বিকেল তিনটার সময় সভা ডাকা হয়েছিল এবং একেবারে কাঁটায় কাঁটায় তিনটার সময় মহামান্য রিহা হলঘরটিতে ঢুকলেন। সবাই দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান দেখালো। মহামান্য রিহার চেহারায় বয়সের ছাপ ফুটে উঠেছে। এবং তিনি শেষ পর্যন্ত বয়সের ভারে একটু কুঁজো হয়ে হাঁটছেন। নিজের চেয়ারে বসে বললেন, “বস। তোমরা সবাই বস।”
সবাই তাদের চেয়ারে বসল। মহামান্য রিহা সবার দিকে এক নজর তাকালেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন, “আমি তোমাদের সাথে এই ঘরে অসংখ্যবার বসেছি। অসংখ্য বিষয় নিয়ে কথা বলেছি এবং অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আজকের এই সভাটিতে এসে আমার কুড়ি বছর আগের একটা সভার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।”
মহামান্য রিহার কথা শুনে বেশ কয়েকজন মাথা নাড়ল। তারা বুঝতে পেরেছে, মহামান্য রিহা কোন সভাটির কথা বলেছেন।
মহামান্য রিহা বললেন, “তোমরা যারা সেই সভাটিতে ছিলে তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সেদিন আমরা ভয়ঙ্কর একটি বিপদের মুখে ছিলাম। সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুখোমুখি হয়েছিল। পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে কখনো জানানো হয়নি, কিন্তু তোমরা জানো, তখন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে একজন মহাকাশচারী আত্মাহুতি দিয়েছিল। একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে মহাকাশে সেই গ্রহকণাটিকে ধ্বংস করেছিল। সেই মহাকাশচারীর নাম ছিল রায়ীনা।
“পৃথিবীর মানুষ জানে না, কিন্তু সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তোমরা জানো, সেই গ্রহকণাটি আসলে ছিল মহাজাগতিক কোনো একটি প্রাণীর মহাকাশযান। এরপর এক যুগ থেকে বেশি সময় আমরা সেই মহাজাগতিক প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করেছি। তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রচেষ্টা থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সেই মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। এটি সাধারণ যোগাযোগ হতে পারে, এটি একটি সংঘর্ষও হতে পারে, শেষ পর্যন্ত এটি কী হবে, আমরা জানি না। শুধু জানি, আমরা প্রথমবারের মতো মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার জন্যে একটি অভিযান করতে যাচ্ছি।
“আমি সেই অভিযানের সদস্যদের সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাদের ডেকেছি। তোমাদের কারো কিছু বলার থাকলে বল, তারপর আমি অভিযানের সদস্যদের ডাকব।”
জীববিজ্ঞানী লিয়া সবার আগে কথা বলল, “মহামান্য রিহা, বুদ্ধিমত্তা খুবই বিচিত্র একটা বিষয়। যদি শুধুমাত্র বেঁচে থাকার কৌশলটি লক্ষ্য করি, তাহলে একটা ভাইরাস যথেষ্ট বুদ্ধিমান, কিন্তু আমরা কখনোই ভাইরাসের সাথে তথ্য বিনিময় করতে পারব না। কাজেই মহাজাগতিক প্রাণীটির বুদ্ধিমত্তা যদি আমাদের বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি হয় এবং অন্যরকম হয়, তাহলে আমরা কখনোই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারব না!”
মহামান্য রিহা শব্দ করে হাসলেন। বললেন, “লিয়া, ভাইরাসের সাথে তুলনা করার উপমাটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ভাইরাস আমাদের সাথে তথ্য বিনিময় করতে পারে না, কিন্তু আমাদের অসুস্থ করে তাদের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেয়। প্রয়োজন হলে আমরাও সেটা করব।”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “এই অভিযানের কিছু বিষয়ে আমি কাজ করেছি। যোগাযোগটি করা হবে নিউট্রিনো বীম দিয়ে। আশা করছি, নতুন এই প্রযুক্তিটি আমাদের হতাশ করবে না।”
মহামান্য রিহা বললেন, “রিশি তুমি কখনোই পৃথিবীর মানুষকে কিংবা আমাকে হতাশ করোনি। আমি নিশ্চিত, এবারেও তুমি হতাশ করবে না। তোমার প্রযুক্তিটি নিশ্চয়ই কাজ করবে।”
পরিবেশ বিজ্ঞানী নীহা বলল, “সৌরজগতের বাইরে যাওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ একটি অভিযান। আশা করি, আমাদের অভিযাত্রীরা এই দীর্ঘযাত্রায় সুস্থ থাকবে।”
মহামান্য রিহা বললেন, “আমি আমাদের অভিযাত্রী দল সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। তোমরা নিজেরাই দেখবে এবং আমি নিশ্চিত, একটুখানি বিস্মিত এবং অনেকখানি অনুপ্রাণিত হবে।”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “আমার মনে হয়, তাদেরকে এখন ডাকা যেতে পারে।”
মহামান্য রিহা তখন তার সামনে রাখা ঘণ্টাটিতে টোকা দিয়ে অভিযাত্রীদের ডাকার জন্যে সংকেত দিলেন। প্রায় সাথে সাথেই ত্রাতিনা এবং তার সাথে আরো দু’জন অভিযাত্রী হলঘরে এসে ঢুকল। গত চার বছরে ত্রাতিনার চেহারা থেকে কিশোরীসুলভ ভাবটি সরে গিয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন নেই। অন্য দু’জনের একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। তাদের বয়স কুড়ি থেকে চল্লিশের ভেতর যা কিছু হতে পারে।
মহামান্য রিহা তাদের বসতে বললেন এবং তারা তাদের জন্যে আলাদা করে রাখা চেয়ারে বসল।
মহামান্য রিহা বললেন, “প্রিয় সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ, আমি তোমাদের সাথে এই তিনজন অভিযাত্রীর পরিচয় করিয়ে দিই। দলপতি হচ্ছে ত্রাতিনা, তোমরা ত্রাতিনাকে কখনোই না দেখে থাকলেও তার মায়ের পরিচয় সবাই জান। সে মহাকাশচারী রায়ীনার মেয়ে।”
কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য সবাই এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকালো। পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “ত্রাতিনা, তোমাকে অভিনন্দন। এরকম একটি অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া অনেক বড় দায়িত্ব।”
ত্রাতিনা বলল, “আমি আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করব। আমাদের উপর এই দায়িত্ব দেয়ার জন্য আমরা আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, আমার সাথে রুখ এবং গিসাকে দেয়া হয়েছে।”