- বইয়ের নামঃ একা একা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, রোম্যান্টিক গল্পের বই
রাত দুপুরে দুমদুম করে দরজায় কিল
রাত দুপুরে দুমদুম করে দরজায় কিল পড়তে লাগল। সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। আগুনটাগুন লেগেছে কিংবা চোর এসেছে। চোর হবার সম্ভাবনাই বেশি। খুব চুরি হচ্ছে চারদিকে।
আমরা দু জনের কেউই ঘুমাই নি। ঘর অন্ধকার করে বসে আছি। বাবুভাই তার শেষ সিগারেটটি ধরিয়েছে। সিগারেট হাতে থাকলে সে কোনো কথাবার্তা বলে না। কাজেই আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কে?
দরজা খোল।
বড়োচাচার গলা। ধরা যেতে পারে সাংঘাতিক কিছু হয় নি। এ বাড়িতে বড়োচাচার কোনো অস্তিত্ব নেই। কাজকর্ম কিছু করেন না। সে জন্যই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে হৈ-চৈ করে বাড়ি মাথায় তোলেন। এক বার রাত তিনটায় এমন চেঁচামেচি শুরু করলেন যে পাহারাদার পুলিশ আমাদের গেটের কাছে বাঁশি বাজাতে লাগল। আমি এবং বাবুভাই দু জনে ছুটে গিয়ে দেখি ছোটচাচীর পোষা বেড়াল তাঁর ঘরে ঢুকে বিছানার উপর বমি করেছে। বড়োচাচার সে কী চিৎকার! যেন ভয়ংকর একটা কিছু হয়েছে।
আজ রাতেও নিশ্চয়ই সে রকম কিছু হবে। হয়তো চাচীর বেড়াল তাঁর ঘরে গিয়ে কুকীর্তি করে এসেছে। আর এই নিয়ে ঘুমুবার সময়টায় তিনি লাফঝাঁপ শুরু করেছেন।
দরজা খুলতে বললাম, কানো যায় না?
ব্যাপারটা কী?
চড় দিয়ে দাঁত খুলে ফেলব। লাটসাহেব কোথাকার। দরজা খোল।
বাবুভাই সিগারেট ফেলে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, রাত দুপুরে কী শুরু করেছেন?
কি শুরু করেছি মানে? একটা মানুষ মারা যাচ্ছে!
কে মারা যাচ্ছে?
বড়োচাচা তার উত্তর না দিয়ে প্রচণ্ড একটা লাথি কষলেন। দরজায়।
বাবুভাই উঠে দরজা খুলল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, কে মারা যাচ্ছে?
বড়োচাচা হুঁঙ্কার দিয়ে বললেন, সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকিস না, নিচে যা।
হয়েছেটা কি বলবেন তো?
বাবার অবস্থা বেশি ভালো না।
স্ট্রোক হয়েছে নাকি?
হতে পারে। অবস্থা খুব সিরিয়াস। খুবই সিরিয়াস।
বড়োচাচাকে দেখে মনে হল না। তিনি খুব বিচলিত। বরঞ্চ এই উপলক্ষে হৈচৈ করার সুযোগ পাওয়ায় তাঁকে বেশ খুশিখুশিই মনে হল। অনেক দিন পর একটা দায়িত্ব পেয়েছেন।
সবাইকে খবর দেওয়া দরকার। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নাই এখন। উফ, কী ঝামেলা!
তিনি ঝড়ের মতো নিচে নেমে গেলেন। তাঁর গলা অবশ্যি শোনা যেতে লাগল, ড্রাইভার কোথায়? ড্রাইভার? কাজের সময় সব কোথায় যায়? পেয়েছে কী?
