স্যুটকেস খুলে তিনি দুইটা খেলনা বের করে একটা দিলেন বল্টুকে, আরেকটা মিলিকে, তারপর হঠাৎ সাথে আমাকে দেখে থতমত খেয়ে গিয়ে বললেন, এটা কে?
বল্টু বলল, আমার খালাতো ভাই। গ্রাম থেকে এসেছে। এর বাবা পাগল।
ছোট খালু বল্টুকে একটা রাম-ধমক দিলেন।
খালুর তাই একবার ছোট খালার দিকে তাকালেন, আরেকবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার ছোটা খালার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাবী, আমি তো জানতাম না, আর কেউ আছে এখানে, তাই শুধু দুইটা খেলনা এনেছি। এখন—
বল্টু ততক্ষণে তার খেলনাটা খুলে ফেলেছে, একটা মেকানো সেট। কী চমৎকার খেলনা, এটা জুড়ে দিয়ে কত রকম জিনিস তৈরি করা যায়। বল্টু ‘মেকানো সেট—আমার মেকানো সেট’ বলে চিৎকার করে খুশিতে লাফাতে লাগল। মিলিও তার খেলনাটা বের করল, কী সুন্দর একটা পুতুল একটা ট্রাই সাইকেলে বসে আছে। পিছনে সুইচটা টিপতেই সেটি বাজনা বাজিয়ে ঘুরতে শুরু করে। ইস, কী সুন্দর।
ছোট খালু বললেন, ব, তোর তো অনেক খেলনা আছে, এইটা বিলুকে দিয়ে দে, আরেক বার—
না না না না না–বলে বল্ট ঠোট উল্টিয়ে মুখ বাঁকা করে চিৎকার করে লাফিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আমার কিছু লাগবে না, কিছু লাগবে না—
ছোট খালুর ভাই তার সুটকেস খুলে এদিক-সেদিক হাতড়ে একটা কলম, একটা রংচঙে নোটবই, আরেকটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে বললেন, তুমি এগুলোর কোনো একটা নিতে চাও?
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটার জন্যে আমার খুব লোত হচ্ছিল, কিন্তু আমি তবু জোরেজোরে মাথা নেড়ে বললাম, আমার কিছু লাগবে না।
নাও, যেটা পছন্দ সেটা নাও।
আমি সাবধানে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা তুলে নিলাম। হাতের উপর রেখে হাতটা দেখতেই মনে হল একটা দৈত্যের হাত।
ছোট খালুর ভাই হেসে বললেন, এটা দিয়ে শুধু একটা জিনিসে সাবধান, কখনো সূর্যের দিকে তাকাবে না।
আমি মাথা নাড়লাম।
আমার মনে হল ম্যাগনিফাইং গ্লাস থেকে মজার কোন জিনিস পৃথিবীতে থাকতে পারে না। একটা পিঁপড়াকে দেখলাম ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে, সেটাকে দেখাল একটা ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো, দেয়াল থেকে একটা মাকড়সা ধরে এনে দেখলাম, সেটাকে দেখাল একটা অক্টোপাসের মতো আমি কখনো অক্টোপাস দেখি নি, কিন্তু দেখতে নিশ্চয়ই এরকম হবে। একটা গাছের পাতাকে ছিঁড়ে দেখলাম, সেটাকে মনে হল বিছানার চাদর। আমি আমার ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম সারাদিন। যেটাই পাই সেটাই দেখি। বাবার চিঠিটাও দেখলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। লাইনগুলোকে মনে হল পীচটালা রাস্তা।
