- বইয়ের নামঃ একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
কবি রুস্তম আলী দেওয়ানের ছদ্মনাম রু আদে
কবি রুস্তম আলী দেওয়ানের ছদ্মনাম রু আদে। নিজ নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে ছদ্মনাম। রুস্তমের রু, আলীর আ এবং দেওয়ানের দে–রু আদে। তার একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম রু আদের সাইকেল। কাব্যগ্রন্থে চল্লিশটি কবিতা আছে। প্রথম কবিতার নাম পিঁপড়া।
পিঁপড়া
আমার গ্লাস বেয়ে একটা পিঁপড়া উঠছে।
তার মাথা কালো
শরীরের বর্ণ মধুলাল।
এখন সকাল।
গ্লাসে ফ্রিজের পানি
শূন্যের কাছাকাছি তাপ
তৃষায় কাতর পিঁপড়া পানি খুঁজে পাবে কি না
মনে সেই চাপ…
দ্বিতীয় কবিতা মশা। তৃতীয়টি ফড়িং। কবির সব কবিতাই কীটপতঙ্গ নিয়ে। সর্বশেষ কবিতাটির নাম অন্ধ উইপোকা।
রুস্তমের দুলাভাই আমিন সাহেব এই বই তাঁর এক বন্ধুর প্রেস থেকে ছেপে দিয়েছেন। প্রচ্ছদ এঁকেছে প্রেসের এক কর্মচারী। বইয়ে প্রচ্ছদ শিল্পীর নাম নেই। প্রচ্ছদে উল্টো করে রাখা একটা সাইকেল। সাইকেলের চাকা আকাশের দিকে। একটি চাকায় নীল রঙের পাখি বসে আছে। ঠিক কী পাখি, তা বোঝার উপায় নেই। ঘুঘু হতে পারে, আবার কবুতরও হতে পারে। পাখিটা আহত। তার ডানা ভাঙা। ভাঙা ডানায় গাঢ় লাল রঙের রক্তের আভাস। কয়েক ফোটা রক্ত সাইকেলের স্পাইকের ওপরও পড়েছে। সাইকেলের চাকার পাশে এক কাপ চা। চা থেকে গরম ধুঁয়া উড়ছে।
কবি সাহেবের বয়স চল্লিশ। সরলরেখার মতো কৃশকায়। কৃশকায় লোক সাধারণত লম্বা হয়। রুস্তম আলী বেঁটে। সে কবি নজরুল স্টাইলে মাথায় বাবরি রেখেছিল। মাথার তালুতে ফাংগাসের প্রবল আক্রমণে তাকে মাথা কামিয়ে ফেলতে হয়েছে। মাথা কামানোয় তার চেহারায় আলাভোলা ভাব চলে এসেছে। তার চোখ বড় বড়। চোখের মণি ঘন কালো। চোখের পল্লব মেয়েদের চোখের পল্লবের মতো দীর্ঘ বলে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।
কবি রুস্তম ধানমণ্ডির একটি দোতলা বাড়িতে থাকেন। বাড়ি লেকের পাশে, নাম আসমা ভিলা। বাড়িটা তিনি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন। রুস্তমের বাবা সাজ্জাদ আলী দুনম্বরি ব্যবসায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ব্যবসায়ী মহলে তার নাম ছিল বজ্জাত আলী। বর্তমানে তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে স্ত্রী হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন জেল খাটছেন। ছয় বছর খাটা হয়েছে। আর আট বছরের মাথায় মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা। জেলের যাবজ্জীবন চৌদ্দপনেরো বছরে শেষ হয়।
তার স্ত্রীর নাম আসমা। আসমা রুস্তম আলীর মা। আসমার নামেই ধানমণ্ডির বাড়ির নাম আসমা ভিলা। শেতপাথরে খোদাই করে লেখা বাড়ির নাম বেশিদিন থাকে না। কালো রঙ উঠে যায়। আসমা ভিলার সব আকার চিহ্ন উঠে গেছে। এখন বাড়ির নাম অসম ভিল।
স্ত্রী হত্যার দায় থেকে সাজ্জাদ আলী বেকসুর খালাস পেতে যাচ্ছিলেন। চাক্ষুষ কোনো সাক্ষী নেই। হঠাৎ কোখেকে তার কাজের মেয়ে সালমার মা উদয় হয়ে আদালতকে জানাল, সে এবং তার মেয়ে সালমা দুজনই বেগম সাহেবকে খুন হতে দেখেছে।
স্ত্রী হত্যা মামলার শেষ পর্যায়ে সাজ্জাদ আলী হতাশ গলায় জজ সাহেবকে বলেছেন, স্যার, আমার স্ত্রী আসমা ছিল তিন মণি মুটকি। আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন। আমার ওজন চল্লিশ পাউন্ড। আমার পক্ষে কি সম্ভব ওই মুটকিটাকে গলা টিপে মারা? মুটকি একটা লাথি দিলেই তো আমি শেষ। তারপরেও ধরলাম মেরেছি। মুটকিটাকে ফ্যানের সঙ্গে দড়িতে ঝুলাব কী করে? তাকে ঝুলাতে কপিকল লাগবে। মুটকি সুইসাইড করেছে, এটা কেন বোঝেন না? আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ।
কোর্টে হাসির ধুম পড়ল। জজ সাহেব নিজেও হাড্ডিসর্বস্ব সাজ্জাদ আলীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে দিলেন।
জেলে সাজ্জাদ আলী খুব যে কষ্টে আছেন, তা না। জেলের মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে তিনি ভালোমতোই যুক্ত। বাংলা মদ, স্কচ হুইস্কি, ফেনসিডিল সবই তিনি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জোগাড় করে দিতে পারেন। তার গা, হাত-পা টেপার জন্য দুজন কয়েদি আছে। রাতে একজন গা টিপে, অন্যজন তালপাখায় বাতাস করে ঘুম পাড়ায়। গরম বেশি পড়লে তিনি জেলের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। সেখানে ফ্যানের ব্যবস্থা আছে।
বৎসরে ছটা চিঠি পাঠানোর অনুমতি সাজ্জাদ আলীর আছে। তিনি তার ছেলে রুস্তমের নামে ছয়টা চিঠি পাঠান। সব চিঠির বিষয়বস্তু এবং ভাষা একই। একটা চিঠির নমুনা—
৭৮৬
বাবা রুস্তম আলী
দোয়াগো,
তোমার ওপর আমার বিরক্তির সীমা নাই। তোমাকে বলেছি সালমার মাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবে। এই বদ মাগীর সাক্ষীর কারণে আমি আজ জেলখানায়। সে নাকি নিজের চোখে দেখেছে আমি তোমার মাকে খুন করেছি। এই শুয়োরনিকে দিয়ে সত্য কথা বলায়ে মামলা পুনর্বিবেচনার ব্যবস্থা। করবে। এটা আমার আদেশ। এই আদেশের যেন অন্যথা না হয়।
ইতি তোমার হতভাগ্য পিতা
এস. আলী B.Sc. (Hons)
পুনশ্চ-১ : ধানমণ্ডির বাড়ি বিক্রির জন্য অনেক দালাল তোমাকে ধরবে। তাদের কথায় কর্ণপাত করবে না। জেলখানা থেকে ফিরে এসে যা করার আমি কক্ষ।
পুনশ্চ-২: আমার ব্যবসার পার্টনার গোলাম মওলার কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকবে। তার অবস্থান ইবলিশ শয়তানের তিন ধাপ নিচে।
পুনশ্চ-৩: তোমার মাথা কিঞ্চিৎ আউলা অবস্থায় আছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। অবহেলা করবে না। অবহেলা করলে দেখা যাবে একটা পর্যায়ে তুমি গায়ের সব কাপড় বিসর্জন দিয়ে ফার্মগেটের মোড়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতেছ।
রুস্তম আলী বাবার চিঠির উত্তর দেয় না। সালমার মাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে তার মধ্যে কোনোরকম আগ্রহ দেখা যায় না। বর্তমানে সে একটি সুররিয়েলিস্টিক উপন্যাস লেখার চিন্তায় ব্যস্ত আছে। উপন্যাসের নায়ক মৃত। কিন্তু সে তা জানে না। সে তার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করে। তার ছেলেকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যায়। পিজাহাটে নিয়ে যায়। ছেলে পিজা খায়, সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। নিজে কিছু খায় না। কারণ সে ক্ষুধা-তৃষ্ণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। নায়ক হিন্দু, নাম শলারাম। শলারাম শব্দটা উল্টালে হয় মরা লাশ।
অতি জটিল উপন্যাস বলেই চিন্তাভাবনাতেই রুস্তম আলীর অনেক সময় কাটছে।
উপন্যাসের নানান খুঁটিনাটি যখনই তার মাথায় আসছে, সে লিখে রাখছে। যেমন, মৃত্যুর এক মাস পরও মানুষের মাথার চুল এবং নখ বাড়ে। বন্ধ হৃৎপিণ্ড হঠাৎ চালু হয়ে কিছু রক্ত সঞ্চালন করে।
রুস্তমের বাড়িভর্তি লোকজন। বেশিরভাগ লোকজনকেই সে চেনে না। একজনের নাম চণ্ডিবাবু। তিনি একতলার সর্বদক্ষিণে থাকেন। দুপুরের পর থেকে বারান্দায় খালি গায়ে বসে থাকেন। তার পরনে থাকে লুঙ্গি। প্রায়ই এই লুঙ্গি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে থাকে বলে বারান্দার দক্ষিণে কেউ তাকায় না।
ড্রাইভার সুরুজকে রুস্তম চেনে। ড্রাইভার সুরুজের সঙ্গে আরেকজন ফিটফাট বাবু থাকে, তাকে সে চেনে না। এই ফিটবাবু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চোখে সানগ্লাস পরে থাকে। ইন করে শার্ট পরে। গলায় লাল রঙের টাই। তার ব্যবহার অত্যন্ত দ্র। যত বারই রুস্তম বের হয়, সে ছুটে এসে গেট খুলে দেয় এবং বিনীত গলায় বলে, স্যার ভালো আছেন? রাতে ঘুম কি ভালো হয়েছে? কোথায় যাচ্ছেন স্যার? গাড়ি বের করতে বলব?
রুস্তম কখনো গাড়ি বের করতে বলে না। তার ক্লস্টোফোবিয়া আছে। গাড়ির দরজা বন্ধ করা মাত্র ভীষণ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এই গাড়ি নিউমার্কেট থেকে কাঁচাবাজার করার কাজে ব্যবহার হয়।
ইঞ্জিন যেন বসে না যায়, এই জন্য ড্রাইভার সুরুজ সপ্তাহে তিন দিন গ্যারাজে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তখন গাড়ির পেছনের সিটে ফিটবাবু গম্ভীর মুখে বসে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সে দাওয়াত খেতে যাচ্ছে।
রান্নাঘরের বাবুর্চি মরিয়মকে রুস্তম চেনে। মরিয়মের সঙ্গে ইদানীং অল্পবয়স্ক সুশ্রী চেহারার এক মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। সে সবসময় সেজেগুজে থাকে এবং বিরহী ভঙ্গিতে ঘুরঘুর করে। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে যায়। ছাদে সে গুনগুন করে গান করে। হিন্দি সিরিয়ালের কোনো গান। গানের মাঝখানে হো…হো…হো… শব্দ আছে।
রাত দশটার দিকে সে রুস্তম আলীর ঘরে ঢুকে। তার পরনে থাকে রাতের পাতলা পোশাক। সেই পোশাক এমনই যে তাকালে গা ঝিমঝিম করে। সে রুস্তমের দিকে তাকিয়ে খানিকটা নাকি গলায় বলে, স্যার, কিছু লাগবে?
রুস্তম তখন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, না না, কিছু লাগবে না। থ্যাংক ইউ। বিরহিণী তার পরেও দরজা ধরে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। উদাসী এই মেয়ের নাম মুনিয়া। এই নাম কবি রুস্তমের প্রায়ই মনে থাকে না। পাখির নামে মেয়ের নাম, এটুকু শুধু মনে থাকে। কী পাখি সেটা আর মনে আসে না। অদ্ভুত অদ্ভুত পাখির নাম মনে আসে, যেসব পাখির নামে মেয়েদের নাম রাখা হয় না।
যেমন—
ধনেশ পাখি
হরিয়াল
ঘুঘু
লেজবোলা কাকাতুয়া
চিল
সারস
বক
মেয়েটা মনে হয় ড্রাইভারের কোনো আত্মীয় কিংবা ড্রাইভারের সঙ্গে যে ফিটবাবু থাকে তার আত্মীয়। ড্রাইভারকে এবং ফিটবাবুকে মেয়েটা ডাকে ছোটকাকু। রুস্তম প্রায়ই ভাবে, মেয়েটার বিষয়ে খোঁজ নেবে। খোঁজ নেওয়া হয় না।
দোতলায় রুস্তমের আর্ট টিচার সাদেক হোসেন মিয়ার জন্য একটা ঘর আছে। সাদেক হোসেন মিয়া চারুকলা থেকে পাঁচ বছর আগে পাস করেছেন। অনেক চেষ্টা এবং সাধনায় তিনি তার চেহারা উলুমুসের মতো করেছেন। মুখভর্তি দাড়ি। মাথা এবং ভুরু সুন্দর করে কামানো। ডান কানে তিনি দুল পরেন। এই দুলের ডিজাইন তার নিজের। একটা আস্ত পাকা সুপারি রুপার রিংয়ে ঝুলতে থাকে। তার ডিজাইন করা এই দুল এখন অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।
ফ্রান্সে যাওয়ার নানান ধান্ধায় সাদেক হোসেন মিয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তেমন কিছু হচ্ছে না।
সাদেক হোসেন তার ছাত্রকে বলেছেন, আপনার ভেতর জিনিস নাই। জিনিস থাকলে টুথপেস্টের মতো টিপে বের করে ফেলতাম। যাই হোক, আপনার প্রধান কাজ হবে ক্যানভাসে ব্রাশ দিয়ে রঙ ঘষা। রঙ ঘষতে ঘষতে হাত ফ্রি হবে, তখন আমি চেষ্টা নিব।
রুস্তম আলী ক্যানভাসে নিয়মিত রঙ ঘষে যাচ্ছেন। তার শিক্ষক সস্তা সিগারেট ফুঁকে সময় পার করছেন। ভদ্রলোকের থাকা-খাওয়া ফ্রি। মাস শেষে বেতন পাঁচ হাজার টাকা। তিনি বেতনের টাকাটা অতি অনাগ্রহের সঙ্গে হাতে নেন। সেদিনই ছাত্রের ছবি আঁকা বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নেন। কিছু কথাবার্তাও হয়।
রঙ ঘষা চলছে?
চলছে।
কত নম্বর ব্রাশ ব্যবহার করছেন?
ছয়।
সিঙ্গেল রঙ ব্যবহার করছেন তো?
জি।
গুড। এখন শুরু করুন দুটা রঙ ঘষা। ক্যানভাসের এক কোনায় দিবেন কোবাল্ট ব্ল, অন্য কোনায় লেমন ইয়েলো। ডায়াগোনালি রঙ দেওয়া শুরু করবেন। মিডপয়েন্টে দুটা রঙের সাক্ষাৎ হবে। ব্লু এবং ইয়েলো মিলে হবে সবুজ। সবুজের একটা আড়াআড়ি লাইন হবে। লাইন ইউনিফর্ম সবুজ হবে না। গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ এইসব হবে। সেখানেই মজা। বুঝতে পারছেন তো?
হুঁ।
আঁকা কমপ্লিট হলে মাঝখানে লাল রঙ দিয়ে একটা ঘষা দিবেন। লাল রঙ সবুজ রঙে প্রাণ নিয়ে আসে। আজ থেকে শুরু করে দিন।
আচ্ছা শুরু করব। আপনার ফ্রান্সে যাওয়ার কী হলো?
এখনো কিছু হয় নাই, চেষ্টা চলছে। মনে হচ্ছে ইতালি দিয়ে ঢুকতে হবে। অসুবিধা নাই, খসরু ইতালিতে আছে।
খসরু কে?
আমার বোসম ফ্রেন্ড। একসঙ্গে পাস করেছি। ওয়াটার কালারে গোল্ড মেডেল পেয়েছিল। এখন ইতালির এক জুতার দোকানে কাজ করে।
ও আচ্ছা।
স্প্যানিশ এক মেয়ের সঙ্গে লিভ টুগেদার করে। ওই মেয়েও একই জুতার দোকানে কাজ করে। মেয়ের নাম এলিজা।
ভালো তো।
আফসোস, লিভ টুগেদার বাংলাদেশে এখনো চালু হয় নাই। বিবাহ মানে বন্ধন। বন্ধনের ভেতর থেকে কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ হয় না। আপনার লাইফ স্টাইল আমার পছন্দ। বন্ধনমুক্ত লাইফ। ছবি আঁকায় আপনার কিছু হবে না, অন্য কোনো লাইনে হতেও পারে। তবে কবিতায় হবে না। আমাকে যে কবিতার বই দিয়েছেন, সাইকেল না মোটরসাইকেল কী যেন নাম, ওইটা পড়ে দেখেছি। আবর্জনা হয়েছে, কবিতা হয়নি। আমার কথা শুনে আপনি আবার মন খারাপ করবেন না। আর্টিস্ট মানুষ তো পেটে কথা চেপে রাখতে পারি না। নো অফেন্স প্লিজ।
ঠিক আছে। ঠিক আছে।
লেজ ভেতরে থাকলে যথাসময় লেজ গজায়। লেজ না থাকলে লেজ কখনোই গজাবে না। ছবি আঁকার বিদ্যাটা লেজের মতো। ভেতরে থাকতে হবে। তাই বলে ডিসহার্টেড হবেন না। রঙ নষ্ট করতে থাকুন। আপনার তো আর টাকার অভাব নাই। ঠিক বলেছি?
রস্তম আলী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল।
আপনার এখানে একটা মেয়ে ঘুরঘুর করে। আমি একদিন নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সে ঠোঁট বঁকিয়ে বলেছে, নাম ভুলে গেছি। আপনি একটা নাম দিয়ে দিন। এসন ফাজিল মেয়ে আমি প্রথম দেখলাম। আপনার আত্মীয়?
না।
ফাজিল মেয়েটার নাম কী?
নাম এখন মনে পড়ছে না। পাখির নামে নাম। ম দিয়ে শুরু।
ময়ূরী নাকি?
না ময়ূরী না।
তাহলে কি ময়না?
না, ময়নাও না, তবে কাছাকাছি।
ময়নার কাছাকাছি নাম আর কি থাকবে? যাই হোক, জিজ্ঞেস করে জেনে আমাকে বলবেন তো। মেয়েটার চেহারায় এবং ফিগারে অন্যরকম ব্যাপার আছে। নুড মডেল হিসেবে অসাধারণ হবে। রাজি হবে বলে মনে হয় না। আপনি আমার হয়ে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। ডেইলি এক ঘণ্টা সিটিং দিলেই হবে। পাঁচশ টাকা পার আওয়ার দেব। U.S. ডলারে প্রায় দশ ডলার। খারাপ না।
আচ্ছা বলে দেখব।
থাক, আপনার বলার দরকার নাই। আপনি গুছিয়ে বলতে পারবেন না। মেয়ে অন্য অর্থ করবে। যা বলার আমিই বলব।
আচ্ছা।
কবি রুস্তম সপ্তাহে একদিন জিগাতলায় তার বোনের বাসায় যায়। তার একটাই বোন, নাম সামিনা। সামিনা অপ্সরীদের চেয়েও রূপবতী। নয় বছর হলো বিয়ে হয়েছে, এখনো ছেলেমেয়ে হয়নি। সামিনার তা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই, বরং আনন্দ আছে। ছেলেমেয়ে মানেই ঝামেলা। সন্তান হলে শরীর নষ্ট হবে। সন্তান পেটে থাকার সময় যে পেট বড় হবে, খালাসের পর সেই পেট কমলেও একটা থলথলে ভাব থেকেই যাবে। নাভি বের করে শাড়ি পরা জন্মের জন্য শেষ। সামিনা অনেক টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুরে গিয়ে নাভিতে একটা হীরার দুল লাগিয়েছে। সেই দুল যদি শাড়ি দিয়ে ঢেকেই রাখতে হয় তাহলে এত টাকা খরচ করে নাভি ফোটা করার মানে কী?
সামিনার স্বামীর নাম আমিন। বয়স পঞ্চাশ। চুল পেকে গেছে। গাল ভেঙেছে। একটা চোখে ছানি পড়েছে। ছানি পোক্ত হয়নি বলে অপারেশন করা যাচ্ছে না। আমিনের বেশ কিছু চালু ব্যবসা আছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবসা। ট্রাকে করে বাড়িতে বাড়িতে পাঁচ গ্যালনের পানি সাপ্লাই করা হয়। একটা চালু ফার্মেসি আছে। ফার্মেসির নাম শুরুতে ছিল শেফা। শেফা আরবি শব্দ। অর্থ আরোগ্য। এখন নাম ফার্মেসি সামিনা। স্ত্রীর নামে নাম। একটা দেশি জুতার দোকানের মালিকানা তিনি সম্প্রতি কিনেছেন। দোকানের নাম ছিল হংকং শু প্যালেস। এখন নাম সামিনা শু প্যালেস।
আমিন নিতান্তই ভালো মানুষ। রুস্তমকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। রুস্তম শুক্রবার দুপুরে তার এখানে খায় বলে তিনি নিজে বাজার করেন। ফ্রেশ মাছ-মাংস। রুস্তমের পছন্দ টকদই দিয়ে রসমালাই। আমিনের একজন কর্মচারী হাফিজ মিয়া প্রতি শুক্রবার সকালে কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডার থেকে এক কেজি রসমালাই নিয়ে আসে।
আজ শুক্রবার। ১টার মতো বাজে। আমিন চিন্তিত মুখে বসে আছেন। কারণ কুমিল্লা থেকে রসমালাই এখনো এসে পৌঁছেনি। হাফিজ মিয়ার মোবাইলে টেলিফোন করা হচ্ছে। রিং হয়, কিন্তু সে টেলিফোন ধরে না।
আমিন মন খারাপ করে জুমার নামাজ পড়তে গেলেন। তার মন খারাপের প্রধান কারণ কুমিল্লার রসমালাই, দ্বিতীয় কারণ সামিনা বাসায় নেই। কোথায় গেছে তাও কাউকে বলে যায়নি। রুস্তম খেতে বসে দেখবে তার বোন নেই। বেচারার মনটা নিশ্চয়ই খারাপ হবে।
রুস্তম নিঃশব্দে দুলাভাইয়ের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেল। তার পছন্দের সব আইটেমই ছিল। যেমন–তেলচুপচুপ ইলিশ মাছের ভাজি, কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ, ছোট মাছের টক, টাকি মাছ দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল।
মাষকলাইয়ের ডালের আইটেমটা আমিন নিজের হাতে বেঁধেছেন। আমিন বললেন, সবচেয়ে ভালো আইটেম কোনটা হয়েছে?
রুস্তম বলল, আপনি যেটা বেঁধেছেন সেটা।
আমি কোনটা বেঁধেছি?
মাষকলাইয়ের ডাল।
আমিন বিস্মিত হয়ে বললেন, বুঝলে কী করে?
রুস্তম জবাব দিল না। আমিন রুস্তমের এই বিষয়টা জানেন। রুস্তম কিছু কিছু বিষয় না জেনেই বলতে পারে। তিনি যখন হংকং শু প্যালেস কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সেদিনই রুস্তমকে বললেন, একটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি। কেমন হবে বুঝতে পারছি না।
রুস্তম বলল, এই ব্যবসা ভালো হবে।
আমিন বললেন, কী ব্যবসা বলো তো?
জুতার ব্যবসা।
বুঝলে কিভাবে?
মনে হয়েছে।
তুমি তো দিন দিন পীর-ফকিরের পর্যায়ে চলে যাচ্ছ। তোমার কথাবার্তায় মাঝে মধ্যে এমন অবাক হই।
খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই হাফিজ মিয়া রসমালাই এবং টকদই নিয়ে উপস্থিত হলো। রাস্তায় বাস এক্সিডেন্টের কারণে চার ঘণ্টা রোড ব্লক ছিল বলে দেরি হয়েছে।
আমিন অত্যন্ত আনন্দিত। রসমালাই শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। তিনি রুস্তমের বাটিতে রসমালাই এবং দই দিতে দিতে বললেন, তোমার বুবু থাকলে ভালো হতো। কোথায় যেন গেছে। বলেও যায়নি। মোবাইল টেলিফোন করছি, ধরছে না।
রুস্তম স্বাভাবিক গলায় বলল, বুবু পালিয়ে গেছে। আর ফিরবে না।
আমিন হতভম্ব গলায় বললেন, তুমি কী বললে?
রুস্তম বলল, আপনার গায়ে ঘামের গন্ধ। বুবুর পছন্দ না। অনেকে থাকে এ রকম। তারা দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারে না।
আমার গায়ে দুর্গন্ধ?
আমি পাই না, বুবু পায়। তার নাক অনেক সেনসেটিভ।
তুমি কি এইসব অনুমানে বলছ, নাকি জেনে বলছ?
জেনে বলছি। আমাকে টেলিফোনে সব বলেছে।
সে এখন আছে কোথায়?
রুস্তম হাই তুলতে তুলতে বলল, আপনি যার কাছ থেকে হংকং শু প্যালেস কিনেছেন, বুবু আছে তার সঙ্গে। আফতাব চৌধুরী। দুলাভাই, একটা পান খাব। ঘরে পান আছে?
পান খাবে?
হুঁ।
পান তো থাকার কথা। তোমার বুবু মাঝে মধ্যে পান খেত। দাঁড়াও দেখি।
আমিন পানের সন্ধানে গেলেন না। বসে রইলেন। রুস্তম বলল, আপনার মন কি বেশি খারাপ হয়েছে?
হুঁ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আফতাব চৌধুরীকে খুন করাব। ভাড়াটে খুনি লাগবে।
দোষটা তো বুবুর। খুন করাতে চাইলে বুবুকে খুন করান। আপনার সন্ধানে কি ভাড়াটে খুনি আছে?
না।
আমার সন্ধানে আছে। আপনি চাইলে তাকে আপনার কাছে পাঠাতে পারি।
তোমার সন্ধানে ভাড়াটে খুনি আছে?
বাবার পার্টনার গোলাম মওলা আংকেলের কাছে আছে। উনি মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। তাকে ভাড়াটে খুনির কথা বললে উনি ব্যবস্থা করে দেবেন।
আমিন কিছু বললেন না। ঝিম ধরে রইলেন। রুস্তম আবারও বলল, দুলাভাই পান খাব।
আমিন মনে হলো শুনতে পাননি। তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে কি তোমার দেখা হয়?
না। সে তো এখন আমার স্ত্রী না। তাকে স্ত্রী বলা উচিত না।
তোমার ছেলে কত বড় হয়েছে তুমি জানো?
না।
তোমার স্ত্রী এবং ছেলের সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল। নিউমার্কেটে। তোমার স্ত্রী এমন ভাব করল যেন আমাকে চেনে না। স্ত্রী
জাতিকে কোনো বিশ্বাস নাই। এটা মনে রাখবে।
জি আচ্ছা, মনে রাখব।
খনার বচনে নারী সম্পর্কে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলা হয়েছে। খনা মেয়েমানুষ হয়েও বলে গেছেন।
একটা বলুন শুনি।
এখন মনে পড়ছে না। মনে হলে বলব।
জি আচ্ছা।
তোমার ছেলের চেহারা তোমার মতোই হয়েছে। চোখে চশমা। এই বয়সে চোখ নষ্ট করে বসে আছে।
দুলাভাই, আমার ছেলের প্রসঙ্গটা থাকুক। ডাক্তার আমাকে বলেছেন, আমি যেন সবসময় আনন্দে থাকি।
চারদিকে নিরানন্দ, এর মধ্যে আনন্দে থাকা সম্ভব? তোমার এই ডাক্তার কিছু জানে না। ডাক্তার বদলাতে হবে।
দুলাভাই! আপনার মন কি বেশি খারাপ?
হ্যাঁ।
সাইকেলে চড়বেন? সাইকেলে চড়লে মন ভালো হবে।
কে বলেছে? তোমার ডাক্তার?
না। এটা আমি বের করেছি। সাইকেলে চড়লে কেন মন ভালো হয় ব্যাখ্যা করব?
ব্যাখ্যা লাগবে না।
বুবু আপনার জন্য একটা চিঠি লিখে রেখেছে।
কোথায় রেখেছে?
আমার কাছে রেখে গেছে।
কী লিখেছে চিঠিতে?
আমি পড়ি নাই। স্ত্রী চিঠি লিখেছে স্বামীকে, সেই চিঠি পড়া উচিত না।
চিঠি সঙ্গে করে এনেছ?
জি।
আমিন চিঠি পড়লেন। তার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। নিঃশ্বাসেও সামান্য কষ্ট শুরু হলো। চিঠিটা এ রকম—
এই শোনো,
তোমার কাছে লেখা এটা আমার প্রথম চিঠি এবং শেষ চিঠি। যেসব স্বামী-স্ত্রী চব্বিশ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকে তারা চিঠি চালাচালি করে না।
এখন আমি তোমাকে ল্যাং মেরে চলে গেছি, কাজেই দুএকটা চিঠি লেখা যেতে পারে। ল্যাং শব্দটা খুবই খারাপ শোনাচ্ছে। এই মুহূর্তে অন্য কোনো শব্দ মাথায় আসছে না। ল্যাং-এর বদলে ইংরেজি Kick ব্যবহার করা যেত। এটা ল্যাংয়ের চেয়েও খারাপ।
ল্যাং শব্দ ব্যবহারের জন্য সরি।
তোমাকে ছেড়ে আসার সাতটা কারণ আমি বের করেছি। প্রধান কারণ তোমার গায়ে পাঠার মতো বোটকা গন্ধ।
অন্য কারণগুলো বলছি—
১. ঘুমালেই নাক ডাকো, মনে হয় প্রেসার কুকার চলছে।
২. তুমি সবার সামনে নির্বিকার ভঙ্গিতে নাকের লোম ছিড়।
৩. বাথরুম করে ফ্ল্যাশ টানতে বেশিরভাগ সময় ভুলে যাও।
৪. নিজের ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে তোমার আগ্রহ নেই।
৫. ঘুমানোর সময় তুমি হাঁ করে ঘুমাও।
৬. বাড়িতে যতক্ষণ থাকো, খালি গায়ে থাকো…।
৭. তুমি প্রথম শ্রেণীর নির্বোধ।
আমিন চিঠি পড়ার মাঝখানে বললেন, তোমার বুবুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নয় বৎসর সে আমার গায়ে কোনো গন্ধ পেল না। এখন একেবারে পাঁঠার গন্ধ?
