গ্রাহা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, তারপর খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “তুমি রায়ীনার মেয়ে?”
“হ্যাঁ। আমার ক্রোমোজমের তেইশটি রায়ীনার কাছ থেকে এসেছে!”
গ্রাহা উঠে দাঁড়িয়ে ত্রাতিনার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ত্রাতিনা, আমি তোমাকে একটু আলিঙ্গন করি?”
ত্রাতিনা কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল এবং গ্রাহা তাকে গভীর ভালোবাসায় আলিঙ্গন করল। রুখ এবং গিসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকিয়েছিল। তারা এবারে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। রুখ গলা নামিয়ে গিসাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী অনুমান করেছিলে গ্রাহা হঠাৎ করে এতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বে?”
“না।” গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “না আমি অনুমান করিনি। সত্যি কথা বলতে কী আমার কাছে আবেগের এ ধরনের বহিঃপ্রকাশকে খানিকটা বাহুল্য মনে হয়।”
রুখ বলল, “সেটাই হচ্ছে আমাদের সমস্যা। এ কারণেই আমাদের প্রোফাইলের মানবিক সত্তা পুরো একশ ভাগ হতে পারছে না!”
গ্রাহা আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার পর ত্রাতিনা বলল, “যাই হোক যেটা বলছিলাম, পৃথিবীর বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা যখন নিশ্চিত হলেন যে, কোনো একটা মহাজাগতিক প্রাণী পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য এই গ্রহকণারূপী মহাকাশযানটি পাঠিয়েছে, তখন তারা বিষয়টা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা শুরু করলেন। তারা যেটা খুঁজে বের করলেন, সেটা খুবই বিচিত্র।”
গ্রাহা একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “সেটা কী?”
“সেটা হচ্ছে মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার এই অস্তিত্ব পৃথিবীকে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কারণে ধ্বংস করছে না। তারা এটা করছে নিছক একটা কৌতূহল থেকে। বুদ্ধিমান হওয়ার প্রথম শর্ত কৌতূহল।”
“কৌতূহল?”
“হ্যাঁ, যেহেতু কাছে আসতে পারছে না, তাই দূর থেকে এটা পর্যবেক্ষণ করার সবচেয়ে সোজা উপায় হচ্ছে সেখানে কিছু একটা ছুঁড়ে দেয়া। বিজ্ঞানীরা যেভাবে প্রোটন প্রোটন সংঘর্ষ করে ভেতরে কোয়ার্কেরা কী রকম আছে সেটা বের করে নেয়!”
গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। তুমি বলছ তারা কাছে আসতে পারছে না। যদি আসলেই বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, কাছে আসতে সমস্যা কী?”
“সূর্যের জন্য কাছে আসতে পারে না।”
“সূর্য?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ সূর্য। আমাদের সূর্যের প্রধান বিক্রিয়া হচ্ছে প্রোটন প্রোটন বিক্রিয়া, সেখান থেকে নিউট্রিনো বের হয়, পৃথিবীতে তার ফ্লাক্স বিশাল। পৃথিবীর পৃষ্ঠে যদি আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, প্রতি সেকেন্ডে শুধু আমাদের চোখের মণি দিয়ে এক বিলিয়ন নিউট্রিনো যায়। আমরা সেটা টের পাই না, কারণ নিউট্রিনোর বিক্রিয়া বলতে গেলে কিছু নেই।”
গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ আমরা হাইস্কুলে এগুলো পড়েছি।”
”আমাদের শরীর নিউট্রিনোর সাথে বিক্রিয়া করে না, কিন্তু আমি যে মহাজাগতিক অস্তিত্বের কথা বলছি, সেটা করে। তাই সেটা সূর্যের কাছে আসতে পারে না। আমরা সূর্য থেকে যত দূরে যাব, নিউট্রিনো ফ্লাক্স তত কমতে থাকবে। শনি গ্রহের কাছাকাছি নিউট্রিনো ফ্লাক্স হবে পৃথিবীর এক শত ভাগের এক ভাগ। সৌর জগতের শেষ মাথায় যদি যাই, নিউট্রিনো ফ্লাক্স পৃথিবীর এক হাজার ভাগের এক ভাগ। কাজেই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বের করেছেন, মহাজাগতিক অস্তিত্ব শুরু হয়েছে সৌরজগতের বাইরে থেকে। বুঝেছ?”
গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “তুমি যেটা বলেছ, সেটা বুঝেছি। কিন্তু কী বলতে চাইছ সেটা এখনো বুঝিনি।”
ত্রাতিনা বলল, “আপাতত এটুকু বুঝলেই চলবে। যেহেতু মহাজাগতিক অস্তিত্বটুকু সৌরজগতের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু, তাই আমি সেখানে যাচ্ছি।”
গ্রাহা মাথা চুলকে বলল, “সেই হাইস্কুলে যেটুকু পদার্থবিজ্ঞান পড়েছিলাম এবং যতটুকু মনে আছে, সেটা থেকে বলতে পারি এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব যেহেতু নিউট্রিনোর সাথে বিক্রিয়া করে, অর্থাৎ সেটা তৈরি উইম্পস দিয়ে। কাজেই সে তোমাকে দেখবে না!”
ত্রাতিনা আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, “এই তো তুমি পুরোটাই বুঝে গেছ! এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব আমাকে দেখতেই পাবে না! কাজেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে আমার নিজেকে জানাতে হবে, বলতে হবে, আমি এসেছি।”
“কীভাবে বলবে?”
“একটা দশ মেগাটন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা পাঠাব! সেটা যখন বিস্ফোরিত হবে সেখান থেকে বিশাল নিউট্রিনো ফ্লাক্স বের হবে–এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব জানবে আমি এসেছি!”
গ্রাহা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, “এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব নিশ্চয়ই একটা প্রাণীর মতো না, তার নিশ্চয়ই হাত পা নেই, মাথা নেই, চোখ নেই।”
ত্রাতিনা বলল, “না, নেই।”
“শুধু মস্তিষ্কের মতো কিছু?”
“হ্যাঁ। আমাদের যে রকম অসংখ্য নিউরন, একটার সাথে আরেকটা, সংযোগ, এটাও তাই। বিশাল মহাবিশ্ব জুড়ে ওই রূপ ছড়িয়ে আছে, একটার সাথে আরেকটা যোগাযোগ রাখছে। বলতে পারো বিশাল এলাকায় যেন বুদ্ধিমত্তা ছড়িয়ে পড়ছে!”
“তার মানে তুমি যখন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমাটা ফাটাবে, সেটা অনেকটা এই মহাজাগতিক প্রাণীর মস্তিষ্কের ভেতর গুলি করার মতো?”
ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল। বলল, “তোমার উপমাটা ভালো, আমার পছন্দ হয়েছে। আমরা এই মহাজাগতিক প্রাণীর মস্তিষ্ক বল, বুদ্ধিমত্তার আস্তরণ বল সেখানে গুলি করতে যাচ্ছি!”