- বইয়ের নামঃ টুকি ও ঝায়ের (প্রায়) দুঃসাহসিক অভিযান
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. টুকি এবং ঝা দুজনকে মিলিয়ে
নিবেদন
আমার মাঝে মাঝেই সায়েন্স ফিকশান নিয়ে কৌতুক করে কিছু একটা লেখার ইচ্ছে করে, টুকি এবং ঝায়ের (প্রায়) দুঃসাহসিক অভিযান বইটি সেরকম একটা ইচ্ছে থেকে লেখা। যারা গোড়া সায়েন্স ফিকশান ভক্ত তারা আমার এরকম লেখা দেখে খুব বিরক্ত হন। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। অনুপম প্রকাশনী থেকে এই বইটি নূতন করে প্রকাশ করা উপলক্ষে অনেকদিন পর আবার পড়ার সুযোগ হলো–এরকম কাহিনী যে আরো অনেকবার লিখতে হবে সেই ব্যাপারটি আবারো নিশ্চিত হলো।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১০/৮/০৪
———–
পূর্ব কথা
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে দুজন মানুষ অন্ধকারে উবু হয়ে বসে আছে। একজনের নাম টুকি। অন্যজনের নাম ঝা। তাদের সামনে আবছা অন্ধকারে উঁচু মতন কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। উপরে হঠাৎ একটা আলো জ্বলে উঠে নিভে যেতেই দুজনেই চমকে উঠল। টুকির মনে হল ঘটনাটা আগে ঘটেছে, কিন্তু কবে ঘটেছে কোথায় ঘটেছে কিছুতেই সে মনে করতে পারল না। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওটা কী?
———–
০১.
টুকি এবং ঝা দুজনকে মিলিয়ে মোটামুটিভাবে একজন পুরো মানুষ তৈরি করা যায়। টুকি শুকনো কাঠির মতন, তার শরীরে মেদ বা চর্বি দূরে থাকুক প্রয়োজনীয় মাংসটুকুও নেই, যেটুকু থাকা প্রয়োজন ছিল সেটা জমা হয়েছে ঝায়ের শরীরে—সে দেখতে একটা ছোটখাট পাহাড়ের মতন। টুকির নাকের নিচে বিশাল গোফ সেটাও খুব সহজে ঝায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়া যেতো। বুদ্ধি শুদ্ধির ব্যাপারগুলোও দুজনের মাঝে ঠিক করে ভাগাভাগি করা হয় নি, ঝায়ের ভাগে বেশ কম পড়েছে এবং সেটুকু মনে হয় টুকি পুষিয়ে নিয়েছে। কোন একটা কিছু বুঝতে যখন ঝায়ের অনেক সময় লেগে যায় সেটা টুকি চোখের পলকে বুঝে নেয়। শুধু তাই নয়, যেটুকু না বুঝলেও ক্ষতি নেই কিংবা যেটুকু বোঝা উচিত নয় সেটাও সে বুঝে ফেলে পুরো জিনিসটাতেই একটা বিদঘুটে ঘোট পাকিয়ে ফেলে। চরিত্রের অন্যান্য দিকগুলোতেও তাই—টুকি হাসি তামাশার মাঝে নেই, কোন একটি হাসির দৃশ্য দেখেও সে এর মাঝে হাসার কোন কিছু খুঁজে পায় না। রসিকতার পুরো ব্যাপারটি পেয়েছে ঝা, অত্যন্ত কাঠখোট্টা একটা দৃশ্য দেখেও ঝা তার সমস্ত শরীর দুলিয়ে হা হা করে হাসতে শুরু করে। টুকি সন্দেহপ্রবণ মানুষ কোন কিছুকেই সে বিশ্বাস করে না, ঝা সাদাসিধে সহজ সরল, তাকে দশবার বিক্রি করে দিলেও সেটা নিয়ে কোন রকম আপত্তি করবে না। টুকি বদরাগী—চট করে ক্ষেপে গিয়ে হঠাৎ হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসে, ঝা মোটামুটি মাটির মানুষ, প্রয়োজনের সময়েও সে রেগে উঠতে পারে না।
চেহারা ছবি চালচলন বা চরিত্রের কোন দিক দিয়ে তাদের কোন মিল না থাকলেও একটা ব্যাপারে দুজনের মিল রয়েছে, তারা দুজনেই চোর। ছোটখাট ছিচকে চোর নয় রীতিমতো চোরের বিশেষ কলেজ থেকে পাস করা ডিপ্লোমাধারী পেশাদার চোর। ইন্টার গ্যালাক্টিক বুলেটিন বোর্ডে তাদের নাম পরিচয় প্রায়ই ছাপা হয়। পুলিশ সব সময়েই হন্যে হয়ে তাদের খোঁজাখুঁজি করছে এবং তারা দুজনেই সব সময় পুলিশ থেকে এক ধাপ এগিয়ে থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলেছে। শৈশবে টুকি এবং ঝা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের প্রটোনিয়াম বা প্রতিরক্ষা দফতরের সফটওয়ার চুরি করে হাত পাকিয়েছে। যৌবনে আন্তঃগ্যালাক্টিক সন্ত্রাসী দলের জন্যে পারমাণবিক বোমা চুরি করেছে। এখন দুজনেরই মধ্যবয়স, উত্তেজক জিনিসপত্রে উৎসাহ নেই, ইদানীং মূল্যবান রত্নের দিকে ঝুকে পড়েছে। সত্যি কথা বলতে কী বড় একটা দাও মেরে চুরি-চামারী ছেড়ে দিয়ে নিরিবিলি কোন একটা গ্রহে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার জন্যে আজকাল মাঝে মাঝেই দুজনের মন উসখুস করে।
সেই অর্থে আজকের চুরির প্রজেক্টটা টুকি এবং ঝা দুজনের জন্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেন্ট্রাল ব্যাংকের ভল্টে দুইশ চব্বিশ ক্যারটের হীরা এসেছে খবরটা সোলার-নেটে দেখার পর থেকে দুজনেই সেটা গাপ করে দেবার তালে ছিল। খোঁজ-খবর নিয়ে টুকি আর ঝা বসে বসে নিখুঁত পরিকল্পনা করেছে। জেট চালিত জুতো পরে দেওয়াল বেয়ে উঠে গেছে, মাইক্রো-এক্সপ্লোসিভ দিয়ে দেওয়াল ফুটো করেছে, এক্স-রে লেজার দিয়ে ভল্ট কেটেছে, রিকিভ সিস্টেমে লেখা কম্পিউটার ভাইরাস দিয়ে সিকিউরিটি সিস্টেম নষ্ট করেছে, তারপর দুইশ চব্বিশ ক্যারটের বিশাল হীরাগুলো নিয়ে সরে এসেছে। পুরো ব্যাপারটা একেবারে নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছিল কিন্তু একেবারে শেষ। মুহূর্তে একটা ঝামেলা হয়ে গেল। দুশো চুরানব্বই তালা দালানের একশ বিরাশি তালায় এসে ঝায়ের বাথরুম পেয়ে গেল। সেখানে বাথরুম খুঁজে বের করে কাজ সেরে নিচে নেমে আসতে আসতে দেখে ততক্ষণে সিকিউরিটি সিস্টেম খবর। পেয়ে গেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংকটা ঘিরে প্রায় এক ডজন পুলিশের গাড়ি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
টুকি এবং ঝা তখন জেট চালিত জুতা ব্যবহার করে লাফিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পালানোর চেষ্টা করেছে। পুলিশকে ধোকা দেওয়ার তাদের আধ ডজন। প্রোগ্রাম রেডী করা থাকে। দেখতে নিরীহ দর্শন গাড়িটি আসলে একটা ভাসমান। গাড়ি, নিচু হয়ে উড়তে পারে। সেটায় চড়ে তারা তাদের আধডজন প্রোগ্রাম ব্যবহার করেও পুলিশকে কোনভাবে খসাতে পারল না। তখন আর কোন উপায় না দেখে তাদের শেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করতে হল, তাদের ভাসমান গাড়িটিকে একসিডেন্টের ভান করে ধ্বংস করে দেওয়া হল। আগে থেকেই সেখানে তাদের জামা কাপড় পরানো সত্যিকার টিস্যু দিয়ে তৈরি তাদের চেহারার এক জোড়া রবোট বসানো আছে, পুলিশ এই মুহূর্তে সেগুলোকে ধরে নানাভাবে জেরা করছে আর সেই ফাকে তারা সরে এসেছে।
লুকিয়ে লুকিয়ে টুকি এবং ঝা যে জায়গায় এসে হাজির হয়েছে সেটি জংলা এবং নির্জন। বুকে ভর দিয়ে নিজেদের হাচড় পাচড় করে টেনে টেনে তারা প্রায়। কয়েক কিলোমিটার চলে এসেছে। কনুইয়ের ছাল উঠে গেছে, ঝোপঝাড়ের খোঁচা খেয়ে খেয়ে মুখের জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে, বিছুটি জাতীয় একটা গাছ ভুল করে ছুয়ে ফেলায় টুকির সারা শরীর চুলকাচ্ছে, কাদা পানিতে দুজনেই মাখামাখি এবং খুব সঙ্গত কারণেই টুকির মেজাজ বাড়াবাড়ি রকম খারাপ হয়ে আছে। সে প্রায় একশ বাহান্নবারের মত ঝাকে গালি দিয়ে বলল, রবোটের বাচ্চা রবোট কোথাকার, সাত মাত্রার অপারেশনে কেউ বাথরুমে যায়?
ঝা ছোটখাট ঝোপঝাড়কে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে নিজেকে ছেড়ে ছেচড়ে সামনে নিতে নিতে বলল, আমি কী করব? তুমি জান সিনথেটিক গলদা চিংড়ি আমার পেটে সয় না।
পেটে সয় না তো এতগুলো খেলে কেন?
মনোসোডিয়াম গ্লুকোমেট দিয়ে ঝাল করে বেঁধেছে। জিবের স্বাদ বেড়ে গেল হঠাৎ—
টুকি রেগেমেগে আরেকটা কী বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। প্যাচপ্যাচে কাদায় আধডোবা হয়ে থেকে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, একেই বলে কপাল। এখন এর মাঝে বৃষ্টি শুরু হল।
ঝা হাসি হাসি মুখে বলল, মৌসুমী বৃষ্টি। একেবারে সময়মত এসেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিউশান একেবারে ধুয়ে নিয়ে যাবে।
টুকি রেগেমেগে বলল, তোমার বৃষ্টির চৌদ্দগুষ্ঠির লিভারে ক্যান্সার হোক।
ঝা মুখের হাসিকে আরো বিস্তৃত করে বলল, এত রেগে যাচ্ছ কেন? কী চমৎকার বৃষ্টি, দেখ না একবার। তিন চার ঘণ্টার মাঝে থেমে যাবে।
তিন চার ঘণ্টা! টুকি মুখ খিচিয়ে বলল, ততক্ষণ আমরা কী করব?
ভিজব। মঙ্গল গ্রহে বৃষ্টিতে ভেজার একটা ট্যুর আছে। সাড়ে সাতশ ইউনিট দিলে দশ মিনিট ভিজতে দেয়। সিনথেটিক বৃষ্টি। আর এইটা হল একেবারে খাঁটি প্রাকৃতিক বৃষ্টি।
টুকি রেগেমেগে আবার কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। সামনে আবছা অন্ধকারে উঁচু মতন কিছু একটা দেখা যাচ্ছে উপরে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। টুকি ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওটা কী?
ঝা পকেট থেকে বাইনোকুলার বের করে চোখে লাগিয়ে খানিকক্ষণ দেখে বলল, একটা দালান।
এই জংলা জায়গায় দালান তৈরি করেছে কোন আহাম্মক? আর এইটা যদি দালানই হবে তাহলে দরজা জানালা কই?
মানুষের খেয়াল! ঝা উদাস গলায় বলল, মনে নাই নাইন্টি-নাইনে একটা বাড়িতে চুরি করলাম, পুরো বাসাটা একটা থালার মতো, ছাদ নেই।
টুকি কোন কথা না বলে উবু হয়ে বসে বলল, এটা যদি সত্যি দালান হয় তাহলে এই বৃষ্টির মাঝে আমি আর কোথাও যাচ্ছি না। আমি এই দালানে বসে বিশ্রাম নেব।
যদি কেউ থাকে? টুকি মেঘস্বরে বলল, থাকলে ঘাড় ধরে বের করে দেব।
ঝা ভয়ে ভয়ে বলল, এত কষ্ট করে এত বড় একটা দাও মারলাম আর এখন যদি ছোট খাট বৃষ্টির জন্যে ধরা পড়ে যাই
সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। টুকি পাখির খাঁচার মত তার টিংটিংয়ে বুকে সজোরে একটা থাবা দিয়ে বলল, এই বান্দা কোনো কাঁচা কাজ করে না। ব্রেন ট্রান্সপ্ল্যান্ট আইনসিদ্ধ হলে আমার ব্রেন এতদিনে লাখ দুই লাখ ইউনিটে বিক্রি হতো।
দালানটা দেখতে নিরীহ মনে হলেও ভিতরে ঢোকা খুব সহজ হল না। দালানটা ঘিরে প্রথমে কাটাতারের বেড়া, তারপর গোপন ইলেক্ট্রিক লাইন, সবশেষে উঁচু দেওয়াল। তারা ঘাঘু চোর না হলে প্রথমেই ধরা পড়ে যেতো সে। ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সাবধানে উঁচু দালানটার কাছে এসে তারা কোন দরজা খুঁজে পেল না। তখন মৌসুমী বৃষ্টি আরো চেপে এসেছে, অধৈর্য হয়ে এক্সরে লেজার দিয়ে কেটে একটা দরজা প্রায় বের করে ফেলছিল ঠিক তখন ঝা। দরজা খোলার গোপন ফুটোটা আবিষ্কার করে ফেলল। টুকি তার মাস্টার কী ভিতরে ঢুকিয়ে চাপ দিতেই খুট করে দরজা খুলে গেল।
ভিতরে আবছা অন্ধকার। সাধারণ ঘরবাড়ি দেখতে যেরকম হয় দালানটির ভিতরে মোটেও সেরকম নয়—এটি যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। টুকি এবং ঝা অনেক খুঁজেও ওপরে ওঠার এলিভেটরটি খুঁজে পেল না। তখন বাধ্য হয়ে পায়ে সাকশান জুতো লাগিয়ে তারা পাইপ বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। খানিকদূর উঠেই অবশ্য তারা একটা সিড়ি আবিষ্কার করে, সেই সিড়ি ধরে মোটামুটিভাবে দালানটার একেবারে উপরে উঠে এল। নানা স্তরে নানা রকম ঘর পার হয়ে এলেও তারা আরাম করে বসার মত কোন জায়গা খুঁজে পেল না। যখন তারা প্রায় আশা ছেড়ে দিচ্ছিল ঠিক তখন হঠাৎ করে দুজন মানুষের কথোপকথন শুনে টুকি এবং ঝা পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল মাঝারী আকারের একটা ঘরে ভারী আরামদায়ক দুটি চেয়ারে প্রায় গা ড়ুবিয়ে দুজন বুড়োমানুষ খোশগল্প করছে। মানুষ দুজন টুকি এবং ঝাকে দেখে প্রায় ভূত দেখার মত চমকে উঠে বলল, তোমরা কে?
টুকি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বুড়োমতন একজন ধমক দেয়ার মত করে বলল, তোমরা এখানে কী করছ?
টুকি এবং ঝা পেশাদার চোর, তাদের সব কাজকর্ম হয় মানুষের অগোচরে। এরা সাধারণত মানুষের দেখা পায় না এবং হঠাৎ করে কোন মানুষ ধমকে। উঠলে খুব স্বাভাবিক কারণেই তারা ভয় পেয়ে যায়। এবারও দুজনেই ভিতরে ভিতরে একটু ভয় পেয়ে গেল, টুকি ভয়টা গোপন করে তার ব্যাগ থেকে মাঝারী আকারের একটা অস্ত্র বের করে গলার স্বর মোটা করে বলল, একটা কথা বললে ঘিলু বের করে দেব।
ঝা অস্ত্রটার দিকে এক নজর তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, এটা তো ট্রাংকুলাইজার গান। এটা দিয়ে কী ঘিলু বের হবে?
টুকি এবারে ঝায়ের দিকে তাকিয়ে একটা বাজখাই ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর তুমি।
বুড়ো মানুষদের একজন বলল, কিন্তু–
টুকির ধমক খেয়ে ঝায়ের মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল এবারে সে মনের ঝাল মেটালো মানুষগুলোর উপরে, চিৎকার করে বলল, কোন কথা নয়। এক দাবড়া দিয়ে মাথা ভেঙ্গে দেব।
মানুষটা তখনো কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। বলল, কিন্তু—
ঝা তখন অঙ্গভঙ্গী করে মাথা ভেঙ্গে ফেলে দেবার ভাণ করে দাঁত কিড়মিড় করে এগিয়ে যায় এবং সেটা দেখে টুকি পর্যন্ত একটু ঘাবড়ে গিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে গুলি করে বসল। ট্রাংকুয়ালাইজার গানের গুলি খেয়ে মানুষ দুজন ফোঁস জাতীয় একটা শব্দ করে সাথে সাথে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল। ঘুম যে গাঢ় সেটি প্রমাণ করার জন্যেই সম্ভবত সাথে সাথে তাদের নাক ডাকতে শুরু করে।
ঝা তার মুখে ভয়ংকর অঙ্গভঙ্গীটি ধরে রেখে বলল, কী হল, মরে গেল নাকী?
মরবে কেন? টুকি বিরক্ত হয়ে বলল, ট্রাঙ্কুলাইজার গানের গুলি খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। দেখছ না নাক ডাকছে।
ঝা ঠিক বুঝতে পারল না মুখে ভয়ংকর ভঙ্গীটি ধরে রাখবে কী না, দ্বিধান্বিত হয়ে খানিকটা প্রশ্নের ভঙ্গীতে টুকির দিকে তাকাল। টুকি তার অস্ত্রটি ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, যাও, এদের বাইরে রেখে এস।
ঝা অবাক হয়ে বলল, কেন?
শুনতে পাচ্ছ না জেট ইঞ্জিনের মত নাক ডাকছে? কেউ কানের কাছে এভাবে নাক ডাকলে বিশ্রাম নেওয়া যায়?।
ঝা ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমার একটু বাথরুমে যাওয়ার দরকার ছিল। সিনথেটিক গলদা চিংড়িগুলো পেটের মাঝে–
যেতে তোমাকে না করছে কে? মানুষগুলোকে বাইরে রেখে বাথরুমে কেন। ইচ্ছে হলে নরকে চলে যাও।
ঝা খুব বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকা বুড়ো মানুষ দুটির সার্টের কলার ধরে টেনে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। টুকি নরম চেয়ারে গা ড়ুবিয়ে বসে সামনে রাখা বিশাল ভিডিও স্ক্রীনের টেলিভিষণটি চালু করার চেষ্টা করতে থাকে। এরকম সময়ে পাবলিক চ্যানেলগুলোতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হয়। বড় ধরনের কিছু একটা চুরি করে এসে সে সব সময় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনে তার স্নায়ুকে শীতল করে। থাকে। এখন সে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত দূরে থাকুক কোন ধরনের। অনুষ্ঠানই শুনতে পেল না, সব চ্যানেলেই নানা ধরনের দুর্বোধ্য যান্ত্রিক ছবি। টুকি বিরক্ত হয়ে টেলিভিষণ বন্ধ করে দেয়।
মানুষ দুটিকে বাইরে রেখে ফিরে আসতে ঝায়ের খুব বেশি সময় লাগার। কথা নয় কিন্তু দেখা গেল তার কোন দেখা নেই। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে টুকি তার নরম চেয়ার থেকে উঠে ঘরটাতে পায়চারী শুরু করে এবং ঠিক তখন সে আবিষ্কার করল ঘরের এক কোনায় একটি রবোট চুপ করে দাঁড়িয়ে তার দিকে সবুজ ফটোসেলের চোখে তাকিয়ে আছে। টুকি প্রথমে চমকে উঠল তারপর সাহসে ভর করে কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, এই রবোট–
রবোটটি কোন কথা না বলে কয়েকবার চোখ পিট পিট করল। টুকি আবার বলল, এই রবোট—কথা বলছ না কেন?
রবোটটি এবারেও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চোখ দুটি আরও কয়েকবার পিট পিট করল। টুকি যখন তৃতীয়বার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে কী না চিন্তা করছে ঠিক তখন ঝা ঘরে এসে ঢুকল। সে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। টুকি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সে কী! তুমি ভিজলে কেমন করে?
বাইরে যা বৃষ্টি! ভিজব না?
টুকি চোখ কপালে তুলে বলল, এই বৃষ্টিতে তুমি বাইরে গেলে কেন?
তুমি না বললে মানুষগুলিকে বাইরে রেখে আসতে!
আরে রবোটের বাচ্চা—আমি বলেছিলাম ঘরের বাইরে!
ঝা খানিকক্ষণ হা করে থেকে অপ্রস্তুতের মত বলল, আমি ভেবেছি তুমি বলেছ বিল্ডিংয়ের বাইরে—
ঠিক এই সময়ে সমস্ত বিল্ডিংটা মৃদু মৃদু কাঁপতে শুরু করে এবং কোথায়। জানি একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। সামনের বড় ভিডিও স্ক্রিনগুলোতে বিচিত্র সব নকশা খেলা করতে থাকে। ঝা মাথা নেড়ে বলল, এই বিল্ডিংয়ের সবকিছু। আজব। কেমন শব্দ করছে দেখছ?
টুকি মাথা নাড়ল। ঝা বলল, সারা বিল্ডিংয়ে কোন বাথরুম নেই। বাথরুম নেই?
না! একটা আছে সেটা উল্টো।
টুকি অবাক হয়ে বলল, উল্টো?
হ্যাঁ! ছাদ থেকে ঝুলছে। এটা কী ধরনের ফাজলেমো? আমরা কী উড়ে উড়ে গিয়ে বাথরুম করব?
টুকি খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ!
ঝা ভয় পেয়ে বলল, কী হয়েছে?
পালাও! এখান থেকে পালাও।
কেন? কী হয়েছে?
বুঝতে পারছ না? এইটা একটা মহাকাশযান।
মহাকাশযান?
হ্যাঁ! মহাকাশযান। মহাকাশযানে কোন সোজা উল্টো নেই। সেখানে মহাকর্ষ নেই বলে সবকিছু ভাসতে থাকে। এটাও নিশ্চয়ই মহাকাশে যাবে। শুনতে পাচ্ছ না ইঞ্জিন চালু হয়েছে?
ঝা কান পেতে শুনল সত্যি সত্যি গুম গুম করে ইঞ্জিন শব্দ করছে। সে ফ্যাকাশে মুখে বলল, যে দুজনকে বাইরে রেখে এসেছি তারা মহাকাশচারী?
হ্যাঁ!
সর্বনাশ।
নিচে চল, বের হতে হবে এখান থেকে।
টুকি বিদ্যুবেগে নিচে ছুটতে থাকে, পিছনে পিছনে ঝ। ছুটতে ছুটতে তারা শুনতে পায় ইঞ্জিনের শব্দটা বাড়ছে, দেয়াল মেঝে ছাদ সবকিছু কাঁপতে শুরু করেছে। কোন রকমে নিচে এসে দরজা খোলার জন্যে হ্যান্ডেলে হাত রাখতেই হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেল এবং হঠাৎ করে তারা বুঝতে পারল মহাকাশযানটি উপরে উঠতে শুরু করেছে। টুকি এবং ঝা হুঁমড়ি খেয়ে পড়ল এবং তাদের মনে হতে লাগল অদৃশ্য একটা শক্তি তাদেরকে মেঝের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। ঝা কোনমতে বলল, নড়তে পারছি না।
পারবে না! দশ জি এক্সেলেরেশান।
ঝা টুকির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে! সর্বনাশ মুখের চামড়া নিচে ঝুলে যাচ্ছে।
টুকি রেগে বলল, বয়স নয় রবোটের বাচ্চা কোথাকার–এক্সেলেরেশানে চামড়া ঝুলে যাচ্ছে।
কী অদ্ভুত লাগছে তোমাকে!
