“আমি জানি, তুমি চাইছ আমি যেন পৃথিবীতে গিয়ে আমার মেয়ের সাথে মিলিত হই। তাকে দেখি, তার সাথে কথা বলে সময় কাটাই। ত্রাতিনা, আমি আমার মেয়ের সাথে মিলিত হয়েছি। দেখা করেছি, তার সাথে কথা বলেছি, কারণ তুমি হচ্ছ আমার সেই মেয়ে। পৃথিবীতে আমার আরও একটি মেয়ে আছে। ক্লিয়া। সম্ভব হলে তুমি ক্লিয়ার সাথে দেখা করো। সেই মেয়েটিকে আমার হয়ে একবার আলিঙ্গন করো। তাকে বলো, আমি তাকে অনেক ভালোবাসি। সৌর জগতের শেষ প্রান্তে একটি ক্রোমিয়াম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে থাকব।”
গ্রাহা উঠে দাঁড়ালো। ত্রাতিনার দিকে অগ্রসর হয়ে বলল, “মা ত্রাতিনা, তুমি অচেতন হওয়ার আগে আমি তোমাকে একটি অনুরোধ করতে পারি? তুমি এখন আর কথা বলতে পারবে না। শুধু একবার একটুখানি হাসো, একটুখানি।”
ত্রাতিনার মুখে খুব ধীরে ধীরে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল। গ্রাহা ত্রাতিনার মাথায় হাত বুলিয়ে গভীর মমতায় ফিসফিস করে বলল, “পৃথিবীতে ফিরে যাও মা। মহাকাশের জগতে তোমার প্রয়োজন নেই। ত্রাতিনা মা আমার, তোমার প্রয়োজন পৃথিবীতে।”
রুখ এবং গিসা নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। গ্রাহা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ত্রাতিনাকে একটা ক্যাপসুলে নিরাপদে ঢুকিয়ে দাও। তাকে শীতল করে রাখো, বারো বছর পর পৃথিবীতে ফিরে যাবার পর জাগিয়ে তুলতে হবে।”
রুখ মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
“আর আমার জন্যে একটা ক্যাপসুল রেডি করো। আমাকে যখন মহাকাশে ছুঁড়ে দেবে, লাউঞ্জ থেকে ওই দেহ দুটোও বাইরে ছুঁড়ে দিও। এগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
রুখ আবার মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”
“আমাকে ছুঁড়ে দেবার পর পেপিরার যাত্রাপথ পৃথিবীর দিকে করে নিও। আমি নিশ্চিত, মহাজাগতিক প্রাণী তখন তোমাদের ফিরে যেতে দেবে।”
রুখ বলল, “আমরা তাই আশা করছি।”
গ্রাহা এবার গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে। তুমি কি আমার জন্যে চমৎকার একটা ডিনার রেডি করতে পারবে? তিতির পাখির মাংস, যবের রুটি আর আঙুরের রস?”
গিসা মাথা নাড়ল বলল, “পারব।”।
“আমি যখন খাব, তখন তুমি কী আমার প্লেটে খাবারগুলো তুলে দেবে? আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমার মা যেভাবে তুলে দিতো?”
গিসা বলল, “অবশ্যই তুলে দেব গ্রাহা, অবশ্যই তুলে দেব।”
৫. শেষ পর্ব (বারো বছর পর)
বাইভার্বাল থেকে নেমে ত্রাতিনা মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে ছোট বাসাটার দিকে এগিয়ে যায়। গাছপালা ঢাকা মেঠো পথ, গাছগুলোতে পাখি কিচির মিচির করছে।
ত্রাতিনা সিঁড়ি বেয়ে উঠে বাসার দরজায় শব্দ করল। কয়েক মুহূর্ত পরে দরজাটি খুলে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটি মেয়ে বের হয়ে এলো। মেয়েটি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকায়। ত্রাতিনা নরম গলায় বলে, “আমার নাম ত্রাতিনা। তুমি নিশ্চয়ই ক্লিয়া?”।
মেয়েটি মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ।”
ত্রাতিনা বলল, “তোমার বাবা গ্রাহা একজন খুব দুঃসাহসী মহাকাশচারী ছিল।”
ক্লিয়া একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি কেমন করে জান?”
“আমি জানি, কারণ আমিও একজন মহাকাশচারী। তোমার বাবার সাথে আমার একটি মহাকাশযানে সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল।”
ক্লিয়া ত্রাতিনার হাত ধরে বলল, “তুমি কী একটু ভেতরে আসবে? আমার বাবার কথা একটু বলবে?”
“হ্যাঁ বলব। আমি সেজন্যেই এসেছি। তার আগে আমি কী তোমাকে একবার আলিঙ্গন করতে পারি? তোমার বাবা তার জীবনের শেষ মুহূর্তটিতে আমাকে বলেছিল, আমি যেন তোমাকে তার হয়ে একবার আলিঙ্গন করি।”
ক্লিয়া কোনো কথা না বলে ত্রাতিনাকে জড়িয়ে ধরল। ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “আমি যেন পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারি, সেজন্যে তোমার বাবা তার জীবন দিয়েছিল। তুমি যেরকম তোমার বাবার সন্তান, আমিও ঠিক সেরকম তার আরেকজন সন্তান।”
ঘরের দরজায় দুইটি তরুণী একে অপরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুইজন এর আগে কখনো একজন আরেকজনকে দেখেনি। কিন্তু দুইজনই হঠাৎ করে বুঝতে পারে, তারা একজন আরেকজনের খুব আপনজন।