“বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক রিহার কাছ থেকে।”
ত্রাতিনা চমকে উঠল, “মহামান্য রিহা?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি তাকে দেখেছ?”
কমান্ডার লী হাসল। বলল, “দেখেছি। অনেকবার দেখেছি। তুমিও দেখবে। মহামান্য রিহা তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।”
ত্রাতিনা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “আমার সাথে?”
“হ্যাঁ। তোমার সাথে। চল, আমরা যাই।”
হলঘরের ভেতর দিয়ে যাবার সময় রবোট মহিলাটি বলল, “কমান্ডার লী, আমার মনে হয় এই মেয়েটিকে প্রয়োজনের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে যাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তোমার বেসামরিক কিশোর কিশোরীকে এতো গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য কেউ সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারবে।”
কমান্ডার লী বলল, “কিকি, তুমি এখন একটু বিশ্রাম নাও। মনে হয়, তোমার কপোট্রন উত্তপ্ত হয়ে আছে।”
.
২.৪
ত্রাতিনা ভেবেছিল মহামান্য রিহার বাসভনটি হবে বিশাল। তার ঘরের মেঝে হবে মার্বেল পাথরের। দেওয়াল হবে গ্রানাইটের। ঘরের দরজা হবে মূল্যবান ক্রোমিয়াম এলয়ের। ঘরের ভেতর থাকবে আধুনিক যন্ত্রপাতি। কিন্তু ত্রাতিনা খুবই অবাক হয়ে দেখলো, তার বাসভবনটি আসলে ছোট একটি দোতলা কাঠের বাসা। বাসার চারপাশে বড় বড় গাছ এবং সেই গাছগুলোতে অসংখ্য পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে।
ঘরের সামনে কোনো গার্ড নেই। কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। ত্রাতিনা কখনো কাঠের সিঁড়ি ব্যবহার করেনি। সে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করল, সিঁড়িটা তাদের পায়ের নিচে রীতিমত কাঁচক্যাচ শব্দ করে জানান দিচ্ছে।
দোতলায় একটা বড় ঘর। তার পাশে একটা দরজা। সেই দরজাটির অপর পাশে বারান্দা। ত্রাতিনা লক্ষ্য করল, কমান্ডার লী এই বাসাটার সাথে বেশ পরিচিত। দরজাটি অল্প একটু খুলে বলল, “আসতে পারি মহামান্য রিহা?”
বারান্দা থেকে মহামান্য রিহা বললেন, “এসো এসো।”
কমান্ডার লী বলল, “আমি রায়ীনার মেয়েটিকে নিয়ে এসেছি। আপনি তাকে দেখতে চেয়েছিলেন।”
“নিয়ে এসো।”
কমান্ডার লী ত্রাতিনার হাত ধরে বারান্দায় গেল। ত্রাতিনা তখন অল্প অল্প কাঁপছে। এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষটির সাথে তার দেখা হবে। তার হৃৎপিণ্ড ধ্বক ধ্বক করছে, মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডের শব্দে সে আর কিছু শুনতে পাবে না।
মহামান্য রিহা বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীরে সাদা একটি ঢিলেঢালা পোশাক। মাথার চুল এলোমেলো, মুখমণ্ডলে বয়সের ছাপ। ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, “এসো মা। কাছে এসো।”
ত্রাতিনা এগিয়ে গেল। মহামান্য রিহার কাছাকাছি আসতেই হাত বাড়িয়ে ত্রাতিনার কনুইটি ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, “তুমি রায়ীনার মেয়ে ত্রাতিনা?”
ত্রাতিনার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। সে কোনোভাবে তার মাথা নাড়ল।
“তোমার মাকে আমি দেখিনি। আমি শেষবারের মতো তাকে দেখতে চেয়েছিলাম। কমান্ডার বলল, সময় নেই। তাই আর দেখা হল না।” মহামান্য রিহা কথা শেষ করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। নিঃশ্বাসটাকে কেমন জানি দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনালো।
মহামান্য রিহা ত্রাতিনার কনুইটা ছেড়ে দিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “তোমার মা পৃথিবীর সব মানুষকে রক্ষা করেছে, সেটি তুমি জান?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল।
কমান্ডার লী বলল, “বিস্তারিত কিছু জানে না। সত্যি কথা বলতে কী, কেউ তাকে কিছু বলেনি। ত্রাতিনা নিজেই চিন্তা করে করে অনেক কিছু বের করেছে। সে নিজে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, তা না হলে আমি কিছুতেই তাকে খুঁজে পেতাম না। অনাথ আশ্রমগুলোর নিয়ম খুব কঠিন। তারা কারো তথ্য কাউকে দেয় না।”
মহামান্য রিহা মাথা নাড়লেন। বললেন, “কেন দেবে? একজন মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে সম্মান করতে হয়।”
কমান্ডার লী বলল, “আমার মনে হয় রায়ীনার মেয়ের তার মা সম্পর্কে জানার অধিকার আছে। আপনি অনুমতি দিলে আমি তাকে তার মা সম্পর্কে বলতে পারি!”
মহামান্য রিহা কিছুক্ষণ ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কমান্ডার লীকে বললেন, “মেয়েটি একেবারে বাচ্চা মেয়ে! তাকে কী বলবে? কতোটুকু বলবে?”
কমান্ডার লী বলল, “আমার মনে হয়, সেটি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করতে হবে না। মহাকাশ ইনস্টিটিউটে রাখা ত্রাতিনার প্রোফাইলটা আমি দেখেছি। ত্রাতিনার বয়স মাত্র ষোল, কিন্তু সে এর মাঝে পুরোপুরি দায়িত্বশীল একজন মানুষ। নিনিষ স্কেলে তার বুদ্ধিমত্তা আট পর্যায়ের।”
মহামান্য রিহা হা হা করে হাসলেন। বললেন, “নিনিষ স্কেলে আমার বুদ্ধিমত্তা কখনো মাপা হয়নি। মাপা হলে এটা টেনে টুনে ছয়ের বেশি হবে। বলে মনে হয় না!”
কমান্ডার লী বলল, “আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমরা বিদায় নিই। আপনি আমাদের সময় দিয়েছেন, সে জন্যে কৃতজ্ঞতা।”
মহামান্য রিহা ত্রাতিনার দিকে তাকালেন। একটুখানি হেসে বললেন, “কিন্তু আমি তো এই মেয়েটির গলার স্বরটুকু শুনতে পেলাম না!”
ত্রাতিনা মাথা নিচু করে বলল, “মহামান্য রিহা, আপনার সামনে কথা বলার সাহস আমার নেই।”
“আমি কোনো বাঘ ভালুক নই। আমাকে এতো ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি কিছু বলতে চাইলে বল।”
ত্রাতিনা বলল, “আমার কিছু বলার নেই মহামান্য রিহা।”