তোমাকেও খুব সুন্দর দেখাচ্ছে না। টুকি চেষ্টা করে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, সব দোষ তোমার। তুমি যদি একশ বিরাশি তালার বাথরুমে না যেতে–
দোষ আমার? তুমি যদি এই বিল্ডিংয়ে না আসতে–
ঝায়ের কথা তার মুখে আটকে গেল। মহাকাশযানটি এখন প্রচণ্ড বেগে উপরে উঠছে তার ভয়ংকর ভূরণে দুজনের চোখের সামনে একটা লাল পর্দা ঝুলতে থাকে। সেই লাল পর্দা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে একসময় অন্ধকার হয়ে আসে। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে শুনল রিনরিনে গলায় কে যেন বলল, এম, সেভেন্টি ওয়ানে মানুষের তৃতীয় কলোনীতে আপনাদের ভ্রমণ আনন্দময় হোক।
টুকি অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকাল। উপরে নিশ্চল হয়ে দাঁড়ানো রবোটটি কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা আপনাদের জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ারে না বসে মেঝেতে চ্যাপটা হয়ে কেন শুয়ে আছেন আমি জানি না।
টুকি চাপা গলায় বলল, চুপ কর হতভাগা।
আপনারা যদি আপনাদের জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে থাকতেন তাহলে আপনাদের বর্তমান শারীরিক যন্ত্রণা উপশম করার জন্যে মস্তিষ্কে বিশেষ তরঙ্গ পাঠানো যেত। কিন্তু এখন কিছু করার নেই। আপনাদের উপরে তুলে নেওয়া প্রায় অসম্ভব।
ঝা চিঁ চিঁ করে বলল, কেন?
আপনার স্বাভাবিক ওজনই একশ পঞ্চাশ কেজির কাছাকাছি। এখন আপনার ওজন দাঁড়িয়েছে দেড় হাজার কে জ্বি।
কতক্ষণ এরকম থাকবে?
বেশ অনেক্ষণ।
কষ্ট কী আরো বাড়বে।
কষ্ট এখনো শুরু হয়নি। কিছুক্ষণের মাঝে শুরু হবে।
ঝা কাতর গলায় বলল, কিছু কী করা যায় না?
একটা উপায় আছে। আপনাদের মাথায় আঘাত দিয়ে অচেতন করে দেওয়া। তাহলে কিছু টের পাবেন না।
টুকি এবং ঝা প্রবল বেগে মাথা নেড়ে নিষেধ করার চেষ্টা করল কিন্তু অদৃশ্য কোন একটা শক্তি এত জোরে তাদেরকে মেঝের সাথে চেপে ধরে রেখেছে যে শরীরের একটা মাংসপেশীও এতটুকু নাড়াতে পারল না। টুকি এবং ঝা অনেক কষ্টে চোখ খুলে আতংকে নীল হয়ে দেখল রবোর্টটি বড় সাইজের একটা গদা নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
ভয়ে, গদার আঘাতে নাকী মহাকাশযানের প্রচণ্ড গতিবেগের ত্বরণের কারণে তারা জ্ঞান হারিয়েছে সেটা টুকি কিংবা ঝা কারো মনে নেই।
০২. জ্ঞান ফিরে ঝা আবিষ্কার করল
জ্ঞান ফিরে ঝা আবিষ্কার করল মাধ্যাকর্ষণহীন একটা ঘরে সে ভেসে বেড়াচ্ছে। পরে সুমসাম নীরবতা। মাথা ঘুরিয়ে দেখল টুকিও ভাসতে ভাসতে কুলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে, কপালের কাছে খানিকটা জায়গা আলুর মত ফুলে আছে নিশ্চয়ই সেখানে রবোটের বাচ্চা রবোট গদা দিয়ে মেরেছিল। ঝা টুকিকে জাগিয়ে তোলার জন্যে তার কাছে যেতে চাইল কিন্তু ব্যাপারটা সোজা নয়। ঝা এক জায়গায় হাড় পাচড় করতে থাকে কিন্তু এক সেন্টিমিটার সামনেও এগুতে পারে না।
আপনি কি ব্যায়াম করছেন? আমি কখনো কাউকে ব্যায়াম করতে দেখিনি।
গলার স্বর শুনে ঝা নিচে তাকাল, সেখানে সোজা হয়ে রবোটটি দাঁড়িয়ে আছে। রাগ চেপে বলল, না আমি ব্যায়াম করছি না। আমি সামনে যাবার চেষ্টা করছি।
সামনে যেতে হলে আপনাকে পিছনে ধাক্কা দিতে হবে। প্রাচীন বিজ্ঞানী নিউটন ভরবেগের সাম্যতার এই সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। পিছনে ধাক্কা দিলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামনে একটি ক্রিয়া হয়। সেই ক্রিয়াতে–
ঝা ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ, সাধারণত রাগ করে না, এবারে রেগে উঠে বলল, চুপ কর হতভাগা, না হয় এক রদ্দা দিয়ে ঘিলু বের করে দেব।
রবোটটি তার গলার স্বরে এক ধরনের উৎফুল্ল ভাব ফুটিয়ে বলল, আপনি কী রাগ করছেন? আমি কখনো কাউকে রাগ করতে দেখিনি। রবোট ফার্মে আমার বন্ধুরা বলেছে মানুষ যখন রাগ হয় তখন নাকী তারা বিচিত্র সব কাজকর্ম করে। সেটা দেখা নাকী অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আপনি আরও একটু রাগ করবেন? আমি আবার দেখি।
ঝা চোখ পাকিয়ে রবোটটার দিকে তাকিয়ে পা দিয়ে কাছাকাছি একটা দেওয়ালে ধাক্কা দিয়ে টুকির দিকে এগিয়ে গেল। কাছে এসে তাকে বার কতক ঝাকুনি দিতেই সে চোখ খুলে চিৎকার করে বলল, ধরা পরে গেছি? পুলিশ এসে গেছে?
না, ঝা মাথা নেড়ে বলল, ধরা পড়ি নি। কিন্তু ধরা পরলেই অনেক ভাল ছিল। আমরা এখন মহাকাশে।
টুকির সব কথা মনে পড়ে গেল এবং সে সাথে সাথে ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করতে থাকে। শূন্যে ভাসমান অবস্থায় ধড়মড় করে উঠে বসা যায় না। কাজেই টুকি ওলট পালট খেয়ে এক জায়গায় ঘুরতে শুরু করল, তাকে থামাতে গিয়ে ঝাও একই জায়গায় ওলট পালট খেতে লাগল। রবোটটি নিচে দাঁড়িয়ে বলল, মানুষ প্রজাতির নির্বোধ কাজ দেখা বড় আনন্দের।
টুকি কোন মতে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, ব্যাটা রবোটের বাচ্চা তুই ভাসছিস না কেন? সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেমন করে?
আমার পায়ে রয়েছে বিশেষ সাকশান জুতো।
তাহলে আমাদের সেই জুতো দিচ্ছিস না কেন?
আপনারা চাইছেন না তাই দিচ্ছি না।
ঠিক আছে এখন চাইলাম।
এক্ষুণি এনে দিচ্ছি। আপনাদের পায়ের সাইজ যেন কত?
কিছুক্ষণের মাঝেই টুকি এবং ঝা তাদের পায়ে সাকশান জুতো পরে মেঝেতে স্থির হল। প্রথমেই তারা জানার চেষ্টা করল এই মুহূর্তে মহাকাশযানটা কোথায় আছে এবং কোনদিকে যাচ্ছে। রবোটটিকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, আমি জানি কিন্তু বলব না।
কেন বলবে না?
এটি একটি গোপন প্রজেক্ট।
রবোটের বাচ্চা রবোট—এই গোপন প্রজেক্টে আমরা বসে আছি আর আমরা জানতে পারব না কোথায় যাচ্ছি?
আমি রবোটের বাচ্চা নই–রবোটটি মাথা নেড়ে বলল, আমার নাম রোবি।
ঐ একই কথা।
এক কথা নয়। রবোটের বাচ্চা রবোট সম্পূর্ণ অর্থহীন কথা। রবোটের বিয়ে হয় না এবং রবোটের বাচ্চা হয় না। আমার নাম রোবি।
ঠিক আছে ঠিক আছে। রোবি, তুমি বল আমরা কোথায় যাচ্ছি।
রোবি শান্ত গলায় বলল, এটা বলা যাবে না।
টুকি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, বলা যাবে না?
না। এই প্রজেক্টে যাদের যাওয়ার কথা ছিল আপনারা তাদের ফেলে রেখে চলে এসেছেন। আপনারা বে-আইনী। মনে হচ্ছে অনেক বড় গোলমাল পাকিয়ে দিয়েছেন।
ঝা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কী হবে?
জানি না। আমি যখন আপনাদের কথা বলেছি তখন পৃথিবীর কন্ট্রোল রুমে বিশাল হৈ চৈ শুরু হয়েছে। যিনি ডিরেক্টর তিনি মাথার চুল ছিড়তে ছিড়তে। বলেছেন, শালাদের কিলিয়ে ভর্তা বানাও।
তাই বলেছেন?
হ্যাঁ। এটাই মনে হচ্ছে অফিসিয়াল নির্দেশ। আমার আপনাদের দুজনকে কিলিয়ে ভর্তা বানাতে হবে। কখন করতে হবে জানালেই কাজ শুরু করে দেব। সেন্ট্রাল ডাটাবেস থেকে শুধু জেনে নিতে হবে কিলিয়ে কথাটার মানে কী আর
ভর্তা কথাটার মানে কী। আপনারা জানেন?
টুকি রোবির শক্ত হাতের মুঠির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমরা জানি। আমরা যদি বলে দিই তাহলেও কী সেন্ট্রাল ডাটাবেস থেকে জানার দরকার আছে?
ভাল করে বুঝিয়ে দিলে দরকার হবে না।
টুকি উদাস গলায় বলল, কিলিয়ে ভত্তা করা মানে যত্ন করে রাখা–কোন অসুবিধা যেন না হয়।
ঝা যোগ করল, বিশেষ লক্ষ্য রাখা যেন খেতে কোন অসুবিধা না হয়। সিনথেটিক খাবার না দিয়ে প্রাকৃতিক খাবার। বড় বড় গলদা চিংড়ি
হ্যাঁ টুকি মাথা নাড়ল, সাথে নরম বিছানা। আর ঘুম থেকে ওঠার পর ভাল পানীয় এবং ক্লাসিক্যাল মিউজিক।।
পরিস্কার কাপড়। সিনথেটিক নয়। একশভাগ কটন।
হাল ফ্যাসন হলে ভাল হয়। ঢিলেঢালা ধরনের।
দুই ঘণ্টা পর পর নাস্তা। মেনু কী হবে আগে থেকে জানিয়ে রাখা।
গোসলের পানি হবে হালকা কুসুম কুসুম গরম।
রোবি চোখ পিট পিট করে বলল, মানুষের ভাষা বড়ই বিচিত্র। কিলিয়ে ভর্তা করা তিন শব্দের একটা বাক্য অথচ এর অর্থ কত ব্যাপক। সত্যিই বিচিত্র।
টুকি এবং ঝা একসাথে মাথা নাড়ল।
কিলিয়ে ভর্তা করার ব্যবস্থা হওয়ার পরেও টুকি এবং ঝা মনমরা হয়ে মহাকাশযানে বসে আছে। প্রথম কিছুক্ষণ মহাকাশযানের জানালা দিয়ে নীল পৃথিবীটাকে দেখা গেছে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। মহাকাশযানের বড় বড় ইঞ্জিনগুলো চালু হয়ে সেটাকে পৃথিবী থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। সারাজীবন চুরি-চামারী করে কাটিয়েছে বলে গ্রহ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে দেখে নি। যদি গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানটুকুও থাকত তাহলে তারা বুঝতে পারত মহাকাশযানটি মঙ্গল গ্রহের পাশ কাটিয়ে বৃহস্পতির মহাকর্ষ বলকে ব্যবহার করে একটি হাইপার ডাইভ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মহাকাশযানের ছোট ঘরটাতে তাদের কাজকর্ম বিশেষ কিছু নেই। সময় কাটানো একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য সময় হলে টুকি এবং ঝা ঝগড়াঝাটি করে সময় কাটাতে পারত কিন্তু এখন সেটাও করতে পারছে না। প্রত্যেকবার তারা একে অপরের উপর রেগে উঠতেই রোবি গলায় তার যান্ত্রিক ধরনের আনন্দ ঢেলে বলে, কী চমঙ্কার! কী চমৎকার! আপনারা নিশ্চয়ই রাগ করছেন। আমি শুনেছি মানুষের রাগের প্রথম পর্যায়ে নাকি একে অন্যের সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করে। সেগুলি নাকি শুনতে খুব ভাল লাগে। রাগারাগির দ্বিতীয় পর্যায়ে নাকি একজন অন্যজনের নাকে হাত দিয়ে আঘাত করে। সেটি দেখলে নাকি অনেক আনন্দ হয়। কখন আপনারা একে অন্যকে আঘাত করবেন?
কাজেই যত রাগই হোক টুকি এবং ঝা চুপ করে মুখ শক্ত করে বসে থাকে। খুব যখন মন খারাপ হয় তখন তারা তাদের ঝোলা বের করে চুরি করে আনা হীরার টুকরোগুলোতে হাত বুলায়। হাতের মুঠির মত বড় বড় হীরা, কয়েকটা কাটা হয়েছে, কয়েকটা কাটা হয় নি, হাত বুলাতে তাদের বড় ভাল লাগে। পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে এগুলো বিক্রি করে কোন একটা দ্বীপ কিনে নিয়ে মোটামুটিভাবে বাকি জীবনটা আরামে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে যাবে সেরকম কোন আশা এই মুহূর্তে তাদের সামনে নেই। মহাকাশযানটি বৃহস্পতি এবং নেপচুনের মাঝামাঝি এসে হাইপার ডাইভ দিয়ে সৌরজগৎ থেকে অদৃশ্য গেছে, সেটা বের হয়েছে গ্যালাক্সির অন্যপাশে সেখানকার এম সেভেন্টিওয়ান নক্ষত্রপুঞ্জে, যার আশেপাশে বসতিযোগ্য অনেকগুলো গ্রহ উপগ্রহ রয়েছে এবং যে গ্রহ-উপগ্রহগুলোতে একসময় পৃথিবীর মানুষেরা তাদের কলোনী তৈরি করেছিল।
টুকি এবং ঝা সেই কলোনীগুলোর অস্তিত্বের কথাই জানত না, কাজেই সেখানে যে বিগত দুই শতাব্দী থেকে চরম অরাজকতা চলছে সেটা জানারও তাদের কোন উপায়ই ছিল না।
০৩. শুয়ে বসে থেকে এবং ভাল খেয়ে
শুয়ে বসে থেকে এবং ভাল খেয়ে টুকি এবং ঝায়ের স্বাস্থ্যের খানিকটা উন্নতি হল কিন্তু কিছু না করে এবং চব্বিশ ঘণ্টা রোবি নামের হাবাগোবা রবোটটার কথা শুনতে শুনতে তাদের মন মেজাজের অবস্থা হল খুব খারাপ। রোবির কপোট্রনের কানেকশান কেটে তাকে অচল করে রাখা টুকি কিংবা ঝায়ের জন্যে এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় কিন্তু মহাকাশযানের কোথায় কী আছে সেগুলো রোবি ছাড়া আর কেউ জানে না বলে তাকে চলাফেরা করতে দিতে হচ্ছে।
হাইপার ডাইভ দেওয়ার দুই সপ্তাহ পর রোবির যন্ত্রণায় টুকি এবং ঝায়ের জীবন যখন মোটামুটি অসহ্য হয়ে উঠল তখন হঠাৎ করে তাদের জীবনে খানিকটা উত্তেজনা দেখা দিল। ঘুম থেকে উঠে তারা আবিষ্কার করল এই নক্ষত্রপুঞ্জের সবচেয়ে হিংস্র এবং সবচেয়ে যুদ্ধবাজ বিদ্রোহী দলটি তাদের মহাকাশযানটিকে দখল করে বিচিত্র একটি গ্রহে নামিয়ে ফেলেছে।
টুকি, ঝা এবং রোবিকে মহাকাশযান থেকে নামিয়ে বিদ্রোহী দল তাদের আস্তানায় নিয়ে যেতে থাকে। যারা তাদেরকে টেনে হিচড়ে নামিয়েছে তারা সবাই খুব উগ্র প্রকৃতির মানুষ, টুকি এবং ঝাকে গলাধাক্কা দিয়ে নামিয়ে নিতে নিতে তাদের সম্পর্কে নানা ধরনের অসম্মানজনক কথা বলতে লাগল। টুকি এবং ঝা অবশ্যি বিশেষ কিছু মনে করল না, তাদের জীবনে তারা অসংখ্যবার এরকম পরিবেশে পড়েছে। রোবি অবশ্য সারাক্ষণ তাদের জ্বালাতন করতে লাগল, পিছু পিছু হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী ভয় পাচ্ছেন?
টুকি মুখ শক্ত করে বলল, পেলে পেয়েছি, তাতে তোমার বাবার কী?
না, আমি শুনেছি মানুষ খুব ভয় পেলে জামা কাপড়ে নাকি পেচ্ছাব করে দেয়। আপনারা কী পেচ্ছাব করে দিয়েছেন?
ঝা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, না, করি নি।
কেমন করে জানেন করেন নি? হয়তো নিজের অজান্তে করে দিয়েছেন। আমি শুনেছি মানুষ নিজের অজান্তে পেচ্ছাব করে দেয়। ব্লাডার বলে একটা জিনিস থাকে, কিডনি থেকে ফিল্টার হয়ে পেচ্ছাব সেখানে এসে জমা হয়, সেটাকে যেটা কন্ট্রোল করে–
চুপ কর হতভাগা–ফিউজড বাল্ব, প্যাচ কাটা স্কু–
ঝায়ের ধমক খেয়েও রোবি নিবৃত্ত হল না, ফিসফিস করে বলল, মানুষ ভয় পেলে তাদেরকে নাকি খুব বিচিত্র দেখায়। আপনাদেরকেও বিচিত্র দেখাচ্ছে। কি মনে হয় এখন আপনাদের কি গুলি করে মারবে? তাহলে ভয় পেয়ে নিশ্চয়ই কাপড়ে পেচ্ছাব করে দেবেন। আচ্ছা, পেচ্ছাব জিনিসটা কী? তার পি. এইচ. কত? স্পেসেফিক গ্র্যাভিটি? ক্যামিকেল কম্পােজিশান? রংটা কী?
পেছন থেকে রোবির পিছনে কষে একটা লাথি মারার ইচ্ছা ঝাকে অনেক কষ্ট করে সংবরণ করতে হল।
টুকি এবং ঝাকে বিদ্রোহী দলের নেতার সামনে এনে প্রায় ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়া হল। নেতা মানুষটির বয়স খুব বেশি নয়, মাথায় বড় চুল এবং লম্বা লম্বা গোঁফ, গায়ের রং ফ্যাকাশে, চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু এবং টকটকে লাল। ঢিলেঢালা আলখাল্লার মতো একটা ক্যাটক্যাটে হলুদ রংয়ের কাপড় পরে আছে। ঢুলু ঢুলু চোখে টুকি এবং ঝাকে এক নজর দেখে বলল, এরাই তারা?
রাগী রাগী চেহারার একজন মোটা গলায় বলল, জী হুঁজুর! তারপর সে টুকি এবং ঝায়ের পিছনে গুতো দিয়ে বলল, আমাদের নেতাকে অভিবাদন কর–
টুকি শুকনো মুখে বলল, অভিবাদন কেমন করে করে?
মাটিতে মাথা ঠেকাও। বেকুব কোথাকার।
টুকি এবং ঝা মাটিতে মাথা ঠেকাতে যাচ্ছিল তখন বিদ্রোহী দলের নেতাটি গুরুগম্ভীর গলায় বলল, তুমি বেকুব কাকে বলছ? এই দুজন হচ্ছেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ পরিচালনাকারী অস্ত্রবিজ্ঞানী রিকি এবং ফ্রাউল।
টুকি এবং ঝা চমকে উঠলো, তারা নিচু শ্রেণীর চোর, বিজ্ঞানী রিচি-ফ্রাউল নয় কিন্তু সেটা এখন বলা ঠিক হবে কী না বোঝা যাচ্ছে না।
দলের নেতা তার লম্বা গোঁফে হাত বুলিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখকে যেটুকু সম্ভব খুলে বলল, এই দুজন অস্ত্রবিজ্ঞানীকে গোপনে আমাদের এম সেভেন্টিওয়ান এলাকায় পাঠানো হয়েছে। আমরা তাদের ধরে ফেলেছি, এখন তাদেরকে কত দামে গ্যালাক্টিক হাই কমাণ্ডের কছে বিক্রি করতে পারব চিন্তা করে দেখেছ কেউ?
যে মানুষটি টুকি এবং ঝাকে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে অভিবাদন করার জন্যে পীড়াপিড়ি করছিল, সে এবারে খুব কাচুমাচু হয়ে পড়ল। মাথা নিচু করে বলল, বুঝতে পারি নাই স্যার—একেবারে চোরের মত চেহারা ছবি–
চুপ কর বেয়াদপ। এক্ষুনি বিজ্ঞানী রিচি আর ফ্রাউলের পায়ে চুমু খেয়ে ক্ষমা চাও।
যারা টুকি এবং ঝাকে মহাকাশযান থেকে ধরে এনেছে তাদের অনেকেই এবার উবু হয়ে টুকি এবং ঝায়ের পায়ে চুমু খাবার চেষ্টা করতে লাগল। ঝা মোটামুটি হতবাক হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল টুকি ততক্ষণে খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছে। বৃষ্টির রাতে আশ্রয় নেবার জন্যে মহাকাশযানে উঠে বুড়োমতন যে দুজন বদরাগী মানুষকে বৃষ্টির মাঝে বাইরে ফেলে এসেছিল তারাই নিশ্চয় বিজ্ঞানী রিচি আর ফ্রাউল। তারা সেই মহাকাশযানটিতে করে এসেছে বলে তাদেরকেই মনে করছে অস্ত্রবিজ্ঞানী রিচি আর ফ্রাউল। এই রকম মাথা গরম বিদ্রোহী দলকে সত্যি কথাটা তাড়াতাড়ি বলে দেওয়া ভাল। এটি গোপন রাখার চেষ্টা করেও খুব লাভ হবে বলে মনে হয় না। টুকি কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমরা আসলে বিজ্ঞানী রিচি আর ফ্রাউল নই। আমার নাম হচ্ছে টুকি আর এ হচ্ছে ঝা।
বিদ্রোহী দলের নেতা হা হা করে হেসে উঠে বলল, আমি ঠিক এরকম একটা উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম মহামান্য অস্ত্রবিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্রাউল। এর আগেরবার আমরা যখন গ্যালাক্টিক এম্বেসডরকে ধরেছিলাম তিনিও প্রথমে কিছুতেই স্বীকার করতে চাচ্ছিলেন না। শেষে আমরা যখন একটা একটা করে তার নাকের লোম ছিড়তে শুরু করলাম–
নাকের নোম?
হ্যাঁ! তখন সব স্বীকার করে ফেললেন। আপনারা অবশ্যি জ্ঞানী মানুষ, আপনাদের উপর নিচু স্তরের অত্যাচার করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু দরকার পড়লে আর কী করব?
টুকি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আসলে আমরা সত্যিই বিজ্ঞানী নই।
খুব যেন একটা মজার কথা শুনেছে সেরকম ভান করে বিদ্রোহী দলের নেতা জিজ্ঞেস করল, তাহলে আপনারা কী?
আমরা আসলে চোর।
চোর? হা হা হা–দলপতির সাথে অন্য সবাই এবারে উচ্চস্বরে হা হা করে হাসতে শুরু করে এবং টুকি আর ঝা হঠাৎ করে খুব অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। দলপতি এক সময় হাসি থামিয়ে বলল, আপনারা সত্যি সত্যি জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ব্যক্তি। মিথ্যা কথাটি কেমন করে বলতে হয় তার বিন্দু বিসর্গও জানেন না। মিথ্যা কথা বলতে হয় সত্যের খুব কাছাকাছি করে। আপনাদের বলা উচিত ছিল যে আপনারা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার কিংবা শিল্পীসাহিত্যিক। তা না বলে আপনারা বললেন চোর!
টুকি মুখ শক্ত করে বলল, আমরা সত্যিই চোর।
দলপতি তার চোখে কৌতুকের হাসি ধরে রেখে বলল, তার কোন প্রমাণ আছে?
আছে। আমরা শেষবার যেটা চুরি করেছি সেটা আমাদের কাছেই আছে।
দেখি, কী চুরি করেছেন।
টুকি তার কোমর থেকে খুলে হীরার ঝোলাটি দলপতির দিকে এগিয়ে দিল। সে ভিতরে এক নজর তাকিয়ে একটা বড় সাইজের হীরা বের করে এনে আবার উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। অন্য সবাই যারা কাছাকাছি ছিল এবারে তারাও হাসতে শুরু করল। টুকি এবং ঝা প্রথমবারের মত পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেল, হীরা চুরি করার মাঝে কোন অংশটি হাসির কে জানে। দলপতি কোনমতে হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বলল, আপনারা চুরি করার আর জিনিস পেলেন না? হীরা চুরি করলেন?
কী হয় হীরা চুরি করলে?
