“যে মানুষটি এই পৃথিবীটা রক্ষা করেছে, তুমি তার মেয়ে। তোমার মায়ের কাছে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। তোমার কাছে জানাই।”
ত্রাতিনা বলল, “আমাকে লজ্জা দেবেন না মহামান্য রিহা। আমার মা শুধুমাত্র তার দায়িত্ব পালন করেছে। আপনি আমার মায়ের কৃতজ্ঞতাটুকু আমাকে জানিয়েছেন, সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
মহামান্য রিহা বললেন, “তুমি আমার কাছে এসেছ, তোমাকে আমার একটা উপহার দেয়া উচিত। বল তুমি কী উপহার চাও।”
ত্রাতিনার গলা কেঁপে উঠল, বলল, “আমি কোনো উপহার চাই না মহামান্য রিহা। আপনি আমার মাথায় হাত রেখেছেন, সেটি আমার সবচেয়ে বড় উপহার।”
কমান্ডার লী বলল, “ত্রাতিনা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তুমি কতো বড় সুযোগ পেয়েছ। সারা পৃথিবীতে এর আগে অন্য কেউ এ সুযোগ পেয়েছে বলে মনে হয় না। তুমি যা ইচ্ছা তাই চাইতে পার।”
ত্রাতিনা বলল, “মহামান্য রিহা, আমি শুধু একবার আপনাকে স্পর্শ করতে চাই।”
মহামান্য রিহা হাসলেন। হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নাও স্পর্শ করো। একজন বৃদ্ধ মানুষের কুঞ্চিত চামড়া স্পর্শ করে তুমি কী পাবে আমি জানি না। জীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের আয়ু বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটি ঠিক হয়েছে কি না, বুঝতে পারছি না! আমার অর্ধশতক বছর আগে মারা যাওয়ার কথা ছিল।”
ত্রাতিনা মহামান্য রিহার হাতটা স্পর্শ করে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করে। এই মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ, সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ। সে তার হাত স্পর্শ করছে। কী আশ্চর্য!
মহামান্য রিহা বললেন, “তুমি এখনো ইচ্ছা করলে আরো কিছু চাইতে পার। বল কী চাও।”
ত্রাতিনা মাথা নিচু করে বলল, “সত্যি চাইব?”
“হ্যাঁ চাও।”
ত্রাতিনা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তারপর সাহস সঞ্চয় করে এক নিঃশ্বাসে বলল, “মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার জন্যে মহাকাশে যে অভিযান চালানো হবে, আমি সেই অভিযানটি করতে চাই।”
কমান্ডার লী এবং মহামান্য রিহা একই সাথে একইভাবে চমকে উঠলেন। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। কিছুক্ষণ পর কমান্ডার লী বলল, “ত্রাতিনা, তুমি কেমন করে জান মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার জন্য একটি অভিযান হবে?”
ত্রাতিনা বলল, “বিষয়টা অনুমান করা কঠিন নয়। একটি গ্রহকণাকে
ত্রাতিনা ধ্বংস করার জন্যে কাউকে নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে মহাকাশে যেতে হয় না। সেটা খুব সহজে পৃথিবী থেকে ধবংস করা যায়। কিন্তু আমার মা নিজে গিয়েছিল, কারণ যেটি ধ্বংস করতে গিয়েছিল, সেটি গ্রহকণা ছিল না। সেটি নিশ্চয়ই ছিল কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর মহাকাশযান। পৃথিবীর মানুষ আগে হোক পরে হোক, সেই প্রাণীর মুখোমুখি হবে।”
মহামান্য রিহা মৃদু গলায় বললেন, “যুক্তিতে কোনো ভুল নেই।”
কমান্ডার লী বলল, “কিন্তু তুমি কেমন করে অনুমান করলে সে জন্যে মহাকাশ অভিযান হবে?”
“তোমার অফিসে মানুষের মতো দেখতে রবোর্ট দেখে এসেছি। তুমি বলেছ দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানের জন্যে সেগুলো তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানের কারণ আর কী হতে পারে?”
মহামান্য রিহা হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, “কমান্ডার লী, “বুদ্ধির খেলায় তুমি এই মেয়েটির কাছে হেরে গেছ। এই মেয়েটি তোমার গোপন থেকে গোপনতম প্রজেক্টের কথা জেনে গেছে!”
কমান্ডার লী মাথা চুলকে বলল, “ত্রাতিনা জেনে গেলে আমি দুর্ভাবনা করব না, ত্রাতিনা আমাদের নিজেদের মানুষ।”
ত্রাতিনা মহামান্য রিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “মহামান্য রিহা, আপনি কী অনুমতি দেবেন? আমার মা মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সংঘর্ষের একটি অংশের জন্যে দায়িত্ব নিয়েছে। আমি, তার মেয়ে অন্য অংশটির দায়িত্ব নিতে চাই। আমার মায়ের প্রতি সেটিই হবে আমার ভালোবাসা, আমার কৃতজ্ঞতা।”
এই প্রথম মহামান্য রিহার চেহারায় এক ধরনের গাম্ভীর্য নেমে এল। তিনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “মহাজাগতিক প্রাণীর বিরুদ্ধে সেই অভিযানটি হবে একেবারে অন্যরকম। তুমি শত চেষ্টা করেও তার প্রকৃতিটি অনুমান করতে পারবে না। সেই অভিযানটি হবে সময়সাপেক্ষ, একটি মহাকাশযানে টানা বারো বছর থাকা সোজা কথা নয়। যদিও বেশিরভাগ সময় হিমঘরে ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সংঘর্ষ শেষে ফিরে আসতে পারবে কি না, সেটি কেউ জানে না। যে যাবে, সে
আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে যাবে।”
ত্রাতিনা বলল, “আমি জানি মহামান্য রিহা। বেঁচে থাকার সময় দিয়ে আমি জীবনের পরিমাপ করি না। কী করেছি, সেটা দিয়ে জীবনের পরিমাপ করি।”
মহামান্য রিহা বললেন, “ঠিক আছে। আজ থেকে চার বছর পর তুমি যদি প্রমাণ করতে পারো তুমি একজন প্রথম শ্রেণীর মহাকাশচারী হতে পেরেছ, আমরা তোমাকে সেই অভিযানে পাঠাব।”
ত্রাতিনার প্রবল একটি ইচ্ছে হল সে ছুটে গিয়ে মহামান্য রিহাকে আলিঙ্গন করে। কিন্তু সে কিছু না করে নিচু গলায় বলল, “আপনাকে ধন্যবাদ রিহা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
৩. তৃতীয় পর্ব (চার বছর পর)
কমান্ড কাউন্সিলের বড় হলঘরটাতে সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। মহামান্য রিহা এখনো এসে পৌঁছাননি। তাই তার চেয়ারটা খালি। টেবিলের উল্টোদিকে আরো তিনটি চেয়ার খালি। এই তিনটি চেয়ারে কে বসবে, কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যদের জানানো হয়নি।