রুস্তম বলল, গন্ধটা হয়তো আস্তে আস্তে ডেভেলপ করেছে।
আমিন বললেন, পাঁঠার গন্ধ তোমার বোন চেনে? জীবনে কখনো পাঠা দেখেছে?
দুলাভাই আপনি রেগে যাচ্ছেন। আপনাকে কখনো রাগতে দেখি না তো এই জন্যে অবাক লাগছে।
আগে গায়ে পাঁঠার গন্ধ ছিল না বলে রাগ করতাম না। এখন পাঁঠার গন্ধ কাজেই রাগ করছি।
কিছুক্ষণ মুখ থেকে জিভ বের করে বসে থাকুন। দেখবেন রাগ কমে গেছে।
কে বলেছে?
আমার আর্ট টিচার। উনি প্রায়ই জিভ বের করে বসে থাকেন। মুখ থেকে জিভ বের করলে আমাদের মধ্যে কুকুর ভাব চলে আসে তখন রাগ পড়ে যায়।
আমিন বিরক্ত গলায় বললেন, উদ্ভট কর্মকাণ্ড তোমার আর্ট টিচার করুক। আমি করব না।
রুস্তম বলল, একটা এক্সপেরিমেন্ট করায় তো দোষ নাই। মুখ থেকে কিছুক্ষণের জন্যে জিভ বের করা।
আমিন জিভ বের করলেন। অদ্ভুত কাণ্ড। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর রাগ কমে গেল।
দুলাভাই! রাগ কমেছে?
হুঁ।
রুস্তম বলল, আমাকে খুব শিগগিরই একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। কবে নিয়ে যাবেন?
নতুন কোনো সমস্যা?
রুস্তম বলল, আমার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে সামান্য সমস্যা হচ্ছে। প্রচ্ছদে ছিল সাইকেলের চাকায় একটা পাখি বসে আছে। কয়েক দিন হলো দেখছি পাখিটা চায়ের কাপের উপর বসে আছে।
বলো কি?
কবিতার বইটা আপনার কাছে আছে, নিয়ে আসুন না।
আমিন চিন্তিত মুখে কবিতার বইয়ের সন্ধানে গেলেন।
বই পাওয়া গেল। পাখিটা সাইকেলের চাকার উপরেই আছে। চা খেতে নিচে নামেনি। রুস্তম বই হাতে নিয়ে বলল, দুলাভাই দেখনু চায়ের কাপে বসে আছে।
আমিন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। রুস্তমের মাথা দ্রুত এলোমেলো হচ্ছে। আটকানোর বুদ্ধি কি কে জানে। তার ধারণা রুস্তমের ডাক্তার অবস্থাটা আরো খারাপ করে দিচ্ছে।
রুস্তম বলল, দুলাভাই এটা কি পাখি?
আমিন বললেন, জানি না। আমি পাখি চিনি না। ঢাকা শহরে যারা বাস করে তারা কাক ছাড়া আর কিছু চিনে না।
রুস্তম বলল, আমার ধারণা এটা ডাহুক পাখি। ডাহুক পাখি মারা গেলে কি করে জানেন?
না।
পা দুটা আকাশের দিকে তুলে রাখে।
কেন?
মৃত্যুর আগে আগে ডাহুক পাখি মনে করে আকাশ ভেঙে তার উপর পড়ছে। তখন সে দু পায়ে আকাশ আটকাতে চায়।
আমিন বললেন, এইসব কি তুমি নিজে নিজে বানাচ্ছ?
রুস্তম হাসল। তার হাসি সুন্দর। দেখতে ভালো লাগে।
দুলাভাই।
বলো।
আমার বইটার প্রচ্ছদ যে এঁকেছে তার সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার।
কেন?
তাকে জিজ্ঞাস করতাম উনি কি পাখি এঁকেছেন।
এর কি দরকার আছে?
অবশ্যই দরকার আছে।
বাংলাবাজার চলে যাও। বই হাতে নিয়ে যাও। প্রেসের ঠিকানা দেয়া আছে। তুমি পান খেতে চেয়েছিলে। পান খুঁজে পেলাম না। দোকান থেকে একটা পান কিনে নিও।
জি আচ্ছা।
রুস্তমের কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ যিনি করেছেন তিনি বিরাট মাওলানা। চাপদাড়ি, চোখে সুরমা। বাংলাদেশের মাওলানারা মাথায় পাগড়ি কমই পরেন। ইনার মাথায় সবুজ রঙের পাগড়ি। মাওলানার নাম হাজি আসমত উল্লাহ।
রুস্তম বলল, মওলানা সাহেব এটা কি পাখি?
হাজি আসমত উল্লাহ বললেন, মনের ধ্যান থেকে এঁকেছি জনাব। কি পাখি বলতে পারব না। তবে পাখি আঁকা ঠিক হয় নাই। গুনাহর কাজ হয়েছে?
কেন?
পশু পাখি মানুষ আঁকা নিষিদ্ধ। এদের জীবন দেয়া যায় না বলেই নিষিদ্ধ। আমি একটা পাপ কাজ করে ফেলে গুনাগার হয়েছি।
আপনার আঁকা ছবি খুব সুন্দর হয়েছে। আমি একটা উপন্যাস লিখব বলে ঠিক করেছি। সেটার প্রচ্ছদও আপনি করবেন।
আল্লাহপাকের হুকুম হলে আমাকে করতেই হবে। উনার হুকুমের বাইরে যাওয়ার আমার উপায় নাই।
সবকিছুতেই তাঁর হুকুম লাগবে?
জি জনাব। এই যে আপনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন ফেলছেন তাও উনার হুকুমে চলছে। মনে করেন আপনি নিঃশ্বাস নিলেন তখনই আল্লাহপাক নিঃশ্বাস ফেলার হুকুম বন্ধ করলেন, আপনি আর নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন না। জনাব চা খাবেন?
খাব।
একটু বসেন। আমি জোহরের নামাজ আদায় করে নিজের হাতে আপনাকে চা বানায়ে দেব। আল্লাহপাকের হুকুমে আমি খুব ভালো চা বানাতে পারি।
গোলাম মওলা এসেছেন রুস্তমের কাছে
গোলাম মওলা এসেছেন রুস্তমের কাছে। গোলাম মওলা রুস্তমের প্রাক্তন শ্বশুর। তাঁর কন্যা দিনার সঙ্গে রুস্তমের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে তিন বছর টিকেছিল।
গোলাম মওলা সাদা লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি পরেছেন। গায়ে তসরের চাদর। কিছুদিন আগেও তার গালভর্তি দাড়ি ছিল, এখন নেই। মাথার চুলে মেন্দি দিয়েছেন। চুল টকটকে লাল। গোলাম মওলা জর্দা দিয়ে পান চিবুচ্ছেন বলে ঘরময় জর্দার গন্ধ। গন্ধটা কড়া না মিষ্টি। তিনি বসেছেন দোতলার বারান্দায়। তার কোলের কাছে বাঁকানো বেতের লাঠি। রুস্তম লাঠিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে, উনি লাঠিটা মেঝেতে ছেড়ে দিলেই এটা একটা সাপ হয়ে যাবে। রুস্তমের খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছে।
রুস্তম ভালো আছ?
জি।
প্রায়ই তোমার কথা মনে হয়। আসা হয় না। আজ ঠিক করে রেখেছি। যত কাজই থাকুক তোমার এখানে একবার আসব।
লাঠিটা কোত্থেকে কিনেছেন?
ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে কিনেছি। দিনা কিনে দিয়েছে। লাঠিটা কি তোমার পছন্দ হচ্ছে?
জি।
রেখে দাও।
রুস্তম আগ্রহ করে লাঠি নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। খাটের সঙ্গে লাঠি দাঁড়া করিয়ে ফিরে এলো।
গোলাম মওলা বললেন, তোমার চিকিৎসা ঠিকমতো চলছে তো?
জি চলছে।
চিকিৎসায় অবহেলা করবে না। রোজ খানিকক্ষণ হাঁটবে। যে কোনো রোগের জন্য হাঁটা এবং ঘুমানো হলো মহৌষধ। আমি এই বয়সেও ঘড়ি ধরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটি। ডাক্তার আধঘণ্টা হাঁটতে বলেছিলেন, আমি পনের মিনিট বেশি হাঁটি।
রুস্তম বলল, অধিকন্ত ন দোষায়।
কী বললে?
বললাম, অধিকন্তু ন দোষায়, অর্থাৎ বেশিতে দোষ হয় না।
এটা কোন ভাষা?
সংস্কৃত।
তুমি সংস্কৃত জানো নাকি?
জি না। কিছু শ্লোক জানি।
গোলাম মওলা বললেন, তোমাদের বাড়ির ছাদ তো অনেক বড়, ছাদে নিয়ম করে হাঁটবে। সম্ভব হলে রোজ কালিজিরার ভর্তা খাবে। নবি-একরিম বলেছেন কালিজিরা মৃত্যু রোগ ছাড়া অন্য সব রোগের মহৌষধ
জি আচ্ছা।
এই বাড়ি নিয়ে তোমার সুঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। গুরুত্বপূর্ণ কথা। আজই বলব নাকি অন্য একদিন আসব?
আজই বলুন।
ব্যবসায় তোমার বাবা ছিলেন, আমার পার্টনার। সমান সমান পার্টনার। ধানমণ্ডির এই বাড়ির সন্ধান আমি তোমার বাবাকে দেই। বাড়ির মালিক থাকত অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। হুন্ডির মাধ্যমে তাকে টাকা পাঠাই। তোমার বাবার হাতে তখন টাকা ছিল না, পুরো টাকাটা আমি দেই। এরপর আমি একটা পুলিশি ঝামেলায় পড়ি। দুই মাসের জন্য ইন্ডিয়া চলে যাই। ঝামেলা মেটার পর ফিরে এসে দেখি তোমার বাবা এই বাড়ি তোমার নামে কিনেছে। নামজারি পর্যন্ত করিয়ে ফেলেছে। তুমি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছ?
জি আংকেল।
তুমি তো অন্যদিকে তাকিয়ে আছ।
আমি খুব মন দিয়ে যখন কথা শুনি তখন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি।
এটা জানতাম না। যাই হোক, শোনো, তোমার বাবা ভেবেছিল বাকি জীবন আমি ইন্ডিয়াতেই থাকব। দেশে ফিরতে পারব না। আমাকে ফিরে আসতে দেখে তার টনক নড়ল। একটা ফয়সালা হলো–বাড়ি সিক্সটি ফোর্টি মালিকানা হবে। সিক্সটি আমার ফোর্টি তোমার বাবার। তখন তোমার মা খুন হলেন। তোমার বাবা চলে গেলেন পুলিশ কাস্টডিতে। কথা কী বলছি মন দিয়ে শুনছ তো?
জি।
এই বাড়ি কেনার ইতিহাস নিয়ে তোমার বাবা কি কখনো তোমার সঙ্গে আলোচনা করেছে?
জি না।
আমার বিষয়ে কিছু বলেছে?
আপনার কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকতে বলেছে।
বলো কী?
আর বলেছেন, আপনার অবস্থান ইবলিশ শয়তানের তিন ধাপ নিচে।
তোমাকে ঠাট্টা করে বলেছে, তুমি বোঝো নাই। তুমি তো আবার ঠাট্টাতামাশা বোঝে না। যাই হোক, এখন বললা বাড়ি নিয়ে তুমি কি আমার সঙ্গে ফয়সালায় আসবে? সিক্সটি মালিকানা আমাকে বুঝিয়ে দিবে?
জি আচ্ছা।
কী বললা?
বললাম জি আচ্ছা।
তাহলে আমি কি উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করব কিভাবে কাজটা করা যায়?
পরামর্শ করুন।
তোমার মনে আবার এমন সন্দেহ হচ্ছে না তো যে, আমি ভুলিয়েভালিয়ে তোমার বাড়ি নিয়ে নিচ্ছি?
জি না।
বরং একটা কাজ করি, ফিফটি-ফিফটিতে যাই। ঠিক আছে?
জি ঠিক আছে।
তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি খুবই আনন্দ পেলাম। উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি শিগগিরই একদিন আসব। এখন বলো তোমার কিছু লাগবে?
একজন ভাড়াটে খুনি লাগবে।
কী লাগবে?
একজন ভাড়াটে খুনি, যে টাকার বিনিময়ে খুন করবে।
তোমার ভাড়াটে খুনি লাগবে? এইসব কী বলছ?
আমার লাগবে না। দুলাভাইয়ের লাগবে। দুলাভাই একজনকে খুন করাবেন।
কাকে খুন করাবে?
আফতাব চৌধুরী নামের একজনকে। বুবু তার সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
কবে?
গত শুক্রবারে।
বলো কী, সামিনা এই কাজ করেছে। ভাড়াটে খুনি-ফুনি এইসব ফালতু কথা। কাউন্সেলিং করে সব ঠিক করে ফেলব। তুমি তোমার দুলাভাই এবং সামিনার টেলিফোন নাম্বার দাও। আমি কথা বলব।
তাদের টেলিফোন নাম্বার তো আমার কাছে নাই। তারা যখন টেলিফোন করে তখনি আমি কথা বলি।
তোমার দুলাভাইয়ের বাসার ঠিকানা দাও।
ঠিকানা তো জানি না। বাসা চিনি। কলাবাগানে বাসা।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে কিছুই দিতে হবে না। আমি বের করে ফেলব। তাহলে তোমার সঙ্গে এই কথা রইল–একজন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে সঙ্গে করে তোমার কাছে আসব।
জি আচ্ছা। একটা বই নিয়ে যান। আপনি আমাকে লাঠি দিয়েছেন। লাঠির বদলে বই।
কী বই।
কবিতার বই। আমি একটা কবিতার বই লিখেছি, নাম রু আদের সাইকেল।
রু আদের সাইকেল জিনিসটা কী?
কবিতার বইয়ের নাম।
আচ্ছা দাও তোমার কবিতার বই। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই, ভোমার সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, তা গোপন রাখবে।
জি আচ্ছা।
আমাদের উচিত সর্ববিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা। আল্লাহপাক নিজেও গোপনীয়তা পছন্দ করেন বলেই তার সবকিছুই বাতেনি। বাতেনি কি জানো?
না।
বাতেনি হলো গুপ্ত। আচ্ছা উঠি। লাঠিটা কি সত্যি তোমার পছন্দ হয়েছে? বয়সের কারণে আমি এখন লাঠি ছাড়া চলাফেরা করতে পারি না। তাছাড়া লাঠিটা আমার মেয়ে দিনা পছন্দ করে কিনেছে। আমি তার উপহার অন্যকে দিয়ে দিয়েছি জানলে মনে কষ্ট পাবে।
দিনা কি আপনার সঙ্গে থাকে?
না। সে আলাদা থাকে। তার বাড়িতে যখন-তখন যাওয়াও যায় না। আর গেলেও সে তার ছেলেকে আমার সামনে আনে না।
আনে না কেন?
জানি না কেন। জিজ্ঞেস করি নাই। লাঠিটা নিয়ে আসো।
লাঠিটা আমার পছন্দ হয়েছে।
পছন্দ হলে আর কথা নাই। আচ্ছা শোনো, আমি যদি আগামীকাল সন্ধ্যায় উকিল নিয়ে আসি তোমার অসুবিধা হবে?
না।
আগামীকাল আসতে পারব মনে হচ্ছে না। অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, দেখি যত তাড়াতাড়ি পারি আসব।
জি আচ্ছা।
সামিনা তার স্বামীকে ছেড়ে চলে গেল কেন?
সাতটা কারণ আছে আংকেল। দুলাভাই সাতের ঝামেলায় পড়েছেন। দুলাভাইয়ের গায়ে পাঁঠার মতো দুর্গন্ধ, দুলাভাই হাঁ করে ঘুমান, সবের সামনে নাকের লোম ছিঁড়েন, বাথরুমে ফ্ল্যাশ টানেন না…
বাদ দাও, এইসব শুনতে ভালো লাগছে না।
গোলাম মওলা লাঠি ছাড়াই রওনা হলেন।
রাত দশটা। রুস্তম ইজিচেয়ারে বসে আছে, তার কোলে মোটা বাঁধানো খাতা। উপন্যাসটা আজ শুরু করবে কি না তা নিয়ে গত চল্লিশ মিনিট ধরে চিন্তা করছে। একটা প্যারা লিখে ফেলা উচিত। সে চোখ বন্ধ করে উপন্যাসের প্রথম প্যারা মনে মনে সাজাল।
এক শ্রাবণ মাসের দুপুরে শলারাম বাথরুমে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাড়িতে কেউ ছিল না। তার স্ত্রী সীতা গাউছিয়াতে সবুজ কাচের চুড়ি কিনতে গিয়েছিল। তার সব রঙের চুড়ি আছে কিন্তু সবুজ রঙের চুড়ি নাই। গাউছিয়ার এক চুড়ির দোকানে সে সবুজ চুড়ির অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। দোকানদার বলেছে, আপা মঙ্গলবারে এসে নিয়ে যাবেন। আজ মঙ্গলবার।
আঠারটা সবুজ চুড়ি কিনে সীতা বাড়ি ফিরে দেখল স্বামী মৃত। এইসব ক্ষেত্রে স্ত্রীরা হাউমাউ করে কাঁদে। সীতা কাঁদল না। কারণ তার কান্না শোনার মতো ঘরে কেউ নাই। মেয়েরা একা একা কাঁদতে পারে না। সে তার আত্মীয়স্বজনদের খবর দিল। আত্মীয়স্বজন আসা, শুরু হওয়ার পরপর গলা ছেড়ে কাঁদতে বসল।
ডেডবডি রাতেই শ্মশানে দাহ করা হবে। মুখাগ্নি করবে শলারামের ছেলে প্রণব।
প্রণব ক্লাস সিক্সে পড়ে। সে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জ তার জেঠির বাড়িতে। তাকে গাড়ি পাঠিয়ে আনা হলো। তাকে বলা হলো না যে তার বাবা মারা গেছেন। প্রণব ঘরে ঢুকেই বলল, বাবা!
শলারাম বলল, কী?
তোমার চোখ বন্ধ কেন?
শলারাম বলল, আমি মারা গেছি এই জন্যে চোখ বন্ধ।
প্রণব বাবার চোখের পাতা খুলে বলল, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?
শলারাম বলল, পাচ্ছি। ছায়া ছায়াভাবে দেখছি। মনে হচ্ছে সব ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট।
চিন্তার এই পর্যায়ে মুনিয়া দরজা ধরে দাঁড়াল এবং মিষ্টি গলায় বলল, স্যার কিছু লাগবে? রুস্তম মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হকচকিয়ে গেল। মুনিয়া কালো রঙের গাউনের মতো একটা রাতপোশাক পরেছে। পোশাক পলিথিনের মতো স্বচ্ছ। মুনিয়ার নাভির ডান দিকের লাল তিলটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
রুস্তম চট করে চোখ ফিরিয়ে নিল। অস্বস্তির কারণে সে মুনিয়ার নাম ভুলে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, ময়ূরী। কিছু লাগবে না।
স্যার আমার নাম মুনিয়া।
ও আচ্ছা মুনিয়া। সরি নামটা ভুলে গেছি।
আমাকে ময়ূরী ডাকতে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে ময়ূরী ডাকবেন। আমার কোনো সমস্যা নেই।
আচ্ছা।
বিছানার চাদরটা কি পাল্টে দিব?
না না চাদর পাল্টাতে হবে না।
আপনার কাছে একটা কমপ্লেইন আছে। বলব?
বলো।
আপনার সামনে বসে বলি?
সামনে আসতে হবে না, যেখানে আছ সেখান থেকে বলো।
আপনার যে আর্টের টিচার, উনি আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। বলেছেন, এক ঘণ্টা করে নেংটো হয়ে তার সামনে বসে থাকতে। তিনি ছবি আঁকবেন। ঘণ্টায় পাঁচশ টাকা দিবেন।
রুস্তম বলল, এটা কোনো কুপ্রস্তাব না। আর্টিস্টরা ছবি আঁকার জন্য মডেল ব্যবহার করে।
মুনিয়া বলল, আপনি যদি মডেল হতে বলতেন সেটা ভিন্ন কথা। চিনি জানি না তার সামনে নেংটো হয়ে বসে থাকব?
তাকে না করে দাও।
জি আচ্ছা। স্যার আমি কি চলে যাব?
হ্যাঁ। গুড নাইট।
চা-কফি কিছু খাবেন?
না।
স্যার আপনি কি কোনো কারণে আমার ওপর নারাজ?
নারাজ হবো কেন?
আমার মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি দেখলে নিজের মুখে বলবেন। আমি শোধরাব।
আচ্ছা।
আর এখন থেকে আপনি আমাকে ময়ূরী নামে ডাকবেন। অন্য কোনো নামে ডাকলে আমি রাগ করব। সবাই ডাকরে মুনিয়া শুধু আপনি ডাকবেন ময়ূরী।
এখন যাও তো।
ধমক দিচ্ছেন কেন স্যার? মিষ্টি করে বলুন, ময়ূরী এখন যাও।
রুস্তম হতাশ গলায় বলল, ময়ূরী এখন যাও!
স্যার, আমি আমার ঘরের দরজা সবসময় খোলা রাখি। কোনো কিছুর দরকার হলে চলে আসবেন। দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকবেন স্যার। আমার শোয়া খুব খারাপ। কাপড়-চোপড় ঠিক থাকে না। এই জন্যে বললাম।
বলে ভালো করেছ। মুনিয়া এখন যাও। আমি জরুরি একটা কাজ করছি।
মুনিয়া বলবেন না স্যার। আমি ময়ূরী।
ময়ূরী এখন যাও। প্লিজ।
মুনিয়ার ওপর খানিকটা মেজাজ খারাপ করে রুস্তম ঘুমুতে গেল। মেজাজ খারাপের একমাত্র কারণ উপন্যাসের শুরুটা সে এলোমলো করে দিয়েছে। আবার নতুন করে মাথায় গোছাতে হবে। নতুন করে শুরু করা একদিক দিয়ে ভালো। কিছু কারেকশন করা হবে। বাথরুমে একা মরে পড়ে থাকাটা ভালো লাগছে না। মৃত্যু অনেকের সামনে হওয়া ভালো। ছুটির দিনে বাসার সবাই আছে। প্রণব তার বাবাকে গল্প শোনাচ্ছে, এই সময় হঠাৎ মাথা এলিয়ে শলারাম পড়ে গেল। শলারাম নামটাও এখন পছন্দ হচ্ছে না। প্রণব এবং সীতার সঙ্গে শলারাম যাচ্ছে না। এমন কোনো নাম খুঁজে বের করতে হবে যার অর্থ মৃত্যু। তার নাম প্রণাশ রাখা যেতে পারে। প্রণাশ শব্দের অর্থও মৃত্যু, বিনাশ। প্রণাশ চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে প্রণব চট্টোপাধ্যায়। স্ত্রীর নাম সীতা।
বালিশের কাছে রাখা টেলিফোন বাজছে। রুস্তম টেলিফোন ধরে বলল, হ্যালো।
ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ বলল, তোর খবর কী?
রুস্তম টেলিফোনে গলা চিনতে পারে না। টেলিফোনে তার কাছে সব মেয়ের গলা একরকম মনে হয় আবার সব ছেলের গলা একরকম মনে হয়। রুস্তম বলল, কে?
আরে গাধা, আমি তোর বুবু।
বুবু কেমন আছ?
ভালো। তুই কি ঘুমিয়ে পড়েছিলি?
প্রায়।
মাত্র এগারোটা বাজে এর মধ্যেই ঘুম? শরীর ভালো তো?
হুঁ।
তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে আমার বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে?
না।
আমি চলে যাওয়াতে সে কী পরিমাণ আপসেটঃ
বুঝতে পারছি না। তবে আফতাব চৌধুরীর উপর দুলাভাই মনে হয় রাগ করেছেন। আমাকে বলেছেন ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে খুন করাবেন।
সিরিয়াসলি বলেছে?
হুঁ।
ওর পক্ষে অসম্ভব কিছু না।
বুবু আমি রাখি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ইন্টারেস্টিং একটা কথা বলে টেলিফোন রাখ। হুট করে টেলিফোন রেখে দেওয়া ঠিক না।
তুমি বলো, আমার ইন্টারেস্টিং কিছু মনে আসছে না। বুবু একটা মিনিট ধরো, আমি লাঠিটা সরিয়ে আসি।
কী লাঠি?
আমার বিছানার কাছে একটা বেতের লাঠি। এখন মনে হচ্ছে লাঠিটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় ভয় লাগছে।
লাঠি তাকিয়ে থাকবে কিভাবে? লাঠির কি চোখ আছে?
তা জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তারের দেওয়া ওষুধগুলি কি তুই নিয়মিত খাচ্ছিস?
খাচ্ছি।
তুই এক কাজ কর। আমি সিঙ্গাপুরে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে চল। মাউন্ট এলিজাবেথে বড় ডাক্তার দেখাবি।
বুবু আমি লাঠিটা সরিয়ে তারপর কথা বলব। সাবধানে সরাতে হবে। হাত ফসকে লাঠি যদি মেঝেতে পড়ে তাহলে সেটা সাপ হয়ে যাবে।
Oh God. এইসব কী কথাবার্তা! লাঠি মেঝেতে পড়লে সাপ হবে pa?
মুসা আলায়েস সালামের লাঠি মেঝেতে পড়লে সাপ হয়ে যেত।
তুই কি মুসা আলায়েস সালাম?
তা না, তারপরেও কিছু বলা যায় না।
রুস্তম টেলিফোন রেখে লাঠি সরাতে গেল। ফিরে এসে টেলিফোন ধরল না। সামিনা অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে লাইন কেটে দিল।
কড়া ঘুমের ওষুধ খায় বলেই বিছানায় যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রুস্তম ঘুমিয়ে পড়ে। আজ ঘুম আসছে না। সাপের ভয়ের কারণেই মনে হয় ঘুম কেটে গেছে। লাঠিটা সে নিজে কাবার্ডে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদি পড়েও যায় কাবার্ড থেকে বের হতে পারবে না। তারপরেও ভয় যাচ্ছে না। কেন কে জানে!
রুস্তম উঠে বসল। বিছানার পাশের লাইট জ্বালাল। হাতের কাছে বেশ কিছু বই সাজানো। বেশিরভাগই ডিকশনারি। তার ডাক্তার বলেছেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরেও যদি ঘুম না নাসে তাহলে চোখের পাতা না ফেলে ডিকশনারি পড়বেন। চোখ ক্লান্ত হবে। ঘুম আসবে। রুস্তম ডিকশনারি খুলল, সাপের প্রতিশব্দ বের করে মুখস্থ করে ফেলাটা একটা কাজের কাজ হবে। একজন লেখকের শব্দভাণ্ডার ভালো হতে হয়।
সাপ, সর্প, অহি, ভুজঙ্গ, ফণী, নাগ, ভুজগ, ভুজঙ্গম, আশীবিষ, উরগ, চক্রী, কুণ্ডলী, বিষধর, অকর্ণ, পল্লগ, কাকাদর, দ্বিরসন, দ্বিজিন, ফণধর, ফলাকার, ফণভুৎ, ফণাভুৎ, বিলশয়, ছকশ্রুতি, বিলেশয়, কাদ্রবেয়, পবনাশন, পবনাশ, উরঞ্চম, ব্যাল, কষ্ণুকী, উরঙ্গ, ভেকভুজ, কম্ভীস্ম, সর্পী, নাগিনী, সর্পিনী, ভুজঙ্গী, ভুজঙ্গিনী, ভুজগী, অহীরণি…
সাপের প্রতিশব্দ একচল্লিশটা পাওয়া গেল। একচল্লিশটা প্রতিশব্দ মুখস্থ করতে করতে রাত চারটা বেজে গেল। এখন ঘুমের চেষ্টা করেও লাভ নেই। রুস্তম বিছানা থেকে নেমে হাত-মুখ ধুয়ে ছাদে হাঁটতে গেল। গোলাম মওলা সাহেব তাকে ছাদে হাঁটতে বলেছেন। হাঁটা এবং ঘুম শরীরের জন্য মহৌষধ। এক ওষুধ কাজে লাগানো গেল না। এখন দ্বিতীয় ওষুধে যদি কিছু হয়। রুস্তম সূর্য না ওঠা পর্যন্ত ছাদে হটল। সাপের প্রতিশব্দ মনে করতে করতে হাঁটা। সাপ, সর্প, অহি, ভুজঙ্গ, ফণী, নাগ, ভুজগ, ভুজঙ্গম…
নাস্তার টেবিলে আর্ট টিচার হোসেন মিয়া উপস্থিত হলো। বিস্মিত গলায় বলল, আপনার চোখ টকটকে লাল। ঘুম হয়নি?
রুস্তম বলল, না। ভয়ে ঘুমাতে পারিনি।
কিসের ভয়?
অহীরণির ভয়।
অহীরণি কী বস্তু?
