গ্রাহা বলল, “আমি তুলনামূলকভাবে বেশি খাই। এখন হয়তো আমি আরো বেশি খাব। তোমার খাবার সরবরাহে সমস্যা হতে পারে।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “সেটা নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা করতে হবে না। এই অভিযানে আমি বেশিরভাগ সময়ে ঘুমিয়ে থাকি। সময় কাটানোর এটা সবচেয়ে সহজ উপায়।”
গ্রাহা বলল, “তোমার অভিযান সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। আমি হাজির হয়ে তোমার অভিযানের কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেছি কি না, সেটাও বুঝতে পারছি না।”
ব্রাতিনা বলল, “আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করব। আমার ধারণা, আমার অভিযানটি সম্পর্কে জানার পর তুমি তোমার বিদঘুঁটে মহাকাশযানে করে যেখান থেকে এসেছ আবার সেখানে ফিরে চলে যাবে।”
.
মেডিকেল চেক আপে গ্রাহার শরীরে রক্তশূন্যতা, অপুষ্টি, হৃৎপিণ্ডের প্রদাহ, স্নায়ু বৈকল্য এরকম গুরুতর অনেকগুলো সমস্যা ধরা পড়ল। কিন্তু সেগুলো দেখে কেউই বিচলিত হলো না। এই মানুষটি বেঁচে আছে সেটি পুরোপুরি একটি অলৌকিক বিষয়। সে তুলনায় কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যাকে বিবেচনায় আনার কোনো প্রয়োজন নেই।
পেপিরার মেডিকেল সেবা নিয়ে গ্রাহা ত্রাতিনার সাথে ডিনার করার সময় তার ইতিহাসটুকু বলল। গ্রাহা একজন প্রথম শ্রেণির মহাকাশচারী। তিন বছর আগে সে বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ ইউরোপাতে একটি অভিযানে এসেছিল। একেবারেই দুর্ঘটনাক্রমে একটা উল্কার আঘাতে তাদের মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে যায়। কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে ইউরোপাতে নামতে হয়। মূল ইঞ্জিন ছাড়া সেটি ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। মহাকাশযানের কেউই বাঁচেনি। গ্রাহা কীভাবে বেঁচে গিয়েছে, সেটি সব সময়েই রহস্য হিসেবে থেকে যাবে।
তাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপা উপগ্রহটি মানুষের বসবাসের কতোটুকু উপযোগী, সেটা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া–গ্রাহা এখন সেই ধারণাটি নিজের জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই উপগ্রহে জীবন ধারণের মূল উপাদান পানি এবং অক্সিজেন দু’টিই আছে। এর সাথে অল্পকিছু সাহায্য পেলে একজন মানুষ অনির্দিষ্টকাল ইউরোপাতে বেঁচে থাকতে পারবে।
গ্রাহার দুর্ভাগ্য, তাদের মহাকাশযানের মূল যোগাযোগ মডিউলটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই পৃথিবীর সাথে আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি। অনেক কষ্ট করে সে তার আংশিক চালু করেছিল, যে কারণে মহাকাশের কিছু সিগন্যাল সে পেতো, কিন্তু কিছুই পাঠাতে পারত না।
সময় কাটানোর জন্যে সে বিধ্বস্ত মহাকাশযানের অংশগুলো জোড়াতালি দিয়ে এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছিল। সেটি দিয়ে কখনোই কোনো মহাকাশযানে নামতে পারবে আশা করেনি। কিন্তু বিশাল একটা উপগ্রহে পুরোপুরি একাকী বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার থেকে প্রায় অসম্ভব কিছু একটা চেষ্টা করতে গিয়ে মারা যাওয়াটাই তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তাই যখন তার যোগাযোগ মডিউলে পেপিরার সংকেত ধরা পড়েছে, সে সেটাকে ধরার চেষ্টা করেছে। বৃহস্পতি গ্রহের এতো কাছে দিয়ে সত্যিকারের মহাকাশচারী নিয়ে একটি মহাকাশযান উড়ে যাবে, সেটি সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। সে যে সত্যি সত্যি এই মহাকাশযানের ভেতরে নিরাপদে আশ্রয় পেয়েছে, সেটি সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
গ্রাহা তখন ত্রাতিনার কাছে তার অভিযানের উদ্দেশ্যটি জানতে চাইল। ত্রাতিনা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তোমাকে এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলব যে আমরা একটা মহাজাগতিক প্রাণীর কাছে একটা মেসেজ নিয়ে যাচ্ছি।”
গ্রাহা কিছুক্ষণ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “মহাজাগতিক প্রাণী?”
ত্রাতিনা বলল, “মহাজাগতিক প্রাণী শব্দটা হয়তো ঠিক হলো না, প্রাণী বললেই আমাদের মনে হাত পা চোখ মুখ আছে এরকম একটা জীবন্ত কিছুর ছবি ভেসে ওঠে! আমার শুদ্ধ করে বলা উচিত মহাজাগতিক অস্তিত্ব।”
“অস্তিত্ব? মহাজাগতিক অস্তিত্ব?” এবারে গ্রাহাকে আরো বেশি বিভ্রান্ত দেখালো।
ত্রাতিনা বলল, “আরো শুদ্ধ করে বলা যাক, একটি বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব!”
গ্রাহা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো একটা জায়গায় একটা বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব ঘাপটি মেরে বসে আছে? তুমি তার কাছে একটা চিঠি নিয়ে যাচ্ছ?”
ত্রাতিনা হাসল, বলল, “ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।”
”তুমি কেমন করে জান এই মহাবিশ্বে একটা বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব আছে?”
ত্রাতিনা বুকে হাত দিয়ে বলল, “আমি ত্রাতিনা সেটা জানি না পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানী গবেষকরা সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। কারণ আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে একটা মহাজাগতিক কণা পৃথিবীটাকে ধ্বংস করার জন্যে ছুটে গিয়েছিল, যেটাকে শেষ মুহূর্তে একটা থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ধ্বংস করে পৃথিবীকে রক্ষা করা হয়েছে।”
গ্রাহা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বিষয়টা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমরা মহাকাশচারীদের অনেকে সেটা শুনেছি। রায়ীনা নামে একজন মহাকাশচারী–”
ত্রাতিনা হঠাৎ শব্দ করে হাসল। গ্রাহা থেমে গেল, ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি হাসলে কেন?”
“তোমার মুখে আমার মায়ের নাম শুনে!”