পরিবেশ বিজ্ঞানী নীহা বলল, “আসলে কী করতে হবে, আমরা সেটা সবাই জানি। গ্রহকণাটির কক্ষপথে পরিবর্তন আনতে হবে যেন সেটি পৃথিবীতে আছড়ে না পড়ে। এটি যেন পৃথিবীকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি মাথা নেড়ে বলল, “কাজটি এতো সহজ নয় নীহা। যদি কক্ষপথে যথেষ্ট পরিবর্তন আনতে না পার, তাহলে এটা হয়তো আফ্রিকাতে আঘাত না করে সাইবেরিয়াতে আঘাত করবে। আমাদের কোনো লাভ হবে না।”
নীহা বলল, “সেই হিসেবটুকু নিশ্চয়ই করা হবে। আমরা নিশ্চয়ই শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে গ্রহকণাটির কক্ষপথ পাল্টানোর চেষ্টা করব না। কাজটা নিখুঁতভাবেই করব। কিন্তু সেই কাজটুকু নিখুঁতভাবে করার জন্যে আমাদের যে প্রযুক্তির প্রয়োজন, সেটি কী আছে? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?”
প্রযুক্তিবিদ কিরি বলল, “আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি।”
মহামান্য রিহা বললেন, “চমৎকার। উত্তর দাও কিরি।”
কিরি এক মুহূর্তে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হল, তার হাতের মাঝে কোথাও যেন প্রশ্নের উত্তরটি লেখা রয়েছে। এক মুহূর্ত পর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের কাছে এক সময় এই প্রযুক্তি খুব ভালোভাবে ছিল। পৃথিবী যখন নানা দেশে বিভক্ত ছিল, নিজেদের ভেতর যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল, তখন সব দেশই একে অপরকে আক্রমণ করার জন্যে এই প্রযুক্তি তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু পুরো পৃথিবীটা শান্তির দিকে এগিয়েছে। এখন পৃথিবীতে আলাদা আলাদা দেশ নেই, পুরো পৃথিবী মিলে একটি দেশ। শুধু তাই না, পৃথিবী পরিচালনার জন্যে পৃথিবীর মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমাদের মতো বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা এখন পৃথিবীকে পরিচালনা করি। আমরা অস্ত্রগুলো অকেজো করেছি। এখন যখন প্রয়োজন হয়েছে, আমাদের হাতে সেই প্রযুক্তি নেই। যেটি আগে নিশ্চিতভাবে করা যেতো, এখন সেটি করার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। আমরা গ্রহকণাটিকে আঘাত করতেও পারি, আবার নাও করতে পারি।”
মহামান্য রিহা বললেন, “তাহলে আমরা এখন কী করতে পারি?”
“আমাদের হাতে দুটি ভিন্ন পথ খোলা আছে। আমার মনে হয়, আমাদের একই সাথে দুটি পথেই চেষ্টা করতে হবে। একটি হচ্ছে, পৃথিবী থেকে মিসাইল দিয়ে গ্রহকণাটিকে আঘাত করার চেষ্টা করা। যদি আঘাত করে ধ্বংস করে দিতে পারি, আমাদের বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু আমি শুধু এটুকুর উপর ভরসা করতে চাই না। গ্রহকণাটির আকার বিদঘুঁটে এবং সেটি
খুবই বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খেতে খেতে আসছে। মিসাইলটি গ্রহকণাটিকে ঠিকভাবে আঘাত করতে পারবে কী না, আমি সে বিষয়ে তত নিশ্চিত নই। আমার মনে হয়, আমাদের দ্বিতীয় আরেকটা পথে কাজ করতে হবে।”
“সেটি কী?”
“একটা টিমকে নিউক্লিয়ার বোমাসহ মহাকাশযানে করে পাঠাতে হবে। তারা এই গ্রহকণার উপর নামবে। সেখানে বোমাটি বসাবে এবং বিস্ফোরণ ঘটাবে। এই কাজটি অসম্ভব কঠিন, কিন্তু এটি নিশ্চিতভাবে কাজ করবে।”
মহামান্য রিহা কিছুক্ষণ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “টিমের সদস্যরা কেউ বেঁচে ফিরে আসবে না?”
“না। যেটুকু সময় আছে, সেই সময়ে তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারবে না। যারা যাবে, তারা পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে যাবে।”
মহামান্য রিহা আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তারপর মাথা তুলে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে, যদি এটাই একমাত্র উপায় হয়ে থাকে, তাহলে এটাই আমাদের করতে হবে। এসো তোমাদের নিয়ে পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করে ফেলি।”
পনেরো মিনিটের ভেতর কমান্ড কাউন্সিল পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করে নিল। সাথে আরো একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, পৃথিবীর মানুষকে এই ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে কিছু জানানো হবে না। সত্যিই যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়, সেটি ঘটুক সবার অগোচরে।
.
১.০২
কমান্ডার লী তার সামনে বসে থাকা কুড়িজন মহাকাশচারীর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “আমাদের এখন কী করতে হবে, তোমরা সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।”
মহাকাশচারীরা মাথা নাড়ল। কেউ মুখে কোনো কথা বলল না। কমান্ডার লী গলার স্বরকে একটুখানি উঁচু করে বলল, “সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে তোমাদের ভেতর থেকে একটি টিম তৈরি করার জন্যে। যে টিমটি গ্রহাণুটিকে ধ্বংস করতে যাবে।”
মহাকাশচারীরা এবারেও কোনো কথা বলল না। পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল। কমান্ডার লী বলল, “আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের কয়েকজনকে নিয়ে সেই টিম তৈরি করে দিতে পারি। কিংবা তোমরা চাইলে নিজেদের ভেতরে আলোচনা করে আমাকে একটা টিম তৈরি করে দিতে পার। এখন তোমাদের কী ইচ্ছা, বল।”
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, “আমাদের পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময় দেয়া হলে আমরা নিজেদের ভেতর কথা বলে তোমাকে টিমের সদস্যদের তালিকা তৈরি করে দিতে পারব।”
পিছন থেকে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তার প্রয়োজন নেই কমান্ডার। আমি এই মিশনের দায়িত্ব নিতে চাই।”
সবাই মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটির নাম রায়ীনা। মহাকাশচারীদের এই দলটির মাঝে সবচেয়ে অভিজ্ঞ কয়েকজনের একজন।
কমান্ডার একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “রায়ীনা, তুমি জান এটা হচ্ছে একটা সুইসাইড মিশন।”