খুব বড় রকমের গাধামো হয়। মাটি থেকেই যখন দশ কেজি বিশ কেজি সাইজের হীরা তুলে নেওয়া যায় তখন যদি কেউ এইটুকুন হীরা দেখিয়ে বলে সে সেটা চুরি করে এনেছে তখন শুনতে কেমন লাগে?
টুকি আর ঝা কিছুই বুঝতে পারল না, খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। দলপতি বলল, এই পুরো গ্রহটা হীরার তৈরি। এই যে আপনি মেঝের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা হীরার, দেওয়ালটা হীরার, এই গ্রহের ছাদ হীরার, বাইরের পাহাড়টা হীরার! দুই বিলিয়ন বছর আগে এই গ্রহের কার্বন-কোর বাইরের পাথরের চাপে হীরা হয়ে গেছে। তারপর গত এক বিলিয়ন বছরে বাইরের পাথর ক্ষয়ে গিয়ে ভিতরের হীরা বের হয়ে এসেছে। এখানে কেউ হীরা চুরি করে না।
টুকি এবং ঝা নিচে তাকাল। সত্যি সত্যি তারা স্বচ্ছ কিছুর উপর দাঁড়িয়ে আছে, চারিদিকে সেই একই স্বচ্ছ দেওয়াল, স্বচ্ছ ঘরের ছাদ। চারিদিকে এত হীরা আর তারা কী না এই অল্প কয়টা হীরা চুরি করার জন্যে জীবন পণ করেছিল? টুকি এবং বার হঠাৎ নিজেদের বোকার মত মনে হতে থাকে।
দলপতি হাসি হাসি মুখে বলল, আপনারা কী এখনো দাবি করবেন যে আপনারা চোর, নাকি সত্যি কথাটি বলে দেবেন বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্রাউল।
টুকি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি কথাটাই হচ্ছে আমরা চোর।
বেশ। তাই যদি মনে করেন তাহলে তাই হোক। দলপতির চোখমুখ হঠাৎ কেমন জানি থমথমে হয়ে যায়, গম্ভীর গলায় বলে, যদি আপনারা সেই বিখ্যাত খ্যাতিমান অস্ত্রবিজ্ঞানী না হয়ে থাকেন, আপনাদেরকে আমার কোন প্রয়োজন নেই।
ঝা এক গাল হেসে বলল, তাহলে আমরা যেতে পারি?
উহুঁ। দলপতি মাথা নেড়ে বলল, আমি বলেছি আপনাদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আপনাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রয়োজন নেই সেটা তো বলি নি। ফেডারেশানের সাথে আমাদের বার বছর থেকে যুদ্ধ চলছে। আমাদের লোকজন আহত হচ্ছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হচ্ছে—আমাদের তাজা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দরকার। আপনাদের কিডনি, লিভার, প্যাংক্ৰিয়াস, ইন্টেস্টাইন, হার্ট, লাংস, আংগুল, হাত, পা, চোখ, কান দরকার।
ঝা মুখ হা করে বলল, সবই তো দরকার। তাহলে বাকি থাকল কী?
একজন হি হি করে হেসে বলল, চুল।
টাক মাথা একজন এগিয়ে এসে বলল, আমার চুলও দরকার।
তার কথা শেষ হবার আগেই একজন মানুষ ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে এগিয়ে এসে বলল, স্কাউটশীপ যুদ্ধে আমার ডান পাটা গেছে। আমি শুকনো মানুষটার পাটা চাই।
চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন এগিয়ে এসে বলল, আমি একটা চোখ চাই।
বুক থেকে কিছু টিউব বের হয়ে একটা যন্ত্রের সাথে লাগানো আছে সেরকম একজন বলল, আমাকে একটা হার্ট দিলেই চলবে।
আগুনে পোড়া ঝলসে যাওয়া একজন মানুষ চেঁচিয়ে বলল, আমার দরকার চামড়া। মোটাটার চামড়া, ভাল ইলাস্টিক মনে হচ্ছে।
দেখতে দেখতে অসংখ্য কানা, খোড়া, পোড়া, কাটা, ফাটা, ঝলসানো মানুষ। টুকি এবং ঝাকে ঘিরে ফেলল। তারা সবাই টুকি এবং ঝায়ের শরীরের কিছু না কিছু চাচ্ছে।
দলপতি হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমাদের যা প্রয়োজন সব পাবে। অস্ত্রোপাচারকারী রবোটকে ডাক, নিয়ে যাক এক্ষুনি। কাটাকুটি করে ভাগাভাগি করে নাও, যাও।
দলপতির কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে মানুষগুলো আনন্দে চিৎকার করে উঠে টুকি এবং ঝাকে খামচা খামচি করতে থাকে। সবাই মিলে যখন দুজনকে ধরে টানাটানি করছে ঠিক তখন তারা হঠাৎ করে সত্যিকার বিপদটা টের পেল। প্রথমে টুকি নিজেকে সামলে নিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, আমরা আসলে বিজ্ঞানী রিচি আর ফ্রাউল। এতক্ষণ মিছে কথা বলছিলাম।
কানা খোড়া এবং ঝলসানো মানুষ তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সরবরাহ হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে টুকির কথাকে চাপা দিয়ে হৈ হুঁল্লোর করে টানাটানি করতে থাকে। টুকির সাথে গলা মিলিয়ে ঝাও তখন গলা উঁচিয়ে বলল, আমরা অস্ত্র বিজ্ঞানী। অস্ত্রবিজ্ঞানী।
বিদ্রোহী দলপতি আবার হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে ভুরু কুচকে বলল, আপনারা অস্ত্রবিজ্ঞানী?
জী।
এতক্ষণ তাহলে নিজেদের চোর বলে দাবি করছিলেন কেন?
টুকি থতমত খেয়ে বলল, অত্যন্ত গোপন প্রজেক্টে যাচ্ছিলাম, আমাদের উপরে খুব কড়া নির্দেশ ছিল যে কিছুতেই সত্যিকারের পরিচয় দেয়া যাবে না।
দলপতি শক্ত মুখে বলল, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী আমার মনে হয় আপনারা প্রথমে সত্যি কথা বলেছিলেন এখন মিথ্যা কথা বলছেন। আসলেই আপনারা চোর। আপনাদের চেহারায় একটা চোর ছ্যাচড়ের ভাব আছে। বিশেষ করে এই যে মোটাটা, একে দেখে একটা গর্দভের মত মনে হয়।
অন্য সময় হলে ঝা নিঃসন্দেহে অপমানিত বোধ করত কিন্তু এখন করল না। আমতা আমতা করে বলল, মানুষের চেহারার উপর নিজের হাত নেই। যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার আমার চেহারার ডিজাইন করেছে, সেই ব্যাটা বদমাইশ নেশা করে।
দলপতি মাথা নেড়ে বলল, আমি ওসব কথা শুনতে চাই না। আপনারা যে বিজ্ঞানী তার কোন প্রমাণ আছে?
উপস্থিত কানা খোড়া কাটা ফাটা এবং ঝলসানো মানুষেরা সমস্বরে চিৎকার করে বলল, নাই। নাই।
টুকি চিঁ চিঁ করে বলল, মহাকাশযানের লগ পরীক্ষা করে দেখেন, সেখানে আমরা ছাড়া আর কে থাকবে?
দলপতি বলল, ঠিক আছে, আজ রাতে আমরা ফেডারেশানের একটা দলকে আক্রমণ করব। যুদ্ধ চলাকালীন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আপনাদের দুজনের। আপনারা সত্যিকারের অস্ত্রবিজ্ঞানী কী না তখনই প্রমাণ হয়ে যাবে।
টুকি ফ্যাকাসে মুখে বলল, আমাদের কী করতে হবে?
মেগা কম্পিউটারে সিস্টেমস কন্ট্রোল করতে হবে। ভয়েস কমান্ড দিয়ে সুপার মাইজার চালাতে হবে, স্কাউটশীপ স্কোয়াড্রনকে ট্র্যাক করতে হবে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন সবকিছু।
টুকি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, জানি। জানি। করতে পারবেন তো সবকিছু?। টুকি চিঁ চিঁ করে বলল, পারব। একশবার পারব। ঝা মাথা নেড়ে বলল, সোজা কাজ। একেবারে পানির মত সোজা।
রোবি এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, কী সুন্দর মিথ্যা কথা বলছেন আপনারা মুগ্ধ হয়ে গেছি দেখে। মানুষ কী সুন্দর মিথ্যা কথা বলতে–
দলপতি জিজ্ঞেস করলো, কী বলছে এই ব্যাটা রবোট?
ইয়ে বলছে বলছে আপনাদের দলটি খুব দুর্ধর্ষ!
দলপতি মৃদু হেসে বলল, এখনই দুর্ধর্ষ বলছে—যখন আমাদের যুদ্ধ করতে দেখবে তখন কী বলবে?
টুকি কিছু না বলে দুর্বল ভাবে হাসল। দলপতি তার দলের একজনকে ডেকে বলল, জেনারেল কাওয়াগাতা এই দুজনকে কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যাও।
মুখের অর্ধেক উড়ে গেছে এরকম একজন মানুষ এগিয়ে এসে বলল, চলুন বিজ্ঞানী রিচি আর বিজ্ঞানী ফ্রাউল।
টুকি ফ্যাকাসে মুখে বলল, চলুন।
০৪. দলপতির সুদৃশ্য ঘরটিতে
দলপতির সুদৃশ্য ঘরটিতে নরম আরামদায়ক চেয়ারে টুকি এবং ঝ হেলান দিয়ে বসে আছে। সামনে কালো গ্রানাইটের টেবিল, তার অন্য পাশে বিদ্রোহীদের দলপতি, পাশে কয়েকজন বিশ্বাসী জেনারেল। সবার সামনে পানীয় এবং খাবার। দলপতি পানীয়ের একটা গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, আমাদের মহান অতিথিদের উদ্দেশ্যে। ফেডারেশানের সবচেয়ে বড় যুদ্ধে আমাদের জয়ী করিয়ে দেয়ায় তাদের অভূতপূর্ব কৃতিত্বের জন্যে।
সবাই বলল, অভূতপূর্ব কৃতিত্বের জন্যে।
পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জেনারেল কাওয়াগাতা বলল, আমি যদি নিজের চোখে না দেখতাম তাহলে বিশ্বাস করতাম না। এটি ছিল আমার দেখা সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী যুদ্ধ।
ছোট ছোট চুলের একজন জেনারেল মাথা নেড়ে বলল, সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। মূল কম্পিউটারে কোন তথ্য না দিয়ে আমাদের এই মহামান্য মোটা বিজ্ঞানী সেখানে একটা লাথি দিলেন। তার গোদা পায়ের লাথি খেয়ে মাল্টিপ্রসেসর খুলে পুরো সিস্টেম রিসেট হয়ে গেল। সে কারণে শত্রুদের মহাকাশযান আমাদের প্রধান ঘাঁটির খোঁজ পেল না। কেউ কী চিন্তা করতে পারে একটা বড় ধরনের যুদ্ধ হচ্ছে মূল কম্পিউটারকে অচল রেখে?
বুড়োমত একজন জেনারেল বলল, যখন ভয়েস কমান্ড ব্যবহার করার কথা তখন সেখানে কণ্ঠস্বরে কোন আদেশ না দিয়ে বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্ৰাউল মানুষ যেভাবে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠে ঠিক সেরকম শব্দ করতে শুরু করলেন। তখন পুরো ভয়েস কমান্ড সিস্টেম ধসে পড়ল। আর ঠিক তখন কন্ট্রোল মনিটরে একটা ঘুষি দিলেন, কী অপূর্ব সময়জ্ঞান! সাথে সাথে স্কাউটশীপ থেকে দুইটা মিসাইল বের হয়ে এল। নিখুত নিশানায় গিয়ে আঘাত করল ফেডারেশনের যুদ্ধ জাহাজকে।
জেনারেল কাওয়াগাতা বলল, কী-বোর্ডে কোন তথ্য না দিয়ে সেখানে ক্রমাগত থাবড়া দিতে লাগলেন। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল অর্থহীন কাজ। কিন্তু সেটা অর্থহীন নয় সেই থাবড়া খেয়ে কম্পিউটার জ্যাম হয়ে গিয়ে তিনটা নিউক্লিয়ার বোমা ছেড়ে দিল!
আমাদের এক স্কোয়াড্রন স্কাউটশীপ যখন উড়ে যাচ্ছিল তখন কন্ট্রোল রুম থেকে সাহায্য চাইল। কো-অর্ডিনেট না বলে তাদেরকে বললেন গোল্লায় যাও। তার অর্থ বৃত্তাকারে ঘুরতে থাক। বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে মূল মহাকাশযানকে আওতার মাঝে পেয়ে গেল।
আর মাইজার কন্ট্রোলের ঘটনাটা–
দলপতি হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এই দুই মহান বিজ্ঞানীর কথা বলে শেষ করা যাবে বলে মনে হয় না। তার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমাদের মস্তবড় সৌভাগ্য তারা যুদ্ধ পরিচালনায় আমাদেরকে সহযোগিতা করতে রাজী হয়েছিলেন। আমি তাদেরকে অবিশ্বাস করেছিলাম সে জন্যে ক্ষমা চাইছি।
টুকি এবং ঝা মৃদু হেসে ক্ষমা করে দেবার ভঙ্গী করল।
জেনারেল কাওয়াগাতা গম্ভীর মুখে বলল, বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্রাউলের কাছে থেকে আমাদের পুরো যুদ্ধ পরিচালনার নিয়ম-কানুন শিখে নিতে হবে।
দলপতি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।
সবই দলপতির দিকে ঘুরে তাকাল কী আইডিয়া?
আমাদের য়ুতে মাত্র দুইজন অস্ত্রবিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্ৰাউল থাকার কারণেই অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। বিদ্রোহী দল হিসেবে আমাদের সবসময় যুদ্ধ করতে হয়। যদি দুজন না হয়ে দুইশ অস্ত্রবিজ্ঞানী হত? কিংবা দুই হাজার? কিংবা আরো বেশি?
বুড়োমত জেনারেল চোখ বড় বড় করে বলল, আপনি কী বলতে চাইছেন?
আমি এই বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্রাউলের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে তাদের বিদ্যাবুদ্ধি দক্ষতা আমাদের সকল সদস্যদের মাথায় বসিয়ে দিতে চাই। তারা সবাই যেন বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্রাউলের মত ভাবতে পারে, চিন্তা করতে পারে।
উপস্থিত জেনারেলরা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, চমক্কার বুদ্ধি! চমৎকার আইডিয়া!!
টুকি এবং ঝায়ের চোয়াল স্কুলে পড়ল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, সবাই আমাদের দুজনের মত হয়ে যাবে?
হ্যাঁ! আমরা গত যুদ্ধে মস্তিষ্ক স্ক্যানের এই যন্ত্রটি দখল করেছি। এটা ব্যবহার করে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান, বুদ্ধি আরেকজন মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। আপনাদের জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তাধারা ব্যক্তিত্ব সব আরেকজনের মাথায় নিয়ে যাব। যারা শুকনো পাতলা তারা পাবে বিজ্ঞানী রিচির মস্তিষ্ক যারা মোটা তারা পাবে বিজ্ঞানী ফ্রাউলের মস্তিষ্ক।
টুকি এবং ঝা খানিকক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলল, সবাই?
হ্যাঁ! আমি ছাড়া সবাই। প্রথমে জেনারেলেরা তারপর সিনিয়র সদস্যরা। তারপর সাধারণ সদস্যরা। দেরী করে লাভ নেই, এখন থেকেই শুরু করে দেয়া যাক।
দুই সপ্তাহ পরে যখন টুকি এবং ঝা তাদের মহাকাশযান বোঝাই করে এই গ্রহের প্রস্তর খণ্ড নিয়ে—যাকে সাধারণভাবে হীরা বলা হয়—মহাকাশের উদ্দেশ্যে। রওনা দিল তখন বিদায় জানানোর জন্যে মহাকাশ স্টেশনে এই গ্রহের প্রায় সবাই এসে ভীড় জমিয়েছিল। ঠিক বিদায়ের সময় এই গ্রহের সব অধিবাসীরা কেন মুচকি হেসে টুকি এবং ঝায়ের দিকে চোখ টিপে দিল বিদ্রোহী দলের দলপতি সেটা কিছুতেই বুঝতে পারল না। শুধু তাই নয়, যে দুর্ধর্ষ দলটিকে পুরো এম। সেভেন্টিওয়ান নক্ষত্রপুঞ্জের ত্রাস হিসেবে বিবেচনা করা হত তারা ঠিক কী কারণে যুদ্ধ বিগ্রহ ছেড়ে দিয়ে নিরীহ ছিচকে চোর হয়ে গেল, বিদ্রোহী দলের দলপতি সেই রহস্যটিও কোনদিন ভেদ করতে পারল না।
০৫. মহাকাশযানটির কন্ট্রোল প্যানেলে বসে
মহাকাশযানটির কন্ট্রোল প্যানেলে বসে টুকি খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেটি পরীক্ষা করছে। কাছাকাছি মেঝেতে পা ছড়িয়ে খেতে বসেছে ঝা—যন্ত্রপাতিতে তার কোন উৎসাহ নেই। আরো খানিকটা দূরে রোবি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, টুকি খানিকক্ষণ কিছু একটা লক্ষ্য করে অধৈর্য হয়ে হাত নেড়ে বলল, এর মাথামুও কিছু বুঝতে পারছি না।
রোবি বলল, এটি কোন জীবিত জিনিস নয়—এর মাথামুণ্ডু নেই কাজেই এটা বুঝতে পারছ না।
টুকি চোখ পাকিয়ে রোবির দিকে তাকিয়ে বলল, দূর হও হতভাগা।
রোবি দূর হওয়ার কোন চিহ্ন দেখাল না বরং আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, মানুষ যখন নির্বোধের মত কাজ করে তখন আমার দেখতে বড় ভাল লাগে।
আমি কোন জিনিসটা নির্বোধের মত করছি?
এই যে মহাকাশযান চালানোর কোন কিছু না জেনে আপনি এটা চালানোর চেষ্টা করছেন! ভুল জায়গায় টেপাটেপি করছেন।
টুকি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি মহাকাশযান চালানো জান?
জানি। এটাকে কেমন করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়া যায় তুমি জান? অবশ্যি জানি।
তাহলে ব্যাটা বদমাইশ আমি এতদিন থেকে এটাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, আমাকে একবার সাহায্য করতে এলে না কেন?
আমাকে বলেন নাই, তাই আসি নাই।
টুকি খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রোবির দিকে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ঠিক আছে। এখন আমি বলছি, আমাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।
রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ কিছু যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে বলল, এখান থেকে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার দুটি উপায় আছে। একটা বড় হাইপার ডাইভ কিংবা দুটি ছোট হাইপার ডাইভ। বড় হাইপার ডাইভ দেয়ার সমস্যা একটিই–মহাকাশানে যথেষ্ট জালানী নেই। ছোট দুটি হাইপার ডাইভ দেওয়া যেতে পারে তবে সেটারও একটা সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
প্রথমে মহাকাশযানের বেগ বড়াতে হবে, সেজন্যে কাছাছি একটা বড় গ্রহ বা নক্ষত্র দরকার। কাছাকাছি সেরকম কিছু নেই। মহাকাশযানের ট্র্যাজেক্টরীও পাল্টাতে পারব না, জ্বালানী নষ্ট হবে। যদি এভাবে যেতে থাকি চার সপ্তাহের মাঝে একটা মাঝারী গোছের নক্ষত্র পাওয়া যাবে, সেটাকে ব্যবহার করে হাইপার ডাইভ দেওয়া যাবে।
টুকি অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু সমস্যাটা কী?
ঐ যে বললাম, চার সপ্তাহ যেতে হবে। আপনারা যেভাবে তিনবেলা খাচ্ছেন খাবার কম পড়ে যাবে।
ঝা চোখ লাল করে বলল, সেটাই সমস্যা?
সেটাই মূল সমস্যা। আরো কিছু ছোট সমস্যা আছে। মহাকাশযানটা যে পথ দিয়ে যাবে সেখানে আশেপাশে বেশ কিছু গ্রহ উপগ্রহ আছে, সেখানে মানুষ। আর রবোটের বসতি। তারা সেরকম বন্ধুভাবাপন্ন নয়।
ঝা মেঝেতে বসে বড় একটা গলদা চিংড়ি চিবুতে চিবুতে বলল, তাতে সমস্যাটা কী? আমরা কী আর আত্মীয়তা করতে যাচ্ছি?
রোবি তার যন্ত্রপাতির দিকে ঝুকে পড়ে বলল, এ ছাড়াও আরো একটি সমস্যা আছে। হাইপার ডাইভ দেওয়ার পর মাঝে মাঝে সময় নিয়ে গোলমাল হয়।
টুকি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, কী গোলমাল?
যেমন মনে করেন আজকে রওনা দিয়ে গতকাল পৌঁছে যাওয়া।
ঝা হা হা করে হেসে বলল, এটা গোলামাল হবে কেন? এটা তো ভাল, জীবনে খানিকটা সময় বাড়তি পেয়ে যাওয়া যাবে।
ঝা যত সহজে ব্যাপারটা মেনে নিল আসলেই এটা এত সহজে মেনে নেয়া উচিত কী না সেটা নিয়ে টুকির একটু সন্দেহ হয়। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে তার আর মাথা ঘামানোর ইচ্ছে করছিল না। একটু অধৈর্য হয়ে বলল, রোবি, বকবক বন্ধ করে এখন তাহলে চল পৃথিবীর দিকে।
ব্যাপারটা যত সহজ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল সেটা যে এত সহজ নয়। সেটা টের পেল দুদিন পরেই। সবুজ রংয়ের মাঝারী একটা গ্রহের পাশে দিয়ে যাবার সময়, কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে একটা স্কাউটশীপ এসে টুকি, ঝা আর রোবিকে ধরে নিয়ে গেল।
যারা তাদের ধরে নিয়ে গেল তারা সবাই রবোট। যাদের কাছে ধরে নিয়ে গেল তারাও রবোট এবং তারা যাদের কাছে তাদের ধরে নিয়ে গেল তারাও রবোট। টুকি একজনকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের এখানে কোন মানুষ নেই?
যাকে জিজ্ঞেস করল সে কালচে রংয়ের বিদঘুটে একটি যন্ত্র, মুখ দিয়ে ফোৎ করে একটা শব্দ করে বলল, মানুষ? ছিঃ!
তাহলে আমাদের ধরে এনেছ কেন?
ধরে এনেছি? হাহ্।
এখানে কে আছে? কার সাথে কথা বলা যাবে?
কথা?
হুঁ!।
টুকি বুঝতে পারল এই নিম্নশ্রেনীর রবোটটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। বিভিন্ন রবোটের মাঝে হাত বদল হয়ে যখন শেষ পর্যন্ত তারা মোটামুটি নেতা গোছের একটা চালাক চতুর রবোটের সামনে হাজির হল তখন টুকি জিজ্ঞেস করল, তোমরা আমাদের ধরে এনেছ কেন? রবোটটি তার সবুজ চোখ দুটিকে হালকা লাল রংয়ে পাল্টে দিয়ে বলল, তোমাদের কাপাট্রনের কন্ট্রোলার আই.সি.টা দরকার।
টুকি ভুরু কুচকে বলল, কী বললে? কন্ট্রোলার আই. সি.?
হ্যাঁ! তোমাদের মত রেপ্লিকা রবোট আমাদের খুব কম। যদি কপোট্রন থেকে–
ঝ চোখ কপালে তুলে বলল, রেপ্লিকা রবোট? আমরা মোটেও রেপ্লিকা রবোট না।
তাই নাকি? তোমরা কি তাহলে ড়ুপ্লিকা?
না আমরা রেপ্লিকা ড়ুপ্লিকা কোনটাই না। আমরা মানুষ।
মানুষ! রবোটটা একটা আর্ত চিৎকার করে দুই পা পিছিয়ে গেল। ক্লিক ক্লিক করে কয়েটা শব্দ হল, চারপাশে ঘিরে থাকা রবোটেরা হাতে অস্ত্র ধরে তাদের দিকে তাক করে ধরল। গবেট ধরনের একটা রবোট জিজ্ঞেস করল, গুলি করে দেব নাকি?
নেতা গোছের রবোর্টটা বলল, আগেই করো না, তবে গুলির রেঞ্জের মাঝে রাখ।
বেঁটে খাটো একটা রবোট ভাঙা গলায় বলল, সর্বনাশ! মোটা মানুষটা আমার দিকে তাকাচ্ছে। বিপদ হবে না তো আমার?
হতে পারে। চোখে চোখে তাকিও না। তোমার সর্বনাশ করে দেবে। ওদের সব বদমাইশী চোখের মাঝে।
টুকি এবং ঝা মোটামুটি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কোনমতে নিজেদেরকে সামলে নিয়ে বলল, তোমরা আমাদের এত ভয় পাচ্ছ কেন?