সাপকে বলে অহীরণি।
সাপকে অহীরণি বলে এই প্রথম শুনলাম। সাপকে সর্প বলে, ভুজঙ্গ বলে, অহীরণি তো কেউ বলে না।
অহীরণি হলো সাপের প্রতিশব্দ। সাপের একচল্লিশটা প্রতিশব্দ আছে। 7615?
না, না। একচল্লিশটা প্রতিশব্দ শোনার কোনো প্রয়োজন নাই। সাপের মতো একটা তুচ্ছ প্রাণীর একচল্লিশটা প্রতিশব্দ থাকারও প্রয়োজন নাই। সাপ এবং সর্প দুটাই যথেষ্ট। গত রাতে আপনি যেমন ঘুমাতে পারেন নাই, আমিও পারি নাই। আপনাকে সাপ ডিসটার্ব করেছে আমাকে মুনিয়া মেয়েটা ডিসটার্ব করেছে। ঘটনা শুনবেন?
রুস্তম হা-না কিছু বলল না, নাস্তা খাওয়া শুরু করল। এই বাড়িতে ত্রিশ দিন একই নাস্তা–চালের আটার রুটি, সবজি, একটা ডিম পোচ।
হোসেন মিয়া বলল, রাত এগারোটার দিকে ঘুমাতে গেছি, দরজায় টোকা। দরজা খুলে দেখি মুনিয়া। একটা নাইট ড্রেস পরে এসেছে। এই ড্রেস থাকা না থাকা সমান। মুনিয়া বলল, সে মডেল হতে রাজি আছে। এক ঘণ্টা সময় দিবে।
আমি বললাম, মুনিয়া আমি দুপুররাতে কাজ করব না। সানলাইটে কাজ করব। সকাল এগারোটার দিকে আসো।
মুনিয়া বলল, আপনি আমাকে মুনিয়া ডাকবেন না। স্যার আমার নতুন নাম দিয়েছেন। ময়ূরী। এখন থেকে ময়ূরী ডাকবেন। একটি সাইকেল।
আমি বললাম, ঠিক আছে ময়ূরী ডাকব। এখন যাও, আমি সব রেডি করে রাখব। ঠিক এগারোটা থেকে বারোটা এই এক ঘণ্টা আমার সেশন। সাজগোজ কিছু করবে না, নো লিপস্টিক, নো মেকাপ।
মুনিয়া বলল, পাঁচশ টাকায় হবে না। ঘণ্টায় দুহাজার দিবেন।
চিন্তা করেছেন অবস্থা! ঘণ্টায় দুই হাজার চায়। মেয়েটা কে বলুন তো?
জানি না কে? কারোর আত্মীয় হবে।
খোঁজ নেবেন। আমার তো তাকে ডেনজারাস মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। কোনো একদিন সবাই ঘুমিয়ে থাকব, সে সবার গলা কেটে জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাবে।
আমি খোঁজ নেব।
হোসেন মিয়া বলল, আমি তাকে লাস্ট অফার দিয়েছি পার আওয়ার ওয়ান থাউজেন্ড। সে বলেছে চিন্তা করে দেখবে। যদি পুষে তাহলে আসবে। এখানে পুষপুষির কী তাই বুঝলাম না। চেয়ারে এক ঘণ্টা বসে এক হাজার টাকা নট এ মেটার অব জোক।
সকাল সাড়ে দশটা।
হোসেন মিয়া ক্যানভাস গ্লসো দিয়ে রেডি করেছে। চারকোলের পেনসিল কেটে অপেক্ষা করছে। ঘরের আলোর ব্যাপারটা ঠিক করেছে। লাইটের সোর্স পূর্বদিকের জানালা। যে চেয়ারে মুনিয়া বসবে, সেটা রাখা হয়েছে জানালার পাশে। আলো এবং জানালার শিকের ছায়া পড়বে মুনিয়ার গায়ে। লাইট অ্যান্ড শেডের একটা খেলা। এক ঘণ্টায় লাইট অ্যান্ড শেডের অবস্থান বদলাবে। সূর্য তার এক্সিসে আরও ধীরগতিতে ঘুরলে আর্টিস্টদের সুবিধা হতো।
ঠিক এগারোটায় মুনিয়া উপস্থিত হলো। হোসেন মিয়া বলল, দেরি করবে না। কাঠের চেয়ারে বসো। তোমার সামনে আমি একটা লাল বল ঝুলিয়ে দিয়েছি। তুমি তাকিয়ে থাকবে লাল বলটার দিকে।
মুনিয়া বলল, কাঠের চেয়ারে আমি বসব না। গদিওয়ালা চেয়ার ছাড়া আমি বসতে পারি না।
চেয়ারের ওপর কুশন দিয়ে দিচ্ছি, কুশনে বসো।
আজ বসব না।
আজ সমস্যা কী?
আজ সোমবার। সোমবার আমার জন্যে অশুভ। এক পামিস্ট আমার হাত দেখে বলেছেন, সোমবার আর বুধবার অশুভ। আপনি যে লাল বল ঝুলিয়েছেন, ওই বলের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারব না। লাল রঙও আমার জন্যে অশুভ এই জন্যে। আপনি অন্য কালারের বল ঝুলাবেন। নীল হলে ভালো হয়। নীল রঙ আমার জন্য শুভ। আচ্ছা যাই।
মুনিয়া চলে গেল। হোসেন মিয়া বিড়বিড় করে যেসব কথা বলল তা লেখা যাবে না। পাঠকদের রুচিতে আঘাত করা হবে। পাঠকরা এ ধরনের কথা সবসময় শোনেন, কিন্তু লিখিত ভাষ্য পছন্দ করেন না।
রুস্তম মুনিয়া মেয়েটির বিষয়ে খোঁজখবর করল। কেউ কিছু বলতে পারল না। বাবুর্চি মরিয়ম ঝাঁঝালো গলায় বলল, আমি এরে চিনব ক্যামনে? এ আমার কোনো আত্মীয় না, স্বজন না, আমার গেরামেরও না। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়, পাক কোরান আনেন। পাক কোরানে হাত দিয়া বলব। আমার অজু আছে।
মরিয়মের স্বভাব হচ্ছে, যে কোনো কথাই পাক কোরানে হাত দিয়ে বলতে চায় এবং সবসময় তার অজু থাকে। একবার গ্যাস লিক করে রান্নাঘর ভর্তি হয়ে গেল মিথেন গ্যাসে। মরিয়মকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, আমি নিজের হাতে গ্যাসের চুলা বন্ধ করছি। বন্ধ কইরাও আমার শান্তি হয় নাই। দুইবার চেক করছি। যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয় পাক কোরান আনেন। পাক কোরানে হাত দিয়া বলব। আমার অজু আছে।
ড্রাইভার এবং ড্রাইভারের সঙ্গী চশমাপরা ফুলবাবুও বলল, এই মেয়ে তাদের কেউ না।
চণ্ডিবাবু বললেন, মেয়ের নাম মুনিয়া। মুসলমান কন্যা। এর বেশি কিছু জানি না। তবে মেয়ের স্বভাব-চরিত্র ভালো। আমারে দাদু ডাকে। একদিন মাথায় তিলের তেল মালিশ করে দিয়েছে। এমন আরামের মালিশ। মালিশের মাঝখানে দ্ৰিায় চলে গেছিলাম।
বাড়ির দারোয়ান বলল, সে এই মেয়ে বিষয়ে কিছু জানে না। তার বাড়ি খুলনার বাগেরহাটে। এই তথ্য নাকি মেয়ে তাকে দিয়েছে।
একটা মেয়েকে কেউ চিনে না। অথচ চার-পাঁচ মাস ধরে সে এই বাড়িতে আছে। বিস্ময়কর ঘটনা। রুস্তমের উচিত এক্ষুনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করা। রুস্তম ঠিক করল তাড়াহুড়ার কিছু নাই। রাতে মুনিয়া এসে জিজ্ঞেস করবে, স্যার কিছু লাগবে? তখন জিজ্ঞেস করলেই হবে।
রুস্তমের মোবাইল ফোন অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। নিতান্ত অনিচ্ছায় সে টেলিফোন ধরল। টেলিফোন করেছেন তার দুলাভাই। তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ঘটনা কিছু শুনেছ? তোমার বোন শুধু যে চলে গেছে তা না, আমাকে পথের ফকির বানিয়ে গেছে।
রুস্তম বলল, বুবু চলে গেছে এইটুকু জানি। আপনাকে পথের ফকির বানিয়ে গেছে এটা জানি না।
আমার সমস্ত টাকা-পয়সা ছিল দুজনের নামে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে। তাকে খুশি রাখার জন্য জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করা। বেশিরভাগ চেক তাকে দিয়ে কাটাতাম। এতে সে খুশি হতো। ব্যাংকে আমার একাশি লাখ ত্রিশ হাজার টাকা ছিল। সে একাশি লাখ টাকা নিয়ে চলে গেছে। এখানেই শেষ না–
আর কী?
ব্যবসা সব ছিল তার নামে। আমার ধারণা সব সে আফতাব হারামজাদাটাকে লিখে দিয়েছে। আজ সকালে জুতার দোকানে গিয়েছি। সবাই দেখি কেমন কেমন করে তাকায়। ম্যানেজার ক্যাশ দেখছিল, সে আমাকে দেখে উঠে পর্যন্ত দাঁড়ায় নাই। মন এমন অস্থির কী করব বুঝতে পারছি না।
দুলাভাই সাইকেল চালালে মনের অস্থিরতা কমে। ব্যালেন্স রাখতে হয় তো এই জন্যে। ব্রেইনের যে অংশ অস্থিরতার জন্য দায়ী, সেই অংশ তখন ব্যালেন্স রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকে। আমার সাইকেলটা পাঠিয়ে দেব দুলাভাই? সাইকেল চালাবেন?
আমি সাইকেল চালাতে পারি না। সাইকেলের প্রসঙ্গ বাদ রাখো। তোমার বুবুর সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?
গত রাতে কথা হয়েছে।
কিছু বলেছে?
বলেছেন তারা সিঙ্গাপুর যাবেন।
হারামজাদা-হারামজাদি সিঙ্গাপুর যাচ্ছে? কবে যাচ্ছে?
সেটাই তো বলেন নাই।
তোমার সঙ্গে সামনা-সামনি কথা হওয়া দরকার। চলে আসো।
এখন আসতে পারব না দুলাভাই। কাল সারারাত আমার ঘুম হয় নাই। পদ্মগের ভয়ে জেগে ছিলাম।
পন্নগটা কী?
সাপের আরেক নাম পন্নগ।
বলো কী?
সাপের একচল্লিশটা নাম আছে। দুলাভাই বলব?
অবশ্যই বলবে। ডাক্তারের সঙ্গে তোমার নেক্সট অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে?
সতেরো তারিখ।
ওইদিন তুমি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
জি আচ্ছা। এখন কি সাপের প্রতিশব্দগুলো আপনাকে বলব।
রুস্তমের দুলাভাই হতাশ গলায় বললেন, বলো।
রুস্তম বলা শুরু করল–সাপ, সর্প, অহি, ভুজঙ্গ, ফণী, নাগ, ভুজক, ভুজঙ্গম, আশীবিষ, উরগ, চক্র, কুণ্ডলী…
থামো তো।
রুস্তম থামল।
তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। এক পীর সাহেবের কাছে। আগে হিন্দু ছিলেন। ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন। এখন বিরাট পীর। কামেলিয়াত হাসিল করেছেন। তাঁর কাছ থেকে তোমার জন্যে একটা তাবিজ আনব। আমিও একটা তাবিজ নেব।
আপনি তাবিজ নেবেন কেন?
বশীকরণ তাবিজ। তাবিজের গুণে সামিনা ফিরে আসবে।
ভাড়াটে গুণ্ডা লাগবে না? আমি গোলাম মওলা আংকেলকে বলে রেখেছি।
এইসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। পীর সাহেবের কাছে কখন যাবে?
আপনি বললে এখনই যেতে পারি। উনার নাম কী?
নাম কেউ জানে না, সবাই ভাই পীর ডাকে।
ভাই পীরের হুজরাখানা ভর্তি মানুষ। এক মহিলা তিন মাসের সন্তান নিয়ে এসেছেন। সে ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে। এক মধ্যবয়স্ককেও কাঁদতে দেখা গেল। তার কাঁধে গামছা। সে কাঁদছে আর গামছায় চোখ মুছছে। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সকাল নয়টার মধ্যে নাম রেজিস্ট্রি করতে হয়। আজকের মতে রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে গেছে। আমিন রুস্তমের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ঝিম ধরে বসে থাকো। আমি ব্যবস্থা করছি। খাদেমকে টাকা খাওয়ালেই ডাক পড়বে।
রুস্তম বলল, পীর সাহেবের ভিজিট কত?
আমিন বলল, উনি টাকা-পয়সা নেন না। দানবাক্স আছে। দানবাক্সে যার যা ইচ্ছা দেয়।
আমিন কি ব্যবস্থা করলেন বুঝা গেল না তবে দশ মিনিটের মাথায় তাদের ডাক পড়ল।
ভাই পীরের দরবার শরিফ যথেষ্টই আধুনিক। এসি চলছে। ঘর ঠাণ্ড। মেঝেতে টকটকে লাল রঙের কার্পেট। কার্পেটের এক কোনায় ভাই পীর খানিকটা কুঁজো হয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখে চশমা। হাতে সিগারেট। ছাই ফেলার জন্যে দামি অ্যাশট্রে আছে। সব পীর সাহেবদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক খাদেম জাতীয় লোকজন থাকে। ইনার সঙ্গে নেই।
ভাই পীর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আপনা দুজন ভালো আছেন? দয়া করে বসুন। বসতে বসতে একটা ফুলের নাম বলুন।
আমিন বললেন, পারুল ফুল।
ভাই পীর হাসতে হাসতে বললেন, পারুলের মাঝের অক্ষর কেটে দিলে হয় পাল। আপনার স্ত্রীর পালে হাওয়া লেগেছে। হাওয়া উঠেছে বলেই হাওয়া লেগেছে। হাওয়া যখন থেমে যাবে তখন পাল চুপসে যাবে।
আমিন বললেন, হাওয়া কখন থামবে?
ভাই পীর বললেন, সেটা আমি বলতে পারব না। আমি আবহাওয়া দপ্তরের কেউ না।
রুস্তম বলল, আমি কি একটা ফুলের নাম বলব?
বলুন।
বকুল।
ভাই পীর হাতের আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বললেন, বকুলের মাঝের অক্ষর ফেলে দিলে হয় বল। বল আপনার পায়ে। কিন্তু সবাই ধরে নিয়েছে আপনার পায়ে নেই। এটা একটা আফসোস।
আমিন ভীত গলায় বললেন, আমার স্ত্রী কি ফিরবে?
ভাই পীর বললেন, কনফুসিয়াস বলেছেন, যে বস্তু উপরে উঠে সেই বস্তু একসময় নিচে নেমে আসে। আপনার স্ত্রী যদি উপরে উঠে থাকেন তাহলে নেমে আসবেন।
তাকে নেমে আসার জন্যে আমি কি কিছু করতে পারি?
কিছুই করতে পারেন না। মানুষ জানে না সে নিয়তির সন্তান। সে ভাব করে যে তার Free will আছে। এটা ভেবে সে আনন্দ পায়। একটি পতঙ্গের যেমন ফ্রি উইল বলে কিছু নেই, মানুষেরও নেই।
রুস্তম বলল, আপনি বলছেন সবই নিয়তির খেলা।
আমি ক্ষুদ্র মানুষ, আমার বলায় কিছু যায় আসে না। রবীন্দ্রনাথের মতো বড় মানুষ বলেছেন মায়ার খেলা। মায়া আর নিয়তি তো একই।
আমিন বললেন, এটা তো একটা নৃত্যনাট্য।
ভাই পীর বললেন, নৃত্যনাট্যের ভেতরে আসল নৃত্য। কবিগুরুর একটা গান কি শুনবেন?
আমিন অবাক হয়ে বললেন, আপনি গান গাইবেন?
ভাই পীর বললেন, আমার গলায় সুর নেই, গান গাইতে পারব না। কবিতার মতো করে বলল–
যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে
তারা কথার বেড়া গাঁথে কেবল দলের পরে দলে।।
একের কথা আরে
বুঝতে নাহি পারে,
বোঝায় যত কথার বোঝা ততই বেড়ে চলে॥
যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর
তাদের সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর।
বোঝে কি নাই বোঝে
থাকে না তার খোঁজে
বেদন তাদের ঠেকে গিয়ে তোমার চরণতলে॥
আবৃত্তি শেষ করে ভাই পীর বললেন, কিছু বুঝেছেন?
আমিন বললেন, জি না।
ভাই পীর সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন, আপনারা এখন বিদায় হোন। অনেকেই বসে আছে, তাদের সবাইকে কিছু না কিছু বলে ভড়কে দিতে হবে। সবাই এসেছে ভড়কানোর জন্যে।
হুজরাখানা থেকে বের হয়ে আমিন বললেন, বিরাট ভণ্ড। থাবড়ানো দরকার।
রুস্তম বলল, থাবড়ালেন না কেন?
আমিন হতাশ গলায় বললেন, মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সমস্যা। যার করতে ইচ্ছা করে তা করা যায় না।
মার্চ মাসের সতেরো তারিখে
মার্চ মাসের সতেরো তারিখে সাজ্জাদ আলী জেলার সাহেবকে একটি আবেদনপত্র পাঠান। ওই তারিখে তাঁর স্ত্রী খুন হয়েছিলেন। চিঠির বিষয়বস্তু ঘুরেফিরে একই, বিচার পুনর্বিবেচনার আবেদন। একটি আবেদনপত্রের নমুনা–
মাননীয় জেলার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
ঢাকা
জনাব,
আজ আমার জন্য গভীর শোকের একটি দিন। প্রাণাধিক প্রিয় আত্মীয়র মৃত্যুদিবস। এই উপলক্ষে আমি নিজে রোজা আছি। জেলের মসজিদের ইমাম সাহেবকে বলেছি বাদ আসর মিলাদের আয়োজন করার জন্য।
অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, স্ত্রীকে খুনের দায়ে আজ আমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। ফাসি হয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু ছিল না। ফাসি হয়ে গেলে আপনাকে আমি আর এই পত্র দেওয়ার সুযোগ পেতাম না। ফাসি হয়ে যাওয়া একদিক থেকে ভালো ছিল। তিলে তিলে মৃত্যু না হয়ে একবারই শেষ।
জনাব, ওই দিনের ঘটনা আপনাকে বলতে চাই। ধানমণ্ডির আমার বাড়িটি দ্বিতল। কাজের মেয়ে, ড্রাইভার, মালী–এদের কারোরই দোতলায় ওঠার হুকুম নাই। ওই রাতে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির রাতে সবাই আরামে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। শুধু সালমার মা এবং তার কন্যা সালমা জাগ্রত। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? জনাবের বাড়িতে নিশ্চয় কাজের বুয়া আছে। জনাব কি লক্ষ করেছেন সুযোগ পেলেই এরা নিদ্রায় চলে যায়।
এখন মূল বিষয় বলি, যেখানে দোতলায় ওঠারই হুকুম নাই, সেখানে গভীর রাতে মাতা-কন্যা দোতলায় আসে কেন? দোতলায় তাদের কী প্রয়োজন, এই কথা কেন কারোর মনে আসে না?
জনাব, আমার স্ত্রীর মতো বলশালী এবং স্বাস্থ্যবতী মহিলা দুর্লভ। চট্টগ্রামে প্রতি বছর বলীখেলা হয়। মেয়েদের মধ্যে বলীখেলার প্রচলন থাকলে আমার স্ত্রী প্রতি বছর চ্যাম্পিয়ন হতো। এমন একজন কুস্তিগির টাইপ মহিলাকে আমার মতো দুবলা-পাতলা একজন গলা টিপে মারবে এবং সিলিং ফ্যানে দড়ি ঝুলায়ে তাকে ঝুলাবে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? জনাব, আমি আল্লাহপাকের পবিত্র নামে শপথ করে বলছি, ফায়ার ব্রিগেডের ক্রেন ছাড়া ওই মহিলাকে ঝুলানো সম্ভব না। এখন আপনি বলুন আমার পক্ষে কি ফায়ার ব্রিগেড খবর দিয়ে আনা সম্ভব?…
চার পাতার দীর্ঘ চিঠি। চিঠির শেষে মামলা পুনর্বিবেচনার আকুল আবেদন।
আজ মার্চের সতেরো তারিখ। সময় রাত দশটা। আজও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রুস্তম তার উপন্যাস নিয়ে বসেছে। উপন্যাসের প্রথম দুটি লাইন লেখা হয়েছে।
প্রণাশ বাবু নিউমার্কেট কাঁচাবাজার থেকে একটা মাঝারি সাইজের ইলিশ এবং আধা কেজি রাই সরিষা কিনে বাড়ি ফিরলেন। আজ তাঁর সরষে ইলিশ খেতে ইচ্ছা করছে।
মোবাইল ফোন একটু পরপর বাজছে। রুস্তম টেলিফোন কানে নিয়ে বলল, কে?
আমি।
আমিটা কে? তুই আমার গলা চিনতে পারিস না? আশ্চর্য কথা! আমি সামিনা।
বুবু তুমি কোথায়?
আমি সিঙ্গাপুরে। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে একটা ফুল চেকআপ করিয়ে মালয়েশিয়া বেড়াতে যাব। জাহাজে করে যাব। জাহাজে ক্যাসিনো আছে, অনেক দিন পর জুয়া খেলব।
বুবু, আমি একটা জরুরি কাজ করছি।
আমিও একটা জরুরি কাজেই টেলিফোন করেছি। আজ কত তারিখ জানিস?
না।
আজ মার্চের সতেরো। মায়ের মৃত্যুদিন। আমিও তোর মতো ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম তোকে টেলিফোন করি।
ও আচ্ছা।
আমরা সবাই ভুলে গেলেও তোর দুলাভাইয়ের কিন্তু সবসময় মনে থাকে। ওইদিন সে ফকির খাওয়ায়। মিলাদের আয়োজন করে। এইবার করেছে কি না কে জানে! মনে হয় না করেছে। প্রতিবার এইসব করত আমাকে খুশি করার জন্য। এখন তো আর আমাকে খুশি করার কিছু নাই।
সব বার যখন করে, তখন এইবারও নিশ্চয়ই করবে। মানুষ কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার বাইরে যেতে পারে না।
তুই কি তোর দুলাভাইকে একটা টেলিফোন করে আমাকে জানাবি? আমি টেলিফোন ধরে থাকলাম।
বুবু, দুলাভাইয়ের নাম্বার আমার কাছে নেই। কারও নাম্বারই নেই। কেউ টেলিফোন করলেই শুধু আমি কথা বলি। নিজ থেকে কাউকে টেলিফোন করি না।
আমি নাম্বার বলছি। তুমি কাগজে লেখ।
বুবু, আমি জরুরি কাজ করছি। এখন টেলিফোন করতে পারব না। দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে আমি তার কাছ থেকে জেনে রাখব।
রুস্তম টেলিফোন পুরোপুরি বন্ধ করে উপন্যাসে মন দিল আর তখনি কাবার্ডের ভেতর থেকে ফোঁস ফোঁস শব্দ হতে লাগল। রুস্তম চমকে বিছানায় উঠে বসল। এমন কি হতে পারে কাবার্ডের ভেতর লাঠিটা পড়ে গিয়ে সাপ হয়ে গেছে এবং ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে? রুস্তম ডাকল, মুনিয়া! মুনিয়া!
দ্বিতীয়বার ডাকার আগেই মুনিয়া ঘরে ঢুকল। সে মনে হয় দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিল।
স্যার কিছু লাগবে? আরেকটা কথা, আপনি ময়ূরী নাম দিয়ে এখন মুনিয়া ডাকছেন কেন? আমার খুবই মন খারাপ হয়েছে। ময়ূরী ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকলে আমি ঘরে ঢুকব না।
রুস্তম আতঙ্কিত গলায় বলল, কিছু শুনতে পাচ্ছ? মন দিয়ে শোনো।
মুনিয়া বলল, কী শুনতে পাব স্যার?
ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
মুনিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, পাচ্ছি।
শব্দটা কোত্থেকে আসছে বলতে পারছ?
না।
কাবার্ডের ভেতর থেকে। সেখানে একটা সাপ আছে।
কী সর্বনাশ! সাপ মারার ব্যবস্থা করি?
সাপ মারতে হবে না। এটা সাধারণ কোনো সাপ না। আগে ছিল বেতের লাঠি। এখন সাপ হয়েছে।
ও আচ্ছা।
তারপরেও শব্দটার জন্য ভয় ভয় লাগছে।
মুনিয়া বলল, ভয়ের কিছু নাই স্যার। প্রয়োজনে আমি এই ঘরে ঘুমাব।
তুমি কোথায় ঘুমাবে?
মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে থাকব। আমার অসুবিধা নাই।
বাদ দাও।
বাদ দিব কী জন্য? আপনার শরীর খারাপ, ঘুম প্রয়োজন। সাপের ভয়ে যদি ঘুমাতে না পারেন আপনারই ক্ষতি।
সাপের নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
পরিষ্কার শুনছি। আপনাকে দোষ দিয়া লাভ কী! আমার নিজেরই ভয় ত্ম লাগছে। বিছানা নিয়া চলে আসি?
আসো।
মুনিয়া বিছানা আনেনি, শীতলপাটি এনেছে। খাটের পাশে পাটি পেতেছে। ঘরে বাতি জ্বলছে। মুনিয়া বলল, স্যার! আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ।
কী অনুরোধ?
আপনি আমার দিকে তাকাবেন না। ঘুমের সময় আমার কাপড়চোপড় ঠিক থাকে না। ছোটবেলার বদভ্যাস। এই জন্য মায়ের কাছে কত বকা খেয়েছি।
আমি তাকাব না। এই দেখো চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
চোখ বন্ধ করার দরকার নাই। স্যার একটা গল্প বলেন। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাই।
আমি তো গল্প জানি না।
তাহলে বাদ দেন।
আমি যে উপন্যাস লিখছি সেই গল্পটা বলতে পারি। তবে গল্পটা এখনো তৈরি না।
তৈরি না হলে থাক।
উপন্যাসের নাম দিয়েছি ঝিঁঝি। নামটা কি তোমার কাছে ভালো লাগছে?
অসম্ভব সুন্দর নাম।
ঝিঁঝি পোকার ঝিঁঝি। ঝিঁঝি পোকা হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যে সবসময় ঝিঁঝি শব্দ করে নিজেকে জানান দেয়। মানুষও তাই করে। শুধু মৃত মানুষ নিজেকে জানান দিতে পারে না।
মুনিয়া বলল, আহারে, কী দুঃখের কথা!
ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কারণে রুস্তমের চোখ ভারী হয়ে আসছে। এই অবস্থাতে হঠাৎ তার মনে হলো মুনিয়া মেয়েটি কে? কোন পরিচয়ে এ বাড়িতে থাকছে, তা এখনো জানা হয়নি। জানা দরকার। তবে তাড়াহুড়ার কিছু নেই, সকালে জিজ্ঞেস করলেই হবে।
স্যার কি ঘুমায়ে পড়েছেন?
না। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ব।
আমার রাতে ঘুম আসে না।
ঘুমের ওষুধ খাবে? দেব?
জি না। আপনে ঘুমান। আমি আপনার পাহারায় আছি। সাপের শব্দ কি এখনো শুনছেন স্যার?
না। ফোঁসফোঁসানি কমেছে।
আপনার মাথায় যন্ত্রণা করলে বলেন, আমি মাথা টিপে ঘুম পাড়ায়ে দিব। আমার মতো মাথা মালিশ নাপিতেও জানে না।
আমার মাথায় যন্ত্রণা করছে না। তুমি কথা না বললেই আমি ঘুমিয়ে পড়ব।
কথা বলা বন করলাম।
শুভ রাত্রি মুনিয়া।
স্যার আমারে মুনিয়া ডাকবেন না। আপনি আমাকে যে নাম দিয়েছেন, সেই নামে ডাকবেন। বলেন, শুভ রাত্রি ময়ূরী।
শুভ রাত্রি ময়ূরী।
রুস্তমের ডাক্তারের নাম রেণুবালা। সাইকিয়াট্রিতে PhD করেছেন ইউনিভার্সিটি অব আরিজোনা থেকে। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক করেছেন স্কিজোফ্রেনিয়ার ওপর। তাঁর বয়স চল্লিশের মতো। সবসময় সাদা শাড়ি এবং শাড়ির ওপর সাদা অ্যাপ্রন পরেন। হিন্দু মেয়েরা আজকাল সিঁদুর দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। লেড অক্সাইড দিয়ে সিদুর বানানো হয়, এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ, বিয়ে হয়েছে এই সার্টিফিকেট তারা মাথায় পরে ঘুরতে চায় না। ড. রেণুবালা দে মাথায় সিঁদুর পরেন। সাদা শাড়ি, মাথাভর্তি কুচকুচে কালো চুলের মাঝখানে টকটকে লাল রঙের সিঁদুরে তাকে খুব মানায়।
রুস্তম তার কাছে যখনই আসে, মুগ্ধ চোখে সিঁদুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ড. রেণুবালা রুস্তমকে ডাকেন রু আদে। রুস্তমের কবিতার বইটি তিনি পড়েছেন। তাঁর চেম্বার বইপত্রে ঠাসা। দেয়ালে দুটা ছবি আছে, একটা স্বামী বিবেকানন্দের। এই ছবি ক্যামেরার ল্যান্সের দিকে তাকানো অবস্থায় তোলা বলে রুস্তমের মনে হয়, স্বামী বিবেকানন্দ তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার খানিকটা অস্বস্তি লাগে। দ্বিতীয় ছবিতে খালি গায়ে মোটাসোটা এক লোক বসা। হাসি হাসি মুখ। গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রুস্তম একে চেনে না। সবসময় ভাবে, পরিচয় জিজ্ঞেস করবে। শেষ মুহূর্তে জিজ্ঞেস করা হয় না।
রু আদে সাহেব কেমন আছেন?
