ত্রাতিনা বলল, “কথা বলার ব্যাপারে আমার দক্ষতা খুব কম। তবে আমি খুব ভালো শ্রোতা। বিশেষ কোনো কথা বলতে না পারলেও আমি তোমার সব কথা শুনতে রাজি আছি।”
“মাঝে মাঝে হু হা করবে, তাহলেই হবে। আমি একটানা কথা বলে যাব।”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “ঠিক আছে।”
.
মহাকাশযান বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষ ব্যবহার করে স্লিং শট প্রক্রিয়ায় তার গতিবেগ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতি গ্রহের ছায়া থেকে বের হয়েছে। ত্রাতিনা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করেছে এবং নিয়মিত তথ্য বিনিময় শুরু করেছে।
কয়েকদিন পর ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তোমার জন্যে আমি একটি উপহার সংগ্রহ করেছি।”
গ্রাহা একটু অবাক হয়ে বলল, “উপহার? আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ।”
“কোথা থেকে সংগ্রহ করেছ?”
“পৃথিবী থেকে।”
“পৃথিবী থেকে?” গ্রাহা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “দেখি আমার উপহার।”
ত্রাতিনা হাতে ধরে রাখা ছোট মডিউলটি স্পর্শ করতেই তাদের সামনে ছোট একটা জায়গা আলোকিত হয়ে উঠল। সেই আলোকিত জায়গাটিতে ছোট একটা শিশুর ত্রিমাত্রিক ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ত্রাতিনা বলল, “গ্রাহা এটি তোমার মেয়ে।”
গ্রাহা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। ত্রাতিনা নরম গলায় বলল, “মহাকাশযান পেপিরার কমান্ডার হিসেবে আমার অনেক ক্ষমতা। আমি আমার সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে তোমার মেয়ে রিয়ার এই হলোগ্রাফিক ছবিটি নিয়ে এসেছি।”
“আমার মেয়ে? রিয়া?”
“হ্যাঁ। আমরা প্রায় ছয় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে, তাই সিগন্যাল আসতে প্রায় তিরিশ মিনিট সময় লাগছে।
রিয়ার হলোগ্রাফিক ছবিটি ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। সে নড়তে থাকে, কথা বলতে থাকে, খিলখিল করে হাসতে থাকে।
গ্রাহা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, হলোগ্রাফিক ছবি স্পর্শ করা যায় না জেনেও সে ধীরে ধীরে তার হাতটি দিয়ে হলোগ্রাফিক ছবিটি স্পর্শ করার চেষ্টা করল। কিন্তু ছবিটির ভেতর দিয়ে তার হাতটি বের হয়ে এলো। ত্রাতিনা দেখলো গ্রাহার চোখ প্রথমে অশ্রু সজল হয়ে উঠল, তারপর ফোঁটা ফোঁটা পানি বের হয়ে এলো। সে নরম গলায় বলল, “গ্রাহা! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি তোমার মেয়ের কাছে পৌঁছে দেব। হলোগ্রাফিক ছবি নয়, তুমি তোমার রক্ত মাংসের মেয়ের মাথায় হাত বুলাবে।”
গ্রাহা বলল, “আমি জানি, তুমি সেটি করবে। আমি জানি।”
৪. চতুর্থ পর্ব (দশ বছর পর)
ত্রাতিনা চোখ খুলে তাকালো। ক্যাপসুলের পরিচিত স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে সে আবার চোখ বন্ধ করল। নেপচুনের কক্ষপথ পার হয়ে সে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। পৃথিবী থেকে এখানে একটি সিগন্যাল পৌঁছাতে সময় নেয় চার ঘণ্টা। গত দশ বছরে সে দশ বার ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। প্রতিবারই গ্রাহাকে ঘুম থেকে তুলেছে, তারপর দুজন মিলে মহাকাশযান পেপিরার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করেছে। পৃথিবীর সাথে তথ্য বিনিময় করেছে। রুখ এবং গিসার সাথে কথা বলেছে। এই দুটি এনড্রয়েড গত বারো বছর কোনো অভিযোগ না করে কন্ট্রোল রুমে বসে পেপিরার যন্ত্রপাতি লক্ষ্য করেছে, তারা না থাকলে সে প্রতিবার এতো দীর্ঘ সময়ের জন্যে ক্যাপসুলের ভেতর ঘুমিয়ে কাটাতে পারত না।
ত্রাতিনা আবার চোখ খুলে তাকালো। পরিচিত স্ক্রীনটিতে সবুজ একটি বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। স্ক্রীনটি থেকে তাকে জাগিয়ে তোলার জন্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ত্রাতিনা শরীরে শক্তি অনুভব করতে শুরু করেছে। তাকে হাত এবং পা নাড়াতে বলা হলো। তারপর মাথা ঘোরাতে বলা হলো, চোখ খুলতে এবং বন্ধ করতে বলা হলো। তারপর ছোট একটা গুণ অংক করতে দেয়া হলো। মাথার ভেতরে গুণ অংকটি শেষ করে সে ফিসফিস করে উত্তরটি বলার সাথে সাথে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি খুলে যেতে শুরু করে। ক্যাপসুলের দুই পাশে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়ে আছে। তারা হাসিমুখে ত্রাতিনাকে অভিবাদন জানাল। রুখ বলল, “পেপিরাতে তোমাকে স্বাগতম ত্রাতিনা।”
ত্রাতিনা বলল, “তোমাদের ধন্যবাদ। শেষ বছরটি কেমন কেটেছে তোমাদের দু’জনের?
গিসা বলল, “একেবারেই উত্তেজনাহীন। তোমাকে বলার মতো কিছুই ঘটেনি। পেপিরার যন্ত্রপাতি নিখুঁত–আমার মনে হয় এতো নিখুঁত না হলেই ভালো হতো। তাহলে আমাদের জীবনে একটুখানি বৈচিত্র্য থাকতো।”
”ঠিক আছে। আমরা যখন পৃথিবীতে ফিরে যাব, তখন আমাদের রিপোর্টে আমি এই কথাটি লিখে দেব।”
ত্রাতিনা তার ক্যাপসুল থেকে বের হলো। রুখ এবং গিসা তাকে দুই পাশ থেকে ধরে বের হতে সাহায্য করল। ত্রাতিনা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এতোদিন আমরা যা জেনে এসেছি আর যা শিখে এসেছি, এখন তার পরীক্ষা হবে। তোমাদের কী মনে হয় রুখ এবং গিসা, আমাদের মিশন কী : কাজ করবে?”
রুখ মুখ শক্ত করে বলল, “অবশ্যই করবে।”
গিসা বলল, “এই মিশনের প্রতিটি খুঁটিনাটি অনেকবার করে দেখা হয়েছে। নিশ্চয়ই কাজ করবে।”
ত্রাতিনা তার লাউঞ্জের দিকে যেতে যেতে বলল, “যাও গ্রাহাকে তুলে নিয়ে আস। মিশনের খুঁটিনাটিতে গ্রাহা ছিল না, তাকে আমাদের সাথে নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি ভালো হল না খারাপ হল, বুঝতে পারছি না!”
.
কিছুক্ষণ পর লাউঞ্জে বসে খেতে খেতে ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তুমি কী প্রস্তুত?”
“আমি সব সময়েই প্রস্তুত।”
“চমৎকার।”
গ্রাহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরের কুচকুচে অন্ধকার মহাকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি দাবি করছ আমরা এই মুহূর্তে মহাজাগতিক প্রাণী কিংবা মহাজাগতিক অস্তিত্বের মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে গেছি?”