ভয় পাব না? কী বল তুমি? মানুষ হচ্ছে এই সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে খল, ফন্দিবাজ, ধূর্ত, অসৎ, বদমাইশ এবং ধুরন্ধর। তারা ইচ্ছা করলে দিনকে রাত করে দিতে পারে রাতকে দিন করে দিতে পারে। গ্রহকে নক্ষত্র করে দিতে পারে নক্ষত্রকে গ্রহ করে দিতে পারে। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। আমরা রবোটরা মানুষ থেকে দশ লাইট ইয়ার দূরে থাকি।
আমাদেরকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঝা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমরা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ।
সাধারণ মানুষ বলে কোন কথা নেই। আগুন যেরকম ঠাণ্ডা হয় না মানুষ সেরকম সাধারণ হয় না। মানুষ মানেই অসাধারণ
না। ঝা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, মানুষের মাঝে দুষ্টু মানুষ আছে কিন্তু আমরা সেরকম মানুষ নই। আমরা কারো ক্ষতি করি না।
রবোটদের নেতাটি উঁচু গলায় অন্য রববাটদের বলল, বলেছিলাম না, মানুষেরা খুব যুক্তি দিয়ে অযৌক্তিক কথা বলে? এই দেখ। খবরদার কেউ এদের সাথে কথা বলো না।
টুকি একটু এগিয়ে এসে বলল, আমরা মোটেও অযৌক্তিক কোন কথা বলছি না। কিন্তু যদি তোমরা আমাদের সাথে কথা বলতে না চাও তাহলে আমাদের যেতে দাও। আমরা যাই।
গবেট ধরনের রবোটটা আবার বলল, গুলি করে দেব না কী?
না। আগেই করো না, গুলি করলে মরে যাবে। মানুষের মত অপদার্থ প্রাণী খুব কম রয়েছে ছোট একটা গুলি খেলেই মরে যায়।
মরে গেলে আবার সার্ভিসিং করে নেব।
মানুষ মরে গেলে সার্ভিসিং করা যায় না।
কোন কোম্পানি এদের তৈরি করে? কত দিনের ওয়ারেন্টি দেয়?
কোন কোম্পানি এদেরকে তৈরি করে না। এদের কোন ওয়ারেন্টি নেই।
গবেট ধরনের রবোটটা বলল, তাহলে গুলি করে দেই।
না। নেতা গোছের রবোটটা বলল, এদেরকে না মেরে সাবধানে এদের মস্তিষ্ক কেটে আলাদা করে নিতে হবে। তখন আর কোন ভয় থাকবে না, কিন্তু সব রকম বুদ্ধি নেওয়া যাবে। তখন এরা আমাদের সাহায্য করবে।
উপস্থিত সবগুলো রবোট মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার বুদ্ধি! চমকার বুদ্ধি!!
টুকি এবং ঝা শুকনো গলায় বলল, তোমরা কী বলছ এই সব? মস্তিষ্ক কেটে নেবে মানে?
আমাদের অস্ত্রোপচারকারী রবোট আছে, নিখুঁতভাবে মস্তিষ্ক কেটে নিতে পারে।
নিলেই হল? তোমার ধারণা আমার মাস্তিষ্ক কেটে নিলে আমি কোনদিন তোমাদের সাহায্য করব?
করবে না?
করব না।
ঝা-ও জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, কক্ষণাে করব না।
টুকি চোখ মুখ লাল করে বলল, শুধু যে সাহায্য করব না তাই নয়, সাহায্য চাইলে এমন উল্টা পাল্টা বুদ্ধি দেব যে তোমরা বুঝতেই পারবে না, সেটা কাজে লাগাতে গিয়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমাদের।
গবেট ধরনের রবোট বলল, দেই গুলি করে শেষ করে।
টুকি বলল,তার চাইতে এসো মিলে মিশে থাকি। তোমাদের কী বিষয় সাহায্যের দরকার বল আমরা সাহায্য করি। যদি দেখ আমাদের সাহায্যে কাজ হচ্ছে না তখন না হয় যা ইচ্ছে হয় কর।
সত্যি বলছ? একেবারে একশ ভাগ সত্যি। এন্ড্রোমিডার কসম।
রবোটের নেতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমার প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। সেটা আমাদের সব বুদ্ধিজীবী রবোটদের সাথে আলোচনা করে দেখতে হবে।
গবেট ধরনের রবোর্টটা আবার গলা উঁচিয়ে বলল, এত সব ঝামেলা না করে দেই গুলি দিয়ে শেষ করে।
রবোটের নেতা যখন বুদ্ধিজীবী রবোটদের সাথে আলোচনা করছিল তখন টুকি এবং ঝা বসে বসে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে থাকে। চুরি করতে যাওয়ার আগে যেসব বিশেষ বিশেষ প্রার্থনা করত বসে বসে সেগুলো আওড়াতে থাকে। রোবি কাছে এসে বলল, আপনারা কী ভয় পাচ্ছেন? ব্লাডার কন্ট্রোল–
টুকি খেকিয়ে উঠে বলল, চুপ কর ব্যাটা গবেট, রবোটের বাচ্চা রবোট।
কী মনে হয় আপনাদের? মানুষ কী আসলেই খল, ফন্দিবাজ, ধূর্ত, অসৎ, বদমাইশ এবং ধুরন্ধর? আপনাদের কাজকর্ম দেখে মনে হয় সত্যি হতেও পারে ব্যাপারটা। কী বলেন?
ঝা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, বাজে কথা বললে এক ঘুষিতে কপোট্রন তুষ করে দেব।
রোবি তার গলায় মধু ঢেলে বলল, মনে হয় আপনারা একই সাথে ভয় পাচ্ছেন এবং রাগ হচ্ছেন। কী বিচিত্র একটা ব্যাপার। শুধু মাত্র মানুষের পক্ষেই। এটা সম্ভব। রাগ এবং ভয়। কী চমৎকার!
ঠিক এরকম সময়ে রবোটের নেতা বুদ্ধিজীবী রবোটদের নিয়ে হাজির হল বলে রোবির সাথে টুকি এবং ঝায়ের কথাবার্তা আর বেশিদূর এগুতে পারল না। বুদ্ধিজীবী রবোটদের দেখেই বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে তারা বুদ্ধিজীবী, তাদের লিকলিকে হাত পা এবং শরীরের তুলনায় বিশাল একটি মাথা। তাদের শরীরের ভারসাম্য ঠিক নয় এবং প্রত্যেকবার পা ফেলার সাথে সাথে মনে হতে থাকে তাল হারিয়ে নিচে আছাড় খেয়ে পড়বে—খুব সাবধানে তারা নিজেদের রক্ষা করে টুকি এবং ঝায়ের কাছে এগিয়ে আসে। যে বুদ্ধিজীবী রবোটের মাথা সবচেয়ে বড় সে বুদ্ধিজীবী সুলভ নাকী গলায় বলল, আপনারা আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন শুনে আমরা রবোটরা বিশেষ পুলকিত হয়েছি–
ঝা ফিসফিস করে বলল, পুলকিত মানে কী?
টুকি বলল, খুশী হওয়া।
বুদ্ধিজীবী রবোটটা বলল, আমরা সাধারণত মনুষ্য থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে থাকতে পছন্দ করি। তবে ঘটনাক্রমে যেহেতু আপনারা আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছেন, আমাদের কিছু করার নেই। আপনাদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে মস্তিষ্ক উৎপাটন না করে যদি কোন কাজ করা যায় সেটা সম্ভবত গ্রহণযোগ্য। যে ব্যাপারে আমরা আপনাদের সাহায্য কামনা করি সেটি অত্যন্ত গোপনীয়।
টুকি মাথা নেড়ে বলল, আমরা আপনাদের গোপনীয়তা রক্ষা করব।
আপনাদের নিয়ে আমি দুশ্চিন্তিত নই। আমাদের নিজেদের যে অশিক্ষিত অর্বাচীন মূখ রবোর্ট রয়েছে তাদের নিয়েই আমি চিন্তিত–
ঝা আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, অর্বাচীন মানে কী?
কোন একটা গালি গালাজ হতে পারে।
বুদ্ধিজীবী রবোট আবার নাকী সুরে বলল, আপনারা আমাদের সঙ্গে আসুন, ব্যাপারটি বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
গবোট ধরনের রবোটটা ফোৎ করে একটা শব্দ করে বলল, তখনই বলেছিলাম গুলি করে শেষ করে দেই—
বুদ্ধিজীবী রবোটগুলো টুকি এবং ঝাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে, মাথাটি বাড়াবাড়ি রকম বড় হওয়ায় রবোটগুলোর তাল সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল এবং মনে হচ্ছিল যে কোন মূহূর্তে বুঝি উল্টে পড়ে যাবে। সবচেয়ে বড় মাথা যে রবোটটির সে তার নাকী গলায় বলল, সবার জীবনে একটা উদ্দেশ্য থাকতে হয়। উদ্দেশ্যবিহীন জীবন জ্বালানীবিহীন রকেটের মতন।
ঝা মাথা নাড়ল, বলল, কিংবা খাবারহীন ডাইনিং টেবিলের মত।
রবোটটি ঝায়ের কথা শুনতে পেল বলে মনে হল না, রবোটদের খেতে হয় বলে মনে হয় কথার গুরুত্বটাও ধরতে পারল না। সে বলে চলল, আমাদের। জীবনেরও একটা মূল উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব জাতিকে ধ্বংস করা।
টুকি এবং ঝা একসাথে চমকে উঠল, কী বললে?।
হ্যাঁ, মানব জাতিকে ধ্বংস করা। মানুষ মাত্রই হচ্ছে খল, ফন্দিবাজ, ধূৰ্ত্ত, অসৎ, বদমাইশ এবং ধুরন্ধর। এরা সমস্ত বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে জীবাণুর মত ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত সৃষ্টিজগৎকে কলুষিত করে দিচ্ছে। এদেরকে যদি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া যায় এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সত্যিকারের শান্তি নেমে আসবে।
টুকি ঢোক গিলে বলল, তোমরা কীভাবে সেটা করবে?
আমরা সেটা এর মাঝে শুরু করেছি। শত্রুকে ধ্বংস করার প্রথম পর্যায় হচ্ছে তাদেরকে বোঝা। আমরা মানুষকে বোঝার কাজ শুরু করেছি।
কীভাবে সেটা করছ?।
রাগ, দুঃখ, আনন্দ, ঘৃণা, ভালবাসা এই ধরনের কিছু ব্যাপার আছে মানুষের। তারা সেগুলোর নাম দিয়েছে অনুভূতি। আমাদের সেগুলো নেই।
সেটাই হচ্ছে আমাদের মূল সমস্যা।
ঝ একটু ইতস্তত করে বলল, দেখ, তোমাদের একটা কথা বলি–একেবারে একশভাগ সত্যি, এড্রোমিডার কসম!
কী কথা?
তোমাদের যে অনুভূতি নেই সেটা আসলে সমস্যা নয়, সেটা হচ্ছে তোমাদের উপর আশীর্বাদ। এই ঝামেলা যাদের আছে তাদের জীবন একেবারে ফানা ফানা হয়ে যাচ্ছে।
হতে পারে। কিন্তু তবুও মানুষ নামের এই খল, ফন্দিবাজ, ধূর্ত, অসৎ বদমাইশ এবং ধুরন্ধর শত্রুকে বুঝতে হলে আমাদের এই অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে হবে। সেই জন্যে আমরা অনেক দিন থেকে কাজ করছি, আমাদের বেশ খানিকটা সাফল্যও এসেছে।
টুকি ভয়ে ভয়ে মাথা বড় রবোটটির দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তোমরা আজকাল রেগে যাও? দুঃখ আনন্দ এই সব পাও?
ইচ্ছা করলে পেতে পারি। আমরা সেটা আবিষ্কার করেছি। হার্ডওয়ার সফটওয়ার তৈরি হয়ে গেছে, এখন কপোট্রনে বসিয়ে দেওয়ার জন্যে ছোট চীপ তৈরি হচ্ছে।
কথা বলতে বলতে বুদ্ধিজীবী রবোটটা একটা বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের উপরে লেখা দুঃখ ল্যাবরেটরি।
টুকি এবং ঝা একটু অবাক হয়ে বুদ্ধিজীবী রবোটটার দিকে তাকাতেই রবোর্টটা বলল, এই ল্যাবরেটরিতে আমরা রবোটদের দুঃখ দেওয়া নিয়ে গবেষণা করি।
ঝা মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে বলল, মাথা খারাপ আর কাকে বলে। দুঃখ দেওয়ার গবেষণা!
টুকি জিজ্ঞেস করল, কতদূর হয়েছে গবেষণা?
আসুন, আপনাদের দেখাই।
রবোটটা কোথায় চেপে ধরতেই একটা স্বচ্ছ জানালা খুলে গেল এবং দেখা গেল ভিতরে ছোট একটা জানালার পাশে একটা শুকনো ধরনের রবোট বসে আছে। তার হাতে একটা বই। রবোটটি খুব মনোযোগ দিয়ে বইটি পড়ছে। বুদ্ধিজীবী রবোট বলল, এইটা খুব দুঃখের একটা বই। একটা রবোটের কপোট্রনের পাওয়ার সাপ্লাইয়ে কীভাবে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল সেই কাহিনী। লেখা আছে। এই বইটা পড়ে এই রবোটটা দুঃখ পায় কী না দেখা হচ্ছে।
বুদ্ধিজীবী রবোটের কথা শেষ হবার আগেই জানালার পাশে বসে থাকা শুকনো ধরনের রবোটটা হঠাৎ বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মেঝেতে মাথা কুটে হাউ মাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করল। টুকি এবং ঝা স্পষ্ট দেখতে পেল চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। বুদ্ধিজীবী রবোটটি খুব সন্তুষ্টির ভান করে বলল, সফল এক্সপেরিমেন্ট। চোখের পানিটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে লোনা হয়েছে কী না!
টুকি এবং ঝা এবারে খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। কপোট্রনের পাওয়ার সাপ্লাইয়ে গোলমাল হলে কী এভাবে কান্নাকাটি করা উচিত? কে জানে। রহোটদের জীবনে এটাই হয়তো গভীর দুঃখের ব্যাপার। বুদ্ধিজীবী রবোট এবারে টুকি আর ঝাকে নিয়ে গেল পাশের ল্যাবরেটরিতে। তার উপর বড় বড় করে লেখা ক্রোধ ল্যাবরেটরি।
ঝা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কী রাগারাগি হয়?
হ্যাঁ। ক্রোধ অনুভূতিটি এর মাঝে বিশ্লেষণ করা হয়। কী কী কারণে রাগ হওয়া উচিত সেটা বের করে বিশাল একটা ডাটাবেস তৈরি করা হয়েছে। সেই সব কোন একটা ঘটনা ঘটে গেলেই রবোটেরা রেগে উঠে।
রেগে উঠে?
হ্যাঁ তখন কপোট্রনে উল্টোপাল্টা সিগনাল দেওয়া হয়। বিতিকিচ্ছি একটা ব্যাপার ঘটে। আপনাদেরকে দেখাই।
একটা সুইচ টিপে আগের মত একটা স্বচ্ছ জানালা খুলে দেওয়া হল। ভিতরে গাবদা গোবদা একটা রবোট টুলের উপর বসে আছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুটকো মত একটা রবোট। বুদ্ধিজীবী রবোট বলল, যে রবোটটা বসে আছে তাকে এখন রাগিয়ে দেওয়া হবে।
কী ভাবে?
রবোটটি আরেকবার সুইচ টিপে দিয়ে বলল, দেখেই বুঝতে পারবেন।
টুকি এবং ঝা আবাক হয়ে দেখল শুটকো রবোটটি ঘরের এক কোণায় হেঁটে গিয়ে বিশাল একটা হাতুরী নিয়ে এসে বসে থাকা রবোটটার মাথায় গদাম করে মেরে বসল। মনে হলো সেই আঘাতে রবোর্টটার মাথা তার শরীরের ভিতর খানিকটা ঢুকে গেছে।
ঝা মাথা নেড়ে বলল, রাগানোর একেবারে এক নম্বর বুদ্ধি।
টুকি এবং ঝায়ের কোন সন্দেহই রইল না যে গাবদা গোবদা রবোর্টটা রেগে উঠছে। তার সবুজ চোখ দুটি আস্তে আস্তে টকটকে লাল হয়ে উঠল, কান থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করল, শরীর থেকে ছোট ছোট বজ্রপাতের মত বিদ্যুৎপাত হতে শুরু করল। এক সময় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আঁ আঁ করে বিকট চিঙ্কার করতে করতে টুলটা তুলে নিয়ে শুটকো রবোটটাকে এলোপাথাড়িভাবে মারতে শুরু করল। টুলটা কিছুক্ষণের মাঝেই ভেঙ্গেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল তখন খালি হাতেই শুটকো রবোটটিকে চেপে ধরে কিল ঘুষি লাথি মারতে মারতে ঘরের এক কোণা থেকে অন্য কোথায় নিয়ে যায়, দেয়ালে চেপে ধরে পেটে ঘুষি মারতে থাকে, মাথা টেনে শরীর থেকে আলগা করে আনে, নিচে ফেলে উপরে লফিয়ে সমস্ত শরীরটাকে দলামোচা করে ফেলে। কিছুক্ষণেই শুকনো রবোটের শরীরের বিশেষ কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।
বুদ্ধিজীবী রবোট তার মস্ত মাথা নেড়ে বলল, নিখুঁত রাগ। একেবারে মানুষের খাঁটি রাগ।।
টুকি সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেলে শুটকো রবোটটার ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে রইল।
টুকি এবং ঝা এভাবে আনন্দ ল্যাবরেটরি, ঘৃণা ল্যাবরেটরি, হিংসা ল্যাবরেটরি, ভালবাসা ল্যাবরেটরি দেখে শেষ পর্যন্ত একটা বড় ল্যাবরেটরির সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার উপরে বড় করে লেখা কৌতুকবোধ ল্যাবরেটরি। বুদ্ধিজীবী রবোর্টটা ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, আমাদের সমস্ত গবেষণা এইখানে এসে মার খেয়ে যাচ্ছে।
টুকি জিজ্ঞেস করল, কি ভাবে?
বছরের পর বছর আমরা গবেষণা করে যাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই রবোটের মাঝে কৌতুকবোধ জাগাতে পারছি না। কোন জিনিসটা শুনে হাসতে হয় আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। আমাদের মাঝে কোন সেন্স অফ হিউমার নেই।
মানুষের তৈরি যত হাসির গল্প রয়েছে, যত কার্টুন, জোক রসিকতা সব নিয়ে আসা হয়েছে, আমাদের শত শত বুদ্ধিজীবী রবোট সেগুলো পড়ে যাচ্ছে, বিশ্লেষণ করে যাচ্ছে। আমাদের যত সুপারকম্পিউটার রয়েছে সেগুলো লক্ষ লক্ষ সফটওয়ার তৈরি করেছে, বিশাল সমস্ত ডাটাবেস তৈরি হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয় নি। এখনো আমরা দেখে বা শুনে বুঝতে পারি না কোনটা হাসির আর কোনটা হাসির নয়।
ঝা জিব দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে বলল, বড়ই দুঃখের কথা।
বুদ্ধিজীবী রবোটটা নাকী সুরে বলল, এই একটা মাত্র জিনিসের জন্যে আমরা মানুষের সমান হতে পারছি না। এই ব্যাপারে তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন।
টুকি ভুরু কুচকে বলল, আমাদের কী করতে হবে।
আমাদের রসিকতা শেখাতে হবে।
টুকির চোয়াল ঝুলে পড়ল, রসিকতা শেখাতে হবে?
হ্যাঁ! এক সপ্তাহ সময় দেয়া হল। এর মাঝে যদি আমাদের রসিকতা শেখাতে পার তোমাদের চলে যেতে দেব।
টুকি শুকনো গলায় বলল, আর যদি না পারি?
তাহলে তোমাদের মস্তিষ্কটা আলাদা করে নেব।
রবোটদের কোন রসবোধ নেই, তারা যে ঠাট্টা করছে না সেটা বুঝতে টুকি আর ঝায়ের এতটুকু দেরী হল না।
বুদ্ধিজীবী রবোর্টটা কৌতুকবোধ ল্যাবরেটরি ঘরের দরজা খুলে তার মাঝে ঠেলে টুকি এবং ঝাকে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘটাং করে বাইরে থেকে তালা মেরে দিল।
০৬. ঘরের ভিতরে একটা বড় টেবিল
ঘরের ভিতরে একটা বড় টেবিল, তার চারপাশে বেশ কয়েকটা চেয়ার। চেয়ারে পিঠ সোজা করে দুটি রবোট বসে আছে। ঘরের দেয়ালে অসংখ্য তাক সেখানে মাইক্রো ক্রিস্টালে পৃথিবীতে হাস্যকৌতুক নিয়ে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে সব জমা করে রাখা আছে। ঝা শুকনো মুখে বলল, কী বিপদে পড়া গেল।
টুকি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বিপদের কী আছে? হাসি তামাশা তো ছেলেমানুষী ব্যাপার, বোঝানো কঠিন হবে না।
ঝা বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়ল, বলল, হাসি তামাশা করা সোজা। সেটা বোঝানো সোজা নয়।
এস, দেখি চেষ্টা করে এদের কী অবস্থা। টুকি রবোট দুটির সামনে গিয়ে বলল, তোমাদের নাম কী?
রবোট দুটি দেখতে হুঁবহুঁ এক রকম, একজন বলল, আমাদের কোন নাম নেই।
নাম নেই? এ তো মহা যন্ত্রণা হল দেখি।
এটা কী হাসির কথা? আমরা কি হাসব?
না এটা হাসির কথা নয়। কিন্তু তোমাদের নাম না থাকলে ডাকাডাকি করা নিয়ে খুব অসুবিধে হবে। প্রথমে তোমাদের একটা করে নাম দিয়ে দেওয়া যাক।
কী নাম দেবে?
যেহেতু আমাদের প্রজেক্ট তোমাদের হাসাহাসি করানো, কাজেই তোমাদের নাম দেওয়া যাক হাসা আর হাসি। টুকি একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম হাসা তারপর অন্যজনের দিকে তাকিয়ে বলল, আর তোমার নাম হাসি।
রবোট দুটি মাথা নেড়ে নিজেদের নাম গ্রহণ করে নিল।
টুকি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, হাসা এবং হাসি এবার হাসাহাসি শুরু কর।
হাসা নামের রবোর্টটি বলল, এটা কী হাসির কথা? আমরা কী হাসব?
হাসি নামের রবোটটা বলল, না এটা আমার কথা না।
টুকি হেসে বলল, এটা হাসির কথা না সেজন্যে এটা হাসির কথা!
তাহলে কী আমরা হাসব?
হ্যাঁ, হাস।
রবোট দুটি কাঠ কাঠ স্বরে উচ্চারণ করল হা হা হা হা। তাদের এই শুষ্ক ধাতব স্বর শুনে হঠাৎ করে টুকি এবং ঝায়ের শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। টুকি শুকনো গলায় বলল, ঝা, কাজটা সহজ হবে না।
ঝা বলল, আমি জানতাম।
টুকি একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাসা-হাসির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা এতদিন কী করছ?
আমরা একটা কৌতুক নিয়ে সেটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি।
কতদিন থেকে করছ?
হাসা বলল, আজকে নিয়ে সাত বছর দুই মাস এগারো দিন।
টুকি এবং ঝা একসাথে চমকে উঠলো, ঝা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী? কী বললে?
হাসি বলল, এটা কিছুই না। এর আগেরটা নিয়ে আমারা এগারো বছর সময় কাটিয়েছি। শেষে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে সেটা ছেড়ে দিয়েছি। সেই তুলনায় এইটা মনে হয় সহজ। গত ছয় মাস থেকে মনে হয় একটু একটু বুঝতে পারছি।
কী বুঝতে পারছ?
কৌতুকটার কোন জায়গায় হাসতে হবে।
টুকি ভুরু কুচকে বলল, কৌতুকটা কী, শুনি।
একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে বলছে, কাল আমার স্ত্রী শেষ পর্যন্ত আমার সামনে হাঁটুগেড়ে উবু হয়ে বসেছে।
তাই নাকী? হাঁটুগেড়ে বসে কী বলেছে?
বলেছে, খাটের তলা থেকে বের হয়ে আয় মিনষে।
টুকি শুনে খুবখুক করে এবং ঝা হা হা করে হেসে উঠল। হাসা এবং হাসি তাদের সবুজাভ ফটো সেলের চোখ দিয়ে টুকি এবং ঝাকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করে তাদের হাসি থামার পরে বলল, আমাদের ধারণা এটি কেন কৌতুককর আমরা সেটাও বুঝতে পেরেছি।
কেন, শুনি।
কারণ মানুষটি তার বন্ধুকে মিথ্যা কথা বলছে।
কখন মিথ্যা কথা বলল?
