ত্রাতিনা হাসি হাসি মুখে বলল, “আর আমরা?”
“তোমরা হবে অতীতের মানুষ।”
ত্রাতিনা তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। অতীতের মানুষ ভবিষ্যতের মানুষকে স্বাগত জানাচ্ছে। যদি মহাজাগতিক প্রাণী সত্যি সত্যি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়, তাহলে ভবিষ্যতের মানুষ এই পৃথিবীর ইতিহাস, কালচার ঐতিহ্য জ্ঞান বিজ্ঞানকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
গিসা বলল, “তুমি আমাদের নিয়ে কৌতুক করছ। কিন্তু এক সময় নিশ্চয়ই আমাদের গুরুত্বটা বুঝতে পারবে। পারবেই পারবে।”
.
ত্রাতিনা কয়েকদিন মহাকাশযানটিতে কাটিয়ে আবার ঘুমুতে চলে গেল।
এবারে তার ঘুম ভাঙলো এক বছরের আগেই, কারণ তাকে জাগিয়ে তোলা হলো। ক্যাপসুলের ভেতর চোখ খুলেই সে বুঝতে পারলো, সময়ের আগেই তাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে, কারণ মাথার কাছে ছোট একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। ত্রাতিনা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, নিয়ম মাফিক হাত পা এবং মাথা নাড়িয়ে, চোখ খুলে এবং বন্ধ করে শেষে মাথার ভিতরে ছোট একটা হিসেব করে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলো। ক্যাপসুলের বাইরে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়ে আছে, এর আগেরবার তাদের চেহারায় একটা উৎফুল্ল ভাব ছিল, এবারে সেটি নেই। দুজনেই একটু গম্ভীর।
ত্রাতিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কোনো সমস্যা?”
রুখ মাথা নাড়ল, “না, সমস্যা না। তবে–”
“তবে কী?”
“একটা স্কাউটশীপ আমাদের মহাকাশযান পেপিরাকে ধরার চেষ্টা করছে।”
ত্রাতিনা চোখ বড় করে তাকালো, “কী বললে? একটা স্কাউটশীপ?”
“হ্যাঁ।”
“যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছ?”
”করেছি। মনে হয় চ্যানেল খোলা নেই। কোনো উত্তর নেই।”
“পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করেছ?”
“চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা বৃহস্পতি গ্রহের ছায়ার মাঝে আছি, এখান থেকে বের হবার আগে যোগাযোগ হচ্ছে না।”
“কী আশ্চর্য! বৃহস্পতি গ্রহের কাছে একটা স্কাউটশীপ?”
গিসা বলল, “আমি জানি না এটাকে স্কাউটশীপ বলা ঠিক হবে কি না। এটা খুব ছোট অত্যন্ত বিচিত্র একটা মহাকাশযান।”
ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলে গিয়ে মহাকাশযানটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। গিসা ঠিকই বলেছে, এটাকে স্কাউটশীপ কিংবা মহাকাশযান বলা যায় কিনা সন্দেহ আছে। মনে হচ্ছে অত্যন্ত বিচিত্র কিছু যন্ত্রপাতি জুড়ে দিয়ে কিছু একটা দাঁড় করানো হয়েছে। শুধু তাই না, এই মহাকাশযানটার যাত্রাপথ একটি সুইসাইড মিশন। এটি সরাসরি মহাকাশযান পেপিরার সাথে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে, পেপিরার যেটুকু ক্ষতি হবে, সেটা সারিয়ে নেয়ার উপায় আছে, কিন্তু এই মহাকাশযানটার রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই।
ত্রাতিনা কোয়াকম্প দিয়ে হিসেব করে পেপিরার সাপেক্ষে এই বিচিত্র মহাকাশযানটার যাত্রাপথ বের করলো। তাদের মহাকাশযানে আঘাত করার আগে এখনো হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় আছে।
রুখ বলল, “এটি একটি বিপজ্জনক বস্তু। যেহেতু এটি কোনো রকমভাবে যোগাযোগ করছে না, কাজেই ধরে নেয়া যায় এটি একটি মহাজাগতিক জঞ্জাল। আমাদের নিরাপত্তার জন্যে এটা ধ্বংস করে দেয়া সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কাজ।”
গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ ধ্বংস করে দিই।”
রুখ বলল, “আমরা যেখানে আছি তার আশেপাশে কয়েক লক্ষ কিলোমিটারের ভেতর কোনো মানুষের বসতি নেই। এর ভেতরে কোনো মানুষ নেই।”
ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়েছিল, দেখতে পেলো মহাকাশযানটির একটি অংশ হঠাৎ করে ভেঙে উড়ে গেল। রুখ সেটা দেখে মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের হয়তো এটা ধ্বংস করতে হবে না; এটি নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একটা অংশ ভেঙে উড়ে গেছে।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “না। তোমরা বিষয়টি ধরতে পারনি।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“মহাকাশযানের একটা অংশ এমনি এমনি ভেঙে উড়ে যায়নি। এটি ইচ্ছে করে করা হয়েছে।”
“কেন?”
“যাত্রাপথটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে। দেখেছ এর যাত্রাপথ এখন আর সাংঘর্ষিক না। এটি এখন আমাদের সমান্তরালভাবে আসছে।”
গিসা বলল, “এটি কাকতালীয় ব্যাপার। মহাকাশযানের অংশ ভেঙে কেউ মহাকাশযানের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে না। মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশের ইঞ্জিন দিয়ে।”
“যদি মহাকাশযানে ইঞ্জিন না থাকে?”
গিসা একটু হাসল। বলল, “যদি ইঞ্জিন না থাকে, সেটাকে কেউ মহাকাশযান বলে না।”
ত্রাতিনা মনিটরটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বলল, “দেখেছ কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
“মহাকাশযানের আরেক টুকরো বের হয়ে গেছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। গতি একটু বাড়িয়েছে, যেন আমাদের স্পর্শ করতে পারে।”
“তুমি কী বলতে চাইছ?”
“আমি বলতে চাইছি, এই বিচিত্র মহাকাশযানটিকে আমাদের মহাকাশযানে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তুত হও।”
রুখ বলল, “তুমি এটাকে ডক করতে দেবে? এর ভেতরে কী আছে তুমি জানো না। হতে পারে এই কোনো দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো মহাকাশযানের অংশ।”
“যেটাই হোক, আমি সেটা দেখতে চাই।”
মহাকাশযানটি অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন এটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুখ ভালো করে দেখে বলল, “ত্রাতিনা।”
“বল। এটি কোনোভাবে আমাদের মহাকাশযানে ডক করতে পারবে।। এটির বায়ু নিরোধক কোনো হ্যাঁচ নেই।”
ত্রাতিনাকে খুব বিচলিত হতে দেখা গেল না। বলল, “আমি অনুমান করেছিলাম।”
“তাহলে?”
“মহাকাশযানটাকে সরাসরি পেপিরার ভেতরে নিয়ে আসব।”