গ্রাহা বলল, “অনুমান করা খুব কঠিন না। যে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে কৌতূহলী। বুদ্ধিমান প্রাণী সবকিছু জানতে চায়। এই মহাজাগতিক প্রাণী এই মহাকাশযানের সবকিছু জেনে গেছে, তার কাছে সব যন্ত্রপাতি তুচ্ছ! এটাকে সে পুরোপুরি অচল করেছে। তারপর আবার সচল করেছে। রুখ গিসাকে ব্ল্যাক আউট করিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়েছে। কোয়াকম্পের মতো কম্পিউটারকে অচল করেছে, আবার সচল করেছে। কাজেই যান্ত্রিক বিষয় নিয়ে তার কৌতূহল নেই।”
ত্রাতিনা বলল, “তার কৌতূহল শুধু মানুষকে নিয়ে। আমাদের দু’জনকে নিয়ে।”
“হ্যাঁ।”
“আমাদের দুজনকে তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। দেহের খুঁটিনাটি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করেছে, শুধু মস্তিষ্কটি পারেনি।”
গ্রাহা বলল, “কীভাবে পারবে? আমাদের মস্তিষ্ক সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে জটিল যন্ত্র, এখানে একশ বিলিয়ন নিউরন, একটি নিউরন অন্য দশ হাজার নিউরনের সাথে যুক্ত, প্রতি মুহূর্তে সিনান্স সংযোগ হচ্ছে-”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, আমাদের মস্তিষ্কের সম্ভাব্য সবগুলো স্টেট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবগুলো পরমাণুর সংখ্যা থেকে বেশি।”
“এই মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের সেই মস্তিষ্কটি চায়। এটি দেখতে চায়। বিশ্লেষণ করতে চায়।”
ত্রাতিনা আর গ্রাহা যখন কথা বলছিল পাশে দাঁড়িয়ে তখন রুখ আর গিসা নিঃশব্দে তাঁদের কথা শুনছিল। এবার রুখ বলল, “তোমরা দুইজন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছ। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি পেপিরার কক্ষপথ আটকে দেওয়া হয়েছে। এটি পরিবর্তন করা যাচ্ছে না।”
গিসা বলল, “শুধু তাই না। পৃথিবীর সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।”
ত্রাতিনা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “এই মহাজাগতিক প্রাণী হুবহু মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি করতে পারবে না। এটি বিশ্লেষণ করতে পারবে না। যার অর্থ বুঝতে পারছ?”
গ্রাহা বলল, “হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।”
“যার অর্থ আমরা অনন্তকালের জন্যে এখানে আটকা পড়েছি।”
“হ্যাঁ। আমরা অনন্তকালের জন্যে আটকা পড়েছি।”
ত্রাতিনা তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “কিন্তু আমরা এখানে দুইজন মানুষ। তুমি আর আমি। আমাদের দুজনেরইতো অনন্তকালের জন্যে আটকা থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।”
গ্রাহা একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুমি কী বলতে চাইছ?”
“আমি বলতে চাইছি যে, একজন মানুষকেই এই মহাজাগতিক প্রাণী গিনিপিগ হিসেবে বিশ্লেষণ করুক। অন্যজন পৃথিবীতে ফিরে যেতে সমস্যা কোথায়?”
গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “না সমস্যা নেই। একজন অবশ্যই ফিরে যেতে পারে।”
কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে বসে থাকে। গ্রাহা জিজ্ঞেস করে, “কে থাকবে, আর কে ফিরে যাবে?”
ত্রাতিনা একটু অবাক হয়ে গ্রাহার দিকে তাকিয়ে বলে, “এটি কী রকম প্রশ্ন? অবশ্যই আমি থাকব এবং তুমি ফিরে যাবে। আমি পেপিরার কমান্ডার, পেপিরার সবার ভালোমন্দ্রের দায়িত্ব আমার। তুমি পেপিরার অতিথি, তোমাকে বাঁচিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে তোমার মেয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
গ্রাহা কোনো কথা বলল না। ত্রাতিনা বলল, “একটা ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মহাকাশযান থেকে বাইরে ছুঁড়ে দিও। আমি নিশ্চিত, তাহলে মহাজাগতিক প্রাণী পেপিরাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে দেবে।”
গ্রাহা এবারও কোনো কথা বলল না। ত্রাতিনা বলল, “আমার জন্যে তোমার বিচলিত হবার কোনো কারণ নেই গ্রাহা। পৃথিবীতে কোনো আপনজন আমার জন্যে অপেক্ষা করছে না। আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। তোমার কথা ভিন্ন। পৃথিবীতে তোমার স্ত্রী আছে। তোমার মেয়েটি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
গ্রাহা এবারও কোনো কথা বলল না। কিন্তু তার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটু হাসি ফুটে উঠল। ত্রাতিনা সেটা না দেখার ভান করে বলল, “আমার মা পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে প্রাণ দিয়েছে। এবারে আমার পালা। আমার মা যে কাজটি শুরু করেছিল, আমি সেটি শেষ করব।”
গ্রাহার মুখে এবারে খুব বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে ত্রাতিনা অধৈর্য হয়ে বলল, “তুমি কোনো কথা বলছ না কেন?”
গ্রাহা এবারে মুখ খুলল, বলল, “আমি একটুখানি অপেক্ষা করছি।”
“কিসের জন্যে অপেক্ষা করছ?”
“তোমার রক্তে রিটিলিনটুকু মিশে যাবার জন্যে।”
ত্রাতিনা চমকে উঠে বলল, “রিটিলিন?”
“হ্যাঁ। তোমার জন্যে যে পানীয়টুকু এনেছি, আমি সেখানে দুই ফোঁটা রিটিলিন দিয়ে এনেছি। কিছুক্ষণের মাঝে তুমি পুরোপুরি অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আমি লক্ষ করেছি তোমার চোখের পিউপিল বিস্তৃত হচ্ছে, তোমার কণ্ঠস্বর একটুখানি ধীর হয়ে এসেছে।”
ত্রাতিনা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করল, সে উঠতে পারছে না। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল, তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
গ্রাহা একটুখানি এগিয়ে এসে ত্রাতিনার হাত স্পর্শ করে বলল, “ত্রাতিনা, তুমি এখন শুধু শুধু দাঁড়ানোর চেষ্টা করো না। কথা বলারও চেষ্টা করো না। তোমার শরীরে বিটিলিন কাজ করতে শুরু করেছে। আরো মাত্র কয়েক মিনিটি তুমি দেখতে পাবে, কথা শুনতে পাবে। তারপর তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।”
গ্রাহা নরম গলায় বলল, “আমি জানি তুমি পেপিরার কমান্ডার হিসেবে নিজেকে মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দিয়ে আমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাবে। তাই আমাকে এইটুকু অপরাধ করতে হলো। মহাকাশযানের কমান্ডারকে গোপনে রিটিলিন খাইয়ে অবচেতন করা অনেক বড় অপরাধ, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আমি সেই অপরাধটুকু করেছি। জেনে শুনে করেছি। এটি না করে তোমাকে আমি পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে পারতাম না। তুমি কিছুতেই এটা করতে দিবে না। তুমি তোমার মায়ের মতোই একজন আপাদমস্তক মহাকাশচারী।