মানুষ কখনো খাটের তলায় যায় না, এটি মিথ্যা কথা।
মিথ্যা কথা বললে সেটা হাস্যকর হবে কেন?
কারণ মানুষদের নীতি জ্ঞান খুব কম। তারা মিথ্যাচার করে আনন্দ পায়।
টুকি রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, সাত বছর বিশ্লেষণ করে এইটা আবিষ্কার করলে?
হাসি বলল, কেন ভুল হয়েছে?
টুকি কোন কথা না বলে মেঝেতে পা দাপিয়ে ঘরের অন্যপাশ চলে গেল।
হাসা ঝাকে জিজ্ঞেস করল, এইটা কী হাস্যকর? আমরা কী এখন হাসব?
ঝা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ইচ্ছে হলে হাস।
হাসা এবং হাসি একসাথে কাঠ কাঠ স্বরে উচ্চারণ করল, হা হা হা হা এবং সেটা শুনে আবার টুকি এবং ঝায়ের সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠে।
পরবর্তী দিনগুলো টুকি অমানুষিক পরিশ্রম করে রোট দুটিকে হাস্য কৌতুকের মর্মকথা বোঝানোর চেষ্টা করে। যখন সে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল রবোটেরা ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছে তখন সে তাদেরকে একটা কৌতুক শোনাল। কৌতুকটা এরকম:
বায়োলজি শিক্ষক একটা কাবাব চিমটা দিয়ে ধরে বলল, এই যে ব্যঙটা দেখছ এটা এখন আমরা কাটব।
ছাত্রছাত্রীরা বলল, স্যার, এটা তো ব্যঙ নয়, এটা কাবাব।
স্যার চোখ কপালে তুলে বললেন, তাহলে আমি নাস্তা করলাম কী খেয়ে
কৌতুকটা শুনে হাসা এবং হাসি হা হা করে হেসে উঠে এবং সেটা দেখে টুকি বেশ উৎসাহ অনুভব করল। জিজ্ঞেস করল, বল দেখি কোন জায়গাটা হাসির?
হাসা বলল, খুব সহজ। যখন শিক্ষক বলল, তাহলে আমি কী খেয়ে নাস্তা করলাম?
টুকির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বলল, ঠিক ধরেছ। হাসি তুমি এখন বল, কেন এই কথাটা হাসির।
কারণ শিক্ষক দুইটা কাবাব এনেছিল। একটা দিয়ে নাস্তা করেছে আর দু নম্বরটা চিমটা ধরে ছাত্রছাত্রীদেরকে দেখিয়েছে।
টুকির চোয়াল স্কুলে পড়ল। কোনমতে বলল, আর ব্যঙটা?
সেটা লাফ দিয়ে জানালা দিয়ে বের হয়ে গেছে। হা হা হা।
টুকি এবং ঝা খুব মন মরা হয়ে এক বেলা কাটিয়ে দিল। সময় শেষ হয়ে আসছে, যদি তারা রবোটগুলোকে হাস্য কৌতুক শেখাতে না পারে আক্ষরিক অর্থেই তাদের মাথা কাটা যাবে।
পরের তিনদিন টুকি আবার খাওয়া ঘুম ছেড়ে রবোটগুলোর পিছনে লেগে রইল। ঝা-ও সাহায্য করতে চাইছিল কিন্তু টুকি ঝাকে এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না বলে কাছে ঘেষতে দিল না। মানুষ কেন হাসে, কেন হাসা উচিত, কোথায় কোথায় হাসা যায় এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলল, উদাহরণ দিল নিজে নেচে কুদে অভিনয় করে দেখাল এবং সব শেষ করে আবার তাদেরকে একটা কৌতুক শোনাল। এবারের কৌতুকটা এরকম :
একজন এক পায়ে লাল অন্য পায়ে সবুজ মোজা পরে এসেছে। বন্ধু জিজ্ঞেস করল, কী হল দুই পায়ে দুরকম মোজা কেন?
কী করব বল। বাসায় আরো এক জোড়া মোজা আছে সেটাও এরকম।
কৌতুকটা শুনে রবোট দুটি অনেক জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। টুকি একটু আশান্বিত হয়ে বলল, বল দেখি এই কৌতুকটা কেন হাসির?।
হাসা বলল, এটা বলা তো খুবই সোজা। মানুষটার বোকামী নিয়ে হাসা হচ্ছে।
টুকি হাতে কিল দিয়ে বলল, ঠিক বলেছে। এবারে বল দেখি বোকামীটা কী?
মানুষটার বুদ্ধি কম। বাজারে গিয়ে প্রত্যেকবারই দুই রংয়ের দুইটা মোজা কিনে ফেলে।
টুকি আবার তার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। তার এতদিনের পরিশ্রম পুরোটাই বৃথা গেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর মাত্র একটি দিন বাকি, গত ছয়দিনে যাকে এতটুকু শেখানো যায়নি সে বাকি একদিনে পুরোটুকু শিখে নেবে এটা আশা করা ঠিক নয়। টুকি তবু আশা ছাড়ল না, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে সে রবোট দুটির পিছনে লেগে রইল, তাদের সে হাস্য কৌতুকের মর্মকথা বুঝিয়েই ছাড়বে। একটানা আঠারো ঘণ্টা পরিশ্রম করে সে হাসা এবং হাসিকে জিজ্ঞেস করল, এখন বুঝতে পেরেছ?
রবোট দুটি মাথা নাড়ল। বলল, পেরেছি। একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
চমৎকার! টুকি আশা নিয়ে বলল, এবারে তাহলে পরীক্ষা করা যাক। একটা কৌতুক বলি : একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কুকুরটা নাকি এত বুদ্ধিমান যে তোমাদের সাথে তাশ খেলে! মানুষটা উত্তর দিল, বুদ্ধিমান না কচু! হাতে টেক্কা পড়লেই খুশীতে লেজ নাড়তে থাকে আর আমরা বুঝে ফেলি কী পেয়েছে!
হাসা এবং হাসি জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। টুকি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এবার বল তো, কেন এটা হাসির?
খুবই সহজ। মানুষ ভাবছে কুকুরটা বুদ্ধিমান আসলে নেহায়েৎই বোকা! টেক্কা পেলেই লেজ নাড়ানো ঠিক নয়।
টুকি ফ্যাকাশে মুখে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের জীবন এখানেই শেষ ঝা। এক সপ্তাহ চেষ্টা করে কোন লাভ হল না। গবেট রবোটগুলো গবেটই রয়ে গেল।
ঝা বলল, আমি একটু চেষ্টা করে দেখব?
দেখতে চাইলে দেখ, কী লাভ হবে আমি জানি না।
ঝা হাসা এবং হাসির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, পৃথিবীতে হাসির জিনিসগুলো কী জান?
হাসা এবং হাসি দ্বিধান্বিত ভাবে বলল, জানি না।
ঝা এক গাল হেসে বলল, ঠিক বলেছ, আসলে কেউই জানে না। তাই কী করতে হয় জান?
কী?
যেটা দেখবে সেটা দেখেই হাসবে। একজন মানুষকে যদি দেখ মোটা হি হি করে হেসে বলবে মানুষটা কী মোটা! যদি দেখ শুকনো তাহলে হি হি করে হেসে বলবে, মানুষটা কী রোগা! রাগী মানুষকে দেখে হাসবে কারণ সে রাগী, হাসি খুশী মানুষকে দেখে হাসবে কারণ সে হাসিখুশী!
সত্যি?
একশভাগ সত্যি। এন্ড্রোমিডার কসম। হি হি হি করে হাসবে, হা হা হা করে হাসবে হো হো হো করে হাসবে, খিক খিক খিক করে হাসবে–খক খক খক করে হাসবে, খিল খিল খিল করে হাসবে—হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে।
এমনিতেই? কোন কারণ ছাড়া?
হ্যাঁ। এমনিতেই। কোন কারণ ছাড়া।
সত্যি?
সত্যি। হাসি পেলেও হাসবে, হাসি না পেলেও হাসবে। হাসির মত ভাল জিনিস এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কিছু নেই। কোন কিছুকেই গুরুত্ব দিয়ে নেবে না, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গুরুতর কিছু নেই, সব কিছু নিয়ে হাসা যায়। যে যত বেশি হাসে তার তত আনন্দ! নাও শুরু কর।
হাসা এবং হাসি হাসতে শুরু করল, প্রথমে টুকির শুকনো শরীর দেখে হাসল, তারপর তার গোমড়া মুখ দেখে হাসল, ঝাকে দেখে হাসল—তার বিশাল শরীর দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল। ঠিক তখন দরজা খুলে গেল, বুদ্ধিজীবী রবোটগুলো হাস্য কৌতুকের কাজ কতটুকু অগ্রসর হয়েছে দেখতে এসেছে। বিশাল মাথা এবং লিকলিকে শরীর নিয়ে কোন মতে তাল সামলে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী রবোটদের দেখে হাসা এবং হাসি অট্টহাসি দিতে শুরু করে, একে অন্যকে ধরে তারা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। তারা একে অন্যকে দেখে হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে তারা কাশতে থাকে, এবং কাশতে কাশতে তাদের চোখে পানি এসে যায়।
বুদ্ধিজীবী রবোট খানিকক্ষণ অবাক হয়ে হাসা এবং হাসির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, আমরা গত দুই শতাব্দী চেষ্টা করে যেটা করতে পারি নি আপনারা এক সপ্তাহে সেটা করে ফেলেছেন। আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
টুকি এতক্ষণে নিজেকে সামলে ফেলেছে, এক গাল হেসে বলল, এটা কোন ব্যাপারই নয়। এর থেকে হাজার গুণ কঠিন কাজ আমরা করতে পারি।
বুদ্ধিজীবী রবোট কোনমতে নিজের তাল সামলে রেখে বলল, এ ব্যাপারে আমাদের এখন বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
ঝা ইতস্তত করে বলল, আমরা কী এখন আমাদের মহাকাশযানে ফিরে যেতে পারি?
অবশ্যি। অবশ্যি ফিরে যেতে পারেন। আমরা রবোটেরা যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে খল, ফন্দিবাজ, অসৎ, বদমাইশ এবং ধুরন্ধর মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলব তখন কৃতজ্ঞতার সাথে আপনাদের সাথে স্মরণ করা হবে।
টুকি মুখে জোর করে হাসি ফুটয়ে বলল, শুনে খুব খুশী হলাম।
রবোটদের নেতা অনেকক্ষণ কোন কথা বলে নি এবারে এগিয়ে এসে বলল, আপনাদের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া যেন আরো আনন্দময় হয় সে জন্যে আমরা একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
টুকি শুকনো মুখে বলল, কী ব্যবস্থা?
আপনারা মাত্র দুজন মানুষ, তৃতীয়জন রবোট। আপনাদের নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে আপনাদের রবোট রোবির আপনাদের মতই রাগ দুঃখ আনন্দ ঘৃণা এরকম অনুভূতি থাকুক।
টুকি বিস্ফারিত চোখে রবোটটির দিকে তাকাল। সেটি গলায় এক ধরনের আনন্দের ভাব ফুটিয়ে বলল, রোবির ভিতরে আমরা আমাদের বিভিন্ন অনুভূতির ল্যাবরেটরি থেকে অনুভূতিগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছি।
কী-কী-কী বললে?
হ্যাঁ। এখন তোমাদের দীর্ঘ ভ্রমণ হবে আনন্দময়। রোবি এখন আর শুধু যন্ত্র নয়। সে অনুভূতিপ্রবণ একটি সত্তা। শুধু একটি জিনিস খেয়াল রেখ।
কী জিনিস?
কখনো যেন রোবিকে রাগিয়ে দিও না। জানই তো রোবট রেগে গেলে কী সাংঘাতিক অবস্থা হয়।
টুকি এবং ঝা শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। ঝা বিড় বিড় করে বলল, না, ভয় নেই। আমরা রোবিকে রাগাব না। কখনোই রাগাব না।
০৭. জানালার কাছে বসে
জানালার কাছে বসে টুকি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে রাবি বসেছিল সে বিরক্ত ভঙ্গী করে ঘুরে টুকির দিকে তাকিয়ে কর্কশ স্বরে বলল, কী হল? এরকম লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছ কেন? মহাকাশযানের ভিতরে ভাল লাগছে না?
টুকি সাথে সাথে বিগলিত ভঙ্গী করে বলল, না, না, কী যে বল। চমৎকার লাগছে আমাদের। চমৎকার লাগছে।
ঝাও যন্ত্রের মত মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার লাগছে।
রোবি গলার স্বরে অধৈর্যের ভাব ফুটিয়ে বলল, দিনরাত দেখি ভ্যাবলার মত বসে আছ। একটু কাজকর্ম করতে পার না?
সাথে সাথে টুকি এবং ঝা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, অবশ্যি করতে পারি। কী করতে হবে বল?
মহাকাশযানটা যে একটা আঁস্তাকুড় হয়ে আছে খেয়াল করেছ? এটা একটু পরিষ্কার করা যায় না?
টুকি এবং ঝা সাথে সাথে মহাকাশযানটাকে ঘসে মেজে পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। রবোটদের গ্রহে রোবির কপোট্রনে নানারকম অনুভূতি জুড়ে দেবার পর রোবির বড় পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ সময় সে তিরিক্ষ মেজাজে থাকে, মাঝে মাঝে অকারণে তার মন খারাপ হয়ে যায় তখন কয়েকঘন্টা উচ্চস্বরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। তার কাছে তখন যাওয়া যায় না। কারণ সে যেভাবে হাত পা ছুড়তে থাকে যে ধারে কাছে গিয়ে বেকায়দা লেগে গেলে কম্পাউন্ড ফ্রাকচার হয়ে যাবার আশংকা থাকে। টুকি এবং ঝায়ের কোন কোন কাজকর্ম দেথে হঠাৎ হঠাৎ রোবির মাঝে প্রবল ঘৃণাবোধ জেগে উঠে তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে টুকি ঝা এবং সমস্ত মনুষ্য জাতিকে গালি-গালাজ করতে থাকে। কখনো কখনো তার মনে আনন্দের ভাব এসে যায়, সেটি আরো বিপজ্জনক তখন সে টুকি এবং ঝাকে ধরে নাচানাচি করার চেষ্টা করতে থাকে। টুকি কিংবা ঝ দুজনেরই মধ্যবয়স, নাচানাচি করার সময় অনেক দিন হল চলে গিয়েছে, চেষ্টা করে তাদের বিশেষ বিড়ম্বনা হয়। সব মিলিয়ে বলা যায় তাদের জীবন এই মহাকাশযানে বিষময় হয়ে আছে। কবে আরো তিন সপ্তাহ পার হবে, তারা ছোট নক্ষত্রটির পাশে পৌঁছে হাইপার ডাইভ দিয়ে পৃথিবীর দিকে রওনা দেবে সেই আশায় হা করে বসে আছে।
কিন্তু তার আগেই তাদের গতিপথে একটা ছোট গ্রহ পাওয়া গেল। রোবি গ্রহটাকে একপাক ঘুরে এসে বলল, এইখানে নামা যাক।
টুকি ভয়ে ভয়ে বলল, নামার দরকারটা কী? কে না কে আছে আবার নতুন কোন ঝামেলায় পড়ে যাব।
রোবি গলার স্বরে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, এখানে কেউ নেই। কেমন করে জান?
কারণ মানুষ রবোট যাই থাকুক তাদের জন্যে শক্তির দরকার। শক্তি খরচ হলে বায়ুমণ্ডলে তার চিহ্ন থাকে। রেডিয়েশান হিসেবে, বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড, ওজোন লেয়ার বা অন্য কোনভাবে। এখানে সেরকম কিছু নেই।
ঝা বলল, কিন্তু গ্রহটা ফাঁকা বলেই কী নামতে হবে? সবকয়টা ফাঁকা গ্রহে যদি নামতে নামতে যাই তাহলে তো একশ বছর লেগে যাবে–
রোবি একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর বেকুব কোথাকার। আমরা কী মশকরা করার জন্যে নামছি? হাইপার ডাইভ দেবার আগে বড় ইঞ্জিনটা সার্ভিস করতে হবে, সে জন্যে নামছি।
ঝা তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যি অবশ্যি।
ফাঁকা গ্রহটিতে মহাকাশযানটি মোটামুটি নিরাপদভাবে নামল। রোবির কথা সত্যি, ধূ ধূ প্রান্তর কোথাও জন-মানব সভ্যতার চিহ্ন নেই। লাল রংয়ের পাথর ছড়ানো, দেখে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।
রোবি যখন মহাকাশযানের বড় ইঞ্জিনটা খুলে আবার লাগানো শুরু করেছে তখন টুকি আর ঝা হাঁটতে বের হল। গ্রহটিতে খুব হালকা একটা বাতাসের স্তর রয়েছে, নিঃশ্বাস নেবার জন্যে তাদের আলাদা মাস্ক পরে নিতে হল। গ্রহটা জনমানবহীন মনে হচ্ছে সত্যি কিন্তু যদি কোন বিপদ আপদ ঘটে যায় সেজন্যে সাথে নিল দুটি শক্তিশালী লেজার গান, সহজে চলাফেরা করার জন্যে পিঠে রাখল শক্তিশালী জেট প্যাক।
দুজনে লাল পাথরের প্রায় মরুভূমি এলাকায় হাঁটতে থাকে, সামনে একটা বড় পাথরের স্তর। সেটা পার হয়ে অন্য পাশে এসে তারা বিচিত্র কিছু গাছগাছালী আবিষ্কার করল। টুকি গাছগুলো পরীক্ষা করে নিচু গলায় বলল, এই গ্রহে যদি গাছগাছালী থাকে তাহলে অন্য প্রাণীও থাকতে পারে।
হ্যাঁ! ঝা ভয়ে ভয়ে বলল, চল ফিরে যাই।
চল।
দুজনে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে, কয়েক পা এগিয়েই টুকি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ঝা—
কী হল? মনে হচ্ছে আমাদের কেউ অনুসরণ করছে।
ঝা শুকনো গলায় বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। দৌড় দেব নাকী?
দৌড় দেবে কেন? আমাদের জেট প্যাক আছে না? সুইচ টিপলেই আকাশে উড়ে যাব। ভয়ের কিছু নেই।
লেজার গানটা বের করে রাখব?
হ্যাঁ! বিপদ দেখলেই গুলি। মনে থাকবে তো?
টুকির কথা শেষ হবার আগেই বিপদ যেন তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, হঠাৎ করে চারিদিক থেকে হৈ হৈ করে অসংখ্য মানুষ তাদের দিকে ছুটে আসে। টুকি এবং ঝা লেজার গান উদ্যত করে গুলি করার জন্যে ট্রিগারে হাত দিয়েও তারা হতচকিতের মত দাঁড়িয়ে রইল, কারণ যারা হৈ হৈ করে তাদের দিকে ছুটে আসছে সবাই মেয়ে, স্বল্প বসনা এবং অনিন্দ্য সুন্দরী। পুরুষ মানুষ হয়ে এরকম সুন্দরীর মেয়েদেরকে আর যাই করা যাক গুলি করা যায় না।
কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই মেয়েগুলো টুকি এবং ঝাকে ঘিরে ফেলল। নীল চোখ এবং সোনালী চুলের একটি মেয়ে যার শরীর এত সুগঠিত যে একবার চোখ পড়লে চোখ ফেরানো যায় না—সবার আগে কথা বলল, ভাষাটি টুকি এবং ঝায়ের ভাষা থেকে খানিকটা ভিন্ন কিন্তু তবু বুঝতে অসুবিধে হল না। মেয়েটি বলল, হায় ঈশ্বর! এতো দেখছি পুরুষ মানুষ!
কালো চুলের একটি মেয়ে বিস্মিত হয়ে বলল, কী রকম পরিবারের মানুষ যে পুরুষদের একা একা বের হতে দিয়েছে?
নীল চোখের সোনালী চুলের মেয়েটি বলল, থাক, থাক, কিছু বলে কাজ নেই, ভয় পেতে পারে।
টুকি এবং ঝা এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে, হাতের অস্ত্রটা নামিয়ে রেখে হাসার চেষ্টা করে বলল, তোমাদের অভিনন্দন।
সাথে সাথে সব কয়জন মেয়ে বিস্ময়ে হতবাক হবার মত একটা শব্দ করল। কম বয়সী একটা মেয়ে নিজের চোখ ঢাকতে ঢাকতে বলল, কী রকম বেশরম দেখেছ? আমাদের সাথে কথা বলছে!
পোশাকটা দেখেছ? সারা শরীর দেখা যাচ্ছে, লজ্জায় মরে যাই!
টুকি এবং ঝা এবারে খানিকটা হতচকিত হয়ে গেল, তাদের পুরুষ হওয়া নিয়ে এখানে কোন একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। টুকি আবার চেষ্টা করল, বলল, তোমদের সবার জন্যে অভিবাদন। শুভ সকাল—কিংবা বিকাল যেটাই এখন হয়ে আছে।
মেয়েগুলো আবার একটা বিস্ময়ধ্বনি করে একটু পিছিয়ে গেল। কমবয়সী আরেকটা মেয়ে একটু বিচলিত হয়ে নীল চোখের মেয়েটিকে বলল, টাইরা, কিছু একটা কর, লজ্জায় মারা যাচ্ছি।
টাইরা পিছনে ফিরে বলল, দুইটা চাদর দাও।
পিছনের মেয়েরা দুটি উজ্জ্বল রংয়ের চাদর এগিয়ে দিল। টাইরা চাদরগুলো সাবধানে টুকি এবং ঝায়ের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ভাল করে শরীরটাকে ঢেকে নাও। পুরুষ মানুষের শরীর দেখানো খুব লজ্জার ব্যাপার।
টুকি এবং ঝা কিছুই বুঝতে পারছিল না, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে তর্ক করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হল না। তারা উজ্জ্বল রংয়ের কাপড় দুটি দিয়ে নিজেদের ভাল করে ঢেকে নিল। নিজেদেরকে হঠাৎ তাদের বোকার মত মনে হতে থাকে। টুকি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
টাইরা টুকিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল, পুরুষেরা কখনো অপরিচিত মেয়েদের সাথে কথা বলে না। সেটা ভারী লজ্জার ব্যাপার।
ঝা ঢোক গিলে বলল, তাহলে পুরুষেরা কার সাথে কথা বলে?
অন্য পুরুষের সাথে। তাদের ঘরের বাইরে যাবার কথা নয়। পুরুষদের সবসময় মেয়েদের সামনে পর্দা করার কথা।
টুকি এবং ঝা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, হঠাৎ করে তাদের কাছে অনেক জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়। মানুষের একটা বিচ্ছিন্ন সমাজ এখানে গড়ে উঠেছে যেখানে মেয়েরা ঘরের বাইরে থাকে আর পুরুষেরা অন্তঃপুরে বন্দী।
টুকি এবং ঝ ইচ্ছে করলে তাদের জেট প্যাক ব্যবহার করে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারতো কিন্তু যেহেতু পরিবেশটা সেরকম বিপজ্জনক মনে হচ্ছে না তারা ব্যাপারটা আরো একটু যাচাই করে দেখতে চাইল।
মেয়েদের দলটি তাদেরকে হাটিয়ে হাঁটিয়ে নিতে থাকে। বয়স্ক মানুষেরা যেভাবে শিশুদের সাথে ব্যবহার করে মেয়েরা তাদের সাথে ঠিক সেরকম ব্যবহার করছিল। এই সমাজে পুরুষ মানুষেরা নিশ্চয়ই খুব কোমল প্রকৃতির।
হেঁটে হেঁটে তারা একটা লোকালয়ের কাছে পৌঁছতেই অনেকে তাদের দিকে ছুটে এল, সবাই মেয়ে। কেউ বালিকা, কেউ কিশোরী, কেউ তরুণী, কেউ যুবতী, কেউ কেউ মধ্যবয়স্কা। সবাই কৌতূহলী চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিশোরী এবং বখে যাওয়া কিছু তরুণী শীষ দিয়ে টুকি এবং ঝায়ের কাপড় ধরে টান দেয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু টাইরার প্রচণ্ড ধমক খেয়ে তারা পালিয়ে গেল। টুকি এবং ঝা হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করে রাস্তার দুপাশে পাথরের ঘরের ভিতরে জানালার ফাঁক দিয়ে ঘোমটায় ঢাকা পুরুষ মানুষেরা উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে।
মেয়েদের দলটি টুকি এবং ঝাকে নিয়ে একটা বড় বাসার সামনে হাজির হল। বাসাটি সম্ভবত টাইরার, কারণ অন্য সব মেয়েরা বাইরের বারান্দায় অপেক্ষা। করতে লাগল, শুধু টাইরা টুকি এবং ঝাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। সাথে সাথে ভিতর থেকে সুদর্শন কোমল চেহারার একজন পুরুষ মানুষ টাইরার দিকে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওগো সোনামনি, তুমি ফিরে এসেছ?
