কয়েক ঘণ্টার ভেতর সারা পৃথিবীর আকাশ কুচকুচে কালো হয়ে যাবে। পৃথিবী হবে একটি ঘন অন্ধকার গ্রহ। দুই থেকে তিন বছর আকাশ এভাবে অন্ধকার থাকবে। ধুলোবালি পৃথিবীতে ঝরে পড়তে আরো সময় নেবে। সূর্যের আলো ঢুকতে পারবে না বলে সমস্ত পৃথিবী হিমশীতল হয়ে যাবে। পৃথিবীর যত জীবিত প্রাণী, তার শতকরা নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই অংশ মারা যাবে। পৃথিবী হবে একটা প্রাণহীন গ্রহ।”
মহামান্য রিহা একটু থেমে টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক সেঁক পানি খেয়ে বললেন, “আমরা পৃথিবীতে এটা হতে দিতে পারি না। সেজন্যে তোমাদের ডেকে এনেছি। তোমরা বল আমরা কীভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারি?”
কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যরা একে অপরের দিকে তাকালো। জীব বিজ্ঞানী লিয়া সোজা হয়ে বসে বলল, “আমাদের হাতে সময় নেই। তাই আমি একেবারে সময় নেব না। যেটা বলতে চাই, সোজাসুজি সেটা বলছি। আমি সব সময় প্ল্যান বি প্রস্তুত রাখার পক্ষপাতী। প্ল্যান এ বা মূল প্ল্যানটি কাউন্সিলের সদস্যরা বের করে নিয়ে আসুক, সেই পরিকল্পনাটি যদি কাজ না করে, তাহলে কী করতে হবে আমি সেটি বলি।”
জীববিজ্ঞানী লিয়া একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “যদি আমাদের পরিকল্পনা কাজ না করে, তাহলে পৃথিবীটা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে। শেষবার যখন এটা হয়েছিল, তখন ডাইনোসর ধ্বংস হয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণী পৃথিবীতে বংশ বিস্তার শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্ম নিতে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর সময় লেগেছিল। আমি মনে করি, এবারে সেটা হতে দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি কয়েক হাজার নারী-পুরুষ এবং কয়েক লক্ষ মানব ভ্রুণ সংরক্ষণের পক্ষপাতী। পাহাড়ের গভীরে টানেল খুঁড়ে সেখানে হিমঘরে আমরা এভাবে মানব প্রজাতিকে রক্ষা করব। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার কয়েক বছর পর যখন আবার সেটা মানুষের বসবাসের উপযুক্ত হবে, পৃথিবীর মানুষ তখন আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবে। নতুন করে মানব সভ্যতার জন্ম হবে।”
ত্রাতিনা জীববিজ্ঞানী লিয়া তার কথা শেষ করে অন্যদের মুখের দিকে তাকালো, কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। লিয়া একটু ইতস্তত করে বলল, “আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলে মানবপ্রজাতি সংরক্ষণের এই দায়িত্বটুকু আমি নিতে পারি।”
মহামান্য রিহা তার চেয়ারে হেলান দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, “লিয়া, তোমাকে ধন্যবাদ। মূল পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে কী করতে হবে, সেটা তুমি যথেষ্ট স্পষ্ট করে বলেছ এবং তোমাকে সেই দায়িত্ব দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে পছন্দ করি। মূল পরিকল্পনা কী হবে, সেটি ঠিক করার পর আমি তোমার প্ল্যান বি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”
মহামান্য রিহা চুপ করা মাত্রই পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বললেন, “গ্রহকণার খবরটি শোনার পর থেকে আমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব, আমি সেই তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। আমার বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু আমি খোলাখুলি বলে ফেলি। আমার ধারণা, আমরা এইবার পৃথিবী রক্ষা করতে পারব না।”
সবাই ঘুরে পদার্থবিজ্ঞানী রিশির দিকে তাকালো। পরিবেশ বিজ্ঞানী নিহি জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন এটা মনে করছ?”
“গ্রহকণাটি কীভাবে পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে, আমি সেটা বিশ্লেষণ করেছি। এটা শুরু হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। সৌরজগতের বাইরে থেকে একটা অখ্যাত ধূমকেতু প্রথম এই গ্রহকণাটুকুকে তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করেছে। বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণে প্রথম এটি কক্ষপথের বাইরে যাবার শক্তি পেয়েছে। মঙ্গল গ্রহ এটিকে স্লিং শট প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর দিকে পাঠিয়েছে। এই গ্রহকণাটির পৃথিবী থেকে কমপক্ষে এগারো মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে দিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খুবই বিচিত্র কারণে এটি আরেকটা খুবই বৃহৎ গ্রহকণার সাথে সংঘর্ষে তার কক্ষপথ পরিবর্তন করেছে। ঠিক এই সময় সূর্যের বিশাল একটা করোনা ডিসচার্জ হয়েছে। সূর্য থেকে বের হওয়া চার্জড পার্টিকেলে এটা আটকা পড়ে পৃথিবীর কাছে এসেছে। আমরা মাত্র আটচল্লিশটা ঘন্টা আগে এটি সম্পর্কে জেনেছি। কারণ এর আগে এটি ছিল নিরীহ একটি গ্রহকণা, অনেক দূর দিয়ে এর চলে যাবার কথা ছিল। গতিপথ পাল্টে সরাসরি পৃথিবীর দিকে আসার জন্যে অনেকগুলো বিচিত্র ঘটনা ঘটতে হয়েছে এবং সবগুলো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম, সোজা কথায় এগুলো ঘটার কথা না। কিন্তু আমরা জানি, এটা ঘটেছে, কাজেই আমার ধারণা–”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি কথা থামিয়ে মহামান্য রিহার দিকে তাকালো। মহামান্য রিহা বললেন, “তোমার কথা শেষ করো রিশি।”
রিশি বলল, “আমার ধারণা, এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি কাকতালীয় ঘটনা নয়।”
“তাহলে এটি কী?”
“কোনো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে যেভাবে এর একটা পরিবর্তন এনেছিল, এখন আবার সেই পরিবর্তন আনতে চাইছে। কাজেই আমার ধারণা, আমরা এটি থামাতে পারব না।”
মহামান্য রিহা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ক্লান্ত গলায় বললেন, “সম্ভবত তোমার সন্দেহ সত্যি। সম্ভবত কোনো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলার প্রস্তুতি হিসেবে এই গ্রহকণাটিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি সেজন্যে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব না। আমি পৃথিবীকে রক্ষা করার চেষ্টা করব। সেটি কীভাবে করা যায়, আমি তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব শুনতে চাই।”