ত্রাতিনা ক্রিস্টালটি হাতে নিয়ে বসে আছে। তার হাতে ভিডি গগলস। ক্রিস্টালটি ঢুকিয়ে গগলসটি চোখে লাগালেই সে তার মাকে দেখতে পাবে। মাকে দেখার জন্যে একই সাথে সে নিজের ভেতরে এক ধরনের ব্যাকুলতা এবং পাশাপাশি বিচিত্র এক ধরনের ভীতি অনুভব করছে। কী দেখবে সে? সে কী সহ্য করতে পারবে? নাকি ভেঙে পড়বে?
শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে সে কাঁপা হাতে ক্রিস্টালটি ভিডি গগলসের ছোট স্লটটিতে ঢুকিয়ে ক্লিপটা টেনে দিল। তারপর গগলসটি চোখের উপর লাগিয়ে ত্রাতিনা ট্রেনের সিটে মাথা রাখল। প্রথমে একটা নীল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। মৃদু একটা যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেলো। তারপর হঠাৎ করে সে তার মাকে দেখতে পেলো।
ছোট করে কাটা কুচকুচে কালো চুল। গভীর কালো চোখ, সেই চোখে তীব্র একটা দৃষ্টি। মনে হয়, সেই দৃষ্টি দিয়ে তার মা সবকিছু ঝলসে দেবে। ত্রাতিনা কেঁপে উঠল। দেখলো, তার মা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটি তার সত্যিকারের মা নয়, এটি তার মায়ের ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি। তবু ত্রাতিনার মনে হলো সত্যিকারের মা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ত্রাতিনা দেখলো তার মায়ের ঠোঁট নড়ে উঠেছে। সে তখন তার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, স্পষ্ট গলায় তার মা বলল, “ত্রাতিনা, মা আমার। তুই এখন আমার কথা শুনছিস, তার মানে তুই আর আমার ছোট শিশুটি নেই। তুই বড় হয়েছিস। ভালো আছিস মা?”
ত্রাতিনা জানে, এটি তার সত্যিকারের মা নয়। শুধুমাত্র তার মায়ের প্রতিচ্ছবি। তারপরও সে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ মা। ভালো আছি। খুব ভালো আছি।”
“ত্রাতিনা মা, তুই নিশ্চয়ই আমার উপর অনেক অভিমান করে আছিস! তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস, আমি কেমন করে তোকে একটা অনাথ আশ্রমে রেখে চলে গেলাম। মা হয়ে কেমন করে সন্তানকে ছেড়ে গেলাম! তাই না?”
“কিন্তু মা আমার, সোনা আমার! বিশ্বাস কর, তোকে এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমি গিয়েছি। পৃথিবীটা কতো সুন্দর, তুই এখনো দেখিসনি মা, আমি দেখেছি। মহাকাশে আমি রাতের পর রাত মুগ্ধ হয়ে নীল পৃথিবীটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেই পৃথিবীটাতে তুই যেন বেঁচে থাকতে পারিস, তোর মতো আরো লক্ষ কোটি মানুষ যেন বেঁচে থাকতে পারে সে জন্যে আমি গিয়েছি। আমার উপর রাগ করে থাকিস না মা! দোহাই তোর।”
ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “না, মা। আমি তোমার উপর রাগ করে নাই!”
“ত্রাতিনা মা আমার, আমার হাতে সময় নেই। একেবারে সময় নেই। আমার এখনই তোকে নিয়ে অনাথ আশ্রমে যেতে হবে। আমি নিজে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। আমি জানি, সেখানে অনেক ভাইবোনকে নিয়ে বড় হওয়া যায়। সবাই মিলে বিশাল একটা পরিবার হয়, সেখানে সবাই সবার আপনজন। তুই নিশ্চয়ই আপনজনদের নিয়ে বড় হয়েছিস, তাই না মা?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, মা। আমি আপনজনদের মাঝে বড় হয়েছি।”
“তুই এখন বড় হয়েছিস-কতোটুকু বড় হয়েছিস, সেটা তো জানি না। তোর মাথায় কী ঘন কালো চুল। তোর চোখগুলো কী গভীর কালো? তোর কোন বিষয় পড়তে ভালো লাগে? বিজ্ঞান? গণিত? সাহিত্য? গান শুনিস তুই? কার গান শুনতে ভালো লাগে তোর?”
ত্রাতিনা দেখলো, তার মা হঠাৎ থেমে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “আমার এখন যেতে হবে মা। আমি যাই? তোকে কী একটিবার আমার বুকে চেপে ধরতে পারব? শক্ত করে চেপে ধরে রাখব, যেন তুই চলে যেতে না পারিস…”
ত্রাতিনা দেখলো, তার মা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে থরথর করে কাঁপতে থাকে, কোনোভাবে সে নিজেকে সামলাতে পারে না।
হঠাৎ সে অনুভব করল, কেউ তার মাথায় হাত রেখেছে। ত্রাতিনা চোখ থেকে গগলস খুলে তাকাল। সামনের সিটে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটি তার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “সোনামনি মনে হচ্ছে কোনো কিছু দেখে তুমি খুব বিচলিত হয়েছ। আমি কী কোনোভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না। কেউ না।”
বয়স্ক মহিলা গভীর স্নেহে ত্রাতিনার হাতটি ধরে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
.
২.২
মহাকাশ ইনস্টিটিউটের এক পাশে বিশাল একটি কমপ্লেক্স। উঁচু ছাদ, বড় হলঘর। তার মাঝখানে একটি বড় সেন্ট্রিফিউজ। সেন্ট্রিফিউজের দুই পাশে দুটো ছোট কুঠুরি—যার ভেতরে একজন মানুষকে কোনোভাবে রাখা যায়। মানুষটিকে শক্ত একটা সিট বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সেন্ট্রিফিউজটিকে তখন ধীরে ঘোরানো শুরু হয়। প্রথমে আস্তে তারপর গতিবেগ বাড়তে থাকে। কুঠুরির ভেতরে সিট বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখা মানুষটি তখন ঘূর্ণনের চাপটি অনুভব করতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই চাপ বাড়তে থাকে। মহাকাশচারী হওয়ার ট্রেনিংয়ের এটি হচ্ছে একেবারে প্রথম ধাপ। আজকে এই সেন্ট্রিফিউজের এক পাশে ত্রাতিনা, অন্য পাশে ইনস্টিটিউটের অন্য একটি ছাত্র।
ঘূর্ণনের পূর্ণ মাত্রা পৌঁছানোর পর সেন্ট্রিফিউজের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হল। তখন ধীরে ধীরে সেন্ট্রিফিউজের গতি কমে আসতে থাকে। সেন্ট্রিফিউজ পুরোপুরি থেমে যাবার পর দু’জন টেকনিশিয়ান দুই পাশের দুটো কুঠুরি খুলে দিল এবং তার ভেতর থেকে ত্রাতিনা আর অন্য ছাত্রটি বের হয়ে এলো। ত্রাতিনা বেশ স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে তার সহপাঠী ছাত্রটির দিকে এগিয়ে যায়। অন্য ছাত্রটির চেহারা যথেষ্ট বিধ্বস্ত। সে টলতে টলতে কোনোভাবে এগিয়ে একটা পিলার ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে।