জীববিজ্ঞানী লিয়া বলল, “এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযান, কিন্তু তোমার সাথে দু’জন মানুষ না দিয়ে দু’জন এনড্রয়েড দেয়া হয়েছে কেন, সেটা বুঝতে পারলাম না।”
ত্রাতিনা বলল, “সিদ্ধান্তটি আমার নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আনন্দিত যে আমার সাথে রুখ এবং গিসা রয়েছে। মানুষ হিসেবে আমি খুবই কোমল একটি প্রজাতি। তাপ, চাপ, রেডিয়েশান কিংবা পরিবেশের একটুখানি তারতম্য হলেই আমি ধ্বংস হয়ে যাব। সে তুলনায় রুখ এবং গিসা অত্যন্ত কঠোর পরিবেশেও টিকে থাকতে পারবে। আমাদের অভিযানের জন্যে এটি খুবই জরুরি একটি ব্যাপার।”
জীববিজ্ঞানী লিয়া হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, “আমি জানি। আমি আগের যুগের মানুষ, যন্ত্রকে কখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। সেটা রবোট হোক, আর এনড্রয়েড কিংবা সাইবর্গই হোক।”
রুখ হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, “আপনারা আমাদের বিশ্বাস। করতে পারেন।”
গিসা বলল, “যদি আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি তাহলে বলা যায় মানুষও একটি যন্ত্র। জৈবরাসায়নিক যন্ত্র। সত্যি কথা বলতে কী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জৈব রাসায়নিক যন্ত্র থেকে সাধারণ যন্ত্র বেশি কার্যকর।”
মহামান্য রিহা হাত তুলে বিতর্কটি থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ত্রাতিনা, রুখ এবং গিসা আমরা তোমাদের সফল একটি অভিযান কামনা করি।”
ত্রাতিনা বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মহামান্য রিহা।”
মহামান্য রিহা বললেন, “আমি শেষ পর্যন্ত বয়সের ভারে ক্লান্ত হতে শুরু করেছি। তুমি যখন তোমার অভিযান শেষে ফিরে আসবে, আমি তখন আর বেঁচে থাকব না। ত্রাতিনা, তোমার সাথে আজকেই হয়তো আমার শেষ দেখা।”
.
সেদিন রাত্রিবেলা মহামান্য রিহা ঘুমের মাঝে মারা গেলেন। মনে হয়, ত্রাতিনার সাথে শেষ দেখা করার জন্যেই বুঝি তিনি এতোদিন বেঁচে ছিলেন।
.
৩.২
ছোট মহাকাশযানটিতে ত্রাতিনা তার সিটে বসে আছে। তার দুইপাশে রুখ এবং গিসা। এই ছোট মহাকাশযানটি তাকে মূল মহাকাশযান পেপিরাতে পৌঁছে দেবে। এই মুহূর্তে পেপিরা চাঁদের একটি উপগ্রহ হয়ে ঘুরছে। প্রায় এক যুগ থেকে ধীরে ধীরে এটিকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ত্রাতিনা তার দু’জন এনড্রয়েড ক্রু নিয়ে সেটাতে ওঠার পর তাদের সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া হবে। তারপর মহাকাশযান পেপিরা তার যাত্রা শুরু করবে। মহাকাশযানটির নাম পেপিরা প্রাচীন ভাষায় যার অর্থ যোগাযোগ। ত্রাতিনা কিংবা তার কু দু’জন এখনো পেপিরাকে দেখেনি। কিন্তু গত কয়েকমাস তারা পেপিরার একটি মডেলের ভেতর কাজ করেছে। কাজেই অনুমান করছে, তারা যখন সত্যিকারের পেপিরাতে পা দেবে, তখন সেটাকে খুব অপরিচিত একটা আবাসস্থল মনে হবে না।
ত্রাতিনা তার পাশে বসে থাকা রুখ এবং গিসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা প্রস্তুত?”
গিসা বলল, “আমরা অনেকদিন থেকে প্রস্তুত!”
ত্রাতিনা বলল, “এক্ষুনি কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে যাবে।”
গিসা বলল, “হ্যাঁ। আর মাত্র এক মিনিট।”
ঠিক তখন ত্রাতিনা কমান্ডার লীয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, “ত্রাতিনা আমি তোমাকে এই অভিযানের জন্যে বিদায় জানাচ্ছি। প্রায় বিশ বছর আগে আমি তোমার মাকে বিদায় জানিয়েছিলাম। সেটি ছিল সত্যিকারের বিদায়। কারণ আমরা সবাই জানতাম, তার সাথে আর দেখা হবে না। তবে তোমার বিদায়টি মোটেও সে রকম নয়। তোমার সাথে আবার দেখা হবে। আমাদের এই অভিযানটি শুরু করার জন্যে আমরা কয়েক বছর বেশি সময় নিয়েছি, শুধুমাত্র তোমাদের আবার নিরাপদে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে।”
ত্রাতিনা বলল, “অনেক ধন্যবাদ, কমান্ডার লী।”
“তোমার সাথে আমাদের দেখা হবে আজ থেকে চব্বিশ বছর পর। চব্বিশ বছর দীর্ঘ সময়, এই দীর্ঘসময়ে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হবে। আমি বেঁচে থাকব কি না, আমি জানি না। কিন্তু আমরা নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছি, যেন এই দীর্ঘ সময়টি তোমার কাছে দীর্ঘ মনে না হয়। দিন শেষে তুমি যখন তোমার স্লিপিং ব্যাগে ঘুমুতে যাবে, তুমি জানতেও পারবে না যে তোমার ঘুমটি হবে দীর্ঘ। তুমি ঘুম থেকে উঠবে এক বছর পর! কাজেই বারো বছর তোমার কাছে মনে হবে মাত্র বারো দিন। কাজেই তোমার হিসেবে তুমি পৃথিবীতে ফিরে আসবে তিন থেকে চার সপ্তাহের ভেতর!”
ত্রাতিনা বলল, “আমি জানি কমান্ডার লী। আমার যাত্রাকে সহনশীল করার জন্যে তোমরা অনেক কিছু চিন্তা করেছ।”
কমান্ডার লী বলল, “তোমাকে অভিযানের অভিনন্দন!”
কমান্ডার লীয়ের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন শোনা গেল এবং সাথে সাথে একটি সুরেলা নারী কণ্ঠে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেল। সাদা জলীয় বাষ্পে চারপাশ ঢেকে যায় এবং ইঞ্জিনের কম্পন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে।
“নয়–আট–সাত–ছয়-”
ত্রাতিনা শেষ বার তার পরিচিত কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে নেয়।
”চার–তিন–দুই–এক-”
ত্রাতিনা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে এবং মহাকাশযানটি ওপরে উঠতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্ত পরে সে তীব্র ত্বরণের জন্যে নিজের বুকের ওপর একটা চাপ অনুভব করে। ত্রাতিনা শরীরটিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করে সে শুনতে পেলো রুখ এবং গিসা সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। তাদের শরীর জৈবিক শরীর নয়, তাদের যান্ত্রিক দেহ তীব্র ত্বরণের চাপ অনুভব করে না! এনড্রয়েড সম্ভবত কোনো ধরনের শারীরিক কষ্ট অনুভব করে না।