গ্রাহা বলল, “কেউ আমার মাথায় গুলি করলে আমি যথেষ্ট বিরক্ত হব।”।
“ভয় নেই, এই প্রাণী বিরক্ত হবে না।”
“কেন?”
“কারণ, বিরক্তি, ক্রোধ, আনন্দ, হতাশা এগুলো মানুষের অনুভূতি। মানুষের বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমত্তা হলে তারা মানবিক এই বুদ্ধিমত্তার অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায়।”
গ্রাহা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি নিশ্চিত?”
“আমি এসব জানি না, তাই আমার নিশ্চিত হওয়া না হওয়ায় কিছু আসে যায় না। যারা বিশেষজ্ঞ, তারা অনেক গবেষণা করে এই বিষয়টা বের করেছেন।”
“তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো, তুমি এই মহাজাগতিক প্রাণী বা অস্তিত্বের মস্তিষ্কের ভেতর বোমা ফাটিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে। তারপর কী করবে?”
“পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তখন তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে একটা যন্ত্র তৈরি করে দিয়েছেন, তখন সেই যন্ত্র দিয়ে যোগাযোগ করব।”
গ্রাহা বলল, “তাদের সাথে যোগাযোগ করবে? তাদের ভাষায় কথা বলবে?”
“অনেকটা সে রকম। তখন কী হবে, কেমন করে হবে সেটা আমি জানি না। তখন দেখা যাবে। মোটামুটি বলা যায়, আমি বলব তোমাদের জন্যে পৃথিবীর বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন একটা উপহার দিতে এসেছি।”
“পৃথিবী থেকে উপহার? কী রকম উপহার? এদের জন্যে নিশ্চয়ই সোনার আংটি কিংবা হীরার নেকলেসের কোনো গুরুত্ব নেই।”
“না নেই।”
“তাহলে, তাদের কী উপহার দেবে?”
ত্রাতিনা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই যে তোমাদের সামনে বসে আছে, রুখ এবং গিসা। তাদেরকে ঠিক এই উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে।”
রুখ এবং গিসা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। রুখ বলল, “সে জন্যে আমাদের ভেতরের মানবিক সত্তাকে যতদূর সম্ভব মানুষের মানবিক সত্তার কাছাকাছি আনা হয়েছে। আর আমাদের শরীরটা তৈরি হয়েছে এমনভাবে যেন এখান থেকে বেটা ডিকে হয়, নিউট্রিনো বের হয়। যেন সহজে বিশ্লেষণ করতে পারে।”
গ্রাহা কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তোমাদের দু’জনকে দিয়ে দেয়া হবে?”
“হ্যাঁ।”
“তোমাদের ভেতরে যদি সত্যিকারের মানবিক সত্তা থাকতো, তাহলে তোমরা নিশ্চয়ই আপত্তি করতে।”
“আপত্তি? আপত্তি কেন করব? আমাদের কপোট্রন স্ক্যান করে রাখা হবে, কাজেই আবার আমাদের সৃষ্টি করা হবে।”
গ্রাহা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। বলল, “কিন্তু তোমরা তো সত্যিকারের মানুষ নও। মানুষের ডিকয়।”
ত্রাতিনা বলল, “আমাদের কিছু করার নেই। রুখ এবং গিসা শুধু যে মানুষের কাছাকাছি একটা সহজ যান্ত্রিক রূপ তা নয়, তাদের ভেতর পৃথিবীর সব তথ্য দিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে তথ্য আর অন্য কোনোভাবে দেয়া সম্ভব নয়।।
গ্রাহা মাথা নেড়ে বলল, “কেউ যদি আমাকে বলতো যে তোমাকে মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেব, আমি কিন্তু কিছুতেই রাজি হতাম না!”
গিসা বলল, “আমরা আনন্দের সাথে রাজি হয়েছি। পৃথিবীর মানুষের জন্যে আমরা কিছু একটা করতে পেরেছি, সেজন্যে আমরা গর্বিত।”
গ্রাহা বেশ খানিকটা বিস্ময়ের সাথে এই পরিতৃপ্ত এবং গর্বিত এনড্রয়েড দুটির দিকে তাকিয়ে রইল।
.
৩.৪
দু’দিন পর ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা আমাদের দু’জনের একটু কথা বলা দরকার।”
গ্রাহা বলল, “কী বিষয় নিয়ে কথা বলবে?”
“তোমার বিষয়ে।”
গ্রাহা বলল, “আমার বিষয়ে? আমি কী বেশি খেয়ে তোমার রসদ ফুরিয়ে ফেলছি?”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “না, সেরকম কোনো আশংকা নেই।”
“তাহলে তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও?”
“তোমার নিশ্চয়ই পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া দরকার। তুমি প্রাণে রক্ষা পেয়েছ, এখন সেই প্রাণটুকু নিয়ে যদি পৃথিবীতে ফিরে না যাও, তাহলে কেমন হবে? পৃথিবীতে নিশ্চয়ই তোমার পরিবার আছে, আপনজন আছে।”
গ্রাহার মুখটা হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কয়দিন থেকে আমারও আমার পরিবারের কথা মনে হচ্ছিল। পৃথিবীতে আমার স্ত্রী আছে, আমার ছোট একটি মেয়ে আছে। আমি যখন এই অভিযানে রওনা দিয়েছি, তখন আমার মেয়ের বয়স ছিল এক বছর। এখন নিশ্চয়ই সে একটু বড় হয়েছে।”
ত্রাতিনা বলল, “বৃহস্পতির ছায়া থেকে সরে গেলেই আমরা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারবে। তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে।”
গ্রাহা বলল, “আমি জানি না আমি সেটা আসলেই করতে চাই কি না, তিন মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে কথা বলার ব্যাপারটি আমার কাছে কৃত্রিম মনে হয়।”
“কিন্তু তোমার স্ত্রী যখন জানতে পারবে তুমি বেঁচে আছ, সে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।”
গ্রাহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “সেটা নাও হতে পারে।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “নাও হতে পারে?”
“হ্যাঁ। আমার স্ত্রী জানে, আমি মারা গেছি। ছোট একটি সন্তান নিয়ে সে কি একাকী নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকবে? থাকবে না। সে নিশ্চয়ই এতোদিনে নতন একজন সঙ্গী খুঁজে নিয়েছে। এখন হঠাৎ করে যদি জানতে পারে আমি বেঁচে আছি, সেটি তার জীবনে আনন্দের বদলে জটিলতা তৈরি করবে।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, গ্রাহার কথায় যুক্তি আছে। গ্রাহাকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তুমি কী করতে চাও?”
“আমি পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার পর তাদের সাথে যোগাযোগ করব। তার আগে নয়।”
ত্রাতিনা বলল, “ঠিক আছে, তাহলে তোমাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলি।”।
“বল।”
“আমাদের এই মহাকাশযান পেপির ভবিষ্যৎ কী, কেউ জানে না। আমি পৃথিবীতে প্রাণে বেঁচে ফিরে যেতে পারব কিনা সেটিও জানি না। যদি প্রাণে বেঁচে ফিরে যেতেও পারি, তাহলে সেটি হবে আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর পর। বাইশ বছর অনেক দীর্ঘ একটি সময়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর জন্যে এখনই আমাদের কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”