দু’দিন পর আরো একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করলাম, বইয়ে পড়েছিলাম, সত্যি হতে পারে কখনো চিন্তা করি নি। সূর্যের আলোতে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা ধরলে রোদটা এক বিন্দুতে একত্র হয়ে আবার ছড়িয়ে পড়ে। যে-বিন্দুতে সেটা একত্র হয়, সেই বিন্দুটা অসম্ভব গরম। এত গরম যে সেখানে হাত রাখলে হাত রীতিমতো পুড়ে যায়। শুধু তাই নয়, একটা শুকনো কাগজে এই বিলুটাতে ঠিকভাবে ধরে রাখতে পারলে সেখানে আগুন পর্যন্ত ধরে যায়। আমি যখন ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখছিলাম, ঠিক তখন একটা পিঁপড়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেটার উপর, সেই বিন্দুটা ধরতেই ফট করে শব্দ করে পিঁপড়াটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
একটা পিঁপড়াকে খামোকা মেরে ফেললাম, বাবা দেখলে কত রাগ করতেন! কতবার পিঁপড়াটার কাছে আমার হয়ে মাফ চাইতেন।
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আমার সবসময়ের সঙ্গী হয়ে গেল। সবসময় আমার স্কুলের ব্যাগে রাখি, সময় পেলেই সেটা দিয়ে আশেপাশে যা কিছু আছে সেটাকে খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখি। যে-জিনিসটা এমনিতে দেখতে খুব সাধারণ, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে সেটাকেই কী বিচিত্র, কী অসাধারণ মনে হয়। যে-মানুষ প্রথম এটা আবিষ্কার করেছিল তার নিশ্চয়ই কত আনন্দ হয়েছিল।
আমি তখনো জানতাম না যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি ঘটবে এই ম্যাগনিফাইং গ্লাসটি দিয়ে।
০৬. অবাক পোকা
সেদিন আমাদের স্কুল ছুটি। ছোট খালা বল্টু আর মিলিকে নিয়ে বর এক বন্ধুর জন্মদিনে বেড়াতে গিয়েছেন। আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এসব জায়গায় আজকাল আর আমার যাওয়ার ইচ্ছা করে না। কাউকে চিনি না, কিছু না যাওয়ার পর বল্ট প্রথমেই সবাইকে ডেকে বলবে, এই যে এ হচ্ছে বিলু। এর বাবা পাগল, তাই গ্রাম থেকে আমাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে এসেছে।
তখন সবসময়েই কেউ-না-কেউ জানতে চায় আমার বাবা কেমন করে পাগল হলেন, কী রকম পাগলামি করেন, বেঁধে রাখতে হয় কি না, এইসব। আমার খুব খারাপ লাগে। আমি যেতে চাই না শুনে ছোট খালা বেশি জোর করলেন না, বল্টু আর মিলিকে নিয়ে চলে গেলেন। ছোট খালু সকালেই কী-একটা কাজে বের হয়ে গেছেন, তাই বাসায় থাকলাম আমি একা আর বাসার কাজের ছেলেটা।
আমি প্রথমে টেলিভিশনটা চালিয়ে দেখলাম, সেখানে কিছু নেই, তাই রেডিওটা চালিয়ে দেখলাম সেখানে যন্ত্রসংগীত হচ্ছে, আমার যন্ত্রসংগীত একেবারেই ভালো লাগে না, তাই রেডিওটা বন্ধ করে দিচ্ছিলাম, কিন্তু ঠিক তখন খবর শুরু হল। প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে কী রকম যুদ্ধ-বিগ্রহ হচ্ছে সেটা বলে খুব একটা আশ্চর্য খবর বলল। গত কয়েক দিন থেকে নাকি পৃথিবীর সব মানমন্দিরে আশ্চর্য এবং রহস্যময় কিছু সংকেত ধরা পড়ছে। সংকেতগুলো থেকে মনে হয় রহস্যময় কোনো-এক মহাকাশযান পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। রাডার বা মহাকাশের টেলিস্কোপ দিয়ে সেটাকে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু দেখা সম্ভব হয় নি। দুদিন আগে সেই রহস্যময় সংকেতু হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, সেই মহাকাশযান পৃথিবীর কোনো নির্জন এলাকায় নেমেছে কিংবা নামার চেষ্টা করে ধ্বংস হয়ে গেছে।