জি ভালো।
আজ কি একা এসেছেন?
না। দুলাভাই সঙ্গে এসেছেন, তিনি ওয়েটিং রুমে বসে আছেন।
আপনাকে তো বলেছি, একা আসার অভ্যাস করুন।
দুলাভাই আমাকে একা ছাড়তে চান না। যেখানেই যাই, তিনি সঙ্গে Tai
আপনার ছবি আঁকা কেমন চলছে?
ভালো চলছে।
শেষ কী ছবি এঁকেছেন?
ছবি আঁকা এখনো শুরু করিনি। রঙ মেশানো শিখছি।
একটা উপন্যাস শুরু করবেন বলেছিলেন। শুরু করেছেন?
জি। মাত্র দুই লাইন লিখেছি।
উপন্যাসের নাম কী দিয়েছেন?
ঝিঁঝি।
সুন্দর নাম। ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে?
জি।
অদ্ভুত কিছু কি দেখেছেন বা কোন Strange experience কি রিসেন্টলি হয়েছে?
জি না। তেমন কিছু হয়নি।
ভয় পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি?
সামান্য ভয় পেয়েছি।
কী দেখে ভয় পেয়েছেন?
কিছু দেখে ভয় পাইনি, শব্দ শুনে ভয় পেয়েছি। ফোঁসফোসানি শব্দ।
কে ফোঁসফোঁস করছিল?
একটা সাপ। কাবার্ডের ভেতর থেকে ফোঁসফোঁস করছিল।
কাবার্ডে সাপ গেল কিভাবে?
আমি রেখেছি।
আপনি কাবার্ডে সাপ রেখেছেন?
না, আমি রাখিনি। আমি একটা বাঁকানো বেতের লাঠি রেখেছিলাম। খাড়া করে রাখা ছিল। মনে হয় কোনো কারণে লাঠিটা পড়ে গিয়েছে। এই লাঠির বিশেষত্ব হচ্ছে, শোয়ানো অবস্থায় এটা সাপ হয়ে যায়।
লাঠিটা আপনাকে কে দিয়েছে?
গোলাম মওলা আংকেল দিয়েছেন। দিতে চাননি, আমি জোর করে নিয়েছি।
এমন একটা ভয়ঙ্কর জিনিস জোর করে কেন নিলেন?
ভয়ঙ্কর বলেই নিয়েছি। মানুষ সুন্দর যেমন ভালোবাসে, ভয়ঙ্করও ভালোবাসে।
রু আদে সাহেব?
জি বলুন।
আপনি খুবই স্বাভাবিক একজন মানুষ। বুদ্ধিমান, ক্রিয়েটিভ। আপনার কবিতার বইয়ের সবকটা কবিতা আমি পড়েছি। বিশেষ করে অন্ধ উইপোকা কবিতাটা। আমি প্রচুর কবিতা পড়ি। ভালো কবিতা এবং মন্দ কবিতার তফাৎ ধরতে পারি।
ধন্যবাদ।
আপনার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ কি আপনার আঁকা?
জি না।
আমি বিশ্বাস করি, আপনি ছবিও আঁকবেন। নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ নিজে করবেন।
ধন্যবাদ। এখন যে প্রচ্ছদ আঁকা আছে সেখানে ছোট্ট সমস্যা হয়েছে।
কি সমস্যা বলুন তো?
প্রচ্ছদে একটা পাখি আঁকা ছিল। পাখিটা সাইকেলের চাকায় বসা ছিল। এখন দেখি পাখিটা বসে আছে চায়ের কাপে।
চা খাচ্ছে?
খেতে চাচ্ছে। চা অতিরিক্ত গরম বলে খেতে পারছে না।
রেণুবালা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার একটাই সমস্যা, আপনার বাস্তব জগতের পাশাপাশি একটি অবাস্তব জগৎও আছে। অবাস্তব জগৎটাও আপনার কাছে বাস্তব।
কেন?
চট করে এই কেনর জবাব দেওয়া যাবে না। ব্রেইনের নিওরোল কানেকশনে শর্টসার্কিট হলে এ রকম হয়। অনেকে ড্রাগ খেয়ে এই শর্টসার্কিট নিজেরা করে। সাইকাডেলিক ড্রাগ যেমন LSD, ধুতরা। এদের কম্পেজিন serotonin এবং Dopamine-এর মতো। এ দুটি কেমিক্যাল হলো নিউরোট্রান্সমিটার। ঘাগ নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যক্রম বদলে দেয় বলে ঘটনা ঘটে।
আমি তো কোনো ড্রাগ থাই মা।
জানি। কারো কারো ক্ষেত্রে ড্রাগ ছাড়াই এ রকম ঘটে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, কালজয়ী ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তয়োভস্কি। তার প্রায়ই epliptic সিজারের মতো হতো। ঘোর কেটে গেলে তিনি বলতেন, ঈশ্বর কী, মানুষ কী, জগতের সঙ্গে ঈশ্বর এবং মানুষের সম্পর্ক কী, তা তিনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও জেনেছেন।
ও আচ্ছা।
রু আদে সাহেব, আপনি কি কফি খাবেন? আমার এখানে খুব ভালো কফি বানানো হয়।
কফি খাব না।
আমি আপনাকে আগেও বলেছি, এখন আবার বলছি–আপনাকেই আপনার চিকিৎসা করতে হবে।
কিভাবে?
কোনটা বাস্তব, কোনটা অবাস্তব এটা চিন্তা করে বের করতে হবে। আপনি কি কখনো দেখেছেন, কোনো লাঠি মেঝেতে পড়ে গেলে সাপ হয়ে যায়?
না, দেখিনি। তবে হজরত মুসা আলায়েস সালামের লাঠি মেঝেতে পড়লে সাপ হয়ে যেত।
আপনার লাঠি কি সেই লাঠি?
না।
আপনি এক কাজ করবেন। আজ বাসায় গিয়েই লাঠিটা বের করে মেঝেতে ফেলবেন। ফেলার পর কী দেখবেন বলুন তো?
দেখব লাঠি সাপ হয়নি। লাঠি লাঠিই আছে।
আমার ধারণা, আপনি দেখবেন লাঠিটা সাপ হয়ে গেছে। আপনার ব্রেইন সে রকম সিগন্যাল দেবে। আপনি তখন আপনার সঙ্গে অন্য কাউকে রাখবেন। সে কিন্তু লাঠি দেখবে, সাপ দেখবে না। তখন তার কথা বিশ্বাস করবেন। এ কাজগুলো আপনাকেই করতে হবে।
আজ কি উঠব?
হ্যাঁ, আজ বিদায়। আর দয়া করে যার লাঠি তাকে ফেরত দিয়ে বাড়ি থেকে ঝামেলা বিদায় করুন।
আচ্ছা। আপনার এখানে যখনই আসি তখনই একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। যাওয়ার সময় মনে থাকে না।
আজ কি মনে আছে?
আছে।
তাহলে জিজ্ঞেস করুন।
জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না।
তারপরেও জিজ্ঞেস করুন। প্রশ্ন চাপা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো কোনো কাজের কথা না।
স্বামী বিবেকানন্দের পাশের ছবিটা কার?
রামকৃষ্ণ পরমহংসের। তাঁকে বলা হয় কলির অবতার। আমি উনার পরমভক্ত।
ও আচ্ছা।
উনিও কিন্তু স্কিজিওফ্রেনিক ছিলেন। ভক্তরা বলত, প্রায়ই তাঁর ভাব সমাধি হতো। আসলে যেটা হতো তা হলো epleptic seizure.
ও আচ্ছা।
রামকৃষ্ণ সুন্দর সুন্দর কথা বলে গেছেন। আমার কাছে একটা বই আছে, নাম রামকৃষ্ণ কথামালা। বইটা কি পড়বেন? দেব আপনাকে?
না।
রুস্তম দুলাভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে ফিরছে। তাদের গাড়ি পেছনে পেছনে আসছে। গাড়িতে চড়লেই রুস্তমের দম বন্ধ হয়ে আসে বলে এই ব্যবস্থা।
রুস্তম বলল, দুলাভাই! এবারে মায়ের মৃত্যুদিবসে আপনি কি ফকির খাইয়েছিলেন?
অবশ্যই। পাঁচজন ফকির খাইয়েছি। এতিমখানায় এক বেলা খাবার দিয়েছি। শুধু মিলাদ পড়ানো হয় নাই। কেন বলো তো?
বুবুর ধারণা, আপনি এইবার কিছু করেননি।
তার এ রকম ধারণা হলো কেন?
বুবু ভেবেছে, আপনি এসব করতেন শুধু বুবুকে খুশি করার জন্য।
খুবই ভুল ধারণা। আমার শাশুড়ি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন ফেরেশতা পর্যায়ে অতি পুণ্যবতী রমণী। তোমার এবং তোমার বোনের মধ্যে সৎগুণ যা আছে, তা সবই তোমরা পেয়েছ উনার কাছ থেকে।
বুবুর সঙ্গে কি আপনার কথা হয়েছে?
না।
বুবু সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া যাবে জাহাজে করে। জাহাজে ক্যাসিনো আছে। জুয়া খেলতে খেলতে যাবে।
জুয়া খেলবে?
হুঁ।
গুড, জুয়া খেলুক। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে জাহাজের ডেকে উলঙ্গ নৃত্য করুক, আমার কিছুই যায় আসে না। ওর কথা বাদ থাক। ডাক্তার কী বললেন?
বললেন, তিনি আমার অন্ধ উইপোকা কবিতাটা খুব পছন্দ করেছেন।
আর কিছু বলেননি?
সাপ নিয়ে কিছু কথা বলেছেন।
সাপের কথা এলো কেন?
রুস্তম জবাব দিল না। সবসময় তার কথা বলতে ভালো লাগে না।
আমিন বললেন, আমি সিগারেট ধরালে কি তোমার সমস্যা হবে?
রুস্তম বলল, আপনি তো সিগারেট খেতেন না।
এখন খাওয়া শুরু করেছি। সারাদিনে দেড় প্যাকেট লাগে। টেনশন কমানোর জন্য খাচ্ছি।
টেনশন কি কমেছে?
না। তারপরেও চেষ্টা। যে ফ্ল্যাটে আছি, সেটাও ছেড়ে দিতে হবে।
কেন?
ফ্ল্যাটটা তোমার বুবুর নামে কেনা। সে যে এই কাণ্ড করবে, জীবনেও ভাবি নাই।
বুবুর তেমন দোষ নাই। আপনার গায়ে ঘামের গন্ধ।
আর ওই হারামজাদার গা দিয়ে কি গোলাপের গন্ধ বের হচ্ছে?
রুস্তম জবাব দিল না। আমিন সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন, ফ্ল্যাট ছেড়ে দিলে থাকার জায়গা থাকে না। তোমার বাড়িতে উঠব।
জি আচ্ছা। কবে আসবেন?
কাল-পরশুর মধ্যে চলে আসব। তোমার একটা বিষয়ে সাহায্যও দরকার। কিভাবে সামিনাকে জন্মের শিক্ষা দেওয়া যায়। বাকি জীবন যাতে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে। অনেকগুলো প্ল্যান মাথায় এসেছে। প্রথম প্ল্যান আফতাবকে জন্মের মতো আউট করা। গোলাপের ফ্যাক্টরি শেষ। হা হা হা।
রুস্তম বলল, গোলাম মওলা আংকেলের সঙ্গে আমি কথা বলে রেখেছি। উনার আবার আসার কথা, তখন মনে করিয়ে দিব।
অনেক চেষ্টাতেও সিগারেট ধরল না। রিকশা চলছে, বাতাসও আছে। আনাড়ি হাতে ম্যাচ ধরানো কঠিন।
রুস্তম।
জি দুলাভাই।
আফতাব হারামজাদার জন্য আমি একটা মাস্টার প্ল্যান করেছি। শুনলে তুমি চমকে উঠবে। রিকশায় বলা যাবে না। কাল-পরশুর মধ্যে তোমাদের বাড়িতে চলে আসব, তখন বলব।
জি আচ্ছা।
দক্ষিণমুখী একটা ঘর আমার জন্য ঠিক করে রেখো।
মার ঘরে ঘুমাবেন? ঘরটা তালাবদ্ধ আছে। দক্ষিণমুখী।
আমার কোনো অসুবিধা নাই। একজন মানুষ ওই ঘরে মারা গেছে, তাতে কী হয়েছে? মানুষের জন্ম-মৃত্যু থাকবেই।
আমিন সিগারেট ধরানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন।
রাত আটটা বাজে।
রুস্তম তার ঘরে ঢুকে ডাকল, ময়ূরী।
মুনিয়া ঝড়ের গতিতে উপস্থিত হলো। রুস্তম বলল, আমি তোমার সামনে ছোট একটা পরীক্ষা করব। ডাক্তার সাহেব এই পরীক্ষা করতে বলেছেন।
কী পরীক্ষা?
কাবার্ড খুলে আমি সাপটা বের করব। তুমিও দেখবে এবং বলবে কী দেখেছ।
রুস্তম কাবার্ড খুলেই লাফ দিয়ে সরে গেল। হলুদ রঙের একটা সাপ মেঝেতে পড়ে ফণা তুলেছে।
রুস্তুম ভীত গলায় বলল, সাপটাকে দেখতে পাচ্ছ?
জি। কী সর্বনাশ! বলেই মুনিয়া লাফ দিয়ে সরল।
সাপ যে ফণা তুলেছে দেখেছ?
জি।
সাপের মাথা কোনটা, লেজ কোনটা?
মুনিয়া ইতস্তত করে বলল, এইটা মাথা।
রুস্তম বলল, তুমি সাপ দেখছ না। লাঠিই দেখছ। সাপ বললে আমি খুশি হবো ভেবে বলেছ সাপ। তুমি লাঠি দেখছ না?
জি।
লাঠিটা তুলে তোমার ঘরে নিয়ে রাখো। আমার ডাক্তার বলেছে লাঠি সঙ্গে না রাখতে। গোলাম মওলা আংকেল এলে তাকে লাঠিটা ফেরত দিতে হবে।
আজ রাতে আপনার ঘরে ঘুমাব না?
না। এখন তো আর আমার ভয় করছে না। সাপ নিয়ে তুমি চলেই যাচ্ছ।
রাত-বিরাতের কথা। অন্য কিছু দেখেও তো ভয় পেতে পারেন। আমি ঝিম ধরে শুয়ে থাকব। ওই রাতের মতো কটকট করে কথা বলব না।
কোনো প্রয়োজন নেই। আজ ঠিক করেছি অনেক রাত পর্যন্ত লেখালেখি করব। ভালো কথা, তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাই। তোমাকে এই বাড়িতে কে এনেছে?
আপনি এনেছেন।
আমি এনেছি?
জি।
আমি তোমাকে কোথায় পাব যে এ বাড়িতে নিয়ে আসব?
স্যার! রেগে যাচ্ছেন কেন?
রেগে যাচ্ছি না, প্রশ্ন করছি।
আপনার একবার শরীর খুব বেশি খারাপ করল। আপনি কাউকেই চিনতে পারেন না। তখন আপনি কিছুদিন আরোগ্য ক্লিনিকে ছিলেন।
রুস্তম বলল, এটা মনে আছে।
আমি ওই ক্লিনিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স।
অ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স কী জিনিস?
নার্সরা তো অনেক কিছু জানে। আমি কিছু জানি না। বিছানার চাদর বদলে দেই, রোগীদের গা স্পঞ্জ করি। আমি আপনাকে বলেছিলাম, এখানে কাজ করতে আমার ভালো লাগে না। আপনি আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিন। আপনি বলেছিলেন, আচ্ছা। তারপর আমি নিজে নিজে চলে এসেছি।
কাঁদছ কেন?
আপনি আমাকে চিনতে পারেন নাই, এ জন্য কাঁদছি।
মুনিয়া এখন যাও, আমি আমার উপন্যাসটা নিয়ে বসব।
স্যার, আপনি আমাকে মুনিয়া ডাকবেন না। আরেকবার যদি মুনিয়া ডাকেন তাহলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। চলন্ত ট্রাকের সামনে লাফ দিয়ে পড়ব।
তোমার নাম মুনিয়া, তোমাকে মুনিয়া ডাকতে পারব না?
অন্য সবাই মুনিয়া ডাকবে। আপনি ডাকবেন ময়ূরী।
আচ্ছা ময়ূরী। তুমি এখন যাও। এখনো কেন কাঁদছ?
আপনি কঠিন গলায় যাও বলেছেন, এ জন্য কাঁদছি।
প্লিজ, এখন যাও।
চা-কফি কিছু এনে দেব স্যার?
না।
এক বসাতে উপন্যাস অনেক দূর লেখা হয়ে গেল। রুস্তম রাত একটার কিছু পরে ঘুমুতে এসে দেখে, মুনিয়া মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে আছে। সে বলেছিল, ঘুমানোর সময় তার কাপড় ঠিক থাকে না। এ জন্য ছোটবেলায় সে মায়ের অনেক বকা খেয়েছে। রুস্তম দেখল, ঘটনা সত্যি। আসলেই মুনিয়ার গায়ের কাপড় ঠিক নেই। এই অবস্থায় কত সুন্দর যে লাগছে মেয়েটাকে!
রুস্তম সাবধানে বিছানায় এসে সুইচ বন্ধ করল। মেয়েটার যে অবস্থা! বাতি নেভানো থাকাই ভালো।
স্যার, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
না। এই মাত্র শুয়েছি। তুমি জেগে আছ নাকি?
স্যার, আমি গভীর ঘুমে ছিলাম, খুট করে বাতি নেভালেন সেই শব্দে ঘুম ভেঙেছে।
আচ্ছা ঘুমাও।
কিছুক্ষণ জেগে থাকি স্যার। এই ধরুন পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিট আপনার সঙ্গে গল্প করি।
আচ্ছা।
আমার মা, আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাস। তাদের কলমাকান্দায় বিশাল ফার্মেসি আছে। ফার্মেসির নাম দি নিউ মদিনা ফার্মেসি।
ভালো তো।
ছেলেরা দুই ভাই। বড় ভাই দুবাইয়ে চাকরি করেন।
বিয়ে কবে হচ্ছে?
বিয়ে কিভাবে হবে। আমি আরেকজনকে বিয়ে করে ফেলেছি না।
কাকে বিয়ে করেছ? আমার আর্ট টিচারকে?
উনাকে আমি বিয়ে করব কোন দুঃখে। উনাকে বিয়ে করলে সারাজীবন আমাকে নেংটো করে চেয়ারে বসিয়ে রেখে ছবি আঁকবেন। স্বামীর সামনে উদাম হওয়া যায়। যার-তার সামনে যায় না। ঠিক বলেছি না স্যার?
হুঁ।
মজার ব্যাপার কি জানেন স্যার, আমি যাকে বিয়ে করেছি তিনি নিজেও সেটা জানেন না।
সেটা কি করে সম্ভব?
কাজি ছাড়া বিয়ে বলেই সম্ভব। নতুন ধরনের বিয়ে। এই বিয়েতে কনেকে বরের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে তিনবার বলতে হয় তুমি আমার স্বামী। তুমি আমার স্বামী। তুমি আমার স্বামী। এতেই বিয়ে হয়ে যায়।
এ রকম বিয়ের কথা জানতাম না তো!
আপনার জানার কথাও না। এই ধরনের বিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি।
তোমার আবিষ্কার?
জি। একজনকে খুব বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল, উনাকে বলতে পারছিলাম, তখন বুদ্ধি করে এইভাবে বিয়ে করে ফেলেছি। ভালো করেছি না স্যার?
বুঝতে পারছি না। যাকে বিয়ে করলে সে জানতেও পারল না, এটা কেমন কথা!
আমি জানলাম, আমি মনে শান্তি পেলাম। একজনের মনের শান্তিও তো কম না। স্যার আপনি কি জানতে চান আমি কাকে বিয়ে করেছি?
তোমার গোপন বিষয় আমি জানতে চাচ্ছি না। তারপরেও বলতে চাইলে বলো।
স্যার আমি আপনাকে একটা শিল্লুক দিব। যদি ভাঙাতে পারেন আপনাকে বলব আমি কাকে বিয়ে করেছি। শিল্লুকটা হলো
আমি থাকি জলে
আর তুমি থাকো স্থলে
আমাদের দেখা হবে
মরণের কালে।
শিল্লুকের বিষয়টা ভাবতে ভাবতে রুস্তম গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। আজ সে ঘুমের ওষুধ খেতে ভুলে গেছে, তারপরও তার গাঢ় ঘুম হলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখল, সে ট্রেনে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। ট্রেনের গতি ক্রমেই বাড়ছে। একসময় ট্রেন লাইন ছেড়ে আকাশে উঠে গেল। ঘুমের মধ্যেই তার মনে হলো, এই স্বপ্নটা লিখে ফেলতে হবে। কারণ, তার ডাক্তার বলে দিয়েছেন অদ্ভুত কোনো স্বপ্ন দেখলেই লিখে ফেলতে হবে। ডাক্তারের নাম রেণুবালা দে। তার চেম্বারে দুজনের ছবি আছে। একজনের নাম স্বামী বিবেকানন্দ। অন্যজনের নাম সে জানে, কিন্তু এখন মনে পড়ছে না।
উনি একজন মানসিক রোগী। উনার নামের শেষে আছে কৃষ্ণ। শুরুটা তাহলে কি? রাধা? উনার নাম কি রাধাকৃষ্ণ?
রুস্তমের ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে। সে খাটে বসে আছে। বাথরুমের দরজা সামান্য খোলা। সেখান থেকে আলো আসছে। মনে হচ্ছে বাথরুমে কেউ হাঁটাহাঁটি করছে। শুধু যে হাঁটাহাঁটি করছে তা না, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। রুস্তম কথা শোনার জন্য কান পাতল। একটা বাক্যই সে বারবার বলছে–যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে। যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে।…
এই বাক্য আগে কোথাও রুস্তম শুনেছে কিন্তু এখন মনে করতে পারছে। রুস্তম বলল, বাথরুমে কে?
আমি।
আমিটা কে?
ভাই পীর।
এখানে কি?
টয়লেট করতে এসেছি।
রুস্তম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। পুরোটাই বিভ্রম। ডাক্তার রেণুবালাকে নতুন বিভ্রমের কথাটা বলতে হবে।
রুস্তমের মায়ের তালাবদ্ধ ঘর
রুস্তমের মায়ের তালাবদ্ধ ঘর অনেক দিন পর খোলা হয়েছে। ঝাড়গোছ করা হচ্ছে। ঘরের দরজা-জানালা সবই বন্ধ ছিল, তারপরও এত ধুলা জমল কিভাবে কে বলবে! বদ্ধঘরে বাসি খাবারের গন্ধ পাওয়া যায়, এই ঘরে ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ। এই গন্ধ আসছে বন্ধ আলমারি থেকে। রুস্তমের মা আসমা কাপড়ে প্রচুর ন্যাপথলিন দিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। এই গন্ধের প্রতি তার দুর্বলতাও ছিল। প্রায়ই দেখা যেত, হাতভর্তি ন্যাপথলিন নিয়ে আসমা বসে আছেন। মাঝে মাঝে শুকছেন।
ঘর পরিষ্কার করা হচ্ছে আমিনের উপস্থিতিতে। এই কাজের জন্য তিনি তার নিজের লোক নিয়ে এসেছেন। নাকে রুমাল চেপে আমিন বসে আছেন। একে একে নির্দেশ জারি হচ্ছে। নাক-মুখ রুমালে বন্ধ বলে তার নির্দেশ কেউ পরিষ্কার বুঝতে পারছে না।
পুরো ঘর সিলিংসুদ্ধ পরিষ্কার করবে। তারপর ভিক্সল দিয়ে মেঝে মুছবে। ফাইনাল স্টেজে স্যাভলন মেশানো পানি ব্যবহার করবে। গাবদা খাটটা সরাও, আমি সিঙ্গেল খাট রাখব। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল সব ক্লিয়ার। ঘরের মধ্যে খোলামেলা ভাব আমার পছন্দ। এই সিলিং ফ্যান, থাকবে না। নতুন সিলিং ফ্যান বসবে। মিস্ত্রি খবর দিয়েছি। মিস্ত্রি এসে এসি লাগাবে। সন্ধ্যার মধ্যে কাজ কমপ্লিট হতে হবে। সাতটায় আমি এই ঘরে উঠব। দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে দাখিল হবো। যা বলেছি অল ক্লিয়ার?
কেউ জবাব দিল না। সবাই নিজের মতো কাজ করছে। রুস্তম এসে বলল, দুলাভাই আপনি ধুলাবালির মধ্যে বসে আছেন কেন?
আমিন বললেন, কাজ দেখছি। কাজ দেখতে আমার ভালো লাগে।
চা-কফি কিছু খাবেন?
ফার্স্ট ফেজ ক্লিনিংয়ের পর চা খাব। ধুলা একটু কমুক। তোমার বাড়িতে নানান অপরিচিত লোকজন দেখছি। এরা কারা?
ঠিক জানি না এরা কারা।
একজনকে দেখলাম হাফ নেংটা হয়ে বারান্দায় বসা। এ কে?
উনার নাম চণ্ডিবাবু। উনি কে জানি না।
অদ্ভুত কথা শুনলাম। তোমার বাড়িতে বাস করে আর তুমি জানো না এ কে? মুনিয়া মেয়েটাকে দেখলাম ঘুরঘুর করছে, সে এখানে কেন?
মুনিয়াকে চিনেন?
ফাজিল মেয়ে। চিনব না কেন? আরোগ্য ক্লিনিকের ঝি। তোমার কেবিনে সর্বক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিত। শেষ পর্যন্ত ক্লিনিকের এমডির কাছে কমপ্লেইন করতে হলো। ঝি এখানে কী চায়?
ঝি না দুলাভাই। নার্সের অ্যাসিসট্যান্ট। আমিই তাকে নিয়ে এসেছ।
কেন?
জানি না কেন। ওই সময়ের ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে নেই।
ঝাঁটাপেটা করে ঝি বিদায় করো। তোমার অস্বস্তি লাগলে বিদায়ের কাজ আমি করব। হাতে দুই হাজার টাকা ধরিয়ে রিকশায় উঠিয়ে দিতে হবে।
জি আচ্ছা।
একে বলে ফুড ফর ওয়ার্ক। তোমার এখানে থাকব-খাব, বিনিময়ে কিছু কাজ করে দেব না? নিচে আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলো। হানড্রেড পারসেন্ট ইংলিশ সাহেব। গলায় টাই, চকচকে জুতা। আমি বললাম, নাম কী? নাম বলল, ইমন আহমেদ। আমি বললাম, আপনি করেন কী? সে বলল, চাকরির সন্ধানে আছি। বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভু দিচ্ছি। আমি বললাম, চাকরির সন্ধানে আছ ভালো কথা। এখানে কেন? সে বলল, স্যার আমাকে এ বাড়িতে থেকে চাকরি খুঁজতে বলেছেন। চাকরি পেলে চলে যাব। রুস্তম তুমি কি তাই বলেছ?
বলতে পারি। মনে হয় আমার অসুখের সময় ঘটনা ঘটেছে। অসুখের সময়ের অনেক কথা আমার মনে নেই।
আমিন বললেন, সাত দিন সময়। সাত দিনের মাথায় তাকে চলে যেতে হবে। আমিই ব্যবস্থা করব। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু দেখবে। তুমি অবজারভার। আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব আমার। আমি মর্জিনা।
মর্জিনা কে?
আলি বাবা চল্লিশ চোরের মর্জিনা। সে ঘর ঝাঁট দিত আর কোমর দুলিয়ে গান করত, ছিঃ ছিঃ ঘরমে এত্তা জঞ্জাল।
ও আচ্ছা।
পাশের ঘরে একজনের সঙ্গে দেখা হলো। শুনলাম সে নাকি তোমার আর্ট টিচার।
জি, হোসেন মিয়া। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। রাষ্ট্রপতি গোল্ড মেডেল পাওয়া।
তার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি, ঘর অন্ধকার করে খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। হাতে কোকের গ্লাস। আমি বললাম, কী খাচ্ছেন? সে বলল, রাম খাচ্ছি।
আমি বললাম, রাম জিনিসটা কী?
সে বলল, এক ধরনের অ্যালকোহল। মোলাসিস বা চিটাগুড় থেকে তৈরি হয়। খেতে মিষ্টি। এমনভাবে বলল, যেন দিনে-দুপুরে মদ খাওয়া কোনো ব্যাপারই না। একেও বের করে দিতে হবে, তবে অন্যরা যেমন নরম্যালি বের হবে সে সেভাবে বের হবে না। একে কানে ধরে বের করে দিতে হবে। কত বড় সাহস, দিনে-দুপুরে এম খায়! দুদিন পর লক্ষ্মণ খাবে, ভারত খাবে, সীতা খাবে। বদমাইশ।
রুস্তম বলল, তার সঙ্গে এভাবে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না দুলাভাই। উনি আমার টিচার।
টিচার মদ খাবে আর সেটা দেখে ছাত্র শিখবে? এটা আমি হতে দেব না।
ঘটনা কাকতালীয় হলেও একই সময়ে আমিনের স্ত্রীও রাম খাচ্ছিল। রাম দিয়ে বানানো ককটেল। পানীয়ের রং হালকা সবুজ। গ্লাসের এক কোনায় লেবু। সে বসেছে রুলেট টেবিলে। তার পাশে বিরস মুখে আফতাব চৌধুরী বসা। রুলেটে সামিনার প্রচুর টাকা যাচ্ছে। টাকার জোগান দিতে হচ্ছে আফটাবকে। সামিনা কালো শাড়ির সঙ্গে রুপার গয়না পরেছে। তাকে ইন্দ্রানীর মতো দেখাচ্ছে। অনেকেই তাকাচ্ছে সামিনার দিকে। আফতাব চৌধুরীকে দেখাচ্ছে মিয়ানো মুড়ির মতো। তার চোখে কালি পড়েছে। গতকাল থেকে দাঁতে যন্ত্রণা হচ্ছে। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। বাম গাল ফুলে আছে।
আফতাব বলল, আজকের মতো থাক। সামিনা বলল, লাস্ট একটা ডিল খেলব। পনেরো নাম্বারে রব। পনেরো হলো আমার জন্ম তারিখ। জন্ম তারিখ সবার জন্য লাকি হয়। দুইশ ডলার দাও।
দুইশ ডলার ধরবে?
