ত্রাতিনা হাসার চেষ্টা করে বলল, “ওটা নিয়ে দুর্ভাবনা করো না। আমি নিশ্চিত, আমার প্রোফাইল পরীক্ষা করলে দেখবে আমার মানবিক সত্তা টেনে টুনে আশি পার্সেন্ট!”
“তুমি যেহেতু নিজেই মানুষ, তোমার মানবিক সত্তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কখনো মাপার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা যেহেতু মানুষ নই, আমাদের মাপটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তুমি কী বলতে পারবে, ঠিক কোন কারণে আমাদের দুই পার্সেন্ট ঘাটতি?”
ত্রাতিনা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি ঠিক অনুমান করতে পারছি না। হতে পারে যেমন আমি এখন কফি খাচ্ছি সেটা দেখেও তোমাদের কফি খেতে ইচ্ছে করছে না! তোমরা মানুষ হলে এখন নিশ্চয়ই লাউঞ্জ থেকে কফি নিয়ে আসতে।”
গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “না। খাওয়ার ব্যাপারটি এর মাঝে নেই, আমাদের যেহেতু খেতে হয় না, তাই ওটা হিসেবে ধরা হয় না।”
ত্রাতিনা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তোমাদের দুজনের সাথে আমি গত কয়েকমাস সময় কাটিয়েছি। তোমাদের কখনো কোনো কিছু নিয়ে রাগ হতে দেখিনি! রাগ খুবই বড় একটা মানবিক সত্তা। মানুষ কথায় কথায় রাগ হয়।”
“রাগ?” রুখ এবং গিসা একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। কিন্তু রাগ তো একটি নেতিবাচক অনুভূতি।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। রাগ একটি নেতিবাচক অনুভূতি, কিন্তু তোমাকে কে বলেছে মানুষের সব অনুভূতি ইতিবাচক? মানুষের ভেতর ইতিবাচক আর নেতিবাচক দুই অনুভূতিই আছে। যে মানুষ তার নেতিবাচক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক অনুভূতিটি দেখাতে পারে, আমরা তাদের ভালো মানুষ বলি।”
গিসা বুঝে ফেলার ভঙ্গি করল। তারপর বলল, “তার মানে আমাদের রাগ থাকতে হবে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করা যাবে না?”
ত্রাতিনা বলল, “প্রকাশ করা যাবে না তা নয়, প্রয়োজনে রাগ প্রকাশ করা যায়। অনেক সময় রাগ প্রকাশ করতে হয়।”
রুখ এবং গিসাকে খুবই চিন্তিত দেখালো। ত্রাতিনা মনে মনে একটু কৌতুক অনুভব করে। এই দু’টি এনড্রয়েড এই মহাকাশযানের সকল খুঁটিনাটি জানে, মহাকাশযানটিকে নিখুঁতভাবে পরিচালনা করে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে তারা নিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু তাদের আচরণ অনেকটা শিশুর মতো!
ত্রাতিনা মহাকাশযানের কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মহাকাশটি কুচকুচে কালো, শুধু বাইরে বহু দূরে পৃথিবীটা দেখা যাচ্ছে, এর মাঝে অনেক ছোট হয়ে এসেছে। শুধু পৃথিবী নয়, সূর্যটাকেও বেশ ছোট দেখাচ্ছে।
মহাকাশযানের এই ইঞ্জিনগুলো অসাধারণ শক্তিশালী। সে যেহেতু জেগে আছে, ত্বরণটি একটা সহ্যসীমার মাঝে রাখা হয়েছে। সে ঘুমিয়ে যাবার পর যখন তাকে হিমশীতল করে ফেলা হবে, তখন ত্বরণ আরো বাড়িয়ে দেয়া হবে।
ত্রাতিনা মহাকাশযানের তথ্যভাণ্ডার থেকে মহাজাগতিক প্রাণীর সম্ভাব্য আচরণ নিয়ে গবেষণাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। তার হয়তো সৌরজগতের শেষপ্রান্তে পৌঁছাতে বারো বছর লেগে যাবে, কিন্তু প্রায় বেশিরভাগ সময়টুকুই তার হিমঘরেই কাটাতে হবে।
ত্রাতিনা দীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টা একটানা কাজ করে ঘুমুতে গেল। এখনো সে পৃথিবীর কাছাকাছি আছে, তাই পৃথিবীর ভিডি মডিউলের অনুষ্ঠান সে দেখতে পাচ্ছে। পৃথিবীতে কখনোই ছেলেমানুষি এই অনুষ্ঠানগুলো দেখার আগ্রহ অনুভব করেনি। কিন্তু পৃথিবী থেকে লক্ষ মাইল দূরে থেকে হঠাৎ সে এই ছেলেমানুষি অনুষ্ঠানগুলো গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখল।
দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে, নিজেই জানে না।
ত্রাতিনার ঘুম ভাঙল ঠিক এক বছর পর। ঘুমটি যেহেতু দৈনন্দিন ঘুম ছিল না, তাই তাকে বেশ কিছু নিয়ম মেনে তারপর উঠতে হলো। তাকে প্রথমে হাত, তারপর পা নাড়াতে হলো, মাথা ঘোরাতে হলো, বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে হলো। চোখ খুলতে হলো, বন্ধ করতে হলো মাথার ভেতরে ছোট একটা গাণিতিক হিসেব করে উত্তরটা বলতে হলো তারপর ক্যাপসুলের ঢাকনা খুলে বের হতে পারল।
ক্যাপসুলের ঢাকনার দুই পাশে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়েছিল। তারা উল্লসিত গলায় বলল, “পেপিরাতে শুভাগমনের শুভেচ্ছা ত্রাতিনা।”
ত্রাতিনা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমার কাছে মনে হচ্ছে গতরাতে ঘুমিয়ে আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি! তোমাদের শুভকামনা একটু বেশি মনে হচ্ছে।”
“মোটেও বেশি নয়। গত এক বছরে অনেক কিছু ঘটেছে তাই আমরা আগ্রহ নিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।”
ত্রাতিনা ভুরু কুঁচকে বলল, “অনেক কিছু ঘটেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কোনো সমস্যা?”
“না, কোনো সমস্যা হয়নি। পেপিরার যন্ত্রপাতি নিখুঁত, এখানে সমস্যা হবার কিছু নেই।”
“গ্রহকণাদের বেল্টের ভেতর ঢোকার সময় নাটকীয় কিছু ঘটেনি?”
“না, ঘটেনি। আমরা এখনো গ্রহকণা বেল্টের ভেতর আছি, তুমি ইচ্ছে করলে দেখতে পারো নাটকীয় কিছু ঘটানো যায় কি না।”
ত্রাতিনা বলল, “আমরা অনেক বড় অভিযানে যাচ্ছি। যদি তা না হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে আমি একটি গ্রহকণায় নেমে তার ওপরে লিখে আসতাম, ত্রাতিনা এই গ্রহকণায় এসেছিল!”
ত্রাতিনার কথা শুনে রুখ এবং গিসা শব্দ করে হাসল। ঠিক কী কারণে জানা নেই ত্রাতিনার কাছে তাদের হাসিটি সবসময়েই খানিকটা কৃত্রিম শোনায়। এই দুইটি এনড্রয়েড মানুষ হওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, দেখে মাঝে মাঝেই ত্রাতিনার এক ধরনের মায়া হয়।