এভাবে আরো বারো ঘন্টা কেটে গেল। যখন ত্রাতিনা আর গ্রাহা ক্লান্তিতে প্রায় ভেঙে পড়ছে, ঠিক তখন হঠাৎ করে পুরো মহাকাশযান অন্ধকার হয়ে গেল। মহাকাশযানের ইঞ্জিনগুলো থেমে গেল এবং মনে হলো পুরো মহাকাশযানটিতে বুঝি কবরের নীরবতা নেমে এসেছে।
কুচকুচে অন্ধকারে গ্রাহার গলার স্বর শোনা গেল। কাঁপা গলায় সে বলল, “কী হয়েছে?”
ত্রাতিনা শান্ত গলায় বলল, “মনে হয় মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের সাথে যোগাযোগ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।”
“প্রক্রিয়াটি আমার পছন্দ হচ্ছে না।”
“পছন্দ হওয়ার কথা নয়।”
গ্রাহা কাঁপা গলায় ডাকল, “রুখ? গিসা-”
ত্রাতিনা বলল, “তাদের ডেকে লাভ নেই।”
“কেন?”
“মহাজাগতিক প্রাণী এই মহাকাশযানের প্রতিটি যন্ত্র অচল করে দিয়েছে। রুখ আর গিসা যন্ত্র।”
“আমাদের অচল করেনি কেন? আমরাও তো আসলে এক ধরনের যন্ত্র।”
“মনে হয় জটিলতার জন্য। সহজ যন্ত্র অচল করেছে, জটিল যন্ত্র অচল করেনি। কিংবা করতে পারেনি।”
খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ত্রাতিনা বলল, “এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার আমার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে।”
গ্রাহা বলল, “আমি দীর্ঘসময় ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কাটিয়েছি। ইউরোপাতে আমার সময়টি ছিল অন্ধকার এবং নিঃশব্দ। অন্ধকার নিঃশব্দ এবং শীতল।”
ত্রাতিনা বলল, “এই মহাজাগতিক প্রাণী যদি আমাদের অচল যন্ত্রগুলো সচল না করে, তাহলে আমাদের মহাকাশযানটিও হয়ে যাবে অন্ধকার নিঃশব্দ এবং শীতল।”
অন্ধকারে আরো কিছুক্ষণ দুইজন নিঃশব্দে বসে থাকে। হঠাৎ গ্রাহা ডাকলো, “ত্রাতিনা।”
“বল।”
“আমার এক ধরনের বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।”
ত্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ। আমারও বেশ কিছুক্ষণ থেকে সে রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে।”
“তার মানে প্রাণীটি আমাদের দেখছে।”
“হ্যাঁ শুধু দেখছে না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।”
ত্রাতিনার মনে হতে থাকে তার শরীরের ভেতর কিছু একটা ঢুকে গেছে এবং সেটি নড়ছে। হঠাৎ করে শরীরের একটা অংশ কেমন যেন অবশ হয়ে যায়, তারপর হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনুভূতিটি নিচ থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। ত্রাতিনার হঠাৎ করে মাথাটা ঘুরে ওঠে, হঠাৎ করে অসংখ্য স্মৃতি মাথার ভেতর খেলা করে যায়। মুহূর্তের জন্যে সে এক ধরনের আতংক অনুভব করে আবার পর মুহূর্তে এক ধরনের বিষাদ এসে তার উপর ভর করে।
“আমার মস্তিষ্ক নিয়ে খেলছে।” ত্রাতিনা মনে মনে ভাবল, “আমাকে ভয় পেলে চলবে না। আমাকে শান্ত থাকতে হবে। শান্ত থাকতে হবে…”
কিন্তু ত্রাতিনা শান্ত থাকতে পারল না, হঠাৎ অবর্ণনীয় এক ধরনের আতংকে তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে সে এক বিন্দু আলোর জন্যে হাহাকার করতে করতে জ্ঞান হারালো।
.
৪.২
ত্রাতিনা সামনে তাকালো। যতদূর চোখ যায় শুধু শূন্যতা। ত্রাতিনা মাথা ঘুরিয়ে তার চারপাশে তাকালো। কোথাও কিছু নেই। এখানেও যতদূর চোখ যায়, শুধু শূন্যতা। সেই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। ত্রাতিনার মনে হয়, সেই শূন্যতায় সে অতলে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অতলেরও কোনো শেষ নেই। সে নিচে পড়তেই থাকবে, পড়তেই থাকবে। ত্রাতিনা দুই হাত দিয়ে কিছু একটা ধরতে চেষ্টা করল। ধরার কিছু নেই, শূন্যতা ধরা যায় না, দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না। ত্রাতিনার মনে হতে থাকে, এক অসীম শূন্যতায় সে আটকা পড়ে আছে, এই শূন্যতা থেকে তার মুক্তি নেই।
ত্রাতিনা চিষ্কার করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?” তার কণ্ঠস্বর দূরে মিলিয়ে গেল, তারপর প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে এল, আমি কোথায় … আমি কোথায় . . . আমি কোথায় ….
খুব ধীরে ধীরে প্রতিধ্বনিগুলো মিলিয়ে যেতে থাকে। তারপর এক সময় আবার সেই নৈঃশব্দ্যের শূন্যতায় ডুবে যায়।
ত্রাতিনা আবার চিৎকার করল, “আমি কোথায়?” তার চিৎকার বহু দূর থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে, প্রতিধ্বনিত শব্দগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। শব্দগুলো মিলিয়ে যেতে যেতে আবার নূতন করে অনুরণিত হয়, ত্রাতিনার মনে হয় সে বুঝি কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যায় না, কিন্তু কোনো এক ধরনের কণ্ঠস্বর। মনে হয় কেউ কিছু একটা বলছে।
“কে?” ত্রাতিনা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “কে? কথা বলে?”
ত্রাতিনা স্পষ্ট শুনল, কেউ একজন বলল, “আমি।”
“আমি কে?”
“যার কাছে এসেছ।”
ত্রাতিনার চিন্তা এলোমেলো হতে থাকে, সে প্রাণপণ চেষ্টা করে চিন্তাকে সুনির্দিষ্ট রাখতে। অনেক কষ্ট করে সে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী সত্যি?”
কোনো উত্তর নেই।
ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “এটা কী সত্যি?”
“সত্যি বলে কিছু নেই।”
“আমি কী স্বপ্ন দেখছি?”
“সব স্বপ্ন।”
“আমি পৃথিবী থেকে এসেছি। তৃতীয় গ্রহ। নীল গ্রহ। পৃথিবী।”
“জানি।”
“পৃথিবীর মানুষ তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চায়।”
“জানি।”
“পৃথিবীর মানুষ আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে।”
“জানি।”
ত্রাতিনা ক্লান্ত গলায় বলে, “তুমি সব জানো?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে জানো?”
কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি সব কিছু জানো?”
“তুমি যা জানো, আমি তা জানি।”
“তুমি আমার মস্তিষ্কে ঢুকেছ?”
“ঢুকেছি।”
“আমাদের মহাকাশযানে ঢুকেছ?”
“ঢুকেছি।”
“পৃথিবী থেকে আমরা যে তথ্য নিয়ে এসেছি, তুমি সব পেয়েছ?”