শেষ দান বড় করে ধরাই তো উচিত।
পুরো টাকাটাই হারবে।
অসম্ভব। প্রথমত পনেরো আমার জন্ম তারিখ। এই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছয়। ছয় আমার আরেক লাকি নাম্বার।
ছয় পেলে কোথায়?
পনেরো বার এক এবং পাঁচ যোগ করলে হয় ছয়। একে বলে নিউমোরলজি। দুইশ ডলার না, ছয়শ ডলার দাও।
ছয়শ?
হ্যাঁ ছয়শ। দেখো কী ঘটনা ঘটে। আমি জিতলে পাব ৩৬ গুণ অর্থাৎ উনিশ হাজার দুইশ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় তের লাখ টাকারও বেশি। ডলার ৭০ টাকা ধরলে তের লাখ চৌচল্লিশ হাজার টাকা।
আফতাব নিতান্ত অনিচ্ছায় ছয়শ ডলার দিল। সামিনা সঙ্গে সঙ্গেই টাকাটা হারল। আফতাব বিরস গলায় বলল, চলো ঘুমুতে যাই।
সামিনা বলল, আমি আরেকটা ককটেল খাব। ককটেল শেষ না হওয়া পর্যন্ত রুলেট খেলব।
আমি কিন্তু তোমাকে আর টাকা দেব না।
তোমাকে দিতে হবে কেন? আমি আমার টাকায় খেলব। এইবার ধরব দশ নাম্বারে। তোমার বন্ধু আমিনের জন্মদিন হলো দশ। আমি বড় দান 1991
বড় দানটা কত?
একসঙ্গে এক হাজার ডলার।
তোমার নেশা হয়ে গেছে।
তা হয়েছে। মদ খেয়ে অভ্যাস নেই, প্রথম খাচ্ছি। সামিনা পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করল। আফতাব অবাক হয়ে দেখল বল ১০-এর ঘরে। সামিনা খুব সহজ ভঙ্গিতে বাংলাদেশি টাকায় পঁচিশ লাখ টাকার কিছু বেশি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আফতাবকে বলল, চলো ডেকের ভোলা হাওয়ায় বসি। লাস্ট ককটেল ডেকে বসে খাব।
জাহাজের ডেক চারতলায়। মাথার ওপর ছাদ আছে। ছাদ থেকে আলো আসছে। হালকা আলো। এই আলোয় কোনো কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। পরিষ্কার না দেখাই ভালো। বৃদ্ধ কিছু আমেরিকান ব্যাংকক থেকে ভাড়া করে তরুণী বান্ধবী নিয়ে এসেছে। বৃদ্ধগুলোর একমাত্র চিন্তা বান্ধবীদের পেছনে যে ডলার খরচ হয়েছে সেটা যেন উসুল হয়। বান্ধবীরাও সার্ভিস দিতে কার্পণ্য করছে না।
এক কোনায় বার আছে। দুটি মেয়ে টেবিলে টেবিলে ড্রিংক সার্ভ করছে। এরা পরেছে গোলাপি পোশাক।
আফতাব এবং সামিনা বসেছে সামনের দিকে। হুহু করে বাতাস আসছে। বাতাসে সামিনার চুল উড়ছে। তাকে এখন আরও সুন্দর লাগছে। সামিনাকে ককটেল দেওয়া হয়েছে। চুকচুক করে খাচ্ছে।
আফতাব বলল, তুমি অদ্ভুত মেয়ে।
সামিনা বলল, আমি অদ্ভুত না। আমার ভাই অদ্ভুত। ভাইয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব, তখন বুঝবে অদ্ভুত কাহাকে বলে। এই আমার একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। একটা সিগারেট দাও।
তুমি এখন সিগারেট খাবে?
ইয়েস স্যার।
তুমি এখন নেশার ঝেকে আছ। তোমাকে আমার কিছু সিরিয়াস কথা বলা দরকার।
বলো।
এখন বললে তো অর্ধেক কথাই মাথায় ঢুকবে না।
অর্ধেক তো ঢুকবে। সেই অর্ধেকেই কাজ হবে।
তুমি তোমার স্বামীকে ছেড়ে পুরোপুরি চলে এসেছ, এটা তো ঠিক?
তাকে পুরোপুরি ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসব কোন দুঃখে? পুরোপুরি চলে এলে রাতে তোমার কেবিনেই থাকতাম। আমি আলাদা কেবিনে থাকি। তোমাকে আমার ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেই না। ঠিক করে বলো, এখন পর্যন্ত আমার হাত ধরতে পেরেছ?
আফতাব বলল, তোমার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
সামিনা বলল, একটা লোকের গায়ে ঘামের গন্ধ বলে তাকে ছেড়ে আমি চলে আসব? মানুষের গায়ে ঘামের গন্ধ থাকে। নিম সাবান দিয়ে গোসল করলে ঘামের গন্ধ চলে যায়।
তাহলে আমার সঙ্গে এসেছ কেন?
তোমার বন্ধুকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ২২ ঘণ্টা সে ব্যবসার চিন্তায় থাকে। ঘুমের মধ্যেও সে ব্যবসার স্বপ্ন দেখে। এখন আর দেখবে না। যখন ফিরে যাব, সে নলের মতো সোজা হয়ে থাকবে।
একটা লোককে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তুমি আমার সঙ্গে চলে এসেছ?
হ্যাঁ। যে লোক তার প্রেগনেন্ট স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকায় না, তার শিক্ষার প্রয়োজন আছে।
তুমি প্রেগনেন্ট?
হ্যাঁ, চৌদ্দ সপ্তাহ চলছে। এর মধ্যে বাচ্চাটার অবস্থা কী শোনো। আমি বেবি সেন্টারের সদস্য। তারা প্রতি সপ্তাহে বেবির একটা আপডেট পাঠায়। দাঁড়াও তোমাকে ১৪ সপ্তাহেরটা পড়ে শোনাচ্ছি।
আফতাব হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। সামিনা তার আইফোন টেপাটিপি করতে করতে বলল, পড়ে শোনাচ্ছি। মন দিয়ে শোনো।
The baby is now about 12.5 cm or 4.92 Inches. He/she is now producing urine and actually urinating into the amniotic flui at this week your baby is a regular wiggler but because of his/her small size you probly wont feel it yet.
তুমি তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যাবে?
অবশ্যই। ও মালয়েশিয়ায় আসবে। ওকে নিয়ে ঘুরব। তারপর দেশে ফিরব।
আমার অবস্থা কী হবে?
তোমার কপালে দুঃখ আছে। আমিও তোমাকে ছাড়ব না। ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে খুন করালেও আমি অবাক হবে না। আমাদের পরিবারে খুন-খারাবি কোনো ব্যাপারই না। আমার বাবা খুনের দায়ে জেলে আছেন, তোমাকে বলেছি না?
আফতাব চাপা গলায় বলল, you bitch এখন তুমি এইসব কী বলছ?
সামিনা হাসতে হাসতে বলল, ঘেউ ঘেউ।
ঘেউ ঘেউ করছ কেন?
সামিনা বলল, আমি bitch। তাই ঘেউ ঘেউ করছি। ঘেউ ঘেউ ঘেউ!
রুস্তমের মার ঘর সন্ধ্যার মধ্যে পরিষ্কার হওয়ার কথা। পরিষ্কার করা গেল না। তিনটা আলমারির কোনোটিই ঘর থেকে বের করা যাচ্ছে না। আমিন ভেবে পাচ্ছে না এই আলমারি ঘরে ঢুকানো হয়েছিল কিভাবে? মিস্ত্রি কি ঘরের ভেতর বসে আলমারি বানিয়েছে?
রুস্তম বলল, দরজা ভেঙে বের করলে কেমন হয়?
আমিন বলল, এটা আমার লাস্ট অপশন।
রুস্তম বলল, আলমারিগুলো ভেঙে ফেললেও হয়। আলমারির তো তেমন প্রয়োজনও নাই। আলমারি ভেঙে পার্ট বাই পার্ট বের করুক।
আমিন বলল, আজকের রাতটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করি, কাল ডিসিশন নেব।
রাতে কোথায় থাকবেন?
নিজের ফ্ল্যাটেই থাকব।
রাতে খাবেন না?
না। আজ রাতটা উপাস দেব। মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ হয়েছে। মেজাজ খারাপের কারণে নিরম্বু উপবাস।
উপাস দিলে কি মেজাজ ঠিক হয়?
হয়।
আমিন উঠে চলে গেল।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুস্তম উপন্যাস নিয়ে বসেছে, তখন হাসিমুখে মুনিয়া উপস্থিত হয়ে বলল, ভালো খবর আছে স্যার। আলমারি তিনটা বের হয়েছে।
কিভাবে বের হলো?
নিচে যে থাকেন, সবসময় সুট-টাই পরা, উনি সব শুনে নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন। কাল দুপুরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভালো তো।
স্যার আপনি উনাকে কখনো ছাড়বেন না। উনি খুবই কাজের মানুষ। আপনার আশপাশে কাজ জানা লোক থাকা দরকার।
আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যাও।
আজকেও কি অনেক রাত পর্যন্ত লিখবেন?
হ্যাঁ। আমি এ উপন্যাসটা একটু অন্যভাবে লিখছি। ধারাবাহিকভাবে লিখছি না। ঘটনাগুলো আলাদা আলাদা করে লিখছি। পরে একত্র করে দেব। কেমন হবে?
খুবই ভালো হবে। ফ্লাস্কে করে চা এনে আপনার টেবিলে রাখব?
না। লেখার সময় আমার চা-কফি কিছু লাগে না।
আমি যদি আপনার পেছনে বসে থাকি, আপনার কি সমস্যা হবে? আমি কোনো শব্দ করব না। নিঃশ্বাসও ফেলব খুব সাবধানে।
শব্দ না করলে বসে থাকো।
স্যার, থ্যাংক ইউ।
ময়ুরী, একটা অদ্ভুত কথা শুনবে?
অবশ্যই শুনব। স্যার আপনি যে কথাই বলেন আমার কাছে এত অদ্ভুত লাগে! অদ্ভুত কথাটা কী?
উপন্যাসের নাম ঝিঁঝি রাখার পর থেকে প্রায়ই আমি মাথার ভেতর ঝিঁঝির ডাক শুনি।
স্যার একটা কথা বলি?
বলো।
উপন্যাসের নাম বদলে পাখি রেখে দেখুন মাথায় পাখির ডাক শোনেন কি না।
নাম চেঞ্জ করা যাবে না। তবে বুদ্ধিটা ভালো। একদম শব্দ করবে না।
চুপ করে বসে থাকো।
মুনিয়া চুপ করে বসে আছে। রুস্তম প্রণাশের মৃত্যু অংশটি লিখছে। উপন্যাস একত্র করার সুবিধার জন্য প্রতিটি অংশের আলাদা শিরোনাম দেওয়া। মূল উপন্যাসে শিরোনাম থাকবে না।
প্রণাশের মৃত্যু
ইলিশ মাছটা এত ফ্রেশ ছিল তা আগে বোঝা যায়নি। সরিষার ঝুঁজটা চোখে-মুখে লাগছে। প্রণাশ বলল, অসাধারণ রান্না হয়েছে খুকি। প্রণাশ যখন খুব আনন্দে থাকে তখন তার স্ত্রীকে খুকি ডাকে।
প্রণাশের স্ত্রী সীতা নাকে-মুখে শাড়ির আঁচল চেপে বসে আছে। ইলিশ মাছের গন্ধ সে সহ্য করতে পারে না। তার বমি আসে।
প্রণাশ বলল, আমরা ইলিশ মাছ খাই তার গন্ধের জন্য। তোমার উচিত, সাহেবদের মতো ভেটকি মাছ খাওয়া। ভেটকি মাছে গন্ধ নাই, কাঁটা নাই, কিছুই নাই। স্বাদ হলো আলুর মতো। বুঝেছ?
সীতা বলল, বুঝেছি।
প্রণাশ বলল, তোমার পুত্র কোথায়?
ঘুমিয়ে পড়েছে।
ইলিশ মাছ খেয়েছিল?
না।
না খেয়ে ঘুমিয়েছে?
হুঁ। বাজার এনেছ দেরিতে। রান্না শেষ করে দেখি ঘুমাচ্ছে।
যাও ডেকে তোলো। পিতা-পুত্র একসঙ্গে ইলিশ মাছ খাব। খাবার সময় আমার মোবাইল ফোনে একটা ছবি তুলে রাখবে।
মোবাইল ফোনে কিভাবে ছবি তুলতে হয় আমি জানি না।
camera option-এ যেতে হবে। যাও ছেলেকে ডেকে আনে।
সীতা অনেক কষ্টে ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে কোলে করে খাবার ঘরে এসে দেখে, প্রণাশ মরে পড়ে আছে।
লেখা বন্ধ করে রুস্তম ভুরু কুঁচকে খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। মুনিয়া বলল, কোনো সমস্যা হয়েছে স্যার?
রুস্তম বলল, হয়েছে।
কী সমস্যা?
মৃত্যুদৃশ্যটা আমার পছন্দ হয়নি। একটা মানুষ একা একা কেন মারা যাবে? মৃত্যুর সময় তার প্রিয়জন কেউ থাকবে না?
থাকা উচিত। স্যার আপনি নতুন করে লিখুন।
তাই করা উচিত। প্রণাশ খাওয়া-দাওয়া শেষ করে খাটে বসে পান চিবুচ্ছে। পাশে তার স্ত্রী। এই সময় মৃত্যু। কেমন হয়?
খুব ভালো হয়।
রুস্তম আবার লেখা শুরু করল।
প্রণাশের মৃত্যু
(version two)
প্রণাশ বলল, সীতা একটা পান খাওয়াতে পারবে? সীতা বলল, ঘরে পান নেই। কোনোদিন পান খাও না, আজ হঠাৎ পান খেতে চাচ্ছ কেন?
পান খেতে ইচ্ছা করছে। তোমার বুয়া তো পান খায়, তার কাছ থেকে একটা পান এনে দাও না।
শুধু পান? না সঙ্গে জর্দাও লাগবে?
খাব যখন ভালো করেই খাব। জর্দা, এলাচ, লবঙ্গ…
মুনিয়া বলল, স্যার আপনাকে ডাকে।
কে ডাকে?
আপনার আর্ট টিচার হোসেন সাহেব।
রুস্তম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, হোসেন দরজার বাইরে পায়চারি করছে। তার জিভ মুখ থেকে বের হয়ে আছে। মনে হচ্ছে রাগ কমানোর চেষ্টায় আছে। রুস্তমের চোখে চোখ পড়া মাত্র হোসেন বলল, আপনার সঙ্গে আমার অত্যন্ত জরুরি কিছু কথা আছে। কাইন্ডলি কাম টু মাই রুম।
একটা জরুরি কাজ করছি। উপন্যাসে হাত দিয়েছি।
খামাখা সময় নষ্ট। উপন্যাসে হাত দিয়ে কিছু হবে না, পা দিয়েও কিছু হবে না। আমার অত্যন্ত জরুরি কথা আছে। come to my room.
হোসেন মিয়ার ঘর সিগারেট এবং গাঁজার ধোয়ায় বিষাক্ত হয়ে আছে। তার্পিনের গন্ধেও বাতাস ভারী। রুস্তম চেয়ারে বসতে বসতে বলল, বলুন আপনার জরুরি কথা।
জরুরি কথা মুনিয়া মেয়েটির প্রসঙ্গে। অতি ফাজিল, অতি বদ একটি মেয়ে। একদিন শুধু সিটিং দিয়েছে। এক ঘণ্টা বসার কথা। ছাব্বিশ মিনিট বসেই বলেছে, এক কাপ চা খেয়ে আসি। তারপর আর তার খোঁজ নাই। আমি শুধু আউট লাইনটা আঁকতে পেরেছি।
ও আচ্ছা।
ও আচ্ছা বললে তো হবে না। আপনাকেই কিছু একটা করতে হবে। আমার নিজের মাথায়ও একটা সুদ্ধি এসেছে। আমি সেটা নিয়েও আপনার সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই। অবশ্যি আপনার সঙ্গে ডিসকাস করা না করা একই। আপনি ভেজিটেবলের কাছাকাছি একজন মানুষ। তারপরও শুনুন, আমি ঠিক করেছি মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলব। বিয়ের পর তো তাকে আমার কথা শুনতে হবে। সিটিং দিতে হবে। এটা কি বুঝতে পারছেন?
পারছি।
বিয়ের পর কিছুদিন আমরা আপনার এখানেই থাকব। অসুবিধা আছে?
না।
বিয়ের খরচ হিসাবে কিছু টাকা আপনাকে দিতে হবে। বেশি না। বিয়ের শাড়ি কিনব। আমার আর্টিস্ট বন্ধুদের পার্টি দেব। হোটেল ভাড়া করে পার্টি না, আপনার বাড়ির ছাদে। আইডিয়া কেমন লাগছে?
ভালো।
যেহেতু ড্রিংকস থাকবে, ফুড তেমন না থাকলেও হবে। ওয়ান আইটেম। মোরগ পোলাও।
আপনার ইতালি যাওয়ার কী হলো?
সব গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, এখন আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। মুনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যাব। যুবতী স্ত্রী ফেলে রেখে যাওয়া আর শুকনা বারুদ ফেলে রাখা একই। যে কোনো সময় দপ করে জ্বলে উঠবে। এখন বলুন আমার আইডিয়া কেমন?
ভালো।
তাহলে মুনিয়াকে আপনি আমার ঘরে পাঠান। আজই সেটল হবে। বিয়ের প্রপোজাল পাওয়ার পর তার আনন্দটা কী রকম হবে ভেবেই ভালো লাগছে। Have not ফ্যামিলির দরিদ্র মেয়ে, ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরবে, ডিসকো ফ্লোরে নাচানাচি করবে, ভাবাই যায় না। আপনি কাইন্ডলি মুনিয়াকে পাঠান। এক্ষুনি পাঠান। শুভস্য শীঘ্রম।
মুনিয়া চুপচাপ বসে আছে। তার চোখে আগ্রহ নেই, কৌতূহলও নেই। হোসেন বলল, তোমাকে কী জন্য ডেকেছি শুনলে আকাশ থেকে পড়বে। প্রথমে তোমার জন্য একটা উপহার। এই মেডেলটা রাখো, তোমাকে দিলাম।
কিসের মেডেল?
রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক। পঞ্চম এশীয় আর্ট একজিবিশনে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম। কী ছবি এঁকেছিলাম শুনতে চাও?
শুনতে চাই না, বলতে চাইলে বলেন।
ছবিটা ছিল গ্রামের একটা এঁদো পুকুরের। চারদিকে জঙ্গল। মাঝখানে টলটলা পানি। পানিতে শাপলা ফুল ফুটেছে। গরুর ধবধবে সাদা একটা বাচ্চা পানি খেতে এসে অবাক হয়ে শাপলা ফুল দেখছে।
ও আচ্ছা।
ছবিটা এখন আছে ডেনমার্কের রাষ্ট্রপতির কাছে। উনি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন।
খারাপ কি?
তোমাকে যে মেডেলটা দিয়েছি তার ওজন দেড় ভরি। বর্তমান টাকায় এর দাম পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। খুশি হয়েছ?
হুঁ।
তোমার মুখ দেখে তো মনে হয় না খুশি হয়েছ। যাই হোক, আমি তোমাকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি। বিয়ের পর আমরা চলে যাব ইতালি। সেখান থেকে ফ্রান্সে।
মুনিয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, আপনি এটা ঠিক করলে তো হবে। আমার নিজেরও ঠিক করতে হবে।
তুমি রাজি না?
অবশ্যই না। এখন যাই।
সবকিছু চিন্তা করে না বহো। হুট করে না বলছ কেন? আমাকে বিয়ে করতে তোমার অসুবিধাটা কী?
দুই দিন পরে আপনি আমাকে দিবেন ছেড়ে। তখন আমি যাব কই?
ছেড়ে দেব কেন?
আমার ঘটনা শুনলে তো ছাড়বেনই।
তোমার আবার স্ত্রী ঘটনা?
রাতে আমি ঘুমাই স্যারের সঙ্গে। এটা শুনলে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন। আছে আপনার এত সাহস?
রাতে তুমি রুস্তম সাহেবের সঙ্গে ঘুমাও?
Yes, আমার কথা বিশ্বাস না হলে স্যারকে জিজ্ঞেস করেন। উনি মিথ্যা বলার মানুষ না।
মুনিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে। হোসেন বলল, মেডেল রেখে যাও। মেডেল নিয়ে যাচ্ছ কেন?
আদর করে আপনি আমারে একটা জিনিস দিয়েছেন, আমি নেব না? কী বলেন আপনি! মুনিয়া ঘর খেকে বের হয়ে গেল।
খাটে পা ঝুলিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে থাকল হোসেন মিয়া।
রুস্তম প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর তৃতীয় ভার্সান লিখছে। তার সমস্ত চিন্তা এবং চেতনা এই মুহূর্তে প্রণাশ বাবুর মৃত্যুতে। আশপাশে কী ঘটছে সে জানে না। মুনিয়া পাটি নিয়ে ঢুকছে। শুয়ে পড়েছে। তার গায়ের শাড়ি আগের মতোই এলোমেলো। রুস্তম এই বিষয়ে কিছুই জানে না।
প্রণাশ বাবুর মৃত্যু
(Third version)
প্রণাশ আট দিন জ্বরে ভুগল। ভাইরাসের জ্বর পাঁচ দিনের বেশি থাকে। তার বেলায় আট দিন। নতুন ধরনের কোনো ভাইরাস হবে।
আজ জ্বর কম। থার্মোমিটার ৯৯, প্রণাশ একটু ভালো বোধ করছে। সে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে। তার হাতে খবরের কাগজ। এই কদিন সে কাগজ পড়েনি। পড়তে ইচ্ছা করেনি। আজও যে খুব ইচ্ছা করছে তা না।
সীতা বলল, শরীরটা কি একটু ভালো লাগছে?
প্রণাশ বলল, হুঁ।
লেবু চা করে দেব, খাবে?
না।
পাকা পেঁপে এনে রেখেছি। কেটে দেই খাও।
না।
জোর করে খাও, শরীরে বল পাবে…
এই পর্যন্ত লিখে রুস্তমকে থামতে হলো। মোবাইল ফোন ক্রমাগত বাজছে। মোবাইল ফোন শিশুদের মতো। শিশুরা কাঁদতে থাকলে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে ইচ্ছা করে। মোবাইল কাঁদতে শুরু করলেও কান্না থামাতে ইচ্ছা করে।
রুস্তম বলল, হ্যালো।
আমিন বললেন, রুস্তম জেগে আছ?
হ্যাঁ।
আমি ভেবেছিলাম ঘুমাচ্ছ। তারপরও টেলিফোন করলাম কারণ আমার উপায় ছিল না।
নতুন কিছু ঘটেছে?
তোমার বোন মালয়েশিয়া থেকে টেলিফোন করেছে। রোমিং ফোন নিয়ে গেছে। দেখেই আমি চিনেছি। আমি বললাম, হ্যালো। সে তার উত্তরে বলল, ঘেউ ঘেউ।
কী বলল?
কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করল।
বলেন কী?
আমি ভাবলাম হয়তো ভুল শুনেছি। আমি আবার বললাম, কে সামিনা! সামিনা বলল, ঘেউ ঘেউ ঘেউ! আগে দুবার ঘেউ বলেছে, এখন বলল তিনবার।
আপনি টেলিফোন রেখে দিয়েছেন?
হ্যাঁ।
আরেকবার করে দেখুন। এমন হতে পারে যে বুবু ঠিকই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। আপনি তাকে অপছন্দ করবেন বলে ঘেউ ঘেউ শুনছেন। ডক্টর রেণুবালা দে হলে তাই বলতেন। মস্তিষ্ক আমাদের তাই শোনায় যা আমরা প্রবলভাবে শুনতে চাই। দুলাভাই রাখি।
রুস্তম প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর তৃতীয় ভার্সান পড়ল। তার পছন্দ হলো না। একটা মানুষ আগেই আধমরা হয়ে আছে। তার মৃত্যু কারও মনে দাগ কাটবে না। জলজ্যান্ত একজন মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মনে দাগ কাটবে। সে চতুর্থ ভার্সান নিয়ে ভাবতে বসল। এই ভার্সনে প্রণাশ বাবু তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্টার সিনেপ্লেক্সে অবতার ছবিটা দেখতে গেছেন। ছেলেকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছেন। তিনি পপকর্ন নিয়েছেন। ছবি শুরু হওয়া মাত্র তিনি স্ত্রীর কানে কানে বললেন, বুকে ব্যথা করছে। সীতা গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি দেখছে বলে স্বামীর কথা শুনতে পেল না।
মোবাইল ফোন আবারও বাজছে। রুস্তম বলল, হ্যালো।
ওপাশ থেকে আমিন বললেন, তোমার কথামতো আবারও টেলিফোন করেছিলাম। সামিনা আবারও বলল ঘেউ ঘেউ। কী করি বলো তো?
রুস্তম বলল, আমি তো কিছু বলতে পারছি না। তবে এমনও হতে পারে যে বুবু কুকুর হয়ে গেছে।
কুকুর হয়ে গেছে! কুকুর হয়ে গেছে মানে?
মানসিকভাবে কুকুর হয়ে গেছে। সে নিজেকে কুকুর ভাবছে। ডক্টর রেণুবালাকে জিজ্ঞেস করে আমি জেনে নেব।
তোমাকে কিছু জানতে হবে না। তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাও।
জি আচ্ছা।
সকাল সকাল উঠবে। তোমাকে নিয়ে ভাই পীরের কাছে যাব। আজ যেভাবেই হোক উনার কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে আসতে হবে। আমি ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখছি। ছটায় ঘুম থেকে উঠে নাশতা খেয়েই রওনা। তোমাকে আমি ডেকে তুলব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
রুস্তম লেখা নিয়ে বসল। স্টার সিনে কমপ্লেক্সে এক গাদা মানুষের মধ্যে প্রণাশের মৃত্যু হওয়া ঠিক হবে না। মৃত্যু হবে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে।
প্রণাশের মৃত্যু
(Final version)
নেত্রকোনা থেকে প্রণাশের বাবা অবিনাশ বাবু এসেছেন। ছেলেকে নিয়ে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন বলেই ঢাকায় আসা। দুঃস্বপ্নটা ভয়ঙ্কর। কালো রঙের একটা কুকুর এসে কামড়ে কামড়ে প্রণাশকে খাচ্ছে। প্রণাশ চিৎকার বা কান্নাকাটি করছে না। প্রণাশ চেয়ারে বসে তার ছেলের হোম ওয়ার্ক দেখছিল। কুকুর তার বাঁ পাটা হাঁটু পর্যন্ত খেয়ে ফেলার পর সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডান পা এগিয়ে দিল।
এই পর্যন্ত লিখেই রুস্তমকে লেখা বন্ধ করতে হলো। কারণ মুনিয়া ফুপিয়ে কাঁদছে। রুস্তম অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে?
স্যার পিঁপড়ায় কামড়াচ্ছে। মেঝে ভর্তি লাল পিঁপড়া।
নিজের ঘরে চলে যাও। ঘরে গিয়ে আরাম করে ঘুমাও।
আমার ঘরে আরও বেশি পিঁপড়া। বিছানাতেও পিঁপড়া।
ভালো সমস্যা হলো তো।
স্যার আমি আপনার খাটের এক কোনায় পড়ে থাকি। আপনার খাটটা অনেক বড়। আপনি টেরও পাবেন না খাটে আর কেউ আছে। স্যার খাটে শোব?
আচ্ছা।
মুনিয়া খাটে উঠে এলো। রুস্তম প্রণাশের মৃত্যুর ফাইনাল ভার্সান লিখতে লাগল।
স্যার একটা কথা বলব?
কাজ করছি মুনিয়া, এখন কথা বন্ধ।
বেশিক্ষণ কথা বলব না। এক মিনিট। আপনাকে যে শিল্পকটা দিয়েছিলাম ভাঙাতে পারেন নাই। তাই না?
কোন শিল্লুক?
ঐ যে, আমি থাকি জলে আর তুমি থাকো স্থলে…।
না।
সহজ দেখে একটা দেব স্যার। শিল্লুকটা ভাঙালেই আপনি জানতে পারবেন আমি কাকে বিয়ে করেছি।
মুনিয়া শোনো, আমার জানতে ইচ্ছা করছে না। গোপন বিষয় গোপন থাকা ভালো।
স্যার আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছে। তাহলে বলল।
বাতি জ্বালা থাকা অবস্থায় আমি বলতে পারব না স্যার। আমার লজ্জা লাগবে। আপনি বাতিটা নেভান আমি বলছি।
তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি লেখা শেষ করে বাতি নেভাব তারপর বলবে।
জি আচ্ছা। আমি জেগে থাকব।
একটা শব্দ করতে পারবে না। খুব মন দিয়ে লিখি তো, সামান্য শব্দতেও কনসানট্রেশান এলোমেলো হয়ে যায়।
আমি কোনো শব্দ করব না। নিঃশ্বাসও ফেলব সাবধানে। আপনি বললে নিঃশ্বাসও ফেলব না।
রাত তিনটায় রুস্তম লেখার টেবিল থেকে উঠল। অপেক্ষা করতে করতে মুনিয়া ঘুমিয়ে গেছে। রুস্তম দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেল। রেণুবালা বলে দিয়েছেন ওষুধ খাবার আধঘণ্টা পর বিছানায় যেতে। আধঘণ্টা চুপচাপ অপেক্ষা করা।
বাথরুমের বেসিনে শব্দ হচ্ছে। রুস্তম বলল, কে?
