“কী ব্যবস্থা?”
ত্রাতিনা বলল, “আমি ঠিক জানি না। তুমি একজন অভিজ্ঞ মহাকাশচারী। তুমি বল।”
গ্রাহা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “একটা মাত্র উপায়। সেটি হচ্ছে প্রথমে পৃথিবীতে খবর পাঠাই যে আমি বেঁচে আছি। তারপর তোমার মহাকাশযান থেকে প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে একটা স্কাউটশীপে ইউরোপাতে আমার ঘাঁটিতে ফিরে যাই। সেখানে দুই বছর অপেক্ষা করি, এর মাঝে পৃথিবী থেকে উদ্ধারকারী দল চলে আসবে। আরো দুই বছর পর আমি পৃথিবীতে ফিরে যাব। যার অর্থ আজ থেকে চার বৎসর পর আমি পৃথিবীর মাটিতে পা দেব। আমার মেয়ে ততদিনে একটি কিশোরী বালিকা হয়ে যাবে।”
ত্রাতিনা হাত বাড়িয়ে বলল, “চমৎকার পরিকল্পনা। আমিও ঠিক এই সমাধানটির কথা ভাবছিলাম।”
গ্রাহা বলল, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাইলে এটি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
ত্রাতিনা বলল, “তাহলে আমরা ব্যবস্থা করি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার যাওয়া উচিত। কারণ প্রতি ঘণ্টায় আমরা পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাচ্ছি!”
গ্রাহা বলল, “তোমার ব্যস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
“কেন?”
“আমি এটি করতে রাজি নই।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “রাজি নও? কেন?”
“আমার এক বছরের নিঃসঙ্গ জীবনটি ছিল ভয়ঙ্কর। আমি আসলে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কোনোভাবেই সেই জীবনে ফিরে যেতে চাই না। একদিন নয় দুইদিন নয়, টানা দুই বছর নিঃসঙ্গ পরিবেশে একটি গ্রহে একাকী দিন কাটানো থেকে মরে যাওয়া ভালো।”
ত্রাতিনা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, “ঠিক আছে। তাহলে আমি একটুখানি জটিল কিন্তু তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা পরিকল্পনা দিই।”
গ্রাহা মাথা নাড়ল, বলল, “না রাজি না।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “আমি আমার পরিকল্পনাটি এখনো বলিনি।”
“কিন্তু আমি জানি, তুমি কী বলবে?”
“আমি কী বলব?”
“তুমি বলবে আমাকে একটা ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। তারপর ইউরোপার কক্ষপথে আমাকে ছেড়ে দেবে। পৃথিবীর উদ্ধারকারী দল এসে আমার ক্যাপসুলটি উদ্ধার করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে আমার ঘুম ভাঙানো হবে। আমার কাছে মনে হবে আমি আজ ঘুমিয়ে গেছি এবং কাল ভোরে পৃথিবীতে জেগে উঠেছি।”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “তুমি ঠিকই অনুমান করেছ।”
“এর মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। আমাদের মহাকাশ অভিযানের কোর্সে এগুলো শেখানো হয়। তুমি আমি সবাই এক জায়গা থেকে এগুলো শিখেছি।”
“কিন্তু এগুলো কার্যকর পদ্ধতি।”
“কিন্তু গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি না। আমি একটা ক্যাপসুলের ভেতর জড় পদার্থ হয়ে বছরের পর বছর একটা উপগ্রহকে ঘিরে ঘুরতে চাই না।”
“কিন্তু তুমি সেটা জানবে না।”
“তাতে কিছু আসে যায় না।” তাহলে তুমি কী করবে?”
“আমি তোমার সাথে পেপিরাতে থাকব।”
“পেপিরাতে থাকবে? পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে কি না, সেটা তুমি জান না।”
“তুমি যদি ফিরে যেতে পার, তাহলে আমিও ফিরে যাব।”
“তুমি যখন পৃথিবীতে ফিরে যাবে, তখন তোমার মেয়ে আর শিশু থাকবে না। বড় হয়ে যাবে।”
“আমি জানি। বড় হয়ে তোমার বয়সী একটা মেয়ে হবে।”
“হ্যাঁ। আমার বয়সী।”
গ্রাহা একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে তোমার বয়সী একটা মেয়ে খুব চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা। একটি শিশু বা কিশোরীর সাথে হঠাৎ করে দেখা করার থেকে তোমার বয়সী মেয়ের সাথে দেখা করা সহজ। সে তার বাবাকে অনেক সহজে গ্রহণ করতে পারবে।”
ত্রাতিনা চুপ করে বসে রইল। গ্রাহা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “শুধু তাই নয়, আরো একটি ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার?”
“মহাজাগতিক এই প্রাণী কিংবা অস্তিত্বের সাথে তুমি মুখোমুখি হবে, কী হবে কেউ জানে না। অভিজ্ঞতাটা অনেক ভয়ঙ্কর হতে পারে।”
“হ্যাঁ হতে পারে।”
“তখন আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।”
“আমি একা নই। আমার সাথে রুখ এবং গিসা আছে।”
গ্রাহা কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠল। তারপর বলল, “রুখ আর গিসার কথা বলো না। মানুষ চমৎকার একটি বিষয়। যন্ত্রও চমৎকার বিষয়। কিন্তু মানুষের মতো যন্ত্র কিংবা যন্ত্রের মতো মানুষ চরম নির্বুদ্ধিতা। তোমাকে একা পাঠানোর সিদ্ধান্তটি ঠিক হয়নি। সাথে আরো মানুষ দেয়া উচিত ছিল।
“এটি আমার সিদ্ধান্ত। আমি অন্য কোনো মানুষ আনতে রাজি হইনি। আমার মা একা গিয়েছিল, অন্য কারো জীবন বিপন্ন করেনি। আমিও কারো জীবন বিপন্ন করতে চাই না।”
“সেটি ঠিক আছে। তুমি সেভাবে চেয়েছিলে। কিন্তু আমি যেহেতু ঘটনাক্রমে এখানে চলে এসেছি, এখন তোমার আর কিছু করার নেই। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।”
ত্রাতিনা কিছু না বলে গ্রাহার দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রাহা একটু পর বলল, “আমি জানি তুমি এই মহাকাশযানের কমান্ডার। তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে। আমি সেটাই মেনে নেব। কিন্তু আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি, আমাকে তোমার সাথে থাকতে দাও।”
ত্রাতিনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে।” গ্রাহা বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কমান্ডার!” ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। গ্রাহা বলল, “কমান্ডার ত্রাতিনা, এবারে আমার মেয়ের বয়সী মানুষ ত্রাতিনার কাছে একটি অনুরোধ করতে পারি?”
“করো।”
“আমি জানি তোমার এখন শীতল গ্রহে গিয়ে ঘুমানোর কথা। আমি অনুরোধ করছি, তুমি কয়েকদিন পরে ঘুমুতে যাও। আমি বহুদিন মানুষের সাথে কথা বলিনি। কয়েকটা দিন তুমি আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে দাও।”