“পেয়েছি।”
“তাহলে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারি?”
কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা চিৎকার করে বলল, “তাহলে আমরা কী পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারি?”
এবারও কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা চিৎকার করে বলল, “কথা বল। ফিরে যেতে পারি?”
“যখন সময় হবে।”
“কখন সময় হবে?”
কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “কখন সময় হবে?” এবারও কোনো উত্তর নেই।
ত্রাতিনা আবার গভীর শূন্যতায় ডুবে যেতে থাকে। হাত দিয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা ছোঁয়ার কিছু নেই। স্পর্শ করার কিছু নেই।
ত্রাতিনার মনে হল, অনেক দূর থেকে তাকে কেউ ডাকছে। সত্যি কেউ ডাকছে, নাকি এটি মনের ভুল, সে বুঝতে পারল না। ত্রাতিনার মনে হল, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছিল, কিন্তু সেটি কী, সে মনে করতে পারল না।
আবার কেউ একজন তাকে ডাকল। ত্রাতিনা চোখ খুলে তাকায়। সে দেখল তার মুখের উপর গিসা ঝুঁকে পড়েছে। গিসা তাকে ডাকছে, এটি তাহলে স্বপ্ন নয়। এটি সত্যি। খুব ধীরে ধীরে ত্রাতিনার সবকিছু মনে পড়ে যায়। মহাজাগতিক প্রাণী তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। পুরো মহাকাশযানের প্রতিটি যন্ত্রপাতি অচল করে দিয়েছিল। এক সময় মনে হয়েছিল, তার মাথার ভেতর কিছু ঢুকে গেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর আতংকে সে জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান হারিয়ে সে খুব বিচিত্র একটা স্বপ্ন দেখছিল। সেটি কী শুধু স্বপ্ন, নাকি তার মাঝে সত্যি আছে?
ত্রাতিনা চারপাশে তাকালো। মহাকাশযানে আলো জ্বলছে। সে ইঞ্জিনের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে। অচল হয়ে যাওয়া মহাকাশযানটি আবার সচল করে দিয়েছে। ত্রাতিনা উঠে বসল। তার মাথার ভেতর এখনও দপ দপ করছে। মহাজাগতিক প্রাণী কী তাহলে তাদের মুক্তি দিয়েছে? তাহলে এখন কী তারা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে?
ত্রাতিনা রুখকে জিজ্ঞেস করল, “সব কিছু ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে।”
“ইঞ্জিন সবগুলো চালু আছে?”
“চালু আছে।”
“কোয়াকম্প?”
“কোয়াকম্প নিয়ে একটু সমস্যা। শীতল প্রবাহ ছিল না বলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাপমাত্রা কমে গেলে আবার চালু হবে। গিসা সেটা দেখছে।”
“যোগাযোগ মডিউল?”
“চালু করা হয়েছে।”
“গ্রাহা কোথায়?”
“দেখলাম হেঁটে হেঁটে লাউঞ্জের দিকে গেল।”
“সে ঠিক আছে?”
“এখন ঠিক আছে। তোমার মতো অবস্থা। অচেতন হয়ে ছিল।”
“তোমরা কেমন ছিলে?”
“তিরিশ মিনিটের মতো পুরোপুরি ব্ল্যাক আউট হয়ে গিয়েছিল। কী হয়েছে কিছু জানি না।”
ত্রাতিনা উঠে দাঁড়াল। এখনো মাথার ভেতর দপ দপ করছে। সে খানিকটা টলতে টলতে হেঁটে যেতে থাকে। লাউঞ্জের সামনে তার গ্রাহার সাথে দেখা হলো। গ্রাহা লাউঞ্জের দরজার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ রক্তশূন্য।
ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে গ্রাহা?”
গ্রাহা কোনো কথা বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“লাউঞ্জের ভেতর-”
“লাউঞ্জের ভেতরে কী?”
“যেও না।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “যাব না?”
“না।”
“কেন?”
“বলতে পারব না।”
“বলতে পারবে না?”
“না।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “আমাকে তাহলে যেতে হবে। দেখতে হবে।”
গ্রাহা হঠাৎ করে কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, “না, আমি তোমাকে যেতে দেব না।” সে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ত্রাতিনার পথ আটকে দাঁড়াল।
ত্রাতিনা বলল, “সরে যাও গ্রাহা। আমাকে ঢুকতে দাও। আমি পেপিরার কমান্ডার হিসেবে তোমাকে আদেশ করছি।”
গ্রাহা এক ধরনের আহত দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকালো। তারপর দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “কাজটি ভালো হলো না ত্রাতিনা।”
ত্রাতিনা গ্রাহাকে পাশ কাটিয়ে লাউঞ্জের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো এবং একটা আর্ত চিৎকার করে দরজাটি ধরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
লাউঞ্জের মেঝেতে দুটি দেহ। একটি তার নিজের, অন্যটি গ্রাহার। দেহ দু’টি স্থির, দেখে মনে হয় মৃতদেহ। ত্রাতিনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেহ দুটোর দিকে তাকায়। মেঝেতে শুয়ে থাকা ত্রাতিনার দেহটি হঠাৎ চোখ খুলে ত্রাতিনার দিকে তাকালো, চোখের দৃষ্টি শূন্য এবং অর্থহীন। তারপর হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। কী ভয়ংকর সেই হাসি, কী অবিশ্বাস্য সেই চোখের দৃষ্টি।
ত্রাতিনা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী জীবিত, না মৃত?”
“জানি না কী বলব? দেহগুলো নিখুঁতভাবে তৈরি। শুধু মাথায় কোনো মস্তিষ্ক নেই। ফাঁকা।”
ত্রাতিনার হঠাৎ সারা শরীর গুলিয়ে এলো। সে দরজা বন্ধ করে পিছিয়ে আসে। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।
গ্রাহা নরম গলায় বলল, “আমি তোমাকে ঢুকতে নিষেধ করেছিলাম। তুমি আমার কথা শুনলে না।”
ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল, “আমি পেপিরার কমান্ডার। আমার সবকিছু জানতে হবে গ্রাহা।”
.
৪.৩
ত্রাতিনা তার গ্লাসের পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি বুঝতে পারছি না আমি যেটা স্বপ্নে দেখেছি, সেটি কী শুধুই স্বপ্ন, নাকি তার মাঝে সত্যতা আছে?”
গ্রাহা বলল, “না ত্রাতিনা, সেটি স্বপ্ন ছিল না। কারণ অবচেতন অবস্থায় আমারও ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমিও দেখেছি, আমি অসীম শূন্যতায় ভাসছি। অদৃশ্য কারো কথা শুনছি, যে বলছে আমাদের তার দরকার।”
“কী দরকার হতে পারে আমি একটি অনুমান করতে পারি।”