বাথরুম থেকে গম্ভীর গলায় জবাব এলো, জনাব আমি।
আপনি কে?
আমি হাজি আসমত উল্লাহ। আপনার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলাম।
এখানে কি করেন?
অজু করছি জনাব। অজু করে তাহজুতের নামাজ পড়ব।
রুস্তম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আধঘণ্টা অপেক্ষা না করে তার উচিত এখনই বিছানায় যাওয়া।
তুমি কি আমাকে চিনেছ
তুমি কি আমাকে চিনেছ?
চিনব না কেন? তোমার নাম দিনা। তোমার আসল নাম মদিনা। নামটা তোমার কাছে পুরনো মনে হওয়ায় ম কেটে ফেলে দিনা হয়েছ। তোমার লম্বা চুল ছিল। চুল কেটে ছেলে সাজার চেষ্টা করছ।
কথাবার্তা তো খুবই গুছিয়ে বলছ। ব্যাপার কী? তবে তোমাকে দেখে কিন্তু পাগল পাগল লাগছে। আমি শুনেছি, যারা পাগল তাদের গা থেকে Ray বের হয়। যার গায়ে এই Ray বেশি পড়ে সেও পাগল হয়ে যায়।
কথা হচ্ছে দিনার সঙ্গে রুস্তমের। দিনা গোলাম মওলার একমাত্র মেয়ে। তার নিজের কিছু ব্যবসা আছে। জাপান থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি এনে বিক্রি করে। মতিঝিলে তার গাড়ির শোরুম আছে, দিনা মোটরস। ইতালি থেকে সে এলসি খুলে রঙ আনে। দেশ থেকে রফতানি করে সামুদ্রিক মাছের শুটকি এবং শৈবাল। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে এ দেশের বড় ধনীদের একজন।
দিনার গায়ের রঙ কালো। কালো রঙ তার সঙ্গে খুব মানিয়ে গেছে। দিনার চোখ-মুখ বুদ্ধিতে ঝলমল করছে।
দিনা একসময় রুস্তমের স্ত্রী ছিল। সাজ্জাদ আলী এবং তার পার্টনার গোলাম মওলার এই বিয়েতে কোনো মত ছিল না। বিয়ে হয়েছিল রুস্তমের মা আসমার একক আগ্রহ এবং চেষ্টায়। দিনার একটি ছেলে আছে, তার নাম না। দিনার দি ফেলে দিয়ে না।
দিনা কখনোই তার ছেলেকে বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। দিনা নিশ্চিত, ছেলেকে বাবার সঙ্গে মিশতে দিলে ছেলেও বাবার মতো হয়ে যাবে।
দিনা বলল, আমি তোমার কাছে বিশেষ জরুরি কাজে এসেছি। কাজ শেষ করে চলে যাব।
কাজটা কী?
আমার বাবা কোথায়?
তোমার বাবা কোথায় তা তো আমি জানি না। তবে উনার লাঠিটা আমার কাছে। যে লাঠিটা তুমি বালি থেকে উনাকে কিনে দিয়েছ।
দিনা বলল, বালি থেকে আমি তাকে কোন দুঃখে লাঠি কিনে দেব? আমি জীবনে কখনো ইন্দোনেশিয়া যাইনি। বাবা বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। বাবা কখনোই সত্যি কথা বলে না। সত্যি কথা বলাটাকে বাবা শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করে।
উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না?
না। শেষবার বাবা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তুমি তাকে একটা কবিতার বই দিয়েছিলে। গাড়ি পাওয়া গেছে সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে। বাবাও নেই, ড্রাইভারও নেই।
রুস্তম বলল, মনে হয় ইন্ডিয়া চলে গেছেন। কোনো ঝামেলা হলেই উনি ইন্ডিয়া চলে যান।
দিনা বলল, আমার ধারণা বাবা র্যাবের হাতে কিংবা CID পুলিশের হাতে আছে। ওরা কোনো ইনফরমেশন রিলিজ করছে না। ইনফরমেশন রিলিজ না করলে মেরে ফেলতে ওদের সুবিধা হবে। তুমি কি এক কাপ চা খাওয়াবে? নাকি পাগলরা অতিথিদের চা খেতে বলে না?
রুস্তম নিজে উঠে গিয়ে চায়ের কথা বলে এলো। দিনা বলল, একটা মেয়েকে দেখলাম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সে কে?
ওর নাম মুনিয়া।
মেয়েটার যে একটা নাম আছে তা তো বুঝতেই পারছি। নাম ছাড়া মানুষ নেই। মেয়েটা কে? এখানে করে কী?
কিছু করে না। সেজেগুজে হাঁটাহাঁটি করে।
তোমার যৌনসঙ্গী?
রুস্তম কিছু বলল না। আহত চোখে তাকিয়ে রইল। দিনা বলল, সরি। মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। তুমি এই নেচারের না, তা আমি জানি। ভালো কথা, তোমার কবিতার বইটা আমি মন দিয়ে পড়েছি।
ধন্যবাদ।
আমি এসেছি কবিতার বইটা নিয়ে কথা বলতে। বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে–এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। Everybody is paid back by his own coin. বাবা তার নিজের পয়সার হিসাব দিবে। এটাই স্বাভাবিক। ড্রাইভারটার জন্য খারাপ লাগছে। সে নিতান্তই ভালো মানুষ। বাবার কারণে কোনো এঁদো ড়ুবায় মরে পড়ে থাকবে।
রুস্তম বলল, তুমি চায়ের কাপ সামনে নিয়ে বসে আছ। চুমুক দিচ্ছ all
তোমার পুরনো বাবুর্চি মরিয়ম এখনো আছে?
হুঁ।
আমি এসেছি তারপরেও একবার দেখা করতে এলো না!
সে রান্নাঘর ছাড়া কোথাও যায় না।
পাগলের বাড়িতে সবাই কি পাগল হয়ে যায়?
রুস্তম ছোট নিঃশ্বাস ফেলল।
দিনা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমার মতো এমন অসুস্থ একজন মানুষ চমৎকার সব কবিতা লিখবে ভাবাই যায় না। তুমি তোমার ছেলের সম্পর্কে তো কিছু জিজ্ঞেস করলে না?
রুস্তম বলল, ওকে তো তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না, কাজেই ব্রেইন থেকে তাকে আমি অফ করে রেখেছি।
অফ করে রেখেছি মানে কী?
ব্রেইনের যে অংশে ওর প্রতি ভালোবাসা-মমতা এইসব নিয়ে কাজ করে সেটা বন্ধ রেখেছি।
এটা কি সম্ভব?
সবার জন্য সম্ভব না। আমার জন্য সম্ভব।
তোমার ছেলে প্রতি ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে ক্লাস ফোরে উঠেছে। শঙ্কর শিশুচিত্র প্রতিযোগিতার নাম শুনেছ?
না।
শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। সেখানে সে ছবি পাঠিয়েছিল। গোল্ড মেডেল পেয়েছে। দিল্লিতে পুরস্কার দেবে, আমি ওকে নিয়ে যাব।
আমার একজন আর্ট টিটার আছেন। তিনিও গোল্ড মেডেল পাওয়া। রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক।
তুমি ছবি আঁকা শিখছ?
এখনো সেই অর্থে আঁকা শিখিনি। রঙ ঘষাঘষি করছি। ছবি আঁকার জন্য রঙ ঘষাঘষি শেখা খুবই জরুরি।
তুমি কি তোমার ছেলের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চাও?
না।
না কেন?
কিছু সময় কাটালে আরও বেশি সময় কাটাতে ইচ্ছা করবে। মন খারাপ হবে। ডাক্তার রেণুবালা বলেছেন, মন খারাপ হয় এমন কিছুই যেন আমি না করি। আমাকে সবসময় আনন্দের মধ্যে থাকতে হবে। আনন্দ খুঁজে বেড়াতে হবে।
তোমার ছেলেকে স্কুল থেকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে, এক শ শব্দ দিয়ে একটা রচনা লিখতে হবে–My Father. সে লিখেছে–
My father is a mad person.
I dont know anything about him.
রুস্তম বলল, সে তো সত্যি কথাই লিখেছে।
দিনা বলল, হ্যাঁ, সত্যি কথা। তবে তুমি এখন অনেক সুস্থ। প্রায় নরমাল।
রুস্তম বলল, একটু দাঁড়াও। আমি তোমার বাবার লাঠিটা এনে দিচ্ছি। লাঠি নিয়ে যাও। তবে লাঠির বিষয়ে সাবধান।
লাঠির বিষয়ে সাবধান মানে?
লাঠিটা মেঝেতে পড়লে সাপ হক্সে যায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
দিনা বলল, তোমার অসুখ মোটেই সারেনি। বরং খানিকটা বেড়েছে। আমি ভেবেছিলাম, তোমার ছেলেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য পাঠাব। এখন মনে হচ্ছে পাঠানো ঠিক হবে না।
তাহলে পাঠিও না।
দিনা অনাগ্রহের সঙ্গে লাঠি হাতে নিল। বিরক্ত মুখে বলল, আমি অনেকক্ষণ হলো মুনিয়া মেয়েটার কাণ্ডকারখানা দেখছি। আশে সবুজ শাড়ি পরা ছিল। এখন লাল শাড়ি পরে ঘুরঘুর করছে। ঠোঁটে কুচকুচে কালো লিপস্টিক। মেয়েটার মধ্যে প্রস্টিটিউট ভাব আছে।
প্রস্টিটিউট ভাবটা কী?
তুমি বুঝবে না। তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করাও পণ্ডশ্রম। তুমি যত দ্রুত পার মেয়েটাকে বিদায় করো। সম্ভব হলে আজই।
আচ্ছা।
আই রিয়েলি ফিল সরি ফর ইউ।
আমাকে নিয়ে সরি ফিল করার কিছু নাই। আমি ভালো আছি। একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছি। সারাক্ষণ উপন্যাস নিয়েই ভাবছি। উপন্যাসের নাম দিয়েছি ঝিঁঝি। রেণুবালা ঝিঁঝি নামটা খুব পছন্দ করেছেন।
রেণুবালাটা আবার কে?
আমার ডাক্তার। উনিও তোমার মতো আমার কবিতার বইয়ের সবগুলো কবিতা পড়েছেন। তার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে অন্ধ উইপোকা কবিতাটা।
তুমি তাহলে সুখেই আছ?
হ্যাঁ।
আমাকে মিস করো?
না।
ভেরি গুড। অদ্ভুত কারণে আমি তোমাকে মিস করি। হঠাৎ রাতে ঘুম ভাঙলে মনে হয়, মানুষটা পাশে থাকলে ভালো হতো, কিছুক্ষণ গল্প করতাম।
দিনা চলে যাওয়ার পরপর মুনিয়া রুস্তমের ঘরে ঢুকল। কালো লিপস্টিকে মেয়েটাকে ভয়ঙ্কর লাগছে। বাজারে কালো লিপস্টিক পাওয়া যায়–এটাই রুস্তম জানত না।
মুনিয়া বলল, এসেছিলেন যে উনি কে?
ওর নাম দিনা। তার একটা ছেলে আছে, ক্লাস ফোরে পড়ে। ছেলের নাম অদ্ভুত। তার নাম হলো না।
আপনার কে হয়?
এখন আমার কেউ না। একসময় আমার স্ত্রী ছিল। আমি পুরোপুরি পাগল হওয়ার পর সে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে।
ছেলেটা আপনার?
হ্যাঁ।
উনি কি আবার বিয়ে করেছেন?
তা তো জানি না। জিজ্ঞেস করিনি।
আপনার কাছে কেন এসেছেন?
তার বাবার খোঁজ নিতে এসেছে। সে আসায় একটা খুব ভালো কাজ হয়েছে।
ভালো কাজটা কী?
লাঠির হাত থেকে বাঁচলাম। তোমার চোখে পানি কী জন্য?
স্যার, আমার খুব খারাপ লাগছে এই জন্য চোখে পানি। ইচ্ছা করছে একটা চলন্ত ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি।
তোমার প্রায়ই চলন্ত ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে ইচ্ছা করেএটা ভালো কথা না। নেক্সট টাইম আমি ডাক্তার রেণুবালার সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করব।
আপনার যা ইচ্ছা করেন। আমি অবশ্যই চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ব। যদি না পড়ি আমার নাম মুনিয়া না।
দুপুরের দিকে আমিন বিধ্বস্ত চেহারা এবং দুটি সুটকেস নিয়ে উপস্থিত হলো। তার ঘর সুন্দর করে গোছানো–এ বিষয়টি নিয়ে মোটেই উচ্ছাস দেখাল না।
দুপুরে ভাত খেতে খাবারের টেবিলে এলো না। তার ঘর থেকে চাপা কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল।
আমিন ঘর থেকে বের হলো সন্ধ্যাবেলায়। মাগরিবের নামাজ পড়ে দুটি বিস্কিট এবং একটা চা খেল।
রুস্তম বলল, আপনাকে দেখেই খুব অসুস্থ লাগছে।
আমিন বলল, দিনের মধ্যে দশ-বারোবার আমার স্ত্রী আমাকে টেলিফোন করে। আমি হ্যালো বলতেই সে বলে ঘেউ ঘেউ। আমি অসুস্থ হবো না?
ডাক্তার রেণুবালার কাছে কি যাবেন?
উনার কাছে আমি যাব কোন দুঃখে? আমি তো টেলিফোনে ঘেউ ঘেউ করি না। যে ঘেউ ঘেউ করে সে যাবে।
তাও ঠিক।
তোমার বাড়িতে আমি কিছু মৌলিক পরিবর্তন করব। এক্সট্রাতে বাড়িভর্তি, এদের ঝেটিয়ে বিদায় করব।
কখন?
কাল দুপুরের মধ্যে দেখবে সব ক্লিয়ার। তোমার কোনো সমস্যা নাই তো?
জি না। তবে মুনিয়া মেয়েটাকে কঠিন কোনো কথা বলবেন না। কঠিন কথা বললে সে চলন্ত ট্রাকের সামনে লাফ দিয়ে পড়বে।
পড়লে পড়বে। বদমেয়েটা ঠোঁটে চায়নিজ ইংক মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন?
চায়নিজ ইংক না। লিপস্টিক। দুলাভাই আজ আমার ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, তবে আমি একা যাব। আপনাকে নেব না।
আমাকে নেবে না কেন?
ডাক্তার বলেছেন আমাকে একা যেতে।
এই ডাক্তার বদলাতে হবে। চিকিৎসার নাম নাই, শুধু থিওরি কপচায়। ফাজিল মেয়ে।
রুস্তম বলল, বুবুর ওপর রাগটা আপনি সবার ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছেনএটা ঠিক না। এটা ভুল।
আমাকে ভুল-শুদ্ধ শেখাবে না।
জি আচ্ছা।
আমিনের টেলিফোন বাজছে। আমিন নাম্বারের দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে আছেন, টেলিফোন ধরছেন না। টেলিফোন করেছে সামিনা।
রুস্তম।
জি দুলাভাই।
তোমার এই বোন আমাকে পাগল বানানোর চেষ্টা করছে।
টেলিফোন ধরবেন না?
ধরে কতক্ষণ থাকব? সে তো টেলিফোন করতেই থাকবে। করতেই থাকবে।
ফোন সেটটা ধানমণ্ডির লেকে ফেলে দিন। বিষয়টা পুরোপুরি অফ হয়ে যাক।
পুরোপুরি অফ করার জন্য লাখ টাকা দামের আইফোন পানিতে ফেলতে হবে কেন? সুইচ বন্ধ রাখলেই হয়।
সুইচ বন্ধ করলেই পুরোপুরি অফ হবে না। আপনি জানবেন বোতাম চাপ দিলেই অন হবে।
আমিন টেলিফোন নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
ডাক্তার রেণুবালা বললেন, সব কি ঠিকঠাক?
রুস্তম হাসল।
লাঠি সমস্যার সমাধান হয়েছে?
হয়েছে। যেখানকার লাঠি সেখানে চলে গেছে।
ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছেন?
জি।
উপন্যাস এগোচ্ছে?
জি।
পরেরবার যখন আসবেন যতটুকু লিখেছেন নিয়ে আসবেন, আমি পড়ব।
জি আচ্ছা।
আমাকে বলার মতো strange ঘটনা কি ঘটেছে?
আমার জীবনে ঘটেনি, আমার দুলাভাইয়ের জীবনে ঘটেছে। বলব?
আপনার বলতে ইচ্ছা করছে অবশ্যই বলবেন।
দুলাভাইয়ের স্ত্রী, অর্থাৎ আমার বুবু দুলাভাইকে ছেড়ে তার বন্ধুর সঙ্গে মালয়েশিয়া চলে গেছে। দুলাভাইয়ের গায়ের ঘামের গন্ধ পছন্দ না বলে বুবু চলে গেছেন।
এটা তো strange কোনো ঘটনা না। এটা দুঃখজনক ঘটনা। দুঃখজনক ঘটনা, আনন্দজনক ঘটনা, অদ্ভুত ঘটনা, এর মধ্যে আপনাকেই পার্থক্য করতে হবে।
রুস্তম বলল, আমার বুবুর অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো সে দিন-রাত দশ থেকে বারোবার দুলাভাইকে টেলিফোন করে। দুলাভাই টেলিফোন ধরলেই বুবু বলেন, ঘেউ ঘেউ।
কী বলেন?
কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ শব্দ করেন।
Oh God.
রুস্তম বলল, আমি এ ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। আমার ব্যাখ্যাটা শুনবেন?
শুনব।
বুবু দুলাভাইকে অত্যন্ত পছন্দ করেন বলেই বারবার টেলিফোন করেন। ঘেউ ঘেউ শব্দ করে দুলাভাইকে বিরক্ত করার জন্য। দুলাভাই যদি মালয়েশিয়া উপস্থিত হন তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আপনার যুক্তি আমি গ্রহণ করছি। ভালো যুক্তি দিয়েছেন।
রুস্তম বলল, আমি যে আনন্দজনক ঘটনা, দুঃখের ঘটনা কিংবা অদ্ভুত ঘটনা আলাদা করতে পারি না, তাও ঠিক না। আমার জীবনে আজ একটা দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে। বলব?
অবশ্যই বলবেন।
আমার একটা ছেলে আছে, তার নাম না। সে ক্লাস ফোরে পড়ে। স্কুল থেকে তাকে তার বাবার ওপর এক শ শব্দের একটা রচনা লিখতে দেওয়া হলো। সে দুলাইনেই রচনা শেষ করেছে। সে লিখেছে—
My father is a mad person.
I dont know anything about him.
আপনার একটা ছেলে আছে, এটাই তো জানতাম না। আপনি বলেননি কেন?
আপনি আমাকে বলেছেন সবসময় আনন্দে থাকতে–এই জন্য ছেলের কথা মনে করি না। কাউকে বলিও না।
আমি আপনার ডাক্তার। আমাকে সবকিছু বলতে হবে। আপনার স্ত্রীর কথা বলুন।
ওর নাম দিনা। একসময় আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লাম, তখন সে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে ছেলে নিয়ে চলে গেল। ভালোই করেছে। দিনা খুব বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে। তার ছেলেটার বুদ্ধি মায়ের মতো হয়েছে কি না কে জানে!
রু আদে সাহেব চা খাবেন?
না। আমি চা খাই না।
খান না তাতে কী? আজ চা খাবেন। আপনাকে সামাজিক হতে হবে। একসঙ্গে চা খাওয়া একটা Social event. আসুন দুজন মিলে চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প করি।
আচ্ছা।
আপনি কি দস্তয়েভস্কির ইডিয়ট উপন্যাসটা পড়েছেন?
না।
ওই উপন্যাসে প্রিন্স মিশকিন নামে একটি চরিত্র আছে। চরিত্রটার সঙ্গে আপনার মিল আছে। প্রিন্স মিশকিন ছিলেন একজন শুদ্ধতম মানুষ। তিনিও আপনার মতো অসুস্থ ছিলেন। উপন্যাসটা দেব? পড়বেন?
না, উপন্যাস পড়তে আমার ভালো লাগে না।
উপন্যাস পড়তে আপনার ভালো লাগে না, অথচ আপনি নিজেই উপন্যাস লিখছেন? ব্যাপারটা কন্ট্রাডিক্টারি না?
জি।
তাতে সমস্যা কিছু নাই। মানুষ মানেই কন্ট্রাডিকশন।
রুস্তম বলল, আপনাকে একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। ভুলে গেছি বলে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এখন মনে পড়েছে।
চা আসুক। চায়ে চুমুক দিতে দিতে জরুরি কথাটা বলবেন।
চা আসতে আসতে ভুলে যেতে পারি। এখনই বলি?
বলুন।
আমার বাড়িতে মুনিয়া বলে একটা মেয়ে থাকে। রাগ করলেই সে বলে, আমি ঝাপ দিয়ে চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ে যাব। চলন্ত ট্রাকের নিচে ঝাপিয়ে পড়া তার পক্ষে কি সম্ভব?
রেণুবালা বললেন, বারবার যদি বলে, তাহলে সম্ভব। একটা কথা বারবার বললে Inhibition কেটে যায়। যারা আত্মহত্যা করে, তারা কিন্তু বারবার মৃত্যুর কথা বলে। এক সময় মৃত্যুবিষয়ক Inhibition কেটে যায়।
তখন ফ্যানে শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে, কিংবা ঘুমের ওষুধ খায়।
চা চলে এসেছে। রুস্তম আগ্রহ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। রেণুবালা বলল, আপনি কি গান শোনেন?
না।
মাঝে মধ্যে গান শুনবেন। মোঞ্জার্টের মিউজিক আপনার ভালো লাগবে বলে আমার ধারণা। মোঞ্জার্ট মানসিক রোগী ছিলেন। প্রায়ই তিনি অদ্ভুত সব জিনিস দেখতেন, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই।
বৃষ্টি হচ্ছিল। রিকশার হুড তুলেও বৃষ্টি পুরোপুরি আটকানো গেল না। রুস্তম বাড়ি ফিরল কাকভেজা হয়ে। বাড়িতে নানান ঝামেলা। হৈচৈ হচ্ছে, চিৎকার হচ্ছে। আমিন দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার সিঁড়ির কাছে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। রুস্তম বলল, কী হয়েছে?
আমিন বললেন, আর্টিস্টের বাচ্চাকে গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করেছি। যেতে চায় না। বলে কী, বৃষ্টির মধ্যে কিভাবে যাবে?
আমি বললাম, ভিজতে ভিজতে যাবি।
তারপরেও তর্ক করে। বলে কী আমার টনসিলের ধাত। বৃষ্টিতে ভিজলে টনসিল পেকে যাবে।
আমি বললাম, তখন পাকা টনসিল নিয়ে ঘুরবি।
রুস্তম বলল, দুলাভাই আপনি শান্ত হন। আপনাকে খুবই অস্থির লাগছে। আপনার হাত-পা কাঁপছে। সবাইকে তুই তুই করে বলছেন এটাও তো ঠিক না।
আমিন বললেন, আমি সন্ধ্যাবেলায় আর্টিস্টের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। গাঁজার বিকট গন্ধে থমকে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, কী খাচ্ছেন?
আর্টিস্টের বাচ্চা বলল, গাঁজা খাচ্ছি আর বোতল খাচ্ছি। স্যার আমার সঙ্গে বোতল খাবেন? কত বড় দুঃসাহস চিন্তা করেছ? ওই বদ মেয়েটাকেও বিদায় করেছি।
কার কথা বলছেন, মুনিয়া?
হা। উল্টাপাল্টা কথা চারদিকে বলে বেড়াচ্ছে। রাতে নাকি তোমার সঙ্গে ঘুমায়। ইচ্ছা করছিল চড় দিয়ে চাপার কয়েকটা দাঁত ফেলে দেই। মেয়ে মানুষ বলে সেটা সম্ভব হয়নি। আমি বললাম, এই তোর দেশের বাড়ি কোথায়?
সে বলল, যশোর।
আমি ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি বের করে একে যশোরের নাইটকোচে তুলে দিয়ে আসো।
মেয়ের সে কী ফড়ফড়ানি। বলে কী, স্যার আমি কিন্তু চলন্ত ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ব।
আমি বললাম, চলন্ত ট্রাক, চলন্ত বাস, চলন্ত বেবিট্যাক্সি যার সামানে পড়তে ইচ্ছা করে পড়বি। আমার কোনো সমস্যা নাই।
রুস্তম বলল, মুনিয়া চলে গেছে?
আমিন বললেন, ড্রাইভার যশোরের টিকিট কেটে তাকে নাইটকোচে তুলে দিয়ে এসেছে। বদ মেয়েছেলে!
রুস্তম বলল, দুলাভাই আপনি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার শরীর কাঁপছে। যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যাবেন। আপনি রাগটা কমান। জিভ বের করে কিছুক্ষণ ফ্যানের নিচে বসুন।
আমিন বললেন, তুমি আমার ঘরে আসো। তোমার বুবু আমাকে এখন একটা sms পাঠিয়েছে। এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা, তোমার বুবুও তোমার পথ ধরেছে। ব্রেইন গন উইথ দ্য উইন্ড।
আমিনের sms-এ লেখা–
The baby is now about 12.5 cm or 4.92 inches. He/she is now producing urine and actually urinating into the amniotic fluid. At this week your baby is regular wiggler but because of his/her small size you probably wont feel it.
আমিন বললেন, এর মনে কী?
রুস্তম বলল, এর মানে বুবুর বাচ্চা হবে। বাচ্চাটা সম্পর্কে কথাবার্তা লেখা।
বলো কী?
আপনার উচিত এক্ষুনি বুবুর কাছে যাওয়া।
এক্ষুনি যাব কিভাবে? ভিসার ব্যাপার আছে না? ও আচ্ছা আচ্ছা, ভিসা তো করানো আছে। তোমার বুবুর ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে দুজন মালয়েশিয়ার ভিসা করিয়েছিলাম। সে বলেছে, আমাকে খুব ভালো একটা খবর বিদেশে গিয়ে দেবে। ব্যবসার একটা ঝামেলায় পড়ে বললাম, এই বছর যাওয়া সম্ভব না। সে আরেকজনকে নিয়ে চলে গেল। এখন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলছে। টেলিফোনে ঘেউ ঘেউ কেন করছে, এটা বুঝতে পারছি opti
আপনাকে বিরক্ত করছে আর কিছু না।
আফতাব হারামজাদাটা তো মনে হয় এখনো ঝুলে আছে।
ঝুলে থাকতে পারে, তবে দুলাভাই আপনি নিশ্চিত থাকেন বুবু তাকে কাছে ঘেঁষতে দেবে না।
আমিন বললেন, এখন তুমি সামনে থেকে যাও। আমি ঠাণ্ডা মাথায় কিছুক্ষণ চিন্তা করি। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। আর্টিস্টের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। সে নিজের ঘরে বসে কী খাচ্ছে, না খাচ্ছে এটা তার ব্যাপার। আমাকে দ্রতা করে খেতে বলেছে। এটা অন্যায় কিছু না, বরং এটাই শোভন। মুনিয়া মেয়েটাকেও জোর করে নাইট কোচে তুলে দেওয়া অন্যায় হয়েছে। আমার মাথায় রাখা উচিত ছিল, সে একটা মেয়েমানুষ। I am such a fool.
বৃষ্টি বেড়েছে। জানালার পর্দা উড়ছে। বৃষ্টির ছাট আসছে। রুস্তম লেখার টেবিলে মোমবাতি এবং দেয়াশলাই নিয়ে বসেছে। ঢাকা শহরে রাতে বৃষ্টি নামলেই ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। রুস্তমের লেখালেখি করতে ইচ্ছে করছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন তাকে সবসময় আনন্দে থাকতে হবে। আনন্দের অনুসন্ধান করতে হবে। তার মধ্যে এ মুহূর্তে আনন্দের ঘাটতি আছে। আর্টিস্ট চলে গেছে তাতে রুস্তমের তেমন খারাপ লাগছে না। হোসেন মিয়া কখন থাকত, কখন থাকত না তা বোঝা যেত না।
মুনিয়া চলে গেছে সেটাও খারাপ লাগছে না। এটা মুনিয়ার বাড়ি না। একসময় তাকে চলে যেতেই হবে। খারাপ লাগছে মেয়েটা সত্যি সত্যি যদি ট্রাকের নিচে পড়ে! এই সম্ভাবনা আছে। ডাক্তার বলেছেন।
রুস্তম কারেন্ট চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আজকের লেখালেখি হবে মোমবাতির আলোয়। প্রণাশের মৃত্যুর আরেকটা ভার্সন লেখা হবে। এই ভার্সানে প্রণাশ মারা যাবে চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়ে। সে তার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বের হয়েছিল। চিড়িয়াখানায় যাবে, জীবজন্তু দেখবে। রিকশার সন্ধানে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তার ওপাশে একটা রিকশা দেখা গেল। এই রিকশা, যাবে বলে প্রণাশ এগিয়ে যেতেই একটা ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গেল।
স্যার, ঘুমাবেন না?
রুস্তম চমকে তাকাল। মুনিয়া আগের মতোই তার বিছানার পাশে পাটি পেতে শুয়ে আছে। তার গায়ের শাড়িও আগের মতোই এলোমেলো।
তুমি যশোর যাওনি?
মুনিয়া উঠে বসে মাথার চুল বাঁধা শুরু করল। জবাব দিল না।
আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ। এখন তমাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে।
মুনিয়া বলল, আজ সারাদিন আপনার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। শুয়ে পড়েন।
প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর অংশটা লিখে শুয়ে পড়ব। আমি ঠিক করেছি উনি মারা যাবেন ট্রাকে চাপা পড়ে।
মুনিয়া শুতে শুতে বলল, আহা বেচারা!
