ত্রাতিনা মহাকাশযানের কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। গ্রহকণা বেল্টটি আলাদাভাবে দেখতে পেলো না। কিন্তু বৃহস্পতি গ্রহটিকে বেশ স্পষ্ট দেখাতে পেলো। কয়েকদিন কাজ করে সে আবার ঘুমিয়ে যাবে। পরের বার যখন উঠবে, তখন বৃহস্পতি গ্রহটার খুব কাছে চলে আসবে। সত্যি কথা বলতে কী, বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষণ বল ব্যবহার করে পেপিরার গতিকে বাড়ানো হবে। মহাকাশচারীদের উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্যে মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত অনেককেই আসতে হয়, কিন্তু এর পর বড় অভিযান ছাড়া আর কেউ আসার সুযোগ পায় না। বছর দুয়েক আগে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাতে একটা অভিযানে এসে একটা মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে সব মহাকাশচারী মারা গিয়েছিল। কারণটি কখনো জানা যায়নি।
ত্রাতিনা রুখ আর গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “গত এক বছরে কী ঘটেছে বল।”
“এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি প্রস্তুত হয়ে এসো। নাস্তা করো। কফি খাও, তখন তোমার সাথে কথা বলব।”
“নিউট্রিনো ফ্লাক্স মেপেছ?”
“এটা প্রতিদিন একবার করে মাপছি।”
“পৃথিবী থেকে কোনো তথ্য? কোনো নির্দেশ?”
“না। কোনো তথ্য নেই। কোনো নির্দেশ নেই। জন্মদিনের শুভেচ্ছা আছে।”
“পৃথিবী ঠিক আছে? কোনো ঘূর্ণিঝড় ভূমিকম্প?”
“ওসব কিছু আছে। কিন্তু যেহেতু আগে থেকে ভবিষ্যৎবাণী করা যাচ্ছে, তাই ক্ষয়ক্ষতি বলতে গেলে নেই। বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন পৃথিবীতে উৎসবের মতো!”
“নূতন কোনো আবিষ্কার?”
“নূতন কিছু প্রাণী তৈরি হয়েছে। নিরীহ গোবেচারা ধরনের, কিন্তু সাইজ অনেক বড়। চিড়িয়াখানায় বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য!”
ত্রাতিনা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে নিজের ঘরে গেল। বরফের মতো কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে ঢিলেঢালা কাপড় পরে লাউঞ্জে এলো। খাওয়ার ট্রেতে গরম খাবার, তরল পানীয় আর গরম কফি নিয়ে সে কন্ট্রোল সেন্টারে এসে বসল। রুখ আর গিসা তার দুই পাশে বসে ত্রাতিনার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। ত্রাতিনা মাথা নেড়ে বলল, “তোমরা ঠিকই অনুমান করেছ, কন্ট্রোল টেবিলে গরম খাবার নিয়ে বসা সপ্তম মাত্রায় অপরাধ।”
“তাহলে?”
“জোরে হাঁচি দেওয়াও সপ্তম মাত্রার অপরাধ। তাছাড়া এখানে আমাকে শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই। তোমরা এনড্রয়েড–এনড্রয়েড মানুষকে শাস্তি দিতে পারে না। কাজেই আমি এই ছোট বেআইনী কাজটি করছি”–বলে ত্রাতিনা তার প্লেট থেকে এক টুকরো ছোট কিন্তু সুস্বাদু প্রোটিন কেটে নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে বলল, “এবারে বল গত এক বছরে অনেক কিছু কী কী ঘটেছে?”
রুখ বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল, “মনে আছে তোমাকে বলেছিলাম আমাদের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আমাদের মানবিক সত্তা আটানব্বই পার্সেন্ট, অর্থাৎ দুই পার্সেন্ট ঘাটতি আছে?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “মনে আছে।”
“তুমি বলেছিলে আমাদের ভেতরে রাগ নেই। রাগ হচ্ছে খুব জরুরি একটি মানবিক সত্তা।”
ব্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ মনে আছে।”
“তোমার কথা সত্যি। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি শুধু রাগ নয়, হিংসা, ঘৃণা এবং লোভ এগুলোও মানবিক সত্তা। তাই গত এক বছর আমরা নিজেদের ভেতরে এই মানবিক সত্তাগুলো তৈরি করেছি।”
ত্রাতিনা চোখ কপালে তুলে বলল, “কী করেছ?”
গিসা বলল, “আমরা এখন রাগ হতে পারি, হিংসা করতে পারি, ঘৃণা করতে পারি এবং লোভ করতে পারি।”
ত্রাতিনা হতাশার ভঙ্গি করে বলল, “তোমরা জান তোমরা কী করেছ?”
“কী করেছি?”
“তোমরা ছিলে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মতো। সাধারণ মানুষের নিচতা হীনতা তোমাদের মাঝে ছিল না। এখন তোমরা হওয়ার চেষ্টা করছ নিচু শ্রেণীর মানুষ-”
গিসা বলল, “আমরা উঁচু নিচু বুঝি না। আমরা পুরোপুরি মানুষের মতো হতে চাই।”
“সেটা কখনো হতে পারবে কি না, আমি জানি না। মানুষ খুবই জটিল একটা প্রাণী। শুধু জটিল না, বলতে পার পুরোপুরি জগাখিচুড়ি একটা প্রাণী। বিবর্তনের কারণে কোনো একটা দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। তারপর অন্য একটা প্রয়োজনে আবার অন্য একদিকে পরিবর্তন হয়েছে। একটা স্তরের উপর আরেকটা স্তর, পুরোপুরি এলোমেলো। খুব ঠাণ্ডা মাথায় যদি মানুষকে নূতন করে ডিজাইন করা যেতো, তাহলে মানুষ হতো খুব সহজ সরল দক্ষ একটা প্রাণী! কিন্তু সেটা তো হতে পারবে না।”
রুখ বলল, “কেন হতে পারবে না?”
ত্রাতিনা তার কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “কীভাবে হবে?”
“মানুষ বলতে তুমি নিশ্চয়ই মানুষের পাকস্থলী, কিডনি কিংবা হৃৎপিণ্ড বোঝাও না। মানুষ হচ্ছে তার মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ককে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে
অন্য সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়েছে। ঠিক কি না?”
ত্রাতিনা বলল, “ঠিক আছে। তর্কের খাতিরে মেনে নিই।”
“তাহলে আমরা যদি মানুষের মস্তিষ্কের মতো জটিল একটা সিস্টেম দাঁড়া করি এবং সেটাকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে সহজ সরল কিছু যন্ত্রপাতি দাঁড়া করি, তাহলে সেটা কী মানুষ থেকে ভালো হল না?”
“কিন্তু সেটা কীভাবে হবে?” রুখ গলা উঁচিয়ে বলল, “কীভাবে হবে মানে? হয়ে গেছে!”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ। এই যে আমরা দুইজন তোমার সামনে বসে আছি। আমরা হচ্ছি ভবিষ্যতের মানুষ। আমাদের ভেতর মানুষের মানবিক সত্তা আছে, বুদ্ধিমত্তা আছে। কিন্তু আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত সঞ্চালন, কিডনি পরিবহন, পুষ্টিতন্ত্র, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কোনো কিছু লাগে না। আমরা হচ্ছি ভবিষ্যতের মানুষ।”