“কী বলছ তুমি?”
“হ্যাঁ। একটা অংশ সিল করে সেটা খুলে দেব। মহাকাশযানটা ভেতরে ঢুকবে। তারপর মহাকাশযান বন্ধ করে বাতাসের চাপ সমন্বয় করব।”
“কী বলছ তুমি? এটা দ্বিতীয় মাত্রার বিপজ্জনক পরিস্থিতি।”
“না। এটা একেবারে প্রথম মাত্রার বিপজ্জনক পরিস্থিতি। এই বিচিত্র মহাকাশযানটার ভেতরে একজন মানুষ রয়েছে। আমাদের তাকে উদ্ধার করতে হবে। যে কোনো মূল্যে–”
“কিন্তু।”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “তোমরা পুরোপুরি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছ। পুরোপুরি মানুষ হওয়ার এটা প্রথম শর্ত অন্য একজন মানুষকে বাঁচাতে হয়। যে কোনো মূল্যে। যাও, তোমরা পেপিরার লোডিং ডক খুলে দাও। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে আছি।”
ত্রাতিনা তার মহাকাশচারী জীবনের পুরো অভিজ্ঞতাটুকু ব্যবহার করে বিচিত্র মহাকাশযানটিকে পেপিরার ভেতরে নিয়ে এলো। প্রাণপণ চেষ্টা করেও মহাকাশযানটিকে ঠিকভাবে নামাতে পারলো না। একেবারে শেষ মুহূর্তে মহাকাশযানটি পেপিরার দেয়ালে আঘাত করল। বিচিত্র মহাকাশযানটি স্থির হবার পর পেপিরার লোডিং ডকের বিশাল ঢাকনাটি ধীরে ধীরে নেমে এলো। বাতাসের চাপ সমান করার সাথে সাথে গিসাকে কন্ট্রোল প্যানেলে রেখে ত্রাতিনা রুখকে নিয়ে ভিতরে ছুটে গেল।
বিচিত্র মহাকাশযানটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এর কোনো দরজা নেই। ভেতর থেকে বের হওয়ার কোনো জায়গা নেই। ত্রাতিনা লেজার দিয়ে সাবধানে একপাশে কেটে একটা গর্ত করে ভেতরে মাথা ঢোকালো। দেখলো মহাকাশযানটির সামনে ছিন্নভিন্ন পোশাকে একজন মানুষ যন্ত্রপাতির নিচে চাপা পড়ে আছে। তার লম্বা মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। ত্রাতিনাকে দেখে মানুষটি হাত নেড়ে বলল, “এটা কী সত্যি ঘটেছে, নাকি এটা কোনো হ্যাঁলুসিনেশন?”
ত্রাতিনা বলল, “আমিও এটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে চাই। এটা কি সত্যি ঘটেছে?”
যন্ত্রপাতির ভেতর থেকে মানুষটা নিজেকে টেনে বের করে আনতে আনতে বলল, “একসাথে দুইজনের একই হ্যাঁলুসিনেশান হতে পারে না। মনে হয়, সত্যিই এটা হচ্ছে।”
ত্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ সত্যি এটা হচ্ছে। তোমার নাম কী?”
“নাম?”
“হ্যাঁ।”
মানুষটি হাসল, দাড়ি গোঁফের জঙ্গলের ভেতর থেকে তার ঝকঝকে দাঁত বের হয়ে আসে।”অনেকদিন নামটা ব্যবহার হয়নি তো, তাই মনে করতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় আমার নাম গ্রাহা।”
“তুমি কী জান, একসময়ে টেক্সট বইয়ে একটা চ্যাপ্টার লেখা হবে যার শিরোনাম হবে গ্রাহা উদ্ধার প্রক্রিয়া?”
গ্রাহা নামের মানুষটা এবারে শব্দ করে হাসল। বলল”আসলে একটা চ্যাপ্টার নয় মনে হয় পুরো একটা বই লেখা সম্ভব। সেটার নাম হতে পারে, ‘হতভাগা গ্রাহার জীবন কাহিনী’।”
রুখ নিচু গলায় বলল, “ত্রাতিনা, আমার মনে হয় তোমরা মহাকাশযানের ভেতরে গিয়ে এই কথাবার্তা বলতে পারবে। তার অনেক সময় আছে।”
.
৩.৩
মহাকাশযান পেপিরার ভেতরে ঢুকে গ্রাহা এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকালো। তারপর নিচু গলায় বলল, “এ রকম একটি মহাকাশযান হতে পারে আমি সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।”
ত্রাতিনা বলল, “আমিও করিনি।”
“তোমাদের কমান্ডারের সাথে দেখা করার আগে আমার মনে হয় একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার।”
ত্রাতিনা বলল, “তার প্রয়োজন হবে না। তোমার এর মাঝে কমান্ডারের সাথে দেখা হয়েছে।”
গ্রাহা অবাক হয়ে বলল, “দেখা হয়েছে?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। আমি এই মহাকাশযানের কমান্ডার। এবং ঝাড়দার এবং নিরাপত্তাকর্মী। এবং বাবুর্চি। এক কথায় সবকিছু।”
গ্রাহা বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “কী আশ্চর্য! এতো বড় মহাকাশযানের দায়িত্বে এতো কমবয়সী একজন? অন্য মহাকাশচারীরা কোথায়?”
ত্রাতিনা বলল, “আর কেউ নেই। আমরা তিনজন এর দায়িত্বে।”
“কী আশ্চর্য! মাত্র তিনজন মানুষ এর দায়িত্বে?”
গিসা বলল, “আসলে তিনজন মানুষ নয়। একজন মানুষ। ত্রাতিনা। আমরা মানুষ নই। আমরা এনড্রয়েড।”
গ্রাহা রীতিমত চমকে উঠল এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে গিসার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “আমি নিজের চোখে দেখে এবং নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করছি না।”
রুখ বলল, “এই অভিযানের জন্যে আমাদের বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। আমরা মূলত ত্রাতিনাকে নিরাপত্তা দেই, কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রায় ত্রাতিনা যেন নিঃসঙ্গ অনুভব না করে সেজন্যে আমাদের রয়েছে প্রায় পূর্ণাঙ্গ মানবসত্তা।”
গিসা বলল, “এছাড়াও আমাদের আরো একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। যেটি এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না।”
গ্রাহা মাথা নাড়ল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। সে সম্ভবত এর আগে কখনোই একটা এনড্রয়েডের সাথে কথা বলেনি। তাদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে, সে জানে না।
ত্রাতিনা ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পারল। সে গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তুমি কীভাবে কোথা থেকে কীভাবে এখানে এসে হাজির হয়েছ, সেটা জানার জন্যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব। তোমার সম্ভবত একটা মেডিকেল চেকআপ করা উচিত। তারপর গরম পানিতে একটা দীর্ঘ গোসল, নূতন কাপড়, ভালো ডিনার, উত্তেজক পানীয় ইত্যাদি। যারা এই মহাকাশযানটি ডিজাইন করেছে, তারা সবকিছু চিন্তা করেছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি এখানে আরো একজন মানুষ এসে হাজির হবে। কাজেই এখানে দ্বিতীয় মানুষের কোনো ব্যবস্থা নেই। তোমাকে সবকিছু আমার সাথে ভাগাভাগি করতে হবে।”