.
ত্রাতিনাদের ছোট মহাকাশযানটি পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছানোর পর দুইবার সেটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করলো। মহাকাশ থেকে সে এক ধরনের মুগ্ধ দৃষ্টিতে পৃথিবী নামের নীল গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নিচের গ্রহটি জীবন্ত, ওপর থেকে সেটি বোঝা যায় না। পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা অসংখ্য প্রাণকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সে সৌর জগতের দ্বিতীয় জীবন্ত প্রাণের সাথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। কেমন হবে তার অভিজ্ঞতাটি? সে কী তার অভিজ্ঞতাটি পৃথিবীতে জানানোর জন্যে জীবন্ত ফিরে আসতে পারবে?
।ত্রাতিনা জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটি সরিয়ে, চাঁদের দিকে তার অভিযানটিকে নির্দিষ্ট করে নিল। তারপর আবার তার সিটে নিজেকে নিরাপত্তা বন্ধনী দিয়ে বেঁধে নিল। ত্রাতিনা চোখ বন্ধ করে শুনতে পেলো রুখ এবং গিসা তর্ক করছে, কিনিস্কীয় নবম নাকি সপ্তম সিম্ফোনিটির মাঝে কোনটি বেশি কালোত্তীর্ণ হয়েছে!
আঠারো ঘণ্টা পর ত্রাতিনাদের ছোট মহাকাশযানটি পেপিরার সাথে ডক করল। বাতাসের চাপ সমম্বিত হওয়ার পর বায়ু নিরোধক হ্যাঁচ খুলে ত্রাতিনা ভাসতে ভাসতে পেপিরার ভেতরে ঢোকে। ভেতরে একজন লাল তারকা কমান্ডার তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। ত্রাতিনাকে দেখে সে এগিয়ে এসে বলল, “এসো ত্রাতিনা, আমরা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি।” কমান্ডার ত্রাতিনাকে আলিঙ্গন করে বলল, “আমাকে অনেকবার সতর্ক করে বলা হয়েছে তোমার বয়স খুব কম; কিন্তু এতো কম আমি বুঝতে পারিনি।”
ত্রাতিনা বলল, “চেহারায় বয়সের ছাপটি পড়েনি বলে বয়স কম মনে হচ্ছে, কিন্তু আসলে আমার বয়স এমন কিছু কম নয়। আমার থেকে কমবয়সী মহাকাশচারী এর আগে আমার থেকে বড় অভিযান করেছে।”
ত্রাতিনা রুখ এবং গিসার সাথে কমান্ডারের পরিচয় করিয়ে দিল। কিন্তু এনড্রয়েড বলেই হয়তো কমান্ডার তাদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত হলো না।
ত্রাতিনা ঘুরে ঘুরে মহাকাশযান পেপিরাটি দেখলো। পৃথিবীতে সে এর মডেলের ভেতর কাজ করেছে, কিন্তু আসল মহাকাশযানটি যে এতো বড়, সে কখনো কল্পনা করেনি।
বারোজনের একটা টিম ত্রাতিনাকে পুরো মহাকাশযানটি ঘুরিয়ে দেখালো। তার যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সুযোগ সুবিধাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল। তথ্যভাণ্ডারের সাথে যুক্ত করে দিল। বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ব্যবহার করার জন্যে অস্ত্রগুলো দেখিয়ে দিল। এই পুরো সময়টুকু রুখ এবং গিসা একটি প্রাচীন কালোত্তীর্ণ সাহিত্য নিয়ে নিজেদের ভেতর আলোচনা করে সময় কাটাচ্ছিল। তাদের আলাদাভাবে এই তথ্যগুলো জানতে হবে না। সব তথ্য সরাসরি তাদের কপোট্রনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
পেপিরাটির দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর ত্রাতিনার শেষবারের মতো পুরো মেডিকেল চেক করে বারোজনের টিমটি বিদায় নিল। বায়ু নিরোধক হ্যাঁচটি বন্ধ করে দেবার পর সে দেখলো স্কাউটশীপটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। নিচে চাঁদে বেস স্টেশনটি দেখা যাচ্ছে, এই মানুষগুলো এখানে কিছুদিন কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাবে।
ত্রাতিনা কিছুক্ষণ নিজের মতো করে এই মহাকাশযানটিতে ঘুরে বেড়ালো। মূল ইঞ্জিন চালু করার আগে সে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করার জন্যে পেপিরাকে মূল অক্ষের সাপেক্ষে ধীরে ধীরে ঘোরাতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা আবার নিজের দেহের ওজন অনুভব করতে শুরু করে। ত্রাতিনা তখন মহাকাশযানের একাধিক কন্ট্রোল সেন্টারের একটিতে বসে কন্ট্রোল প্যানেলের তথ্যগুলো যাচাই করে নিল। কোয়াকম্পটির সুইচ অন করে সে রুখ এবং গিসার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী প্রস্তুত?”
গিসা হেসে বলল, “হ্যাঁ আমরা তো আগেই তোমাকে বলেছি আমরা অনেকদিন থেকে প্রস্তুত।”
“তাহলে আমরা মূল ইঞ্জিন চালু করি?”
“করো।”
ত্রাতিনা নিজের চোখের স্ক্যানিং করে ইঞ্জিনের নিয়ন্ত্রণটি নিয়ে নেয়, তারপর সুইচ টিপে একটি একটি করে ছয়টি ইঞ্জিন চালু করে দিল। ছয় ছয়টি শক্তিশালী ইঞ্জিন, তারপরও মহাকাশযানটিতে খুব সূক্ষ্ম একট কম্পন ছাড়া সে আর কিছুই অনুভব করল না।
দেখতে দেখতে প্রথমে চাঁদের মহাকর্ষণ থেকে এবং কিছুক্ষণের ভেতর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে পেপিরা সৌরজগতের শেষ প্রান্তের দিকে রওনা দেয়। ত্রাতিনা এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে তখনো কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না একুশ বছরের একটি মেয়ে হয়ে সে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহাকাশ অভিযানটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ত্রাতিনা মহাকাশযানটির ভেতরে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে বেড়ালো। একদিন নয় দুইদিন নয়, বারো বছর সে এই মহাকাশযানটিতে কাটাবে। তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সে যন্ত্রপাতিগুলো দেখলো, ইঞ্জিন ঘরে উঁকি দিল। কোয়াকম্পের হিমশীতল চৌকোণা বাক্সটি হাত দিয়ে স্পর্শ করল। অস্ত্রপাতির ঘরে ভয়াবহ অস্ত্রগুলো দেখে সে ছোট লাউঞ্জ থেকে এক কাপ কফি নিয়ে কন্ট্রোল রুমে ফিরে এলো।
রুখ এবং গিসা খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা আলোচনা করছিল। ত্রাতিনাকে দেখে তারা মুখ তুলে তাকালো। রুখ খুব গম্ভীর মুখে ত্রাতিনাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ত্রাতিনা তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
ত্রাতিনা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “করো।”
“আমরা আমাদের দুজনের প্রোফাইল দেখছিলাম। আমাদের দু’জনের প্রোফাইল অনুযায়ী আমাদের মানবিক সত্তা হচ্ছে আটানব্বই পার্সেন্ট। যার অর্থ, আমাদের দুই পার্সেন্ট ঘাটতি আছে।”