টাইরা মাথা নাড়ল। পুরুষ মানুষটি নিশ্চয়ই টাইরার স্বামী, সে আদুরে। বেড়ালের মত ভঙ্গী করে বলল, টাইরা, সোনামনি আমার, পথে কোন কষ্ট হয়নি তো?
না।
তোমায় এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় এনে দিই?
না, লাগবে না। তুমি বরং এই দুজন পুরুষ মানুষকে দেখ।
টাইরার স্বামী, কোমল চেহারার পুরুষটি এবারে টাইরাকে ছেড়ে দিয়ে টুকি এবং ঝায়ের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, এরা কারা?
লাল পাহাড়ের কাছে পেয়েছি। একেবারে বেপর্দা হয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল।
টাইরার স্বামী লজ্জায় জিবে কামড় দিয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
হ্যাঁ! অত্যন্ত বেশরম মানুষ–নিজে থেকে আমাদের সাথে কথা বলছিল।
কী লজ্জা! কী লজ্জা!
তুমি তাদের সাথে একটু কথা বলে দেখ, ব্যাপারটা কী? কোথা থেকে এসেছে, কী সমাচার। না জানি বেচারার স্ত্রীরা এখন কোথায় কী দুশ্চিন্তা করছে।
টাইরার স্বামী মুখে একটা কপট রাগের ভান করে বলল, আমি বুঝতে পারি না কী রকম মেয়েমানুষ তাদের স্বামীদের এরকম একলা ছেড়ে দেয়। যদি কিছু একটা হত? যদি তোমাদের সামনে না পড়ে কোন খারাপ মেয়েদের সামনে পড়ত?
টুকি এবং ঝা দেখল টাইরার কোমল চেহারার সুদর্শন স্বামী ব্যাপারটা চিন্তা করে আতংকে কেমন জানি শিউরে উঠে।
টাইরা চলে যাবার পর টুকি এবং ঝা তাদের সারা শরীরে ঢাকা চাদরগুলো খুলে রাখল। টাইরার স্বামী বিস্মিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কারা ভাই? একা একা কী করছ? তোমাদের স্ত্রীরা কই? তোমাদের একা ছেড়ে দিল কেমন করে?
টুকি মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের স্ত্রী নেই।
মানুষটার মুখে হঠাৎ সমবেদনার চিহ্ন ফুটে উঠে, আহা। বিয়ে হয় নি এখনো? কোন মেয়ে পছন্দ করল না?
না, মানে–
মেয়েদের মন জয় করতে হলে একটু চেষ্টা করতে হয়। সেজে গুজে থাকতে হয়, দাড়ি কামিয়ে চুল পরিপাটি করে আচড়াতে হয়, শরীরে পারফিউম দিয়ে সুন্দর কাপড় পরতে হয়। তোমাদের যেরকম রুক্ষ চেহারা, সাথে যেভাবে বেশরম কাপড় পরেছ কোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে তোমাদের পছন্দ করবে ভেবেছ?
টুকি বলল, আসলে ব্যাপারটা তা নয়। আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানকার নিয়ম-কানুন অন্যরকম।
কোথা থেকে এসেছ তোমরা?
অন্য একটা গ্রহ থেকে। এটা যেরকম এম সেভিন্টিওয়ান–
টাইরার স্বামী বাধা দিয়ে বলল, থাক থাক আর বলতে হবে না। আমি ওসব বুঝি না। আমরা পুরুষ মানুষেরা ঘর সংসার করি বড় বড় জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শুনে কী করব?
টুকি ভুরু কুচকে বলল, তোমরা শুধু ঘর সংসার কর?
টাইরার স্বামী অবাক হয়ে বলল, আর কী করব? একজন পুরুষ মানুষ যদি তার স্ত্রীকে খুশী রাখতে পারে তাহলে তার জীবনে আর কী চাইবার আছে? সারাদিন পরিশ্রম করে স্ত্রী ঘরে এলে তার জন্যে রান্না করে খাবার দেওয়া, পোশাক ধুয়ে রাখা বাচ্চা মানুষ করা—
টুকি এবং ঝা কেমন জানি ভয়ে ভয়ে টাইরার স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক এরকম সময় দরজা খুলে একজন তরুণ এসে ঢুকল, তার চোখে পানি টল টল করছে। টাইরার স্বামী জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার?
আমি আর বাইরে যাব না বাবা। কখনো বাইরে যাব না।
আবার বুঝি পাড়ার বখা মেয়েরা–
হ্যাঁ! আমাকে দেখে শীষ দিয়ে এত খারাপ খারাপ কথা বলেছে— তরুণটা হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মানুষটি তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কাদিস নে বাবা। তোর মাকে বলব দেখি কিছু করতে পারে কী না।
ছেলেটি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলে মানুষটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আগের যুগের সেই নিয়ম-নীতি আর নেই। সবার মাঝে কেমন জানি ভোগ লালসা। মাঝে মাঝে যখন বাইরে যাই বুঝতে পারি মেয়েরা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার শরীরের দিকে। মনে হয় চোখ দিয়ে সমস্ত শরীরটাকে চেটে খাচ্ছে।
মানুষটির সারা শরীর বিতৃষ্ণায় কেমন জানি শিউরে উঠল।
টুকি এবং ঝা এতক্ষণে তাদের মহাকাশযানে ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে। মেয়েদের এই সমাজ ব্যবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হলে তাদের দেখে যে যাই মনে করুক তাদের কিছু করার নেই। জেট প্যাক ব্যবহার করে তারা আকাশে উড়ে যাবে। পুরুষদের ঘরের মাঝে আটকে রাখা তাদের কাছে যতই বিচিত্র মনে হোক এখানে এটা ঘটছে। হাজার বছর আগে পৃথিবীতে ঠিক তার উল্টো ব্যাপার ঘটেছিল, মেয়েদেরকে ঘরের মাঝে আটকে রাখ হয়েছিল।
টুকি আর ঝা টাইরার স্বামীর কাছে গিয়ে বলল, তোমাদের এখানে এসে আমাদের খুব ভাল লেগেছে, এখন আমরা যাব।
টাইরার স্বামী চোখে কপালে তুলে বলল, যাবে? কোথায় যাবে? মহাকশনের কথা বলে খুব একটা লাভ হবে না বলে তারা সে চেষ্টা করল। বলল, যেখান থেকে এসেছি।
কিন্তু তোমাদের খাওয়া হয়নি, বিশ্রাম হয়নি–
না হোক। আমরা ফিরে গিয়ে খাব বিশ্রাম নেব।
কোমল চেহারার সুদর্শন মানুষটির চোখে মুখে সত্যিকার দুশ্চিন্তার ছাপ। ফুটে উঠল, বলল, ঠিক আছে যেতে চাও যাবে তবে কিছু না খেয়ে যেতে পারবে না।
মানুষটির গলার স্বরে এক ধরনের আন্তরিকতা ছিল, টুকি এবং ঝা না করতে পারল না।
খাবারের আয়োজন ছিল সহজ, কিন্তু খুব সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। টুকি এবং ঝা খুব তৃপ্তি করে খেল। খাওয়া সেরে উঠতে গিয়ে হঠাৎ করে টুকি এবং ঝায়ের মাথা দুলে উঠে, কোনমতে টেবিল ধরে নিজেদের সামলে নিল। টাইরার স্বামী বলল, তোমরা হাঁটাহাঁটি করো না। তোমাদের খাবারের সাথে আমি ঘুমের ওষুধ দিয়েছি।
টুকি হতচকিত হয়ে বলল, কী দিয়েছ?
ঘুমের ওষুধ।
টুকি হঠাৎ করে এক ধরনের আতংক অনুভক করে। সত্যি সত্যি ঘুমে তাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কোন মতে কষ্ট করে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, কেন দিয়েছে?
একা বাইরে গিয়ে কী বিপদে পড়বে। বাইরে শুধু দুষ্ট মেয়ে মানুষ আর নষ্ট মেয়ে মানুষ। তোমাদের মত সাদাসিধে পুরুষদের একা পেলে কী অবস্থা হবে জান?
টুকি আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই গভীর ঘুমে তাদের দুই চোখের পাতা জড়িয়ে এল।
০৮. ঘুম থেকে জেগে উঠে
ঘুম থেকে জেগে উঠে ঝা দেখল তার পাশে একজন অপরিচিত মানুষ শুয়ে আছে। ঝা ভাল করে তাকাল এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল মানুষটি টুকি, কেউ একজন তার বিশাল গোঁফ জোড়া নিখুঁত ভাবে চেছে দিয়েছে বলে চিনতে পারছিল না। ঝা ধরমর করে উঠে বসল, হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ে গেছে।
তারা ছোট একটা পাথরের ঘরে শুয়ে আছে, বুক পর্যন্ত কম্বল দিয়ে ঢাকা। ঝ কম্বল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে বসে টুকিকে একটা ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করল। টুকি বিড় বিড় করে কিছু একটা বলে পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু ঝা আবার তাকে ধরে একটা ঝাকুনী দিল। এবারে টুকি চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, কে? কী হয়েছে?
আমি।
টুকি চোখ বড় বড় করে বলল, ঝা? তোমার একি অবস্থা? চুল কোথায় তোমার?
ঝা মাথায় হাত দিয়ে দেখল তার মাথা কেউ পারিষ্কার করে কামিয়ে দিয়েছে। টুকি দাঁত বের করে হেসে বল, তোমাকে পুরোপুরি গবেটের মত দেখাচ্ছে, মাথাটা কামিয়েছ কেন?
আমি কামাই নি। তোমার গোঁফ যে কামিয়েছে আমার মাথাও সে কামিয়েছে।
গোঁফ? আমার গোঁফ? টুকি লাফিয়ে উঠে বসে নাকের নিচে হাত দিয়ে হঠাৎ করে একবারে ঠাণ্ডা মেরে গেল। এই জগতে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল তার গোঁফ।
ঝা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখান থেকে পালানোর সময় হয়েছে।
টুকি নির্জীব গলায় বলল, কিন্তু আমার গোঁফ?
গোঁফ নিয়ে পরে চিন্তা কর। এখন উঠ। জেট প্যাক আর লেজার প্যাক খুঁজে বের কর।
টুকি মনমরা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের জিনিসপত্র খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো। তাদের ঘুমের মাঝে কেউ একজন পোশাক পাল্টিয়ে ঢলঢলে আলখাল্লার মত কিছু একটা পরিয়ে গেছে, কাপড় জামাগুলোও এ ঘরে নেই।
ঘরের মাঝে শব্দ শুনে খুট করে দরজা খুলে গেল, টাইরার স্বামী উঁকি দিয়ে বলল, তোমরা উঠে গেছ?
টুকি কোন কথা না বলে চোখ পাকিয়ে তাকাল, তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে মানুষটি বলল, তোমাদের জন্যে ভাল খবর আছে।
আমার ভাল খবরের দরকার নেই। টুকি মেঘ গলায় বলল, আমাদের জামাকাপড় জেট প্যক লেজার গান কোথায়? এক্ষুণি নিয়ে আস।
তোমাদের জামা কাপড় ধুয়ে দিয়েছি, যা নোংরা হয়েছিল।
জেট প্যাক আর লেজার গান?
ওই বিদঘুটে যন্ত্রগুলো? ওগুলো কী পুরুষ মানুষকে মানায়? সব ফেলে দিয়েছি?
ঝা গর্জন করে বলল, ফেলে দিয়েছ?
হ্যাঁ! মানুষটা মুখে হাসি ফুটয়ে বলল, তোমাদের ভাল খবর কী শুনবে?
না। টুকি ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ভাল খবরের কোন দরকার নেই। আমার গোঁফ কেন কেটেছ?
সেটাই তো বলতে যাচ্ছিলাম। তোমাদের বিয়ে ঠিক করেছি।
বিয়ে ঠিক করেছ?
হ্যাঁ! তোমরা যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন তোমাদের দেখে পছন্দ করে গেছে। তবে তোমাদের মুখে নাকি বেশি চুল। তাই কেটে কিছু কামিয়ে দিয়েছি।
টুকি দাতে কিড়মিড় করে বলল, তাই কেটে কমিয়ে দিয়েছ!
তোমাদের কারা পছন্দ করল শুনবে না?
টুকি রাগে ফেটে পড়ে বলল, না, আমার শোনার কোন দরকার নেই।
ঝা নিচু গলায় বলল, একটু শুনে দেখলে হয় না?
টুকি চোখ লাল করে ঝায়ের দিকে তাকাল এবং সেই দৃষ্টির সামনে ঝা কেমন জান মেইয়ে গেল।
টাইরার স্বামী মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, তোমাদের কোন আপনজন নেই, অভিভাবক নেই, ভারী ভাবনা হয় আমার। সে জন্যেই তো খুঁজে পেতে দুজন মেয়ে বের করেছি। ঠিক মেয়ে নয় মহিলাই বলা উচিত। মধ্য বয়স্কা মহিলা—খুব শক্ত ধরনের।
টুকি আবার গর্জন করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন বাইরে নারী কণ্ঠ শোনা গেল। টাইরার স্বামীর চোখ মুখ হঠাৎ আনন্দে ঝলমল করে উঠে, সে মধুর ভঙ্গীতে হেসে বলল, আমার স্ত্রী তোমাদের যাদের সাথে বিয়ে হবে তাদের তাদের নিয়ে এসেছে। বিয়ের আগে একটু পরিচয় হওয়া ভাল। তোমরা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে নেবে?
টুকি এবং ঝা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে নেবার কোন আগ্রহ না দেখিয়ে টাইরার স্বামীকে একরকম ঠেলে ঘর থেকে বের হয়ে এল। বাইরে দুজন মধ্যবয়স্কা মহিলা টাইরার পিছনে দাঁড়িয়েছিল, তাদের চুল ছোট করে ছাঁটা, ক্রুর দৃষ্টি এবং মুখে সৈনিক সুলভ কাঠিন্য। টুকি এবং ঝাকে দেখে দুজনে কেমন যেন আঁৎকে উঠে। টুকি কঠোর গলায় বলল, এখানে এসব কী হচ্ছে? আমাদের জিনিসপত্র কোথায়? কে তোমাদের আমাদের চুল দাড়ি গোঁফে হাত দিতে বলেছে? কত বড় সাহস আমাদের খাবারে ঘুমের ওষুধ দিয়েছ?
টাইরা অবাক হয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ! পুরুষ মানুষ এভাবে কথা বলে কখনো?
টুকি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এখন তো শুধু কথা বলছি, যখন রদ্দা লাগানো শুরু করব, তখন বুঝবে মজা
টাইরা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়েছিল। মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা তার কঠিন মুখে কুটিল একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, এক সপ্তাহের মাঝে আমি ওকে সিধে করে দেব। শুধু বিয়েটা হয়ে নিক।
ঝা টুকির হাত ধরে বলল, এখানে চেচামেচি করে লাভ নেই। চল আমরা যাই।
টাইরা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?
যেখান থেকে এসেছি সেখানে যাব।
এখন বাইরে যেয়ো না। আধপাগলা একটা রবোট ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথা থেকে এসেছে কে জানে, সবাইকে সমানে গালিগালাজ করে যাচ্ছে।
রোবি!
তোমরা চেনো সেটাকে?
চিনি। কোন্ দিকে গেছে?
উত্তরে-পাহাড়ের দিকে।
টুকি ঝায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, চল ঝা।
কেউ কিছু বলার আগে টুকি এবং ঝা ঘর থেকে বের হয়ে এল। তাদের পিছু পিছু মধ্যবয়স্কা মহিলা দুজন বের হয়ে বলল, সে কী! কোথায় যাচ্ছ তোমরা? তোমাদের জন্যে কত যৌতুক দিয়েছি জান?
টুকি ঝাকে বলল, পা চালিয়ে চল।
দেখা গেলে মহিলা দুজন এত সহজে তাদের যৌতুক দেওয়া স্বামীদের ছেড়ে দিতে রাজী না। তারা পিছু পিছু ছুটতে লাগলো। ঝা পিছনে তাকিয়ে বলল, দৌড়াও।
টুকি এবং ঝা পাহাড়ের দিকে ছুটতে লাগল পিছু পিছু ধাওয়া করে এল দুজন কঠিন চেহারার মহিলা, তাদের পিছু পিছু মজা দেখার জন্যে আরো অসংখ্য শিশু, কিশোরী, তরুণী, মধ্যবয়স্কা মহিলা এবং বৃদ্ধা। পিছন থেকে একটা দুইটা ঢিল এসে পড়ল তাদের গায়ে, টুকি এবং ঝা তখন উধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করে। চুরি করাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্যে তাদের শরীরের যত্ন নিতে হয়, দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটিতে দুজনেই দক্ষ। কাজেই প্রাণপণে ছুটে সবার নাগালের বাইরে চলে যাওয়া তাদের জন্যে খুব কঠিন হল না। লাল রংয়ের পাহাড়টায় উঠেই তারা তাদের মহাকাশযানটাকে দেখতে পায়, বাইরে রোবি দাঁড়িয়েছিল, টুকি এবং ঝাকে কষে বকুনী দিতে যাচ্ছিল কিন্তু পিছনে বিশাল মহিলা বাহিনী দেখে সে সুড় সুড় করে মহাকাশযানের ভিতরে ঢুকে গেল। ছুটতে ছুটতে এসে টুকি আর ঝাও খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে শক্ত করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণেই মহিলা বাহিনী এসে মহাকাশযানটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে।
টুকি গলা উঁচিয়ে বলল, রোবি, মহাকাশযানটা উড়িয়ে নিয়ে চল।
রোবি বলল, ঠিক আছে, যাচ্ছি। এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু ভেবো না তোমাদের কাজকর্মের কথা আমি ভুলে গেছি–মহাকাশে নিয়ে গিয়ে তোমাদের বোঝাচ্ছি মজা।
প্রচণ্ড গর্জন করে যখন মহাকাশযানটা উপরে উঠতে থাকে ঝা তখন জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাবী স্ত্রীকে ফেলে রাখার দুঃখে নাকি একটু পরেই রোবি তাদের যে শাস্তি দেবে সেই ভয়ে সেটা ঠিক বোঝা গেল না।
০৯. মহাকাশযান ছেড়ে বাইরে গিয়ে
মহাকাশযান ছেড়ে বাইরে গিয়ে দুদিনের জন্যে হারিয়ে গিয়ে গ্রহের মেয়েদের সাথে একটা ঝামেলায় ফেঁসে যাওয়ার কারণে রোবি বাড়াবাড়ি রাগ করল। টুকি এবং ঝায়ের খাবার বন্ধ রাখল পুরো চব্বিশঘণ্টা এবং শাস্তি হিসেবে তাদেরকে দিয়ে মহাকাশযানের সবগুলো স্কু টাইট করালো। খাটো একটা স্কু ড্রাইভার দিয়ে স্কুগুলো টাইট করতে গিয়ে তাদের আঙুলের যা একটা দশা হল সেটি আর বলার। মত নয়।
মহাকাশযানে টুকি এবং ঝায়ের জীবন মোটামুটি দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়াল। হাবাগোবা রোবির কপোট্রনে রবোটদের নিজস্ব মানবিক অনুভূতি ঢুকিয়ে দেবার পর টুকি এবং ঝায়ের এক মুহূর্তে শান্তিতে থাকার উপায় রইল না। মাঝারী নক্ষত্রটার কাছাকাছি গিয়ে হাইপার ডাইভ দিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছানোর আগে তাদের জীবনে শান্তি ফিরে আসবে সেরকম কোন আশাই নেই। নক্ষত্রটিতে পৌঁছাতে সপ্তাহ দুয়েক লাগার কথা, এই দুই সপ্তাহ একটি ডোতা যন্ত্রণা হিসেবে রোবি তাদের জীবনকে বিষিয়ে রাখবে টুকি এবং ঝা সেটা নিয়ে মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তাদের জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে। বিস্ময়গুলো হালকা বিস্ময় নয় ভয়ংকর ধরনের বিস্ময়। ব্যাপারটা শুরু হল এভাবে।
মহাকাশযানের তিন-চতুর্থাংশ স্কু টাইট করার পর যখন টুকি এবং ঝা আঙুলের ব্যথায় ঘুমাতে পারছে না তখন একদিন তারা জরুরী চ্যানেলে একটা আবেদন শুনতে পেল, কাছাকাছি একটা গ্রহের কক্ষপথে একটা মহাকাশযান আটকা পড়ে আছে। মহাকাশযানে খাবার জ্বালানী শেষের দিকে। ট্রান্সমিটারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বলে সেটি দূরে খবর পাঠাতে পারছে না। কাছাকাছি একটা সাহায্যের আবেদন পাঠিয়ে যাচ্ছে। একজন বিপদগ্রস্থ মানুষ অন্য বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করতে পারে না এই যুক্তিতে প্রথমে টুকি এবং ঝা ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করে চলে যেতে চাইছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সেটা করতে পারল না। বিপদগ্রস্থ মহাকাশযানটিকে সাহায্য করার জন্যে তারা নিজেদের কক্ষপথ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিল।
মহাকাশযানটির কাছাকাছি এসে টুকি এবং ঝা যোগাযোগ করল, বিপদগ্রস্থ মানুষটি কাতর গলায় জানাল তারা স্বামী স্ত্রী এবং দুটি সন্তান নিয়ে চারজন মানুষ। মহাকাশ-দস্যুর একটি দল তাদেরকে মুক্তিপণের জন্যে ধরে নিয়েছিল, তারা কোনভাবে পালিয়ে এসেছে। তাদের ছোট মহাকাশযানটি এমনিতেই বিধ্বস্ত ছিল তার উপর মাঝপথে জ্বালানী এবং খাবার দুইই শেষ হয়ে গেছে, এখন কোন ধরনের খাবার এবং জ্বালানী না পেলে তারাও শেষ হয়ে যাবে।
ঘটনাটি শুনে টুকি এবং ঝায়ের মন করুণায় দ্রবীভূত হয়ে গেল এবং রোবি হাউমাউ করে মাথাকুটে কাঁদতে শুরু করল। বিপদগ্রস্থ পরিবারটিকে সাহায্য করার জন্যে একটা পরিকল্পনা করা হল। পরিকল্পনাটি এরকম : মহাকাশযানটির কাছাকাছি গিয়ে তারা সেটাকে মাঝখানে রেখে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকবে এবং ঝা ছোট একটা স্কাউটশীপ নিয়ে বিধ্বস্ত মহাকাশযানটিতে যাবে। সেখানকার অবস্থা স্বচক্ষে দেখে তাদেরকে নিয়ে নিজেদের মহাকাশযানে ফিরে আসবে। তারপর তাদের নিজেদের গ্রহ বা আবাসস্থলে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী স্কাউটশীপে করে ঝা বিধ্বস্ত মহাকাশযানটিতে হাজির হল। কন্ট্রোল প্যানেলে রোবি এবং টুকি তার সাথে যোগাযোগ করছিল। ঝা পেশাদার মহাকাশচারী নয় কাজেই তাকে কেমন করে ডক করতে হয়, কেমন করে লগ করে বাতাসের চাপের সমতা আনতে হয়, কেমন করে মহাকাশযানের বৃত্তাকার দরজা খুলতে হয়, সবকিছুই বলে দিতে হচ্ছিল। স্কাউটশীপের যোগাযোগ মডিউল দিয়ে টুকি এবং রোবি ঝাকে দেখতে পাচ্ছিল, তারা তাকে তার বিশাল দেহ নিয়ে মহাকাশযানের ভিতরে ঢুকে যেতে দেখল, প্রায় সাথে সাথেই হঠাৎ করে ঝায়ের সাথে সমস্ত যোগাযোগ কেটে গেল। টুকি অবাক হয়ে বলল, কী হল? যোগাযোগ কেটে গেল কেন?
বুঝতে পারছি না। রোবি যোগাযোগ ফিরে পাবার জন্যে নানারকম যন্ত্রপাতি টেপাটেপি করতে থাকে কিন্তু কোন লাভ হল না। হঠাৎ করে তারা স্কাউটশীপের ক্যামেরায় দেখতে পেল মহাকাশযানের বৃত্তাকার দরজাটি সশব্দে বন্ধ হয়ে গেছে, শুধু তাই নয়, যে মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত অবস্থায় মহাকাশে ঝুলে থাকার কথা সেটি গর্জন করে তার ইঞ্জিনগুলো চালু করে মহাকাশে ছুটে যেতে শুরু করে।
রোবি টুকির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছ? দেখেছ?
টুকি, হ্যাঁ!
