- বইয়ের নামঃ টুকুনজিন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. লাল গাড়ি
আমি আর বাবা বাজার করে ফিরে আসছিলাম। বাজারের বড় ব্যাগটা আমার হাতে বাবার হাতে একটা মাঝারি বোয়াল মাছ। বাবা বোয়াল মাছটাকে উপরে তুলে ধরে। রেখে সেটার সাথে কথা বলছেন। তাঁর একটু মাথা-খারাপের ভাব আছে, এটা হচ্ছে। তার এক নাম্বার লক্ষণ। জন্তু-জানোয়ার, পশুপাখি, গাছপালা সবার সাথে কথা বলেন। বোয়াল মাছটাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা বোয়াল মিয়া, আপনার শরীরটা ভালো? কোন গাং থেকে এসেছেন?
মাছটি মনে হয় এক্ষুণি ধরে এনেছে, এখনো জ্যান্ত। বাবার কথা শুনেই কি না জানি না, দুর্বলভাবে লেজটা একবার নেড়ে দিল। বাবা গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, আপনি বাস্তবিকই সত্যি কথা বলেছেন। নীল গাঙের পানি বড়ই ঘোলা। আপনার বেশি কষ্ট হয় নাই তো?
মাছটির আলাপে বেশি উৎসাহ নেই দেখে বাবা সেটাকে একবার ঝাঁকিয়ে দিলেন, তারপর সেটাকে কানের কাছে ধরে রেখে কিছু-একটা শুনে ফেললেন। মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, খাওয়াদাওয়ার কষ্ট? সেটা কার নাই বলেন, তেয়াত্তর সালে মানুষ পর্যন্ত না খেয়ে রাস্তায় মরে আছে—
আমি বললাম, বাবা, তুমি আসলেই মাছের কথা শুনতে পাও?
বাবা অবাক হয়ে বললেন, কেন শুনতে পাব না?
কেমন করে শোন?
ওরা বলে, তাই শুনি।
আমরা তো শুনি না।
বাবা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, শুনতে চাইলে সবাই শুনতে পারে। কেউ তো শুনতে চায় না।
তুমি আমাকে শোনাতে পারবে?
বাবা চোখ উজ্জ্বল করে বললেন, কেন পারব না? এক শ’ বার পারব। তুই শুনবি?
আমি বললাম, শুনব।
বাবা বড় একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বললেন, নে, ব্যাগটা রাখ। তারপর চোখ। বন্ধ করে গাছের সাথে তোর কানটা লাগা। যখন গাছের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারবি তখন বলবি, জনাৰ গাছ, আপনার শরীরটা ভালো?
আমি বললাম, আপনি করে কেন বলতে হয়?
কত বয়স গাছের, সম্মান করে কথা বলতে হয় না? নে, ব্যাগটা আমার হাতে দো।
সড়ক দিয়ে আরো কত লোকজন যাচ্ছে-আসছে, এর মাঝে চোখ বন্ধ করে গাছের সাথে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কেমন করে? এমনিতেই বাবার একটু মাথাখারাপ বলে আমাদের কত যন্ত্রণা, চেনা কেউ-একজন দেখে ফেললে কোনো উপায় আছে? আমি বললাম, আজ থাক বাবা, আরেকদিন নেব।
বাবার মন-খারাপ হল, মুখটা কালো করে বললেন, এই জন্যে তোরা শুনতে পারিস না, তোদের শোনার আগ্রহ নাই।
বাবা আরো কী বলতে চাইছিলেন, কিন্তু হঠাৎ দূরে কী দেখে থেমে গেলেন। আমিও তাকালাম, দূরে ধুলা উড়িয়ে সড়ক দিয়ে শব্দ করে কী-একটা আসছে। গ্রামের সড়ক, একটা দুইটা রিকশা ছাড়া কিছু যায় না। মাঝে মাঝে পাশের গঞ্জ থেকে একটা পুরানো ট্রাক আসে। মেম্বার সাহেব একটা মোটর সাইকেল কিনেছেন, তাঁর বড় শালা মাঝে মাঝে ফটফট শব্দ করে চালিয়ে বেড়ায়, এর বেশি কিছু নেই। আমিও তাকিয়ে রইলাম, প্রচণ্ড শব্দ করে ধলা উড়িয়ে লাল রংয়ের একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এই সড়ক দিয়ে গাড়ি খুব একটা আসে না, আশেপাশে যারা ছিল সবাই হাঁ করে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল।
বাবাও খানিকক্ষণ অবাক হয়ে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ইস্! কী একটা জিনিস।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, গাড়ি যায় কেমন করে, বাবা?
