবে। এ ধরনের মিশনে আমার অভিজ্ঞতা সবচাইতে বেশি।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “মহাকাশে একটা গ্রহাণুতে মহাকাশযান নামানোতে আমাদের কারো অভিজ্ঞতা নেই। আমরা কেউ আগে এটা করিনি।”
“কিন্তু আমি নিয়মিতভাবে মহাকাশ স্টেশনে রসদ নিয়ে যাই। আমি চোখ বন্ধ করে মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশযান ডক করতে পারি। একটা জটিল মহাকাশ স্টেশন আর গ্রহাণুর মাঝে বড় কোনো পার্থক্য নেই।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “আছে। এই গ্রহকণার বেলায় পার্থক্য আছে। মহাকাশ স্টেশন বিচিত্রভাবে তার তিন অক্ষে ঘুরপাক খায় না। এই গ্রহাণুটি বিচিত্রভাবে তার তিন অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে।”
রায়ীনা একটু হাসির মতো ভঙ্গি করে বলল, “আমি জানি। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, একটি মহাকাশ স্টেশন একবার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সবাই সেটির আশা ছেড়ে দিয়েছিল। আমি তখন নিজ দায়িত্বে সেই মহাকাশ স্টেশনে ডক করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম!”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী হাসল। বলল, “হ্যাঁ। অবশ্যই মনে আছে। তোমার সেই কাজটুকু এখন মহাকাশ অভিযানের টেক্সট বইয়ে ঢোকানো আছে। মহাকাশ ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের সেটা পড়ানো হয়।”
“কাজেই তোমরা আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পার। আমি তোমাদের নিরাশ করব না। মূল কাজটি করবে মহাকাশযানের অন বোর্ড কোয়াকম্প। গ্রহাণুটির গতি বিশ্লেষণ করে মহাকাশযানটিকে তার সাপেক্ষে স্থির করে আনতে হবে। আমি শুধু ম্যানুয়েল কন্ট্রোলে থাকব।”
কমান্ডার লী এতোক্ষণ কোনো কথা বলেনি। রায়ীনার কথা শেষ হবার পর তার দিকে তাকিয়ে বলল, “শুধু ডক করা নয়, ডক করার পর একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা ডেটনেট করার ব্যাপার আছে।”
রায়ীনা হেসে বলল, “সেটি হচ্ছে একটা লাল বোতাম টিপে ধরা। দেখিয়ে দেয়া হলে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও এটা করতে পারে। সেটি করার আগে রেটিনা স্ক্যান করিয়ে সিকিউরিটি কোড ঢোকাতে হবে। আমি সেটা ঢোকাতে পারব। কোনো সাহায্য ছাড়াই আমি সিকিউরিটি কোড মনে রাখতে পারব। পাইয়ের মান দশমিকের পর তেতাল্লিশ ঘর পর্যন্ত আমার এমনিতেই মনে থাকে।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “রায়ীনা। আমার মনে হয়, তোমাকে দায়িত্বটি দেবার আগে আমরা সবাই মিলে বিষয়টা একটুখানি আলোচনা করি।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “যদি তোমাদের কারো মনে হয়, আমি এই কাজটি করার উপযুক্ত নই, তোমরা সেটি প্রকাশ্যে সবার সামনে বলতে পার। আমি মেনে নেব। কিন্তু যদি আমার কর্মক্ষমতা নিয়ে তোমাদের কোনো সন্দেহ না থাকে, তাহলে আমি এই দায়িত্ব পালন করতে চাই। পৃথিবীতে খুব কম মানুষের জীবনে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করার সুযোগ আসে। আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করব, যদি আমাকে এই সুযোগটি দেয়া হয়।”
মহাকাশচারীরা কোনো কথা বলল না। কমবয়সী একজন বলল, “রায়ীনা, তোমার কর্মদক্ষতা নিয়ে আমাদের কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমরা, তরুণেরা সব সময় তোমার মতো একজন হওয়ার চেষ্টা করি–”
তরুণ মহাকাশচারীর কথা শেষ হওয়ার আগেই রায়ীনা বলল, “তোমরা সত্যিই যদি এটি বিশ্বাস করো, তাহলে আমাকে দায়িত্ব দেয়া নিয়ে তোমাদের কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমি দায়িত্বটি নিতে চাই।” রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কমান্ডার, আমাকে দায়িত্বটুকু দিন।”
কমান্ডার কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে রায়ীনা। আমি তোমাকে দায়িত্ব দিচ্ছি। এই দায়িত্ব নেবার জন্য পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
রায়ীনা বলল, “ধন্যবাদ কমান্ডার।” তারপর যেভাবে হঠাৎ উঠে
দাঁড়িয়েছিল, ঠিক সেভাবে তার জায়গায় বসে পড়ল।
কমান্ডার বলল, “আমরা টিম লিডার পেয়েছি। এখন আমাদের আরো দু’জন সদস্য দরকার। যারা রায়ীনার সাথে যাবে।”
একজন তরুণ মহাকাশচারী প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাব।”
সাথে সাথে অন্য সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, “আমি। আমি। আমি যাব।”
যে তরুণ মহাকাশচারী সবার আগে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সে গলা উঁচিয়ে বলল, “আমি রায়ীনার সাথে অনেকবার রসদ নিয়ে মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছি। রায়ীনার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার সবচেয়ে বেশি। আমি রায়ীনার মিশনে চমৎকার একজন সহকর্মী হব।”
সাথে সাথে অন্যেরাও কথা বলতে শুরু করল এবং ঘরের ভেতর একধরনের হট্টগোলের মতো অবস্থা হল। তখন রায়ীনা আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমরা আমাকে আরেকবার কথা বলার সুযোগ দাও।”