ত্রাতিনা মাথা নাড়ল।
গ্রাহা বলল, “ব্যাপারটা চিন্তা করলেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে আসে।”
“চিন্তা করো না।”
“হ্যাঁ। চিন্তা করছি না।”
ত্রাতিনা রুখ এবং গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কী প্রস্তুত?”
দু’জনেই মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। প্রস্তুত।”
“চল তাহলে কাজ শুরু করে দিই।”
.
চারজন তখন পেপিরার শেষ মাথায় গিয়ে লোডিং ডকের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। সেখানে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি রাখা আছে। বোমাটির তিন পাশে তিনটি ছোট ট্রিটন রকেট লাগানো। গ্রাহা একটু বিস্ময়ের সাথে বলল, “আমি আগে কখনো হাইড্রোজেন বোমা দেখিনি।”
ত্রাতিনা বলল, “দেখার কথা না! এটা রেফ্রিজিরেটর কিংবা এয়ার কুলারের মতো একটা জিনিস না।”
গ্রাহা বিস্ময়ে মাথা নেড়ে বলল, “একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা এতো ছোট হয়, আমি জানতাম না।”
ত্রাতিনা বলল, “আমার মনে হয় পৃথিবী যদি রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে শাসন করা হতো, তাহলে বোমার ওপর আরো গবেষণা হতো, বোমাগুলো আরো ছোট হতো। কিন্তু এখন যেহেতু পৃথিবী পরিচালনা করছে। বিজ্ঞানীরা, তাই যুদ্ধ বিগ্রহ নেই। বোমা নিয়েও গবেষণা নেই।”
“ঠিকই বলেছ।”
“আমাদের এই থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির অবস্থান ঠিক করতে হবে।”
ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের কিছু বোতাম টিপে কাজ শুরু করে দেয়। একটা যান্ত্রিক শব্দ হয় এবং তিনটি রকেট লাগানো থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির সামনের অংশ ধীরে ধীরে উঁচু হতে থাকে। ঠিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে আসতেই সেটি থেমে গেল। ত্রাতিনা মুখে সন্তুষ্টির শব্দ করে বলল, “এখন বায়ু নিরোধক হ্যাঁচটি খুলে দিতে হবে। তাহলে রকেট তিনটি বোমাটি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে।”
রুখ এবং গিসা ঘুরে ঘুরে সবকিছু পরীক্ষা করে বলল, “সব ঠিক আছে। রকেট লাগানো বোমাটি পেপিরার মাউন্ট থেকে খুলে দেয়া হয়েছে।”
“চল তাহলে ভেতরে যাই।”
“চল।”
চারজনের ছোট দলটি গোল হ্যাঁচের ভেতর দিয়ে পেপিরার ভেতরে ফিরে এলো। বায়ু নিরোধক ঢাকনা দিয়ে হ্যাঁচ বন্ধ করল। তারপর ওপরের বায়ু নিরোধক ঢাকনাটি খুলে দিল। বোমাটি এখন মহাকাশে বের হওয়ার জন্যে প্রস্তুত। শেষ মুহূর্তে ত্রাতিনা গোপন পাসওয়ার্ড দিয়ে বোমাটিকে বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করে নিল। ঠিক তিরিশ মিনিট পরে এটি বিস্ফোরিত হবে।
ত্রাতিনা সবাইকে নিয়ে কন্ট্রোল রুমে ফিরে আসে। নিজেদের সিটে বসে নিরাপত্তা বন্ধনী দিয়ে নিজেদের আটকে নেয়। তারপর সুইচ টিপে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি উন্মুক্ত করে দেয়। তিনটি ট্রিটন রকেট এক সাথে গর্জন করে চালু হয়ে যায়। পুরো মহাকাশযান একটা প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং সাথে সাথেই তারা মনিটরে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটিকে উড়ে যেতে দেখল। রকেট তিনটির পিছন থেকে জ্বলন্ত গ্যাস বের হতে থাকে। এবং দেখতে দেখতে সেটি চোখের আড়াল হয়ে যায়।।
ত্রাতিনা নিজেকে সিট থেকে মুক্ত করে বলল, “বোমাটি বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশন মাপার জন্যে সবকিছু ঠিক আছে?”
রুখ মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”
“চমৎকার। বোমা বিস্ফোরণের সিগন্যাল পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের যোগাযোগ মডিউলটি চালু করতে হবে।”
“আমরা প্রস্তুত।”
“পরবর্তী তিরিশ মিনিট আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।”
গ্রাহা বলল, “আমি সবসময়েই শুনে এসছি, অপেক্ষা করা মৃত্যু থেকেও ভয়ংকর!”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “মৃত্যু মোটেও ভয়ংকর নয়।”
ঠিক তিরিশ মিনিট পর পেপিরার ভেতরে থাকা সবগুলো তেজস্ক্রিয় মনিটর এক সাথে শব্দ করে উঠল। তখন রুখ এবং গিসা গিয়ে নিউট্রিনো বীম দিয়ে তৈরি যোগাযোগ মডিউলটি চালু করে দিল। মডিউলে মনিটরের এক কোনায় তখন একটা ছোট লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে থাকে।
ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে বলল, “যোগাযোগ মডিউল চালু হয়েছে। আমরা সিগন্যাল পাঠাতে শুরু করেছি।”
“কী সিগন্যাল?”
“আপাতত শুধু প্রাইম সংখ্যা। যে কোনো প্রাণী বা বুদ্ধিমান অস্তিত্ব আর কিছু জানুক বা না জানুক, প্রাইম সংখ্যার অস্তিত্ব জানে। তারা যদি আমাদের এই মহাকাশযান থেকে প্রাইম সংখ্যার সিগন্যাল পেতে থাকে, তারা জানবে আমাদেরও কোনো এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা আছে।”
গ্রাহা জিজ্ঞেস করল, “এখন আমরা কী করব?”
“অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
গ্রাহা মৃদু স্বরে বলল, “আমি তোমাকে আগেই বলেছি, অপেক্ষা করা মৃত্যু থেকেও ভয়ঙ্কর।”
.
সবাই মিলে ছত্রিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করল। কিন্তু কিছুই হলো না। গ্রাহা বলল, “ত্রাতিনা, আমরা কতোক্ষণ অপেক্ষা করব?”
“কেমন করে বলি।”
“আমাদের কাছে সময়ের এক ধরনের পরিমাপ আছে। আমাদের শারীরিক ব্যাপারগুলো সেকেন্ড কিংবা মিলি সেকেন্ডে হয়। এই মহাজাগতিক প্রাণীর সময়ের পরিমাপ কী রকম? আমাদের এক সেকেন্ডের গুরুত্ব যদি তাদের একশ বছরের সমান হয়? তাহলে কী হবে?”
ত্রাতিনা বলল, “সেটি হওয়ার কথা নয়। এটি পৃথিবীর দিকে যখন গ্রহকণাটি পাঠিয়েছিল, সেটি আমাদের সময়ের হিসেবেই পাঠিয়েছিল।”
গ্রাহা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে কি না, সেটি আমরা কেমন করে বুঝব?”
“যদি ধরে নিই তাদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে বেশি, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একটা পিঁপড়া আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না, আমরা ইচ্ছে করলেই একটা পিঁপড়াকে জ্বালাতন করতে পারি।”