বারান্দার লাইট জ্বলিল। চটি ফট্ফটু করে কে যেন নামল। ছোটচাচা? এ বাড়িতে ছোটচাচাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি চটি পরেন এবং শব্দ করে হাঁটেন। নিশ্চয়ই তিনি।
বাবুভাই আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। চিন্তিত স্বরে বলল, তুই চট করে দেখে আয় সত্যি সত্যি অবস্থা খারাপ কি না। আমার মনে হয় বাবা २भ२ 6bbाg5छ!
নিচে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি খারাপ। দাদার ঘরে অনেক লোকজন। ছোটচাচা, বড়োচাচা, শাহানা, আমাদের ভাড়াটে রমিজ সাহেব। কম পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। তাঁর খাটটি সরিয়ে সিলিং ফ্যানের ঠিক নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। রাখা হয়েছে আধশোওয়া করে। তিনি হাত দুটি ছাড়িয়ে নিঃশ্বাস নেবার জন্য ছটফট করছেন। পৃথিবীতে এত অক্সিজেন, কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ ফুসফুসটাকে তিনি আর ভরাতে পারছেন না। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
শাহানা একটি হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবু সে ক্রমাগত পাখা নেড়ে যাচ্ছে। তার মুখ হয়েছে পাংশুবর্ণ। লম্বাটে মুখ আরো লম্বা দেখাচ্ছে।
দাদা কি একটা বলতে চেষ্টা করলেন। শ্লেষ্মা-জড়িত স্বর, কিছুই বোঝা গেল না। বড়োচাচী চেয়ারে বসে ছিলেন। তিনি চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, কী বলছেন রে?
কি জানি কী?
শাহানা, তুই কিছু বুঝতে পারলি?
জ্বি-না মামী।
দাদা এবার স্পষ্ট বলে উঠলেন, মিনু, ও মিনু।
মিনু আমাদের সবচেয়ে বড়ো ফুফু। ন বছর বয়সে গলায় কি একটা ঘা (খুব সম্ভব ক্যানসোর) হয়ে মারা গিয়েছিল। অল্পবয়সে মৃত্যু হবে বলেই হয়তো রাজকন্যার মতো রূপ নিয়ে এসেছিল। আমাদের বসার ঘরে এই ফুফুর একটি বাঁধান ছবি আছে।
দাদা আবার বিড়বিড় করে কী বললেন। তাঁর বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল। শাহানা আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, বড়ো ভয় লাগছে।
ভয়ের কী আছে?
একটা মানুষ মরে যাচ্ছে, এটা ভয়ের না, কী বলছিস তুই?
দাদা ছটফট করতে লাগলেন। এক জন মানুষ শ্বাস নেবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে, আর আমরা এত সহজে নিঃশাস নিচ্ছি। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জাই লাগল।
দাদা তাহলে সত্যি সত্যি মারা যাচ্ছেন। ইদানীং তাঁর সাথে আমার খুব একটা দেখাসাক্ষাৎ হত না। ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তিনি ডাকতেন, কে যায়, বাবু? বাবু না? তাহলে কে, টগর? এ্যাই টগর এ্যাই। আমি না শোনার ভান করে দ্রুত বেরিয়ে যেতাম। কী কথা বলব তাঁর সাথে? দাদার নিজের কোনো কথা নেই বলার। আমারও নেই। এক জন বুড়ো মানুষ, যার স্মৃতিশক্তি নেই, গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁর কাছে দীর্ঘ সময় বসে থাকা যায় না।
কিন্তু মানুষ শুধু কথা বলতে চায়। সর্বক্ষণ চায় কেউ না কেউ থাকুক তার পাশে। কে থাকবে এত সময় তাঁর কাছে? দাদা তা বোঝেন না। তাঁর ধারণা পৃথিবীর সবারই তাঁর মতো অখণ্ড অবসর। কাজেই তিনি কান খাড়া করে দরজার পাশে সারা দিন এবং প্ৰায় সারা রাত বসে থাকেন। কারো পায়ের শব্দ পাওয়া গেলেই ডাকেন, কে যায়? কে এটা, কথা বলে না যে, কে?