রুস্তম বলল, শাড়ি ঠিকঠাক করে ঘুমাও।
মুনিয়া শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, সরি।
রুস্তম বলল, তুমি ঠোঁটে কালো লিপস্টিক দিও না। কালো লিপস্টিকে তোমাকে কুৎসিত লাগে।
মুনিয়া বলল, আর দেব না স্যার।
রুস্তম অবাক হয়ে দেখল, মুনিয়ার ঠোঁটে কালো লিপস্টিক নেই। তার ঠোঁটে এখন হালকা গোলাপি আভা। রুস্তম দরজার দিকে তাকাল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এর একটাই অর্থ, মুনিয়া নেই। সে মুনিয়াকে কল্পনা করছে। সে সাধারণ মানুষ না। একজন অসুস্থ মানুষ বলেই কল্পনাটাকে বাস্তব মনে হচ্ছে।
মুনিয়া!
মুনিয়া পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, আমাকে মুনিয়া ডাকবেন না। আমাকে ডাকবেন ময়ূরী।
ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। রুস্তম মোমবাতি জ্বালিয়ে খাতা খুলল। তার কাছে খুবই ভালো লাগছে যে, মুনিয়া কাছেই শুয়ে আছে।
ময়ূরী।
জি স্যার।
একটু কাছে আসো তো।
ময়ূরী সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলো। রুস্তম বলল, কিছুক্ষণের জন্য তোমার হাতটা ধরব।
রুস্তম ময়ূরীর হাত ধরেছে। হাত ধরে রাখতে কোনো সমস্যা হচ্ছে। কল্পনার মেয়ের হাত ধরা যায় না। কিন্তু সে তো হাত ধরতে পারছে।
রুস্তম বলল, আমার বোন সামিনার বাচ্চা হবে।
বলেন কি! ছেলে না মেয়ে?
ছেলে না মেয়ে জানায়নি। আমার ধারণা যমজ মেয়ে হবে।
স্যার জানেন যমজ বাচ্চার আমারও খুব শখ।
যমজ বাচ্চা মানুষ করা কঠিন আছে। তোমার স্বামীকে সাহায্য করতে হবে। ভালো কথা! তোমার স্বামীর নামটা তো জানা হলো না।
জেনে কি হবে স্যার?
তাও ঠিক, জেনে কি হবে!
ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। মোমবাতির শিখা কাপছে। যে কোনো সময় নিভে যাবে।
রুস্তম বলল, মুনিয়া! তুমি ভালো মেয়ে।
স্যার আমি জানি।
আমার দুলাভাইও কিন্তু ভালো মানুষ। দুঃখে ধান্ধায় ব্রেইন নষ্ট হয়ে গেছে।
আহা বেচারা!
ঝাপটা বাতাসে মোমবাতি নিভে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। মুনিয়া বলল, আপনি ভয় পাবেন না স্যার। আমি আপনার কাছেই আছি।
আমি জানি তুমি কাছে আছ। আগে আমি অন্ধকার ভয় পেতাম এখন পাই না।
অন্ধকার ভয় পেতেন কেন স্যার?
এটা খুবই লজ্জার কথা। আমি কাউকে বলিনি। ডাক্তার রেণুবালাকেও বলিনি। লজ্জার কথা বলে বেড়াতে হয় না।
বলতে ইচ্ছা না করলে বলতে হবে না।
তোমাকে বলতে সমস্যা নেই। কারণ তুমি কেউ না।
স্যার এটা কি বললেন? আমি ময়ূরী।
আমি ময়ূরী ভাবছি বলেই তুমি ময়ূরী। আমি যদি ভাবি তুমি দিনা তাহলেই তুমি দিনা হয়ে যাবে।
আপনার স্ত্রী দিনা?
হুঁ।
যার ভালো নাম মদিনা?
হুঁ। ম কেটে সে হয়েছে দিনা।
আমিও আমার নামের ম কেটে ফেলে দেব। আমি হয়ে যাব ময়ূরী।
বাহ্! তোমার তো অনেক বুদ্ধি।
হুঁ।
উনাকে আমি কি ডাকব?
তাকে তোমার কিছু ডাকতে হবে না। তার সঙ্গে তোমার কখনো দেখা হবে না।
আপনি চাইলেই হবে। আপনার দুপাশে আমরা দুজন বসে থাকব।
রুস্তম বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। আর তখনই কারেন্ট চলে এলো। ঘরে ঝলমলে উজ্জ্বল আলো। ময়ূরী কোথাও নেই।
রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে
রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে। ঘণ্টাখানিক সাইকেলে চক্কর দেবে। সাইকেলে চক্কর দেওয়া মানে ব্যালেন্স রাখা। ব্রেইন ব্যস্ত থাকে ব্যালেন্স রাখতে। কাজেই সে আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়ার সময় পায় না। সাইকেলে উঠলে হাওয়ায় ভেসে থাকার অনুভূতি হয়, সেটাও খারাপ না। মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণী কি হাওয়ায় ভাসার কল্পনা করে? একটা কুকুর বা একটা ভেড়া কি অবসর সময়ে কখনো ভাবে, সে হাওয়ায় উড়ছে?
সাইকেল চালিয়ে রুস্তম ঘরে ফিরল। বারান্দার বেতের চেয়ারে গম্ভীর মুখে চশমা পরা এক বালক বসে আছে। তার হাতে অদ্ভুত এক খেলনা। কাঠির মাথায় কাঠঠোকরা পাখি। পাখিটাকে ছেড়ে দিলেই সে কাঠি টুকরাতে ঠুকরাতে নিচে নামতে থাকে। রুস্তম কি ছেলেটাকে কল্পনায় দেখছে? মনে হয় না। চশমা পরা গম্ভীর মুখের কোনো ছেলে তার কল্পনায় নেই।
রুস্তম বলল, তুমি কে?
ছেলে ইংরেজিতে জবাব দিল। মাই নেম ইজ নো। বেঙ্গলি নো।
এখানে তোমাকে কে এনেছে?
আমাদের ড্রাইভার নিয়ে এসেছে। আমি এক ঘণ্টা থাকব। এক ঘণ্টার মধ্যে পনেরো মিনিট চলে গেছে। তুমি কোথায় ছিলে?
সাইকেল চালাচ্ছিলাম।
মেড পারসন সাইকেল চালাতে পারে না।
তোমাকে কে বলেছে?
আমি জানি। কারণ আমার অনেক বুদ্ধি।
তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?
ইউ আর মাই ড্যাড।
কিভাবে চিনলে?
মার ঘরে তোমার তিনটা ছবি আছে। তুমি কি আমার সঙ্গে হেডশেক করবে?
করব।
রুস্তম হাত বাড়িয়ে ছেলের হাত ধরল। হঠাৎ করেই রুস্তমের চোখে পানি এসে গেল। ছেলে গম্ভীর গলায় বলল, তুমি মেড পারসন না। মেড পারসন শুধু হাসতে পারে, কাঁদতে পারে না।
তোমার ডাকনাম না। ভালো নাম কী?
ভালো নাম বিভাস। বিভাস অর্থ সূর্য। The Sun। সূর্য পৃথিবী থেকে কত দূরে জানো?
জানি না।
সূর্য পৃথিবী থেকে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে।
স্কুলে শিখিয়েছে?
হ্যাঁ। আমি রাইম মিলাতে পারি, তুমি কি পারো?
ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে বলো।
বিভাস বলল, আমার নাম বিভাস। পানিতে ভাসছে একটা হাঁস। বিভাসের সঙ্গে হাঁসের রাইম।
রুস্তম বলল, মনে হয় আমি পারব।
বিভাস বলল, আমি একটা করে সেনটেন্স বলব, তুমি রাইম করবে। ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
The sun is hot
রুস্তম বলল,
The sun is hot
But I am not
I feel cold
My son is bold
He is such a fun
বিভাস বলল, তুমি খুব ভালো রাইম করতে পারো। তুমি কি আমাকে দেখে খুশি হয়েছ?
খুব খুশি হয়েছি।
মা বলেছিল, তুমি কোনো কিছুতেই খুশিও হও না, আবার দুঃখও পাও না।
রুস্তম বলল, আমি খুশি হই আবার দুঃখও পাই। তবে দুঃখ পেলেও কাউকে বুঝতে দেই না। আনন্দে থাকার চেষ্টা করি। আমার ডাক্তার আমাকে সবসময় আনন্দে থাকতে বলেছে।
তুমি কি এখন আনন্দে আছ?
হ্যাঁ।
তুমি কি আমাকে এক পিস কাগজ আর কলম দিতে পারবে?
পারব। কী করবে? ছবি আঁকবে?
না My Father Essayটা লিখব। আগে যেটা লিখেছিলাম, সেটা ভুল ছিল।
পারবে।
তার বাবাকে লেখা বিভাসের রচনাটা এই রকম–
My father is a loving person. He can make Ryhmes with almost anything. He likes to ride byke. A Mad Person cannot ride byke, so he is not a mad person. He is poor in science. He could not tell the distance between earth and sun.
When my father shook is hand with me he cried. This again shows that he is not a mad person. Mad persons cannot cry. They can only laugh. Ha Ha Ha.
বিভাস এক ঘণ্টার জন্য এসেছিল। ঘড়ি দেখে এক ঘণ্টা পার করে বলল, যাই?
রুস্তম বলল, যাও।
বিভাস বলল, মা বলেছে তুমি গুড পেইন্টার। আমি তোমার জন্য একটা ছবি নিয়ে এসেছি। ছবিটা ভালো হয়নি। আমি এর চেয়ে ভালো ছবি আঁকতে পারি।
রুস্তম ছেলের ছবি হাতে নিল। ছবিতে একটা জবা ফুল আঁকা। রুস্তম বলল, ছবি দেখে আমি বুঝতে পারছি, তুমি জবা ফুল এঁকেছ। কাজেই ছবিটা ভালো হয়েছে।
তুমি কি জবা ফুলের ইংরেজি জানো?
জানি। সাধারণভাবে জবাকে বলে চায়না রোজ। মূল ইংরেজি হলো Hibiscus rosa sinensis.
বাবা! তুমি Good boy.
বিভাস একবারই তার বাবাকে বাবা ডেকে গাড়িতে উঠে গেল। রুস্তম তার ছেলের ছবি আইকা গাম দিয়ে লেখার টেবিলের সামনে সেঁটে দিল।
সাজ্জাদ আলী লোক মারফত তার ছেলেকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। যে চিঠি নিয়ে এসেছে তার নাম ছগীর। তার চেহারায় কী কারণে যেন ইঁদুরভাব প্রবল। কোঠর থেকে প্রায় বের হয়ে আসা চোখের কারণে হতে পারে। ছগীরের পোশাক-আশাক পরিষ্কার, কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে নোংরা পোশাক পরে আছে। তার গা থেকে গরম মসলার গন্ধ আসছে।
ছগীর বলল, পত্ৰ মন দিয়ে পাঠ করেন। আমাকে কিছু টাকা দেওয়ার কথা আছে। টাকা দেন। চলে যাব। ভুখ লেগেছে, খানা খেতে হবে।
রুস্তম বলল, আমার এখানে খান। রান্না হয়ে গেছে।
আমি দুই বেলা বিরানি খাই। অন্য কিছু খাই না। এই জন্য আমার আরেক নম বিরানি ছগীর।
সকালে নাশতা কী খান?
নাশতার মধ্যেও হিসাব আছে। খাসির তেহারি খাই। বিষুদবারে খাই মুরগির লটপটি দিয়ে পরোটা।
মুরগির লটপটি কী?
মুরগির লটপটি কী সেই হিসাব আপনাকে পরে দিব। আগে পত্র পাঠ করেন। জেলখানা থেকে পত্র বের করা দিগদারি আছে।
রুস্তম চিঠি পড়তে শুরু করল।
৭৮৬
বাবা রুস্তম,
তুমি কী ভাব? জেলখানায় আছি বলে তোমাদের কোনো সংবাদ পাই না? তোমার এবং তোমার বোনের ওপর নজরদারি করার জন্য আমার লোক আছে। তোমার বোন যে কাণ্ড করেছে তার ক্ষমা অন্যদের কাছে থাকতে পারে, আমার কাছে নাই।
এই পত্র নিয়ে যে তোমার কাছে গিয়েছে তার নাম বিরানি ছগীর। যে কোনো কাজে তুমি তার ওপর ভরসা করতে পারো। যে বদটার সঙ্গে তোমার বোন পালিয়েছে, তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তুমি ছগীরকে ব্যবহার করতে পারো।
আমার শরীর ভালো না। আমি বিরাট অশান্তিতে আছি। পায়ে পানি এসেছে। মেয়েদের পেটে সন্তান এলে পায়ে পানি আসে। আমার পেটে সন্তান আসার কোনো কারণ নাই। কিন্তু পায়ে পানি।
জেলের ডাক্তার বলেছে, কিডনির সমস্যা। কিডনি সমস্যা হলে নাকি পায়ে পানি আসে।
আমার রাতের ঘুম জন্মের মতো বিনাশ হয়েছে। গত মাসের তিন তারিখ থেকে রাতের ঘুম শেষ। ওই তারিখে জেলখানায় মুসা গুণ্ডার ফাঁসি হয়। ফাঁসির আগে সে বিকট চিৎকার করতে থাকে, আমারে মারিস না। আমারে মারিস না।
তারপর থেকে প্রতিরাতেই এই চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙে। বাকি রাত আর ঘুমাতে পারি না। আমি একা যে শুনি তা নয়। সবাই শোনে। জেলার সাহেব নিজেও শুনেছেন। আজিব ঘটনা।
এই চিৎকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাকে জেল থেকে বের হতে হবে। এই বিষয়ে তুমি, তোমার বোন তোমরা কিছুই করছ না। বিরাট আফসোস। যাই হোক, আমার নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করব।
শত দুঃখের মধ্যে একটা ভান্তে সংবাদ হলো, গোলাম মওলা এবং তার ড্রাইভার র্যাবের হাতে ধরা খেয়েছে। এটা পাকা খবর। তার ড্রাইভারের নাম মনু। সে পাকা সন্ত্রাসী। গোলাম মওলার ডান হাত বাম হাত দুইটাই সে। সবাই মনু ড্রাইভারকে অতি ভালো মানুষ হিসেবে জানে। অন্যের কথা বাদ দাও, আমি নিজেও তাই জানতাম।
যাই হোক, নিয়মিত ওষুধ সেবন করবে। যে কোনো প্রয়োজনে ছগীরের সাহায্য নিবে।
ইতি তোমার হতভাগ্য পিতা
এস, আলী B.Sc. (Hons)
চিঠি শেষ করে রুম বলল, আপনাকে কোনো টাকা-পয়সা দেওয়ার কথা চিঠিতে লেখা নাই।
ছগীর হতভম্ব গলায় বলল, বলেন কী? চিঠি আমার কাছে দেন। পড়ে দেখি। আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ দেওয়ার কথা।
ছগীর চিঠি পড়ল। সে অবাক, আসলেই টাকা-পয়সার কোনো উল্লেখ নাই। ছগীর বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ৭৮৬ যে লেখা এটা কী? টাকার পরিমাণ?
না, এটা একটা সাংকেতিক সংখ্যা। এর অর্থ বিসমিল্লাহ হের রহমানের রহিম।
জীবনে প্রথম শুনলাম।
রুস্তম বলল, অনেক কিছুই জীবনে প্রথম শুনতে হয়। একটা বলব?
বলেন শুনি।
সূর্যের আরেক নাম বিভাস। এটা জানেন?
না।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল এটা জানেন?
না।
জবা ফুলের আরেক নাম চীনা গোলাপ। এটা জানেন?
না।
আপনার যদি নতুন কিছু জানতে ইচ্ছা করে চলে আসবেন। আমি শোনাব।
আপনি তো আজিব লোক। এখন বলেন আপনার কোনো কাজ আছে? কনটাকে কাজ করে দেব।
আমার একটা কাজ আছে। মুনিয়া মেয়েটাকে বলতে হবে সে যেন চলন্ত ট্রাকে লাফ দিয়ে পড়ার কথা না ভাৰে। বেশি ভাবলে এটা তার মাথায় ঢুকে যাবে। তখন সে সত্যি চলন্ত কোনো ট্রাকের সামনে পড়বে। Inhibition কেটে গেলে মানুষ যে কোনো কাজ করতে পারে।
মুনিয়াকে এই কথা বলতে হবে?
জি।
সে থাকে কই?
সে থাকে কোথায় আমি জানি না। তাকে যশোরের নাইট কোচে তুলে দেওয়া হয়েছে।
তার কোনো পিকচার কি আছে আপনার কাছে?
না। তবে আমি ঠিক করেছি তার একটা ছবি আঁকব। আর্টিস্ট হোসেন মিয়া আউট লাইন এঁকে আমার অনেক সুবিধা করে দিয়েছেন।
ছগীর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনার সঙ্গে অনেক প্যাচাল পাড়লাম, এখন উঠি। আপনার দেমাগে সমস্যা আছে। ভালো পীর-ফকির দেখে একটা তাবিজ নেন। আপনাকে পছন্দ হয়েছে বলে কথাটা বললাম।
বিরিয়ানি খেতে যাবেন?
হ্যাঁ। আপনাকে তো বলেছি আমার একমাত্র খাদ্য বিরিয়ানি। আমার ঠিকানাটা লিখে রাখেন। এমন জায়গায় রাখেন যেন চোখের সামনে থাকে। যে কোনো সময় আমার প্রয়োজন পড়বে। ভালো মানুষের প্রয়োজন নাই। এখন সময় খারাপ। এখন শুধু দুষ্টের প্রয়োজন।
আপনাকে বিরিয়ানি আনিয়ে দিচ্ছি। আমার সঙ্গে দুপুরের খাবার খান। বাবা চিঠিতে টাকার কথা কিছু না লিখলেও আপনাকে আমি টাকা দিব।
কেন দিবেন?
আমার বাবা মিথুক মানুষ। তিনি টাকার লোভ দেখিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পছন্দ করেন। আপনার বেলাতেও এই কাজ করেছেন। আপনি যে সত্যি কথা বলছেন তা বুঝতে পারছি।
কিভাবে বুঝলেন?
কিভাবে বুঝলাম সেটা বলতে পারব না। আমার মাথার ঠিক নেই। সব কথা গুছিয়ে বলতে পারি না।
আমি আপনাকে পাগলের তেল এনে দিব। এই তেল এক সপ্তাহ মাথায় মাখবেন। ইনশাআল্লাহ আরোগ্য হবেন। যদি আরোগ্য না হন আমি নিজের গু নিজে চেটে খাব।
বিরানির বদলে গু খাবেন?
অবশ্যই খাব। একবার যখন বুলেছি তখন খাব। ধোয়া লুঙ্গি আছে? গোসল করব। গোসল না করে আমি খানা খাই না। যতবার খানা ততবার গোসল।
ধোয়া লুঙ্গি আছে।
বিরিয়ানি কোত্থেকে আনাবেন? মগবাজারের তাজ হোটেলেরটা ভালো। কাউকে পাঠায়ে দেন নিয়ে আসবে। ম্যানেজারকে যেন আমার নাম বলে।
নাম বললে কি হবে?
মাংস ঠিকমতো দিবে। ঘাড়ের মাংস দিবে। আলু এক-দুই পিস বেশি দিবে।
ছগীর দুপুরের খাওয়া শেষ করে লম্বা ঘুম দিল। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পর। সে খালি গায়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ঘুরে বেড়াতে লাগল। যেন এই বাড়ি তার নিজের।
চায়ের কাপ হাতে একসময় রুস্তমের ঘরে ঢুকল। রুস্তম লেখালেখিতে ব্যস্ত। রুস্তমের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, কি লিখেন?
রুস্তম বলল, প্রণাশের মৃত্যুর অংশটা লিখছি।
প্রণাশ কে?
আমার উপন্যাসের চরিত্র। সে মারা যাওয়ার পর উপন্যাস শুরু হয়। কিভাবে মারলে তাকে ভালো হবে এটা বুঝতে পারছি না। অনেকভাবে লিখেছি, কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না। আপনাকে পড়ে শুনাব? আপনার কাছে কোনটা ভালো লাগে যদি বলেন।
ছগীর হাই তুলতে তুলতে বলল, পড়েন শুনি। ছলো পড়বেন। রেলগাড়ির মতো পড়লে কিছু বুঝব না।
রুস্তম প্রণাশের মৃত্যুর সব ভার্সান পড়ল। ছগীর বলল, সিনেমা হলে মিত্যু সবচে ভালো।
কেন?
পাবলিক বিরাট ক্যাসাল শুরু করবে। পাবলিক আসছে বই দেখতে, মিত্যু দেখতে আসে নাই। টিকেট কাটা পাবলিক। হৈ-হল্লা হবে। চেয়ারের গদি কাটা হবে। এর মধ্যে কয়েকটা ককটেল ফুটলে খেলা জমবে।
ককটেল?
ককটেল না থাকলেও চলবে। কোক-ফান্টার বোতল ভালোমতো ঝাঁকি দিয়া যদি ফিক্কা মারেন ককটেল ফোটার আওয়াজ হবে। শেষমেশ সিনেমার পর্দায় আগুন।
ছগীরের চোখ কোটর থেকে খানিকটা বের হয়ে এসেছে। চোখ চকচক করছে। রুস্তমের মনে হলো ছগীর চোখের সামনে দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখছে। বড় লেখকদের লক্ষণ। বড় লেখকরা চোখের সামনে সব দেখতে পান।
প্রণাশ বাবুর পরিবারের বয়স কত?
বয়স অল্প।
অল্পটা কত ঠিকমতো বলেন।
ধরুন বাইশ-তেইশ।
চেহারা-ছবি কেমন?
মিষ্টি চেহারা।
চেহারার আবার ঝাল-মিষ্টি কি! চোখ-মুখের কাটিং কেমন?
ভালো।
নাক মোটা না খাড়া?
সামান্য মোটা।
ঠোঁটের অবস্থা কি? পাতলা না মোটা?
নাকের সঙ্গে মিল রেখে ঠোঁটও খানিকটা মোটা।
গাত্র বর্ণ কালো?
কালো না, শ্যামলা।
প্রণাশ বাবুর মিত্যুর পর তার স্ত্রীর গতি কি হবে কিছু চিন্তা করেছেন? তাকে একটা ভালো মুসলমান ছেলের সঙ্গে শাদির ব্যবস্থা করেন। মেয়েটা কলেমা পড়ে মুসলমান হবে তারপর শাদি। ছেলে গরিব ঘরের। বিবাহের পর তার ভাগ্য খুলে যাবে। দুই হাতে টাকা আসতে থাকবে। ধানমণ্ডিতে ফ্ল্যাট কিনবে। গাড়ি কিনবে। গাড়ি দুইটা দিয়ে দেন। একটা তার আরেকটা তার স্ত্রীর। ছেলের আপন ভাই বিষয়টা ভালো চোখে নিবে না। তার নজর আপন ভাইয়ের স্ত্রীর দিকে। সে সময়ে-অসময়ে ভাইয়ের বাসায় উপস্থিত হয়। ভাবীর জন্য সে দেওয়ানা। মেয়েটা শুরুতে না না করলেও একসময় তার মন দুর্বল হয়। দুইজনে মিলে ঠিক করে পথের কাঁটা দূর করবে। দশ হাজার টাকার কনটাকে তারা একজনরে ঠিক করে, মনে করেন তার নাম ছগীর।
রুস্তম বলল, এই গল্পটা আর শুনতে চাচ্ছি না।
শুনতে না চাইলে শুনবেন না। জোর-জবরদস্তি করে আপনারে কিছু শুনাব না। বিরানি ছগির জোর-জবরদস্তি করে কোনো কিছু করে না।
হোটেলের নাম সাংগ্রিলা
হোটেলের নাম সাংগ্রিলা। হোটেল না, স্বপ্নপুরী। স্বপ্নপুরীর লনে আমিন মুখ ভোঁতা করে বসে আছে। তার সামনে টলটলে পানির নহর। সেখানে রঙিন মাছ ঘুরঘুর করছে। আমিনের মাথার ওপর লাল টালির ছাদ। বাগানবিলাস ছাদকে ঘিরে রেখেছে। বাগানবিলাস ফুটিয়েছে নীল পাতা। কিছুদূর পরপর বার্ড অব প্যারাডাইস নামের কলাবতি ধরনের গাছ। গাছগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবী এত সুন্দর কেন?
আমিন ভাই পীরের প্রতি কৃতজ্ঞ। তার ধারণা যা ঘটেছে ভাই পীরের তাবিজের কারণে ঘটেছে। এই তাবিজ এখনো তার গলায় পরা। আমিন ঠিক করে রেখেছে বাকি জীবন সে তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে রাখবে।
ভাই পীরের তাবিজ বেশ অদ্ভুত। তিনি তার খাওয়া সিগারেটের ছাই খানিকটা ভরে দিয়েছেন। বলেছেন, কাজ হলে এতেই হবে। কাজ যে হয়েছে তা তো দেখাই যাচ্ছে।
সামিনা দুগ্লাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে ঢুকল। আমিনের সামনে গ্লাস রাখতে রাখতে বলল, মুখ ভোঁতা করে রেখেছ কেন?
আমিন বলল, আফতাব বদটা কোথায়?
সে কোথায় আমি কী করে জানব! যেই সে টের পেয়েছে আমি তাকে এনেছি চরণদার হিসেবে, তারপর থেকে সে নিখোঁজ। সুন্দর একটা জায়গায় বসে আছ। মুখ থেকে ভোঁতা ভাব দূর করো। দুএকটা ভালো কথা বলো। চার-পাঁচ লাইনের একটা কবিতা বলো।
আমার কবিতা মুখস্থ থাকলে তো কাজই হতো। স্কু
লে পড়া কোনো কবিতা মনে নাই?
ঐ দেখা যায় তালগাছটা মনে আছে।
তালগাছের কবিতাই বলো।
সত্যি বলব?
হ্যাঁ। দুলাইন হলেও বলো।
ঐ দেখা যায় তালগাছ ঐ আমাদের গাঁ
ঐ খানেতে বাস করে কানাবগির ছা।
সামিনা বলল, তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। কতটা ভালো লাগছে জানতে চাও?
চাই।
মনে হচ্ছে আমার জীবনে কোনো দুঃখ নাই, কষ্ট নাই। আমি বেহেশতে আছি। দেখো, আমার চোখে পানি এসে গেছে। আনন্দে যখন চোখে পানি আসে সেই চোখের পানি লোনা হয় না, এটা জানো?
না।
আঙুলে করে চোখের পানি নিয়ে জিভে লাগিয়ে দেখোলোনা লাগবে না।
মিষ্টি লাগবে?
লাগতেও পারে। তবে লোনা লাগবে না।
আমিন আঙুলে করে চোখের পানি নিয়ে জিভে ছোঁয়াল। অবাক হয়ে বলল, আসলেই তো নোনা লাগছে না, বরং মিষ্টি ভাব আছে।
কমলার রসটা খাও। এর মধ্যে কিছু একটা দিয়েছে। খেতে অদ্ভুত ভালো হয়েছে।
আমিন গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, আসলেই তো অদ্ভুত।
সামিনা বলল, এদের কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে যাব।
আমিন বলল, তোমাকে কী যে সুন্দর লাগছে!
সামিনা বলল, প্রেগন্যান্সির সময় সব মেয়েকে সুন্দর লাগে। তখন ব্যালেন্সড হরমোন সিক্রেশন হয় এই কারণে। এখন কাজের কথা বলি। আমি তোমাকে নিয়ে এক মাস ঘুরব।
অবশ্যই।
আজ শপিংয়ে যাব। যমজ বাচ্চাদের জন্য বেবি স্ট্রলার পাওয়া যায় সেটা কিনব।
তোমার যমজ বাচ্চা হবে নাকি?
আমার ধারণা তাই। হোক বা না হোক, আমি ডাবল স্ট্রলার কিনব।
তোমার কিনতে ইচ্ছে হলে অবশ্যই কিনবে।
আমি ওদের একজনের নামও ঠিক করে রেখেছি–আলিতা। অন্যজনের নাম তুমি রাখবে।
মেয়ে হচ্ছে?
এখনো তো জানি না কী হচ্ছে। আমার মন বলছে যমজ মেয়ে। চার মাস পার হলে ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাফি করে বলতে পারবেন।
আমিন বলল, একজন ভালো ডাক্তারের খোঁজ বের করো তো। আমি ডাক্তার দেখাব।
তোমার কি হয়েছে যে ডাক্তার দেখাবে।
গায়ে দুর্গন্ধ।
সামিনা বলল, তোমার গায়ে কোনো দুর্গন্ধ নেই। তোমাকে রাগাবার জন্য এইসব বলেছি।
বলো কি?
সামিনা হাসতে হাসতে বলল, আমি একটা বই কিনেছি সেখানে মানুষকে রাগানোর নানান কৌশল দেয়া আছে। বইটার নাম How to annoy some one।
দু-একটা কৌশল বলো তো। আমিও শিখে রাখি।
সামিনা জুসে চুমুক দিতে দিতে বলল, পুরুষ মানুষ সবচে বেশি রাগে যখন দ্রভাবে তাকে বোকা বলা হয়। তুমি যদি কাউকে বলো তোমার 1.Q. রুই মাছের চেয়ে বেশি, তাহলে সে রাগবে।
আমিন বলল, রাগবে কেন?
সামিনা বলল, তুমি বাংলাদেশের সেরা বোকাদের একজন। কাজেই তুমি বুঝতে পারবে না।
আমিন হাসল। সামিনা তাকে বোকা বলছে, এটাও শুনতে ভালো লাগছে।
আমিন বলল, অরেঞ্জ জুস খেয়ে মাথা ঘুরছে কেন বলো তো?
সামিনা বলল, তুমি অরেঞ্জ জুস খাচ্ছ না। তুমি খাচ্ছ Tequila Sunrise। এই জন্যে মাথা ঘুরছে। অরেঞ্জ জুসের সঙ্গে টাকিলা মেশানো।
টাকিলা জিনিসটা কি? মদ নাকি?
হুঁ।
নামধাম কোত্থেকে শিখেছ?