ঝা গিয়ে মহাকাশযানটাকে ঠিক করে দিয়েছে। চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে! রোবি তার গলায় বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে বলল, আমি ভাবতাম ঝা গবেট ধরনের মানুষ। আসলে সে বড় মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ার।
টুকি রোবির দিকে তাকিয়ে বলল, ঝা মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ার নয়, এই মহাকাশযানটি আমাদের ধোকা দিয়েছে। ঝাকে ধরে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই মহাকাশ দত্যু হবে।
সর্বনাশ! কী করব এখন?
ওটার পিছু পিছু যেতে হবে। তাড়াতাড়ি।
রোবি তাড়াতাড়ি কন্ট্রোল প্যানেলের উপর ঝুকে পড়ে মহাকাশযানটির গতিপথ পরিবর্তন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
১০. মহাকাশযানের গোল দরজাটা
মহাকাশযানের গোল দরজাটা সাধারণ মানুষদের মাপে তৈরি, এর ভিতর দিয়ে বিশাল শরীরকে ঢোকাতে ঝায়ের রীতিমত বেগ পেতে হল। বিধ্বস্ত মহাকাশযানটির ভিতরে কৃত্রিম মহাকর্ষ বল তৈরি করে রাখা ছিল বলে সে শেষ পর্যন্ত তার পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল। ভিতরে অসহায় একটা পরিবার থাকার কথা কিন্তু ঝা অবাক হয়ে দেখল দুজন ষভাগোছের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতে কালো এক ধরনের অস্ত্র। ঝায়ের যেটুকু ভয় পাওয়ার কথা ছিল সে তার থেকে অনেক বেশি ভয় পেল মানুষ দুজনের চেহারা দেখে, তারা দেখতে হুঁবহুঁ মানুষের মত কিন্তু যেখানে নাক থাকার কথা সেখানে নাকের বদলে একটা শুড়। সেই বঁড়টি সাপের মত কিলবিল করে নড়ছে। ঝা যখন একটা বিকট চিৎকার করে পিছন দিকে লফিয়ে সরে এল ঠিক তখন সেই মানুষ দুজনও বিকট চিৎকার করে পিছনে সরে গেল। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ঝা সাহস সঞ্চয় করে বলল, তোমাদের নাকে কী হয়েছে?
মানুষ দুজন বলল, আমাদের নাকে কিছু হয় নি কিন্তু তোমার নাক এভাবে কেটেছ কেন?
কোন কিছু বুঝতে ঝায়ের একটু সময় বেশি লাগে কিন্তু এবারে সে একবারেই বুঝে গেল যে এই মানুষ দুজনের ধারণা মানুষের নাক হাতির শূড়ের মত কিলবিলে হওয়া উচিত এবং তাদের কাছে মনে হচ্ছে কোন কারণে ঝায়ের নাক কাটা গেছে। ঝা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার নাক কাটি নাই, আমার নাক এরকম।
মানুষ দুজন তাকে ঠিক বিশ্বাস করল বলে মনে হল না, এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে একটা কিম্ভুতকিমার জন্তু। মানুষগুলো হাতের অস্ত্র তাক করে রেখে বলল, তোমার অসুবিধা হয় না?
না। হয় না। কিন্তু আমরা তো সেটা নিয়ে কথা বলতে আসিনি। এখানে একটা পরিবার থাকার কথা মহাকাশ দস্যু যাদের ধরে এনেছিল।
ষন্ডাগোছের মানুষ দুজনের মাঝে যে বেশি লম্বা সে তার নাক কিংবা শূড় যেটাই বলা হোক, নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল, মহাকাশ দস্যু এখনি কাউকে ধরে নেবে।
কাকে?
তোমাকে! বলে দুজনই হা হা করে হাসতে লাগল, হাসির তালে তালে তারা তাদের লম্বা নাক উপরে তুলে নাচাতে লাগল। ঝা স্বীকার না করে পারল
যে লম্বা এবং কিলবিলে একটা নাক দিয়ে মনের ভাব অনেক জোড়ালো ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব। ঝা শুকনো মুখে বলল, আমাকে ধরে নেবে?
হ্যাঁ! এটা আসলে দস্যু জাহাজ, আমরা বেকুব ধরনের মহাকাশচারীদের ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করি।
কিন্তু এখানে আমার জন্যে কেউ মুক্তিপণ দেবে না।
না দিক। তোমার মত নাকখসা মানুষকে চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেয়া যাবে, দশটা মুক্তিপণের সমান টাকা উঠে আসবে সেখান থেকে।
কিন্তু–
কোন কিন্তু টিন্তু নেই নাক-খসা দানব, দুই হাত উপরে তুলে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়।
ঝা মানুষগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কী না একবার চিন্তা করল, কিন্তু কিলবিলে থলথলে নাকে ঘুষি মারার কথা চিন্তা করেই কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠল। কাজেই কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল ঝায়ের হাত পিছন দিকে শক্ত করে বেঁধে একটা ছোট ঘরে ফেলে রাখা হয়েছে। আর বিধ্বস্ত দেখানো মহাকাশযানটি গর্জন করে ছুটে চলেছে কোন একটি অজানা গন্তব্যস্থলের দিকে।
কয়েকদিন পরের কথা। ঝা একটা ছোট ঘরে বসে আছে, ঘরের একদিকে স্বচ্ছ দেওয়াল সেখানে অনেক মানুষের ভীড় সবারই নাকের জায়গায় একটা শূঁড়। কারো শূঁড় লম্বা, কারো খাটো। কারো শূঁড় মোটা কারো সরু। কারো শূঁড় তেল চিকচিকে, কারো শূঁড় খসখসে বিবর্ণ। সবার শূঁড়ই নড়ছে, দেখে মনে হয় নাকে বুঝি একটা সাপ কামড়ে ধরে কিলবিল করছে। প্রথম প্রথম দেখে ঝায়ের শরীর গুলিয়ে আসত, আজকাল অভ্যাস হয়ে আসছে, ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাক নেই কেন?
ঝা কোন উত্তর দিল না। সে এই ছোট ঘরটাতে বসে থাকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তাকে দেখতে আসে, যারা আসে তাদের অনেকেই এই প্রশ্নটা করে, এর কোন উত্তর তার জানা নেই। যারা তাকে দেখতে এসেছে সবাই টিকেট কিনে এসেছে তাদের ধারণা নাক খসা দানব নামের এই বিচিত্র প্রাণীটির মুখ থেকে তাদের কোন একটা উত্তর পাওয়ার অধিকার আছে। সবাই যে একটি প্রশ্নই করে তা নয়, অনেকে বৈজ্ঞানিক প্রশ্নও করে থাকে। যেমন একদিন একজন প্রশ্ন করল, আমাদের এই গ্রহে যে বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে সেটাকে পরিশোধন করার জন্যে ধীরে ধীরে আমাদের এই চমৎকার সুন্দর নাকটিকে তৈরি করা হয়েছে, এটি আসলে একটি ফিল্টার। বিষাক্ত গ্যাস ফিল্টার ছাড়া তুমি বেঁচে আছ কেমন করে?
ঝা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি এই গ্রহের মানুষ নই।
তোমার গ্রহের নাম কী? সেটি কোথায়?
ঝা তার গ্রহের নাম জানলেও সেটি কোথায় ভাল করে জানে না বলে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। দর্শকদের মাঝে যাদের শূড়ের মত নাকটি বেশ কোমল পেলব এবং লম্বা তারা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, সুন্দর নাকের অধিকারীরা সমাজে একটা বিশেষ স্থান দখল করে থাকে। তোমার যে নাক নেই। সেই জন্যে তুমি কী সমাজে অপাংতেয়?
ব্যবসায়ী ধরনের একজন একদিন জিজ্ঞেস করল, নাককে কোমল এবং পেলব করার বিশেষ ধরনের ক্রীম রয়েছে, নাককে লম্বা করার জন্যে বিশেষ ধরনের মালিশের তেল রয়েছে, নাককে সতেজ রাখার জন্যে বিশেষ ধরনের ওষুধ রয়েছে, এগুলো আমাদের গ্রহে বিশাল শিল্প গড়ে তুলেছে। আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখছে। তোমাদের গ্রহের অর্থনীতি কী রকম?
ঝা আবার নিঃশ্বাস ফেলল, সে একজন পেশাদার চোর, পৃথিবীর অর্থনীতি, সমাজনীতি বা রাজনীতি নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় নি। অর্থনীতি যেরকমই হোক, চুরি করার মত জিনিসপত্র সবসময়েই ছিল।
ষন্ডা গোছের বদমেজাজী চেহারার একজন মানুষ একদিন ঝাকে জিজ্ঞেস করল, আমরা যখন একজন আরেকজনকে গালিগালাজ করি নাক নিয়ে অনেক কিছু বলি। যেমন এখানকার প্রিয় গালি নাক-কাটা তোমরা কী বলে গালি দাও?
পৃথিবীতে কী বলে একে অন্যকে গালিগালাজ করে সেটা সম্পর্কে ঝায়ের মোটামুটি ভাল ধারণা আছে কিন্তু ছোট একটা ঘরে প্রদর্শনীর বস্তু হয়ে তার সেটা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে করল না। ষন্ডা গোছের বদমেজাজী চেহারার মানুষটি মনে হল কোন একটা উত্তর না নিয়ে যাবে না, সে আবার জিজ্ঞেস করল, কী হল? আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন নাক-কাটা?
ঝায়ের হঠাৎ খুব মেজাজ খারাপ হল, মানুষটার দিকে তেড়ে উঠে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। যারা দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
মোটাসোটা একজন মহিলা ড়ের মত লম্বা নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাজটা একেবারে ভাল হচ্ছে না।
আরেক জন বলল, কোন কাজটা?
এই যে একজন মানুষকে শুধুমাত্র তার শারীরিক বিকলঙ্গতার জন্যে দশজন মানুষের কাছে দেখানো হচ্ছে।
বয়স্ক একজন মানুষ সমবেদনার ভঙ্গীতে খুঁড়টাকে একবার নাড়িয়ে নিয়ে বলল, নাক নেই বলে মানুষটার চেহারা খারাপ হতে পারে কিন্তু তাই বলে যে তার মনে দুঃখ কষ্ট নেই সেটা তো সত্যি না।
ঠিক আমরা যেভাবে কাদি প্রায় সেভাবেই কাঁদছে, নাক নেই বলে সেটাকে ফোস ফোস করে দুলাতে পারছেনা।
মোটাসোটা মহিলাটি নরম গলায় বলল, কিন্তু দেখ, চোখ থেকে ঠিকই পানি বের হচ্ছে। আহা বেচারা!
ঝায়ের ভেউ ভেউ করে কান্না দেখেই হোক আর মোটাসোটা মহিলার নরম গলার কথা শুনেই হোক উপস্থিত দর্শকদের মাঝে হঠাৎ একটা সমবেদনার ভাব চলে এল। তাদের কেউ কেউ চিৎকার করে বলতে লাগল:
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও,
নাক-কাটা দানবকে ছেড়ে দাও–
হৈ চৈ চেচামেচি দেখে শান্তি রক্ষার রবোটগুলো এসে ভীড় জমাতে থাকে, তারা ভীড় ভেঙে দেবার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু খুব সুবিধে করতে পারে না, ভীড় আরো বেড়েই যেতে থাকে। দর্শকদের বেশির ভাগই এখন ঝায়ের পক্ষে। পারলে তারা এক্ষুণি ঝাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে। উপস্থিত মানুষের সমবেদনা পেয়ে ঝায়ের মনটা আরো ভার হয়ে আসে সে নিও পলিমারের আস্তিনে চোখ নাক মুছে কাতর চেহারা করে ভীড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখতে পেল, মোটাসোটা দয়ালু চেহারার মহিলারা একত্র হয়ে তাদের খুঁড় নেড়ে নেড়ে উঁচু গলায় কথা বলছে। বাড়াবাড়ি দয়ালু একজনের চেহারায় একটু জাঁদরেল ভাব চলে এসেছে সে হাত উপরে তুলে চিৎকার করে বলছে, মানুষকে ঘৃণা করতে হয় না। নাককাটা এই দানবের চেহারা যত কুশ্রীই হোক, তার থলথলে মোটা শরীর দেখে আমাদের ভিতরে যত ঘৃণাই জেগে উঠুক আমাদের তবুও একতাবদ্ধ হয়ে এই কুৎসিত মানুষটাকে উদ্ধার করে তার আপন দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। যে। ভাবেই হোক—
ঝায়ের ঘরের সামনে গোলমাল আরো বাড়তে থাকে। শান্তি রক্ষা রবোট দিয়ে আর কাজ হচ্ছে না বলে বেশ কিছু পুলিশ রবোট এনে নামিয়ে দেওয়া হল। তারা বেশ রূঢ় ধরনের, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এবং থলথলে শূড়ের মত নাক মুচড়ে তারা কিছুক্ষণের মাঝেই ভীড় ফাঁকা করে দিল।
পরের দুইদিন কী হল ঝা জানতে পারল না তবে প্রত্যেক দিন তাকে দেখতে যে রকম হাজার হাজার মানুষ এসে ভীড় জমাতো সেরকম কেউ ভীড় জমালো না। ঝা নিজের ঘরে বসে, ভাল-মন্দ খেয়ে এবং ভিডিও স্ক্রিনে শূড়ের মত লম্বা নাকের পরিচর্যার উপরে নানা ধরনের অনুষ্ঠান শুনে শুনে দিন কাটিয়ে দিল। তৃতীয় দিন খুব ভোরেই তার ঘরের দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকল কয়েকজন মানুষ। তাদের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, কয়েকজন পুলিশ এবং কিছু শান্তিরক্ষাকারী রবোট, সবার পিছনে মোটাসোটা দয়ালু চেহারার কয়েকজন মহিলা। সরকারি কর্মচারীদের মাঝে যে সবচেয়ে উচ্চপদস্থ সে ঝাকে দেখে খুব। ঘাবড়ে গেলেও মুখে ভদ্রতার একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, আমাদের বিচার বিভাগ রায় দিয়েছে তোমাকে এভাবে পরিদর্শন করানো মানবতা বিরোধী কাজ। কাজেই তোমাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হবে।
ঝা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং ভয় পেয়ে সবাই কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ঝা কোন মতে নিজের উচ্ছাসকে সামলে নিয়ে বলল, সত্যি?
সত্যি। তোমাকে তোমার নিজের দেশে ফিরে যেতে সাহায্য করা হবে।
ঝা আনন্দে ঝলমল করে আবার একটা ছোট লাফ দিয়ে ফেলল এবং উপস্থিত সবাই আবার ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। পুলিশ রবোটটি বলল, যারা আপনাকে ধরে এনেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
মোটাসোটা দয়ালু চেহারার মহিলাটি এক পা এগিয়ে এসে বলল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটি এখনো তোমাকে দেওয়া হয় নি।
কী?
আমরা তোমার একটি ব্যাপারে সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম, সরকার আমাদের আবেদন রক্ষা করেছেন।
কী আবেদন?
যেহেতু তোমার নাক নেই—তোমার চেহারা অত্যন্ত কুৎসিত। তোমার নিজের ভিতরে সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই গভীর দুঃখ রয়েছে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম সরকারি খরচে অস্ত্রোপচার করে তোমাকে একটি সত্যিকার নাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্যে। সরকার রাজী হয়েছে।
ঝায়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল, আমতা আমতা করে বলল, কী—কী বললে? নাক লাগিয়ে দেবে।
হ্যাঁ! সত্যিকারের নাক। নরম তুলতুলে পেলব একটি নাক। ভাব বিনিময়ের সময় তুমি আমাদের মত সেটা নাড়তে পারবে, দোলাতে পারবে।
ঝা বার কয়েক ঢোক গিলে আর্তনাদ করে বলল, লাগবে না আমার নাক। আমার যেটা আছে সেটাই ভাল।
দয়ালু চেহারার মহিলা তার পুরুষ্ট ড়ের মত নাক দুলিয়ে বলল, আমাদের উপর অভিমান কেন করছ? তোমার উপর যে অবিচার করা হয়েছে তার খানিকটা অন্তত আমাদের ক্ষমা করিয়ে নেবার সুযোগ করে দাও।
আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার নাক লাগবে না, লাগবে না।
উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী জিব দিয়ে চুক চুক করে বলল, আহা বেচারা, এমনিতেই নিজের চেহারা নিয়ে নিজের ভিতরে গভীর হীনমন্যতা বোধ তার উপর সেটি নিয়ে এক ধরনের প্রদর্শনী সব মিলিয়ে মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। নিজের ভিতর কিভাবে একটি রাগ পুষে রেখেছে দেখেছ?
দয়ালু চেহারার মোটাসোটা মহিলা বলল, ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। দশজনের মত যখন তারও একটা লম্বা পেলব তুলতুলে নাক হবে সে সব দুঃখ ভুলে যাবে।
১১. ঝা অপারেশন থিয়েটারে
ঝা অপারেশন থিয়েটারে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। কিছুতেই সে তার নাকে অস্ত্রোপচার করতে দিতে রাজী হচ্ছিল না বলে তাকে তার বিছানার সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার বিশাল শক্তিশালী শরীর নিয়ে সে বিছানাসহই প্রায় ওলট পালট খাচ্ছিল বলে তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করে রাখা আছে। আধো ঘুমে তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে আছে তার মাঝে সে ঘোলা চোখে অস্ত্রোপচারকারী রবোট এবং ডাক্তারকে দেখার চেষ্টা করল। উপর থেকে তীব্র আলো এসে পড়ছে তাই ভাল করে সে তাদের চেহারা দেখতে পেল না কিন্তু যেটুকু দেখতে পেল তাতে মনে হল সে এই রবোট এবং ডাক্তারকে আগে দেখেছে। কোথায় দেখেছে সে কিছুতেই মনে করতে পারল না ঘুমের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে তার মস্তিষ্ক চিন্তাও করতে পারছে না। চিন্তা করতে ইচ্ছেও করছে না, পুরো ব্যাপারটা একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মত। সাধারণ দুঃস্বপ্ন ভেঙে গেলে সব ঝামেলা মিটে যায় এই দুঃস্বপ্ন সেরকম নয়। এটা ভেঙে যাবার পর দেখা যায় নতুন দুঃস্বপ্নের শুরু হয়েছে। গভীর হতাশার মাঝে ড়ুবে যেতে যেতে ঝা অপারেশান থিয়েটারে জ্ঞান হারাল।
ঝায়ের জ্ঞান হবার পর সে নিজেকে নতুন একটা ঘরে আবিষ্কার করে। চারদিকে সাদা পর্দা দিয়ে ঢাকা হাত দিয়ে নিজের নাক স্পর্শ করার চেষ্টা করে দেখল তার দুই হাত শক্ত করে বিছানার সাথে বাধা। ঝা খানিকক্ষণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে কোন সুবিধে করতে না পেরে বিকট স্বরে একটা চিৎকার করল এবং সাথে সাথেই ডাক্তার, নার্স এবং অস্ত্রোপচারকারী রবোট ছুটে এসে ঢুকল। নার্স নাক দুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার?
ঝা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার সর্বনাশ কী হয়ে গেছে?
নার্স শান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল, সর্বনাশ হবে কেন? কী চমৎকার তুলতুলে কোমল একটা নাক লাগিয়েছে তোমার, নাড়াও দেখি একটু—
ঝা নাক নাড়ানোর কোন চেষ্টা না করে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। ডাক্তার এগিয়ে এসে বলল, ডেলিরিয়াম হচ্ছে মনে হয়। তুমি ঘুমের ওষুধ নিয়ে এস আমি দেখছি।
নার্স ঘর হতে বের হতেই ডাক্তার ঝায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল, ঝা–
ঝা নিজের নাম শুনে চমকে উঠে তাকাল। তার সামনে ডাক্তারের পোশাক পরে টুকি দাঁড়িয়ে আছে—শুধু তারও নাকের জায়গায় একটা শাড় ঝুলছে। ঝা আর্তনাদ করে বলল, সর্বনাশ তোমার নাকেও লাগিয়েছে?
ধুর বেকুব। এটা প্লাস্টিকের শূড়, আঠা দিয়ে লাগানো আছে। ভিতরে ব্যাটারী পাওয়ারের যন্ত্রপাতি দিয়ে নাড়া চাড়া করার ব্যবস্থা।
তুমি এখানে কী করে এসেছ?
সেটা অনেক বড় ইতিহাস। এখন বলার সময় নেই। শুধু শুনে রাখ আমি আর রোবি মিলে ডাক্তার আর অস্ত্রোপচারকারী রবোট সেজে তোমার নাকে অপারেশান করেছি।
সত্যি?
ছাই অপারেশন। প্লাস্টিকের একটা নাক আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছি। ভিতরে নাড়াচাড়া করার যন্ত্রপাতি আছে—শুয়ে শুয়ে নাক নাড়ানো প্র্যাকটিস কর। যদি ধরা পরে যাই আমার হবে জেল আর তুমি পাবে সত্যিকারের শূঁড়।
টুকির কথা শেষ হবার আগেই নার্স বড় একটা সিরিঞ্জে বেগুনি রংয়ের কী একটা ওষুধ নিয়ে হাজির হল। টুকি বলল, রোগী মনে হয় নিজেকে সামলে নিয়েছে। আজে বাজে কথা আর বলছে না।
সত্যি?
হ্যাঁ! টুকি ঝায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নাড়াও দেখি তোমার নাক।
ঝা মুখে হাসি ফুটিয়ে তার নাক নাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু খুব সুবিধে করতে পারল না। নার্স শান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গী করে বলল, নার্ভগুলো এখনো জোড়া লাগে নি। একটু সময় নেবে।
ঝা মাথা নেড়ে বলল, আমার কোন তাড়া নেই।
দুদিন পর ঝা ছাড়া পেল, তাকে বিদায় দিতে এল সরকারি কর্মচারী, পুলিশ অফিসার এবং দয়ালু চেহারার মোটাসোটা কিছু মহিলা। ঝা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্যাটারীর কলকজা লাগানো এই নাকটিকে এর মাঝে বেশ বাগে এনেছে। উপরে তুলতে পারে নিচে নামাতে পারে ডানে বায়ে দুলাতেও পারে। বিদায় সম্ভাষণ জানানোর জন্যে সে তার নাককে দোলাতেই হাসিখুশি চেহারার মোটাসোটা মহিলা খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি সবকিছু ওলট-পালট করছ।
ঝা অবাক হয়ে বলল, কী ওলট-পালট?
বিদায় সম্ভাষণ একটা দুঃখের ব্যাপার। দুঃখের ব্যাপারে নাককে দোলাতে হয় না। নাককে তখন সোজা উপরে তুলে রাখতে হয়।
ঝা নাককে উপরে তুলে রাখার চেষ্টা করতে করতে আবার সবার কাছে। বিদায় সম্ভাষণ জানালো। পুরো ব্যাপারটি যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই ভাল। তাকে নেয়ার জন্যে টুকি আর রোবি একটা ভাসমান গাড়ি নিয়ে একটু দূরে অপেক্ষা করছে। ভাসমান গাড়ি করে যাবে তাদের স্কাউটশীপে। সেই স্কাউটশীপে করে মূল মহাকাশযানে। সেটি এখন এই গ্রহটিকে ঘিরে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে।
যথসময় ঝা ভাসমান গাড়িতে গিয়ে হাজির হল। ড্রাইভারের সীটে রোবি বসে আছে, ঝাকে দেখে বলল, উঠে পড়ন মহামান্য ঝা। আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
ঝা উঠে নিজের সীটে বসতে বসতে বলল, ধন্যবাদ রোবি।
আপনার সেবা করতে পেরে আমার জীবন ধন্য মহামান্য ঝা এবং মহামান্য টুকি।
ঝা নিচু গলায় টুকিকে জিজ্ঞেস করল, রোবির ভাবভঙ্গী এত নরম, ব্যাপার
কী?
টুকি দাঁত বের করে হেসে বলল, তোমার নাকে অপারেশান করার জন্যে যে ডাক্তার ঠিক করা হয়েছিল তাকে যখন খুঁজে বের করছিলাম তখন এক কাণ্ড হল।
কী কাণ্ড?
মনে আছে রোবির মেজাজের কথা?
মনে নেই আবার?
সেই মেজাজ দেখিয়ে ফেলল এক পুলিশ রবোটের সাথে। আর যায় কোথা তক্ষুণি ধরে কপোট্রনে অস্ত্রোপচার। রাগ বদমেজাজ যা ছিল তক্ষুণি পরিষ্কার করে সেই পুলিশ রবোট টেরাবাইট ভদ্রতা আর আদব লেহাজের সফটওয়ার ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমাদের রোবি সেই থেকে একেবারে মাটির মানুষ। তাই না রোবি?
