ত্রাতিনা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল”কী খবর কিহি, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার উপর দিয়ে একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে।”
কিহি মাথা তুলে বলল, “শুধু সাইক্লোন না ত্রাতিনা, আমার উপর দিয়ে টাইফুন টর্নেডো সুনামি সবকিছু বয়ে গেছে। এই সেন্ট্রিফিউজটা হচ্ছে মানুষের উপর নির্যাতন করার একটা যন্ত্র!”
ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল। বলল, “মহাকাশচারীদের ট্রেনিংয়ের প্রথম অংশই হচ্ছে ত্বরণের শক্তিতে অভ্যস্ত হওয়া। এটাকে সকালের ব্রেক ফাস্টের মতো ধরে নাও, প্রতিদিন নিয়ম করে ভোরবেলা এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে।”
কিহি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কিন্তু তুমি এতো সহজে এটা সহ্য করো কেমন করে?”
ত্রাতিনা বলল, “জানি না!” সে ইচ্ছে করলেই বলতে পারতো আমার মা ছিলেন একজন মহাকাশচারী–হয়তো আমার রক্তের মাঝে মহাকাশচারী হওয়ার রক্ত আছে! কিন্তু সে সেটি বলল না। তার মায়ের ব্যাপারটি একান্ত ভাবেই তার নিজের, কাউকে সে তার কথা বলবে না।
কিহি খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে বলল, “চল যাই।”
“চল।”
দু’জনে সেন্ট্রিফিউজ কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে এলো। বাইরে শরতের শীতল হাওয়া। ক্যাম্পাসের বড় বড় গাছগুলোর পাতার রং বদলাতে শুরু করেছে।
কিহি বলল, “খুব খিদে লেগেছে। কিছু একটা খেতে হবে।”
ত্রাতিনা বলল, “যাও। ক্যাফেটেরিয়া থেকে কিছু একটা খেয়ে এসো।”
“তুমি যাবে না?”
“না। আমার খিদে লাগেনি। খাওয়ার সময় ছাড়া আমার খিদে লাগে।”
“ঠিক আছে, কিছু খেতে না চাইলে নাই–একটু কফি খেতে পার আমার সাথে।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “না কিহি। আমার একটু লাইব্রেরিতে যেতে হবে।”
কিহি একটু অবাক হয়ে বলল, “আমাদের লেখাপড়া এখনো শুরু হয়নি। তুমি দিন রাত লাইব্রেরিতে বসে কী কর?”।
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “লেখাপড়া শুরু হয়নি বলেই তো এখন লাইব্রেরিতে সময় কাটাতে পারছি। একবার শুরু হলে কী আর নিঃশ্বাস নিতে পারব?”
কিহি একটু অবাক হয়ে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী করো তুমি লাইব্রেরিতে?”
“পড়ি। নিরিবিলিতে পড়ার জন্য লাইব্রেরি থেকে ভালো কোনো জায়গা নেই।”
“কী পড়!”
“এইতো, যা ভালো লাগে। ইতিহাস, পৃথিবীর ইতিহাস।” কিহি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ত্রাতিনা কিহির দিকে হাত নেড়ে লাইব্রেরির দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
ত্রাতিনা স্পষ্ট করে কিহিকে বলেনি যে লাইব্রেরিতে কী করে। তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ত্রাতিনা তার মায়ের ক্রিস্টালটি থেকে জেনেছে যে, খুব রহস্যময়ভাবে তার মাকে চলে যেতে হয়েছিল। তার মা একজন মহাকাশচারী, কাজেই কোথাও যদি যেতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই মহাকাশে গিয়েছে। কেন গিয়েছে? কী করেছে তার মা? কেন করতে হয়েছে? ত্রাতিনা সেটি বের করতে চায়। ষোল বছর আগের তথ্যগুলো সে খুঁজে খুঁজে বের করছে। সবগুলো একটা পাজলের মতো। টুকরো টুকরো তথ্যগুলো সেই পাজলের একেকটা অংশ। খুব ধীরে ধীরে সেই রহস্যময় সময়টিতে কী হয়েছিল, সেই বিষয়টি ত্রাতিনার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে তার মায়ের অনেক তথ্য আছে। ত্রাতিনা বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করেছে চতুর্থ বর্ষে ঘূর্ণায়মান মহাকাশ স্টেশনে অবতরণের একটা পদ্ধতি তাদের শেখানো হবে, এই পদ্ধতিটির নাম রায়ীনা পদ্ধতি–তার মায়ের নামানুসারে। কী আশ্চর্য। তার বাবা সম্পর্কে বিশেষ তথ্য নেই। খুব অল্প সময়ের জন্যে তার বাবার সাথে পরিচয় হয়েছিল, ত্রাতিনার জন্ম হওয়ার আগেই তার বাবা হারিয়ে গিয়েছে। কেন হারিয়ে গিয়েছে, কোথায় হারিয়ে গেছে সে সম্পর্ক কোনো তথ্য নেই।
তার নিজের সম্পর্কেও একটা লাইন লেখা আছে, লাইনটা এরকম–রায়ীনার শিশুকন্যার নাম ত্রাতিনা। রায়ীনার ইচ্ছানুসারে সে কোনো একটি অনাথ আশ্রমে বড় হচ্ছে।
তথ্য ভাণ্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, তার মায়ের মৃত্যুর দিনটি, অনাথ আশ্রমে তাকে রেখে আসার পরদিন তার মা মারা গিয়েছে। ত্রাতিনা অনুমান করতে পারে, খুব একটা জরুরি কাজে তার মা মহাকাশে অভিযান করেছিল। কাজটি করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনায় মা মারা গিয়েছে, ব্যাপারটা সেরকম নয়। তার মা নিশ্চিতভাবে জানতো যে সে মারা যাবে। সেজন্যে তার মা ত্রাতিনাকে অনাথ আশ্রমে রেখে গেছে।
ত্রাতিনা তার মায়ের মৃত্যুর দিনটিতে মহাকাশে কী ঘটেছিল, সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। বিষয়টি রহস্যময়। তথ্য ভাণ্ডারে ইচ্ছা করে কিছু তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। মনে হয়, অনেক তথ্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেদিন উত্তরের কয়েকটা শহরে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। কিছু কিছু এলাকায় যোগাযোগ বন্ধ ছিল, এরকম কিছু তথ্য আছে। কিন্তু সেখান থেকে কী ঘটেছিল, অনুমান করা কঠিন। ত্রাতিনা তবু বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
লাইব্রেরিতে বসে বসে সে ষোল বছর আগের সেই রহস্যময় সময়টির খুঁটিনাটি তথ্য খুঁজে বের করে। কোনো তথ্য গোপন করা হলে সেটিও বের হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে বিজ্ঞানীরা। তারা মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে না। তার মা কীভাবে মারা গিয়েছিল, সেই তথ্যটি গোপন করার নিশ্চয়ই একটা কারণ ছিল। কারণটা কী হতে পারে, ত্রাতিনা বুঝতে পারছে না।