তোমার বন্ধু আফতাব সাহেবের কাছে শিখেছি। ওস্তাদ লোক।
তোমার মতো ওস্তাদ না।
সামিনা হাসতে হাসতে বলল, তা ঠিক। তোমাকে আরেকটা টাকিলা সানরাইজ দিতে বলি?
পাগল নাকি?
আমার কথা শোনো, আরেকটা নাও, খেয়ে মাতাল হয়ে যাও।
লাভ?
মাতাল হলে একেকজন একেক ধরনের কাণ্ড করে। তুমি কি করো সেটা আমার দেখার ইচ্ছা।
মাতাল হয়েছে কি না বুঝবে কিভাবে?
সামিনা হাসতে হাসতে বলল, যখন দেখবে তোমার সামনে দুজন সামিনা বসে আছে তখন বুঝবে তুমি মাতাল।
দুটা সামিনা?
হুঁ। একটা রিয়েল, আরেকটা আনরিয়েল।
আমিন আগ্রহ নিয়ে টাকিলা সানরাইজ খাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে দুজন সামিনা দেখে।
রুস্তম মুনিয়ার আউট লাইন করা ক্যানভাস নিয়ে বসেছে। তার ছবি আঁকা আগ্রহ নিয়ে দেখছে তার পুত্র বিভাস।
রুস্তম খুব ভালো করে জানে বিভাস তার সামনে নেই। তার ব্রেইন বিভাসকে তৈরি করেছে। এমনভাবে করেছে যে, রুস্তম ইচ্ছা করলে ছেলেকে স্পর্শও করতে পারে।
বাবা! তোমার ছবিটা খুব সুন্দর হচ্ছে।
ধন্যবাদ।
ছবিটার গায়ে কাপড় নেই কেন?
আমার আর্ট টিচার আউট লাইন এইভাবে করে দিয়েছেন।
তুমি কাপড় পরিয়ে দিও।
আচ্ছা।
মেয়েটা কে?
ওর নাম মুনিয়া।
ছবিতে মেয়েটাকে যত সুন্দর লাগছে সে কি এত সুন্দর?
হুঁ।
আমার আঁকা জবা ফুলের ছবিতে তুমি কি এই মেয়েটির ঠিকানা লিখে রেখেছ?
না। মুনিয়ার ঠিকানা আমি জানি না। জবা ফুলে ছগীরের ঠিকানা লেখা।
ছগীর কে?
সে একজন দুষ্টলোক।
দুষ্টলোকদের কোনো ঠিকানা থাকে না বাবা। দুষ্টলোকরা থাকে জেলখানায়।
কিছু দুষ্টলোক জেলখানার বাইরে থাকে। আবার কিছু ভালোমানুষ থাকে জেলখানায়। আমার বাবা কোনো খুন করেন নাই। মা নিজে শাড়ি পেঁচিয়ে ফাঁস নিয়েছিলেন। অথচ দেখো খুনের দায়ে বাবা জেলখানায়।
তোমার বাবা ভালো মানুষ?
ধান্দাবাজ বোকা মানুষ, তবে জেলে থাকার মতো খারাপ না।
বাবা! আমি এখন চলে যাই। দেরি করলে মা বকা দেবে।
আচ্ছা যাও।
তোমার জানালাটা বন্ধ করে দাও বাবা। বৃষ্টির পানি ঢুকছে।
রুস্তম জানালা বন্ধ করে দেখল, বিভাস নেই। ঘর ফাকা। সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ছবি আঁকতে বসল।
দরজার বাইরে থেকে ছগীর বলল, রুস্তম ভাই! কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি দেখলাম আপনি হাত-পা নেড়ে কথা বলছেন। আপনার অবস্থা তো ভালো না। পাগলের তেলটা নিয়া আসা দরকার। নারায়ণগঞ্জ থেকে আনতে হবে। দেখি কাল-পরশু চলে যাব।
রুস্তম বলল, আচ্ছা।
আপনি তো ভালো পিকচার আঁকেন! আমার এক বন্ধু ছিল শামীম নাম। সেও ভালো পিকচার আঁকত। রিকশার পিছনে ভালো ভালো পিকচার সব তার আঁকা। শাবানা ম্যাডামের এমন এক পিকচার এঁকেছিল আমি বললাম, দোস্ত পায়ের ধুলা দে চেটে খাব। আপনি যে মেয়েটারে আঁকতেছেন সে কে?
তার নাম মুনিয়া।
ও আচ্ছা এর কথাই আমাকে বলেছিলেন। মেয়ে তো বেহেশতের হুরের চেয়েও সুন্দর। চোখ বন্ধ করে ফিলমের হিরুইন হইতে পারবে।
রুস্তম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। পেইন্টিংয়ে মেয়েটা যত সুন্দর এসেছে বাস্তবে ততটা সে না। এ ছবির মেয়ের সৌন্দর্য আরোপিত। কে আরোপ করেছে?
এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
ছগীর ঘরে ঢুকে রুস্তমের সামনে বসল। হাই তুলতে তুলতে বলল, আপনার এখানে আরামে থাকলাম। এখন চলে যাব।
রুস্তম বলল, কোথায় যাবেন?
কোথায় যাব বলব না। বিপদ আছে।
কি বিপদ?
ধরেন আমার খোঁজে পুলিশ এসে ধরল আপনাকে। ডলা দিতে দিতে বলল, বিরানি ছগীর কোথায়? আপনাকে তখন বলতেই হবে। পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে যাব। বুঝেছেন সমস্যা?
হুঁ।
তবে আপনাকে বলা যায়। আমি উঠব তাজ হোটেলে। তাদের সাথে ব্যবস্থা আছে।
যেখান থেকে আপনার জন্য বিরানি আনা হয় সেই হোটেলে?
হুঁ।
আপনার ছেলেমেয়ে নাই?
এক মেয়ে ছিল। তার হিস্টোরি শুনবেন?
শুনব।
মেয়ের নাম সখিনা। আমি ডাকতাম সখি। আমি, মেয়ে আর মেয়ের মা থাকতাম বিএনপি বস্তিতে। বিএনপি বস্তি চিনেন?
না।
চিনলেও চলবে। সখির বয়স তখন ছয় কিংবা সাত। সে বিরানি খাবে। ভাত খাবে না। আমি ঠেলা চালাই, মেয়ের জন্যে বিরানি কই পাব। তারে বুঝায়ে বললাম, সে বুঝ মানে না। শেষে দিলাম থাপ্পড়। রাত্রে মেয়ের আসল জ্বর। জ্বরের মধ্যেও বিড়বিড় করে বলে, বাবা বিরানি খাব। মেয়েটা মারা গেল পরদিন দুপুরে। তার মিত্যুর পর থেকে আমি বিরানি ছাড়া কিছু খাই না। যে বিরানির জন্যে আমার সখি মা মারা গেল, আমি ঠিক করলাম বাকি জীবন এই জিনিসই খাব।
মেয়ের মা কোথায়?
জানি না কই আছে। পাঁচ বছর জেল খাটলাম। বাইর হইয়া তারে আর পাই নাই।
খোঁজ করেছেন?
হুঁ। একেক জন একেক কথা বলে। কেউ বলে মারা গেছে, কেউ বলে বেশ্যাপল্লীতে আছে।
রুস্তম বলল, আপনার বিরানি খাবার গল্প শুনে মন খারাপ হয়েছে। আমার সহজে মন খারাপ হয় না। আজ হয়েছে। আপনার মেয়ের কোনো ছবি কি আছে? তাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।
আমার কইলজার মইধ্যে ছবি আছে আর কোনোখানে নাই। রুস্তম ভাই! আমি সকালে চলে যাব। আপনার জন্যে পাগলের তেলের ব্যবস্থা করব। এই বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। আপনার কোনো শত্রু থাকলে নামঠিকানা বলেন, শেষ করে দিয়ে যাব, তার জন্যে কোনো টাকা-পয়সা নিব না।
বাবা রুস্তম আলী
বাবা রুস্তম আলী
দোয়া গো,
আমি তোমার উপর বিরক্ত, মহাবিরক্ত, মহারও অধিক বিরক্ত। তোমার মাথায় কিছু সমস্যা আছে এই বিষয়ে আমি অবগত আছি। আবার তুমি যে বদ্ধ উন্মাদ না এই বিষয়েও আমি অবগত। কিন্তু তুমি এখন যা করছ তা কোনো বদ্ধ উন্মাদও করবে না।
শুনলাম বিরানি ছগীর এখন তোমার সঙ্গেই থাকে, খায়, ঘুমায়। ইহা কি? ছগীর কি বস্তু তা কি তুমি জানো? পাঁচ-দশ হাজার টাকার বিনিময়ে সে মানুষ খুন করতে পারে। র্যাব-পুলিশ তার সন্ধানে আছে। তারা ছগীরকে যখন তোমার বাড়ি থেকে উদ্ধার করবে তখন কি তোমাকে ছাড়বে?
চিঠি পাওয়া মাত্র কিছু টাকা-পয়সা দিয়া ছগীরকে বিদায় করবে। ইহা পিতৃ আজ্ঞা। কথার অন্যথা হলে তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করা ছাড়া আমার গতি নাই।
আমার শরীর ভালো না। রাতে এক ফোঁটা ঘুমাতে পারি। মুসা গুণ্ডার ফাঁসির ঘটনা লিখেছিলাম। ফাঁসির পূর্বে সে চিৎকার করছিল, আমারে মারিস না, আমারে মারিস না। তার চিৎকার এখন আর কেউ শুনে না। কিন্তু আমি শুনি। বিরাট অশান্তিতে আছি। তবে তোমাকে এইসব বলা বৃথা।
তুমি ভালো থাকার চেষ্টা করো।
ইতি তোমার হতভাগ্য
পিতা।
এস. আলী B.Sc. (Hons)
পুনশ্চ ১ বিরানি ছগীরকে বিদায় করো।
পুনশ্চ ২ বিরানি ছগীরকে বিদায় করো।
পুনশ্চ ৩ বিরানি ছগীরকে বিদায় করো।
বিরানি ছগীরকে বিদায় করতে হলো না। সে নিজে নিজেই বিদায় হলো। রুস্তমের জন্যে নারায়ণগঞ্জে পাগলের তেল আনতে গিয়ে র্যাবের হাতে ধরা পড়ল। র্যাবের মেজর ইসমাইল বললেন, তোর হাতে কি?
ছগীর বলল, স্যার বোতল।
কিসের বোতল? বোতলে আছে কি?
ছগীর দাঁত বের করে বলল, আপনি কি ভাবছেন এসিড? এসিড না, পাগলের তেল। দুই বোতল আছে। আপনার প্রয়োজন থাকলে এক বোতল রেখে দেন।
তোর যে সময় শেষ বুঝতে পারছিস?
ইয়েচ চ্যার।
ইংরেজিও জানিস?
দুই-চাইরটা ইংরেজি না জানলে আপনের মতো মানুষদের সামনে কথা বলব ক্যামনে? স্যার কি আমারে ক্রস ফায়ারে দিবেন?
কিছু ইনফরমেশন দে, তারপর বিবেচনা করব। তালেব কোথায় আছে বললে ছেড়ে দিব।
ছগীর বলল, স্যার আমি পুলাপান না। কেন আমারে বুঝ দেন? তালেব কই আছে বললে সেও মরব আমিও মরব। এরচে আমার একা মরা ভালো না।
মেজর ইসমাইল চোখে সানগ্লাস পরলেন। সন্ধ্যার পর মেজর সাহেবের চোখে সানগ্লাস পরা খারাপ লক্ষণ।
ছগীর! রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
না।
কি খেতে চাস বল, বিরানি?
জে। সাথে একটা লাচ্ছি দিয়েন। স্যার আরেকটা কথা, দুই বোতল পাগলের তেল আমি একজনের জন্যে কিনেছি। তার ঠিকানা দিতেছি তেলের বোতল দুটা তার হাতে পৌছায়ে দিবেন। যদি পৌছায়া না দেন রোজ হাশরে আমি আপনার ঘাড় কামড়ায়া ধরব। রোজ হাশরে আপনার হাতে বন্দুক থাকব না কিন্তু আমার মুখে দাঁত ঠিকই থাকব।
পরদিনের খবরের কাগজে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বিরানি ছগীরের ক্রস ফায়ারে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলো।
রুস্তম খবরের কাগজ পড়ে না কাজেই ছগীরের মৃত্যু সংবাদ সে জানল। দুপুরবেলা অচেনা এক লোক তাকে দু বোতল পাগলের তেল দিয়ে গেল।
আমিনের তাড়া খেয়ে রুস্তমের বাড়ি ছেড়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল একে একে তারা সবাই ফিরে আসছে। সবার আগে উপস্থিত হলেন চণ্ডিবাবু। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠার ক্ষমতা তার নেই। ড্রাইভারের কাঁধে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে দোতলায় উঠলেন। রুস্তমের শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, স্যার আমার অন্তিম সময় উপস্থিত। শেষ কয়েকটা দিন কি আপনার বাড়িতে থাকতে পারি?
রুস্তম বলল, অবশ্যই পারেন।
চণ্ডিবাবু বললেন, স্যার আপনার জন্যে আমার কিছু করতে ইচ্ছে করে। কি করব বুঝতে পারি না। আমার শক্তি নাই, সামর্থ্য নাই। জ্ঞান-বুদ্ধিও নাই।
আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে পনার শরীর খুবই খারাপ। কি হয়েছে বলুন তো।
হাঁপানি আগেই ছিল এখন বেড়েছে। আর কিছু না।
হাসপাতালে ভর্তি করে দেই? কিছু দিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন।
আমি হাসপাতালে যাব না। আপনার আশেপাশেই থাকব। বেশ তো থাকুন।
চণ্ডিবাবুর দাখিল হবার পরদিনই ফিটবাবুকে দেখা গেল। তার সবকিছুই আগের মতোই আছে, শুধু টাইয়ের রঙ বদল হয়েছে। এখন টাইয়ের রঙ সবুজ।
রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছে তখন ফিটবাবুর সঙ্গে দেখা। সে ছুটে এসে গেট খুলতে খুলতে বলল, স্যারের কিছু লাগবে?
কিছু লাগবে না।
স্যার কি ভালো আছেন?
হ্যাঁ ভালো।
স্যার আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি নামবে। আজ সাইকেল নিয়ে বের না হলে ভালো হয়।
রুস্তম বলল, কোনো অসুবিধা নেই। না হয় কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজব।
স্যার আমি কি একটা ছাতা নিয়ে পিছনে পিছনে আসব?
না। আপনি ফিরে এসেছেন এটা দেখে ভালো লাগছে। যারা চলে যায় তারা কখনো ফিরে আসে না।
স্যার আমাকে তুমি করে বলবেন।
আচ্ছা বলব।
রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি নামল। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট অদ্ভুত। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা গেলেই রাস্তায় পানি উঠে যায়। বৃষ্টি পড়ার প্রয়োজন হয় না।
মাথায় বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় পানি। রুস্তম পানি কেটে এগুচ্ছে। তার চমৎকার লাগছে। প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর ব্যাপারটা নতুন করে মাথায় এসেছে। ঝড়-বৃষ্টির রাতে তার মৃত্যু হলে কেমন হয়? পথের পাঁচালি উপন্যাসে দুর্গার মৃত্যু যেমন হলো। রুস্তম প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর বিষয়টা মাথায় সাজাতে সাজাতে এগুচ্ছে।
প্রণাশ বাবুর মৃত্যু
(ঝড়-বৃষ্টির রাত)
সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি। শোঁ শোঁ বাতাস। মিউনিসিপালটি ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে শহর অন্ধকার করে দিয়েছে।
প্রণাশ বাবু বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ঘরে ফিরলেন। স্ত্রীকে বললেন, গরম পানি করো তো। ড্রেনে পড়ে গিয়েছিলাম, পা কেটেছে। একটা টিটেনাস ইনজেকশন নেয়া দরকার।
প্রণাশ বাবুর স্ত্রী বললেন, কি সর্বনাশ! রক্তে তো তোমার পাজামা ভিজে গেছে। এতটা কাটল কিভাবে?
কথা বলে সময় নষ্ট করো না। তাড়াতাড়ি পানি গরম করো…।
চণ্ডিবাবুর ফেরার দুদিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে আর্টিস্ট ফিরে এলো। মনে হয় সে বিরাট কোনো ঝামেলার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখ শুকনা। গায়ের কাপড় নোংরা। পায়ে জুতা নেই। হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বাম চোখের চারপাশে কালো ছোপ। চোখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। রুস্তম বলল, আপনার এই অবস্থা কেন?
দুই রাত হাজতে ছিলাম। পুলিশ মারধর করেছে।
হাজতে ছিলেন কেন?
পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে এই জন্য ছিলাম। ইচ্ছা করে কেউ হাজতে যায়? হাজত তো হোটেল না।
পুলিশ ধরল কেন?
এত প্রশ্নের জবাব তত দিতে পারব না। এখন গরম পানি দিয়ে স্নান করব, তারপর আগুনগরম এক কাপ চা বাব। সাত দিন গোসল করি নাই।
দুদিন ছিলেন হাজতে, সাত দিন গোসল করেননি কেন?
আপনার কাছে কৈফিয়ত দেব কী জন্য? আপনি কি অ্যাটর্নি জেনারেল? সিগারেট আনিয়ে দিন। দুই দিনে সিগারেটে একটা টানও দিতে পারি নাই। টাকা নাই যে কাউকে দিয়ে সিগারেট আনা।
রুস্তম বলল, সিগারেট আনিয়ে দিচ্ছি। আপনার একটা ভালো খবর আছে।
ভালো খবরের আমি গুষ্টি কিলাই। আগে গোসল, তারপর গরম চা-সিগারেট। তারপর ভাত খেয়ে ঘুম। আপনার বদ দুলাভাইটা শুনেছি বাড়িতে নাই।
ঠিকই শুনেছেন। উনি মালয়েশিয়ায়।
থাক ব্যাটা মালয়েশিয়াতে। আর আসবি না। তোকে বাংলাদেশের প্রয়োজন নাই। আমি একজন আর্টিস্ট মানুষ। আমাকে সিঁড়িতে ধাক্কা দিয়েছে। একটু হলে পা পিছলে পড়তাম।
হোসেন মিয়া আধঘণ্টা সময় নিয়ে গোসল করল। গরম চায়ের সঙ্গে সিগারেট খেল। একটা সিগারেটের অর্ধেক শেষ হয়েছে, এর মধ্যেই অন্য আরেকটা সিগারেট বের করে দেয়াশলাইয়ের পাশে রেখে দিয়েছে।
সে বসেছে রুস্তমের ঘরে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুস্তমের আঁকা ছবির দিকে।
এই ছবি আপনি এঁকেছেন?
জি।
চোখের পাপড়ি কোবাল্ট রু দিয়ে এঁকেছেন?
জি।
চোখের মণিতে লেমন ইয়েলো দিয়েছেন কেন?
চোখ কোমল করার জন্য।
মেয়েটা কি ফিরে এসেছে?
না।
মন থেকে এঁকেছেন?
জি।
ছবিটা যে অসাধারণ হয়েছে, এটা বুঝতে পারছেন?
না।
এমন ছবি একটা এঁকে মরে গেলে কোনো ক্ষতি নেই। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কী মনে হচ্ছিল জানেন? মনে হচ্ছিল, যে কোনো মুহূর্তে মেয়েটা কথা বলে উঠবে। ছবি আঁকা নিয়ে আপনাকে অনেক কঠিন কঠিন কথা বলেছি। ফালতু উপদেশ দিয়েছি। আপনি ক্ষমা করবেন।
রুস্তম বলল, আপনার ভালো খবরটা কি এখন বলব?
হোসেন মিয়া ছবি থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, বলুন।
ফ্রান্স দূতাবাস থেকে চিঠি এসেছে। ফ্রান্স সরকার আপনাকে একটা স্কলারশিপ দিয়েছে। এক বছরের স্কলারশিপ। সব ফ্রি। হাতখরচ হিসেবে সপ্তাহে পঞ্চাশ ইউরো করে পাবেন।
এত বড় খবরেও হোসেন মিয়ার ভাবান্তর হলো না। সে ছবির দিকেই তাকিয়ে রইল।
হোসেন মিয়া বলল, মুনিয়া মেয়েটাকে এই ছবিটি দেখানো দরকার।
মুনিয়া তো রোজই দেখে।
তার মানে?
মানে আপনি বুঝবেন না। এটা আমার মনের একটা রোগ।
হোসেন মিয়া বিড়বিড় করে বললেন, ভাই যে হাতে আপনি ছবিটা এঁকেছেন, সেই হাতটা দিন। আমি আপনার হাতে চুমু না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না।
বছর ঘুরে নতুন বছর এসেছে। সামিনা দুই কন্যা ডাবল স্ট্রলারে শুইয়ে বড় শপিংমলগুলোতে যাচ্ছে। সামিনার সঙ্গী আমিন। বাচ্চা দুটিকে এক মুহূর্ত না দেখে সে থাকতে পারে না। সে এখন কোনো ব্যবসা দেখে না। মুখে বলে, সব গোল্লায় যাক। মেয়ে দুটা ঠিক থাকলেই আমি ঠিক। দুটা ফুটফুটে মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছে, এই দৃশ্য অনেকেই অবাক হয়ে দেখে। মুগ্ধ চোখে বলে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!
আমিনের খুবই চিন্তা হয়। নজর লাগবে না তো! সে স্ত্রীর কানে কানে তার দুশ্চিন্তার কথা জানায়। সামিনা বলে, দুজনকেই কালো মোজা পরিয়ে রেখেছি। নজর লাগবে না।
হোসেন মিয়া চলে গেছে ফ্রান্সে। সেখানে সে ভালোই আছে। অবসর সময়ে অপূর্ব সব ওয়াটার কালার করছে। বিষয়বস্তু বাংলার গ্রাম। তার অনেক ছবিতে শান্ত দিঘির জলের পাশে একটি তরুণীকে বসে থাকতে দেখা যায়। তরুণীর চেহারার সঙ্গে মুনিয়ার সাদৃশ্য আছে।
বিভাস দার্জিলিংয়ে পড়তে গেছে। যাওয়ার সময় বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে হঠাৎ বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে খুব কাঁদল। রুস্তম বলল, কাঁদছ কেন বাবা? বিশ্বাস করো সারাক্ষণ তুমি আমার পাশেই থাকবে। আমার খুব ভালো একটা অসুখ হয়েছে। এই অসুখের কারণে আমি আমার পছন্দের যে কোনো মানুষকে আমার পাশে বসিয়ে রাখতে পারি।
বাবা তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
আমি নিজেও বুঝতে পারি না। নিজের কাছেও মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে। মনে করো তুমি দার্জিলিংয়ে পড়ছ। হঠাৎ আমার ইচ্ছা হলো তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি। ইচ্ছাটা হওয়া মাত্র তোমাকে আমি আমার সামনে দেখব। তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব।
কম্পিউটার দিয়ে? আমার মা আমাকে একটা ল্যাপটপ দিয়েছে। ল্যাপটপের সামনে বসে আমি যখন মার সঙ্গে কথা বলব তখন মা তার কম্পিউটারে আমাকে দেখতে পাবে।
রুস্তম বলল, অনেকটা সে রকমই, শুধু কম্পিউটার নেই।
বিভাস বলল, মনে হয় তোমার মাথার ভেতর আছে। আমাদের সায়েন্স মিস বলেছেন মানুষের ব্রেইন খুব পাওয়ারফুল কম্পিউটার।
হতে পারে।
মানুষের ব্রেইনে অনেক মেগাবাইট মেমোরি। মেগাবাইট কি তুমি জানো?
না।
তুমি সায়েন্সে দুর্বল তাই না?
হ্যাঁ।
চাঁদ যে একটা আয়না এটা জানো?
না।
আমাদের সায়েন্স মিস বলেছেন চাঁদ একটা আয়না। এই আয়নায় সূর্যের আলো পড়ে। আয়না সেই আলো পৃথিবীতে পাঠায়।
তোমাদের সায়েন্স মিস তো অনেক গুছিয়ে কথা বলেন।
আমাদের সায়েন্স মিসের নাম মিস রুমা। তুমি যে ছবিটা আঁকছ মিস রুমা সেই ছবির মতো সুন্দর। তোমাকে একটা গোপন কথা বলব বাবা?
বলো।
কাউকে কিন্তু বলতে পারবে না।
কাউকে বলব না।
আমি বড় হয়ে সায়েন্স মিসকে বিয়ে করব।
আমি কি সেই উৎসবে থাকতে পারব? দাওয়াতের কার্ড কি পাঠাবে?
বিভাস হালকা গলায় বলল, মা তোমাকে কার্ড পাঠাতে দেবে না। তুমি তো পাগল এই জন্যে। পাগলদের কোনো অনুষ্ঠানে ডাকতে হয় না। পাগলরা ঝামেলা করতে পারে।
তাও ঠিক।
আমার গত জন্মদিনে এই জন্যে মা তোমাকে দাওয়াত করেনি। মা ভালো করেছে না?
হ্যাঁ।
মিস রুমা জন্মদিনে এসেছিলেন। তিনি আমাকে একটা অটোগ্রাফের বই দিয়েছেন। বইটা আমি নিয়ে এসেছি। বাবা তুমি আমার অটোগ্রাফ বইতে কিছু লিখে দাও।
রুস্তম লিখল,
দিঘির কালো জলে
আনন্দে ভেসে চলে
অলৌকিক এক চন্দ্রহাঁস
আমাদের ছোট্ট বিভাস॥
ডাক্তার রেণুবালা বিদেশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। রুস্তমের চিকিৎসা বন্ধ। রেণুবালা প্রায়ই নিউজার্সি থেকে রুস্তমকে টেলিফোন করেন। তার উপন্যাস কেমন এগোচ্ছে জানতে চান। তিনি রুস্তমকে একটা বইও পাঠিয়েছেন, Brain and Mind।
মাসে একবার তিনি টেলিফোনে দীর্ঘ সময় ধরে রুস্তমের সঙ্গে কথা বলেন। টেলিফোনে তার গলা কিশোরীদের গলার মতো শোনায়। তার কথা শুনতে রুস্তমের খুব ভালো লাগে।
রু আদে সাহেব!
জি।
Realityর নানান রূপ আছে এটা কি জানেন?
না।
একজন Sleep walker যখন ঘুমের ঘোরে হেঁটে বেড়ায় তখন সেটাই তার কাছে Reality। যারা তাকে হাঁটতে দেখছে তাদের Reality কিন্তু ভিন্ন। বুঝতে পারছেন?
বুঝার চেষ্টা করছি।
আমরা যখন স্বপ্ন দেখি তখন স্বপ্নটাই আমাদের কাছে বাস্তব। আবার যখন জেগে উঠি তখন জাগ্রত অবস্থাটাই বাস্তব। সমস্যা হচ্ছে একজন মানুষের কি দুই ধরনের বাস্তবতা থাকতে পারে? আপনার কি মনে হয়?
জানি না।
থাকতে পারে। আপনি যেমন অনেক বাস্তবতা নিয়ে বাস করছেন। আপনার সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে আপনি একটা বাস্তবতাকে অন্য একটা বাস্তবতা থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছেন না। আচ্ছা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, মুনিয়া নামের যে মেয়েটির ছবি এঁকে আপনি শেষ করেছেন সে কি ফিরেছে?
না।
তাঁকে খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা কি করেছেন?
না।
না কেন?
ইচ্ছা করলেই তো মুনিয়াকে আমি আমার সামনে উপস্থিত করতে পারি। তাকে খুঁজে বের করার দরকার কি?
তাও ঠিক। আমি এখন টেলিফোন রেখে দেব। আপনি কি কিছু বলতে চান?
চাই।
বলুন, আমি শুনছি।
আমার ছেলে বিভাস বড় হয়ে তার সায়েন্স টিচার মিস রুমাকে বিয়ে করবে।
শুনে ভালো লাগল। আর কি বলবেন?
আমি খুব আনন্দে থাকার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।
আপনি পারবেন। Please dont give up.
সাইকেলে বৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে রুস্তম জ্বরে পড়েছে। প্রবল জ্বর। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপা হয়নি বলে কত জ্বর জানা যাচ্ছে না। তার বিছানা জানালার পাশে। তার সময় কাটছে জানালা দিয়ে বৃষ্টিভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে। আকাশে মেঘের কত না অদ্ভুত খেলা। রুস্তমের মনে হচ্ছে সে তার বাকি জীবনটা বিছানায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে।
শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যা। আকাশে ঘন কালো মেঘ। যে কোনো মুহূর্তে বর্ষণ শুরু হবে। রুস্তমের বাড়ির গেটের কাছে রেক্সিনের সুটকেস হাতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শাড়ি মলিন। চেহারা মলিন। সে ভেতরে ঢোকার সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না। ঘন ঘন ঢোক গিলছে। সে কাঁদছে। তার চোখ ভর্তি টলটলা পানি। মেয়েটার নাম মুনিয়া।
বারান্দা থেকে মেয়েটিকে চণ্ডিবাবু প্রথম দেখলেন। অভয় দেওয়ার মতো গলায় বললেন, ভেতরে চলে যাও মা। স্যার আছেন। স্যার থাকতে আমাদের ভয় কী?
মুনিয়া বললেন, ভালো আছেন দাদু?
চণ্ডিবাবু বললেন, ভালো আছি মা।
আমার স্যার ভালো আছেন?
স্যারের জ্বর। দুদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। আমার শরীরের যে অবস্থা, দোতলায় উঠে যে একবার দেখব সে উপায় নেই।
মুনিয়া সিঁড়ি ভেঙে ধীরে ধীরে দোতলায় উঠছে। তার শরীর কাঁপছে। মুনিয়ার মা মারা গেছেন। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
মুনিয়ার প্রতি লেখক হুমায়ূন আহমেদের শুভেচ্ছা। জীবন তার মঙ্গলময় বাহু দিয়ে মেয়েটিকে স্পর্শ করুক–এই শুভ কামনা।