বাবা অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ভিতরে মনে হয় পাওয়ার আছে। যখন পাওয়ার সামনে দেয় তখন সামনে যায়, যখন পিছনে দেয় তখন পিছনে যায়। পাওয়ার হচ্ছে বড় জিনিস, যার পাওয়ার নাই ভার কিছু নাই। ( কথাটার কি মানে আমি ঠিক বুঝলাম না, পাগল মানুষ; যখন যেটা মনে হয় সেটা বলে ফেলেন, লোকজন শুনে হাসাহাসি করে। খুব খারাপ লাগে তখন। আমার যখন অনেক পয়সা হবে তখন বাবাকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাব, আজকাল নাকি পাগলের চিকিৎসা হয়।
বাবার জন্য আমার বড় কষ্ট হয়।
বাড়ির সামনে এসে দেখি সেখানে মন্ত ভিড়। লাল গাড়িটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর সেটাকে ঘিরে অনেক লোকজন। সবাই গাড়িটা একবার ছুঁয়ে দেখতে চায়। ফুলপ্যান্ট পরা একজন মানুষ নিশ্চয়ই গাড়ির ড্রাইভার হবে, মুখের কোনে একটা সিগারেট কামড়ে ধরে হুঙ্কার দিয়ে বলছে, খবরদার, কেউ কাছে আসবে না, একেবারে
জানে মেরে ফেলব। আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম যে, ছোট খালা এসেছেন। ছোট খালা হচ্ছেন আমাদের বড়লোক আত্মীয়দের মাঝে এক নম্বর। চেহারা খুব ভালো বলে নানাজান অনেক বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছিলেন। ছোট খাল ইঞ্জিনিয়ার, জার্মানি বা আমেরিকা কোথায় জানি গিয়েছিলেন, সেখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে এসেছেন। এটা নিশ্চয়ই সেই গাড়ি।
আমি প্রায় ছুটে ভিতরে ঢুকে গেলাম, বাইরে যেরকম ভিড়, ভিতরেও সেরকম ভিড়। উঠানের মাঝখানে একটা চেয়ারে ছোট খালা বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে পাড়ার সব বৌ-ঝিরা দাঁড়িয়ে আছে। ছোট খালা দরদর করে ঘামছেন, রাঙা বুবু একটা হাতপাখা দিয়ে তাঁকে প্রাণপণে বাতাস করে যাচ্ছে। ছোট খালা একসময়ে নাকি খুব সুন্দরী ছিলেন, কিন্তু এখন আর দেখে বোঝা যায় না, মোটা হয়ে গোল একটা কলসির মতো হয়ে গেছেন। গায়ের রং অবশ্যি ধবধবে ফর্সা, কেমন যেন একটা গোলাপী আভা। তার পাশে আমার মাকে দেখাচ্ছিল শুকনা, কালো এবং অনেক বেশি বয়স।
আমি ছোট খালু কিংবা তাঁদের ছেলেমেয়েদের খুঁজে পেলাম না, মনে হয় ড্রাইভারকে নিয়ে একাই এসেছেন। মা তাঁর ছোট বোনকে দেখে খুব খুশি হয়েছেন, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আমাকে দেখে বললেন, বিলু, ভোর ছোট খালাকে সালাম কর।