রোবি বলল, আপনাদের সেবা করার জন্যে আমার জন্ম। এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কাছে প্রার্থনা করি আপনাদের সেবা করতে করতে একদিন আমার কপোট্রনে শর্ট সার্কিট হোক।
ঝা দাঁত বের করে হেসে বলল, চমৎকার। এই তো চাই।
ভাসমান গাড়ি স্কাউটশীপের কাছে পৌঁছে গেল। দুজনে রোবির পিছু পিছু স্কাউটশীপে ঢুকে পড়ল। স্কাউটশীপে প্রাথমিকভাবে চালু করার সময় এক ধরনের স্পেস স্যুট পরতে হয়, নাকের কাছ থেকে প্রাস্টিকের শূড় ঝুলছে বলে তাদের স্পেস স্যুটের হেলমেট পরতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। ঝা বলল, টান দিয়ে খুলে ফেলব না কী এই নাক?
টুকি হা হা করে বলল, না না-এখনই না। এই এলাকা ছেড়ে পার হই আগে।
কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল টুকি এবং ঝাকে নিয়ে একটা স্কাউটশীপ মহাকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
যে নক্ষত্রের কাছে এসে তাদের হাইপার ডাইভ দেবার কথা টুকি এবং ঝা প্রায় তার কাছাকাছি চলে এসেছে। কয়েকদিনের মাঝেই তারা হাইপার ডাইভ দিতে পারবে। এম-সেভেন্টিওয়ানের মানুষের কলোনীর এলাকা মোটামুটি শেষ। এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মানুষ বা রবোট থাকতে পারে কিন্তু বিপজ্জনক কিছু নেই। নানারকম যন্ত্রণার পর পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে সেটা চিন্তা করে টুকি এবং ঝা দুজনেরই মনে আনন্দের ভাব। রোবির কপোট্রনে এক টেরাবাইট দ্রতা এবং আদব লেহাজের সফটওয়ার ঢুকিয়ে দেওয়ার পর সে একেবারে পাল্টে গেছে। টুকি এবং ঝায়ের আরাম আয়েশের জন্যে রোবি মোটামুটিভাবে নিজের জীবন পাত করে ফেলছে। মহাকাশযানের গোপন রিজার্ভ থেকে ভালমন্দ খাবার বের করে দুই বেলা রান্না হচ্ছে সব মিলিয়ে মহাকাশযানে একটা স্কুর্তি সূর্তি ভাব। টুকি এবং ঝায়ের আনন্দের বড় কারণ অন্য জায়গায় বিদ্রোহী গ্রহ থেকে তারা যে পরিমাণ হীরা তুলে এনেছে পৃথিবীতে পৌঁছে সেটা বিক্রি করে তারা কয়েকশ বছর রাজার হালে থাকতে পারবে।
টুকি নরম একটা চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। আলস্যে চোখ আধবোজা হয়ে আছে, সে অবস্থাতেই চোখ অল্প খুলে ডাকল, রোবি।
রোবি কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ছুটে এসে বলল, বলুন মহামান্য টুকি। আপনার জন্যে আমি কী করতে পারি?
আপাতত এক গ্লাস তরল পানীয় নিয়ে এস তারপর কিনিস্কীর নবম সিম্ফোনীটা লাগিয়ে দাও।
রোবি টুকির জন্যে নবম সিম্ফোনী লাগিয়ে দিয়ে তরল পানীয় আনার জন্যে ছুটে গেল। ক্লাসিক্যাল সংগীত ঝায়ের মোটেই পছন্দ নয়। বিরক্ত হয়ে বলল, দিনরাত এসব কী প্যানপ্যানানি শোন? মেজাজ গরম হয়ে যায়।
টুকি চোখ অল্প একটু খুলে বলল, না হলে করবটা কী? এই মহাকাশযানে আর কিছু করার আছে?
কথাটা সত্যি, ঝা আর কিছু বলতে পারে না। টেবিলে রাখা বড় একটা গলদা চিংড়ির কাটলেট নিয়ে চিবুতে শুরু করে। রোবি কিছুক্ষণের মাঝেই টুকির জন্যে তরল এক গ্লাস পানীয় নিয়ে আসে। টুকি সেটায় চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে আরামের এক ধরনের শব্দ করল।
রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ স্ক্রিণটা পরীক্ষা করে বলল, আমরা এখন এম সেভেন্টি ওয়ানের মানুষের শেষ কলোনীটা পার হয়ে যাচ্ছি।
ঝা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাও।
রোবি বলল, মহামান্য ঝা, মানুষের এই বসতি থেকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ওসব বলে লাভ নেই। মানুষের যে কোন বসতি বিপজ্জনক।
রোবি মধুর গলায় বলল, কিন্তু এই বসতিটি সত্যিই শান্তিপূর্ণ বসতি। এদের মাঝে কোনই বিপদ নেই।
টুকি চোখ খুলে বলল, কেন এই কথা বলছ?
এই বসতির মানুষ হচ্ছে, সৃষ্টি জগতের মানুষদের মাঝে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ মানুষ। তারা এত শান্তিপূর্ণ মানুষ যে এদের সমাজে কোন অস্ত্র নেই।
কোন অস্ত্র নেই?
না।
তাহলে চোর ডাকাতদের ধরে কেমন করে?
এদের সমাজে কোন চোর-ডাকাত নেই।
টুকি সোজা হয়ে বসে বলল, চোর-ডাকাত নেই? কী বলছ তুমি?
সত্যি কথাই বলছি মহামান্য টুকি। এই দেখুন গ্যালাক্টিক এনসাইক্লোপিডিয়াতে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে। এই সমাজে চোর ডাকাত অপরাধী নেই, পুলিশ শান্তিরক্ষার মানুষও নেই।
টুকি জ্বলজ্বলে চোখে ঝায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ঝা, শুনেছ কথাটা। মানব সমাজ অথচ কোন চোর-ডাকাত নেই। পুলিশ নেই।
ঝা একটা হাই তুলে বলল, নীচু ধরনের সমাজ। আনন্দ উত্তেজনাহীন সমাজ। খোঁজ নিয়ে দেখ সেখানে ধন-সম্পত্তিও নেই। সবাই মাদুরে শুয়ে শুয়ে ধ্যান করছে।
রোবি বলল, আমার বেয়াদবী মাপ করবেন মহামান্য ঝা, কিন্তু গ্যালাক্টিক এনসাইক্লোপিডিয়াতে লেখা রয়েছে এখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে অমূল্য সম্পদগুলো রয়েছে। অতুলনীয় ঐশ্বর্য।
এবারে ঝাও সোজা হয়ে বসল। টুকির দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছ টুকি?
শুনেছি।
কী মনে হয়?
অতুলনীয় ঐশ্বর্য অথচ চোর-ডাকাত নেই, পুলিশও নেই। মনে হচ্ছে আমাদের জন্যে কেউ একটা দাও মারার ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ঝা দুই হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলল, শুয়ে বসে থেকে থেকে শরীর ম্যাদা মেরে গেছে, চল একটা দাও মেরে আসি।
টুকি মাথা নেড়ে বলল, যে সমাজে চোর-ডাকাত নেই তাদেরকে ডাকাতি সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে আসাই উচিত। না হয় তাদের জ্ঞানভাণ্ডার অপূর্ণ থেকে যাবে।
ঝা দাঁত বের করে হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। কিভাবে করবে কাজটা?
খুব সোজা। ভারী কয়টা অস্ত্র নিয়ে গিয়ে হাজির হব কিছু সোনাদানা একত্র করে হুংকার দিয়ে বলব, কেউ কাছে আসেলেই গুল্লি।
ঝা একটু ইতস্তত করে বলল, কাজটা গোপনে করলে হত না?
সারাজীবন তো গোপনেই কাজ করলাম। একবার প্রকাশ্যে করে দেখি না কেমন লাগে। এই রকম সুযোগ আর কখনো পাবে বলে মনে হয়?
তা ঠিক।
রোবি বেশ মনোযোগ দিয়ে দুজনের কথা শুনছিল এবারে সুযোগ পেয়ে বলল, আপনারা এই শান্তিপূর্ণ মানব বসতির উপরে হামলা করবেন বলে মনে হয়?
হ্যাঁ। আপত্তি আছে তোমার?।
কী যে বলেন আপনারা–আমার কেন আপত্তি থাকবে? অত্যন্ত চমৎকার একটা কাজ হবে। অত্যন্ত আনন্দদায়ক কাজ।
তাহলে আর দেরী করা যায় না। যাও—স্কাউটশীপটাকে রেডি কর, কিছু ভাল ভাল অস্ত্র নিয়ে আস। ছোট মাঝারী আর লম্বা রেঞ্জের অস্ত্র।
এক্ষুণি নিয়ে আসছি।
ঘন্টা খানেক পরে দেখা গেল টুকি এবং ঝা রোবিকে নিয়ে ছোট একটা স্কাউটশীপে করে সোনাদানা ডাকাতি করার জন্যে উড়ে চলেছে।
গ্রহটি ছোট এবং মসৃণ। উপর দিয়ে দুবার পাক খেয়ে এসে টুকি বলল, এইটাই সেই গ্রহ? মানুষজন কোথায়?
ভিতরে।
ভিতরে? গ্রহের ভিতরে মানুষ থাকে নাকি? মানুষ থাকবে গ্রহের উপরে।
এই গ্রহটির আকার এত ছোট যে এর কোন বায়ুমণ্ডল নেই। তাই এর বাইরে কেউ থাকতে পারে না। সবাই ভিতরে থাকে। তা ছাড়া এত ছোট গ্রহে মাধ্যাকর্ষণ বলতে গেলে নেই; সেজন্যে বাইরে থাকার কোন ঝুকি নেই।
ঝা বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষ কিছু বুঝে না, ইতস্তত করে বলল, যদি বাইরে মাধ্যাকর্ষণ না থাকে তাহলে কিভাবে ভিতরে থাকবে?
রোবি বলল, গ্রহটিকে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয় তখন সেন্ট্রিফিউগাল বলের কারণে ভিতরে এক ধরনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করা যায়।
ঝা কিছুই না বুঝে বলল, অ।
টুকি চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু গ্রহের ভিতরে ঢুকব কেমন করে?
নিশ্চয়ই ঢোকার একটা কিছু রাস্তা আছে। রোবি তার টেলিস্কোপিক চোখ ব্যবহার করে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয়, খানিকক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলল, পাওয়া গেছে। ঐ যে একটা গোল গর্ত।
টুকি এবং ঝা ভাল করে তাকিয়েও কিছু খুঁজে পেল না। জিজ্ঞেস করল, কোথায়? কিছু তো দেখছি না।
আপনাদের চোখ তো ইনফ্রারেড দেখতে পারে না তাই দেখছেন না। কোন চিন্তা করবেন না, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
গ্রহের মাঝামাঝি এক জায়গায় সুড়ঙ্গের মত একটা গর্ত নিচে নেমে গেছে, ভিতর থেকে উষ্ণ এক ধরনের বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। ঝা মনমরা গলায় বলল, ঢোকার এই একটাই রাস্তা?
রোবি বলল, হ্যাঁ! ঢোকার এবং বের হবার একটাই রাস্তা।
ঝা বলল, টুকি মনে আছে চুরি বিদ্যার ডিপ্লোমা কোর্সে আমাদের সবচেয়ে প্রথম কি শিখিয়েছিল?
মনে আছে। যেখানে ঢোকার এবং বের হবার রাস্তা মাত্র একটা কখনো তার মাঝে চুরি করতে ঢুকবে না।
তাহলে ঢোকা কী উচিত হচ্ছে?
আমরা তো এখন চুরি করতে ঢুকছি না, ঢুকছি ডাকাতি করতে।
ঝা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অ।
অন্ধকার সুরুঙ্গ দিয়ে টুকি এবং ঝা নিচে নামতে শুরু করে। সুরুঙ্গের বাইরে স্কাউটশীপ নিয়ে রোবি অপেক্ষা করছে। বের হয়ে এলেই তাদের নিয়ে পালিয়ে যাবে। স্কাউটশীপের মাথায় ছোট আলো লাগানো রয়েছে। সেটা দিয়ে সামনে পথ আলোকিত করে তারা হাঁটতে থাকে। গাঢ় অন্ধকার, ছোট আলোতে সেটা দূর না হয়ে মনে হয় আরো জমাট বেঁধে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সুরুঙ্গ যত গভীরে নামতে থাকে অন্ধকার আরো গাঢ় হতে শুরু করে। অন্ধকারে হাতড়ে আরো কিছুদূর নেমে ঝা বলল, কিছু একটা গোলমাল আছে মনে হয়। এত অন্ধকার কেন? ভুল জায়গায় চলে এসেছি নাকি?
টুকি শুকনো গলায় বলল, ভুল জায়গা ন, ঠিক জায়গাতেই এসেছি। দেখছ না কী মসৃণ দেয়াল, নিখুঁত সিঁড়ি। হাত ধরার রেলিং।
কিন্তু আলো নেই কেন? লোড শেডিং হচ্ছে নাকি?
কী বল বোকার মত? লোড শেডিং কেন হবে?
অন্ধকারে যদি আছাড় খেয়ে যাই। পড়ে হাত-পা ভেঙে গেলে একটা কেলেংকারি হয়ে যাবে।
সাবধানে হাঁট।
সাবাধানে হাঁটতে হাঁটতে তারা এক সময় হারিয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার তার মাঝে নানা রকম গলি ঘুজি, কোনটার মাঝে ঢুকবে বুঝতে না পেরে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করতে করতে এক সময় তাদের আর বোঝার কোন উপায় রইল না তারা কোথায় আছে। ঝা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায় চলে এসেছি? এতো দেখছি গোলক ধাঁধার মত।
টুকি বলল, চিন্তার ব্যাপার হল। আমাদের পোশাকের পাওয়ার সাপ্লাই তো শেষ হতে চলল। একটু পরে তো আলো নিভে যাবে।
সর্বনাশ। ডাকাতির কাজ নেই। চল ফিরে যাই।
চল।
টুকি এবং ঝা উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে, ঘণ্টা খানেক হেঁটেও তারা কোন পথ খুঁজে পেল না এবং অবস্থা আরো খারাপ করে দেবার জন্যে প্রথমে টুকির এবং তারপর ঝায়ের মাথায় লাগানো বাতি দুটি নিভে গিয়ে তারা গাঢ় অন্ধকারে ড়ুবে গেল।
ঝা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, সর্বনাশ!
টুকি শুকনো গলায় বলল, চিন্তার বিষয় হল।
ঠিক তখন তাদের কানের কাছে থেকে কে যেন বলল, চিন্তার কোন ব্যাপার নেই ভাই। আমরা আছি?
ঝা ভয় পেয়ে একটা আর্ত চিৎকার করে বলল, কে? কে কথা বলে?
আমরা এই গ্রহের বাসিন্দা। আমার নাম রু। তোমাদের নাম কী ভাই?
ঝা কাঁপা গলায় বলল, আমার নাম ঝা।
টুকি বলল, আমার নাম টুকি।
কী সুন্দর নাম। আহা। টুকি এবং ঝ। ঝা এবং টুকি।
টুকি এতক্ষণে একটু সাহস ফিরে পেয়েছে, সে গলা উঁচিয়ে বলল, এখানে এত অন্ধকার কেন?
এতক্ষণ যে কথা বলছিল সে হঠাৎ চুপ করে গেল। টুকি আবার বলল, কী হল? রু—কথা বলছ না কেন? এখানে এত অন্ধকার কেন?
রু নরম গলায় বলল, অন্ধকার বড় আপেক্ষিক কথা। তোমাদের জন্যে যেটা অন্ধকার আমাদের জন্যে সেটা আলো।
তার মানে কী? আর তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?
আমি তোমাদের কাছেই আছি সারাক্ষণ। এতক্ষণ তোমাদের মাথার ঐ বিদঘুটে আলোর জন্যে কিছু দেখতে পারছিলাম না বলে কথাবার্তা বলিনি। এখন ওটা নিভেছে তাই দেখতে পাচ্ছি–
দেখতে পাচ্ছ? এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছ?
ঐ যে বললাম ভাই, তোমাদের কাছে যেটা অন্ধকার আমাদের কাছে সেটা আলো। আমাদের চোখ হচ্ছে অবলাল সংবদী—যার অর্থ আমরা ইনফ্রারেড আলো দেখতে পারি। তোমার যেই আলো দেখতে পারো আমাদের চোখের রেটিনাকে সেটা নষ্ট করে দেয়। তাই এখানে তোমাদের আলো নেই।
তার মানে তুমি আমাদের দেখতে পাচ্ছ?
পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। এই যে তুমি শুকনো মত, ছোট ছোট গোফ। আর এই যে আরেকজন ছোটখাট পাহাড়ের মতন মাথায় ছোট ছোট চুল-হা হা হা। রাগ করলে না তো ভাই?
ঝা মাথা নেড়ে বলল, না, রাগ করি নাই।
তোমাদের ঘাড় থেকে কালো লম্বা মতন ঐ সব কী ঝুলছে ভাই? দেখে মনে হচ্ছে অনেক ভারী?
জিনিসগুলো ছোট, মাঝারী এবং বড় রেঞ্জের অস্ত্র কিন্তু সেই কথাটা এখন বলে কেমন করে? টুকি আমতা আমতা করে বলল, ইয়ে মানে এটা হচ্ছে যাকে বলে—
যাই হোক এটা কী সেটা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। এখন চল আমার সাথে তোমাদের নিয়ে যাই। আমাদের এই ছোট গ্রহে অতিথি খুব একটা আসে না, কেউ এলে তাই আমাদের খুব আনন্দ হয়।
ঝা কাতর গলায় বলল, কোনদিকে যাব? কিছুই তো দেখি না।
এসো, আমার হাত ধর— বলে অন্ধকারে একজন তার হাত শক্ত করে ধরল।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে একজন ঝায়ের হাত ধরে এগিয়ে নিতে থাকে, ঝায়ের হাত ধরে ধরে এগিয়ে আসে টুকি। কিছুক্ষণের মাঝে তারা আরো মানুষের কথাবার্তা শুনতে পায়, সবাই তাদের দেখছে কিন্তু তারা কিছু দেখছে না ব্যাপারটা চিন্তা করেই টুকি এবং ঝায়ের গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে তারা এগিয়ে যেতে থাকে তাদের সামনে এবং পিছনে আরো মানুষ একত্র হয়েছে শব্দ, কথাবার্তা শুনে বোঝা যায়। একজন এগিয়ে এসে বলল তোমাদের পিঠে এ ভারী বোঝা তাই কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই। বলে কিছু বোঝার আগেই তাদের ছোট, মাঝারী এবং বড় রেঞ্জের অস্ত্রগুলো খুলে নিয়ে নিল। টুকি আমতা আমতা করে বলল, খুব সাবধান, মানে ইয়ে চাপ না পড়ে যায় তাহলে কিন্তু মানে ইয়ে
কী জিনিস এটা? টেলিস্কোপ নাকি?
আরেকজন বলল, নলটা চোখে লাগিয়ে ঐ ট্রিগারটা টেনে দিলে নিশ্চয়ই কিছু একটা দেখা যাবে, তাই না?
টুকি হা হা করে উঠে বলল, না না না—খবরদার ওরকম কাজ করো না। ভুলেও ট্রিগারে হাত দেবে না।
কী হয় হাত দিলে?
টুকি উত্তর না দিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে।
টুকি এবং ঝা হাত ধরাধরি করে জবুথবু হয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, একটি বিন্দুও দেখা যাচ্ছে না। মানুষ পরিপূর্ণ অন্ধকার দেখে অভ্যস্ত নয়, সব সময়েই যত অন্ধকারই হোক একটু আলো থাকে, তার উপর চোখের রেটিনাও কম আলোতে সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে কাজেই কিছু না কিছু তারা সব সময়েই দেখতে পারে। এই প্রথম তারা একটি পুরোপুরি অন্ধকার জগতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রাণপণে চোখ খোলা রেখেও তারা কিছু দেখতে পাচ্ছে না, নিকষ কালো অন্ধকারে সবকিছু ঢেকে আছে। এই অন্ধকার এত ভয়াবহ যে তাদের মনে হতে থাকে বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। ঝা টুকিকে টেনে বলল, টুকি।
কী হল?
আমাদের দাও মারার পরিকল্পনাটা একেবারে মাঠে মারা গেল।
তাইতো মনে হচ্ছে।
কী মনে হয়? জ্যন্ত ফিরে যেতে পারব?
অস্ত্রগুলো হাতছাড়া হয়েই তো বিপদ হল। কখন ভুল করে গুলি করে দেয়।
কী করব এখন?
করার কিছু নাই। যা করতে বলে তাই করতে হবে।
কাজেই টুকি আর ঝা ঘুটঘুটে অন্ধকারে একজন আরেকজনের হাত ধরে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে তাদের মনে হয় এই বুঝি কোন অতল খাদে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে কিংবা অসতর্ক কোন তরুণ মাঝারী রেঞ্জের অস্ত্র দিয়ে গুলি করে তাদের ধ্বংস করে দেবে। ঝা মনে মনে বলতে লাগল, হে ঈশ্বর, হে সৃষ্টিকর্তা—তোমার কাছে এন্ড্রোমিডার দোহাই লাগে, মিল্কিওয়ের দোহাই লাগে এই যাত্রা আমাদের উদ্ধার করে দাও। আর কোনদিন প্রয়োজন ছাড়া কোথাও হামলা করব না। সত্যিকারের বড় একটা দাও না পেলে দাও মারার চেষ্টা করব না। বাড়াবাড়ি লোভ করব না, অল্পতে সন্তুষ্ট থাকব—
টুকি এবং ঝাকে ধরে ধরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটা ঘরে এনে হাজির করা হল। তারা কিছুই দেখছে না শুধু শব্দ শুনে বুঝতে পারছে তাদেরকে ঘিরে অনেক মানুষ। বয়স্ক একজন বলল, ভিন দেশের অতিথি, আমাদের এই ছোট গ্রহে তোমাদের শুভ আমন্ত্রণ।
টুকি শুকনো গলায় বলল, অনেক ধন্যবাদ তোমাদের আতিথিয়েতার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ঝা সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলল, তোমাদের দেখতে পারছি না বলে ঠিক করে কথা বলতে পারছি না।
আমরা তোমাদের গ্রহ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। তাই ভাবলাম দেখে যাই।
ঝা যোগ করল, কিন্তু দেখতে এসে আবিষ্কার করলাম, এখানে আলো নেই তাই দেখা যায় না।
বয়স্ক মানুষটি বলল, আহা। তোমাদের কথা শুনে এত দুঃখ হচ্ছে কী বলব। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তোমরা দেখতে পাচ্ছ না।
মেয়ে গলার একজন বলল, প্রাচীন কালে যারা দেখতে পেত না তারা নাকি হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখত। আমাদের এই অতিথিরা ইচ্ছা করলে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আমাদের গ্রহটা দেখতে পারে।
হাত বুলিয়ে?
হ্যাঁ। তারা এত দেখতে চাচ্ছেন যখন। তাই না ভাই টুকি?
টুকি শুকনো গলায় বলল, হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়।
সাথে সাথে অন্ধকারে সবাই কথা বলতে থাকে, তাদেরকে অবশ্যি আমাদের ঘূর্ণায়মান পার্কটা দেখতে হবে। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখতে হবে।
কিন্তু সেটা একটু বিপদজনক মনে নাই বড় রোলারটা যখন ঘুরে আসে তখন সময় মত সরে না গেলে মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে যায়?
সেটা আর কঠিন কী? রোলারের শব্দ শুনেই সরে যেতে পারবে।
আর আমাদের সেন্ট্রাল অফিসঘরটা দেখতে হবে।
অবশ্যি অবশ্যি দেখতে হবে, মানে হাত বুলাতে হবে।
অনেক উঁচু অফিসঘর, উঠতে একেবারে জান বের হয়ে যাবে কিন্তু তবু। জায়গাটাতে হাত বুলিয়ে না গেলে হবে না।
ওঠার সময় হতে ফসকে গেলে জান শেষ হয়ে যাবে কিন্তু—
হাত ফসকাবে কেন? ভাল কাজে কেন খারাপ কথা বলছ?
আর আমাদের রি একটরের রাস্তাটা—
হ্যাঁ। হ্যাঁ। রি-এক্টরের রাস্তা। রেডিয়েশান থেকে দূরে থাকতে হবে কিন্তু।
তা তো বটেই—
ঝায়ের ইচ্ছে হল সে ডাক ছেড়ে কাঁদে। কিন্তু তারা এখন যে ঝামেলায়। পড়েছে ডাক ছেড়ে কেঁদে এর থেকে রক্ষা পাবার উপায় নেই। মুখ শুকনো করে দুজন বসে রইল। গ্রহের মানুষ জনেরা তাদের দুজনকে সমাদর করার নানা ধরনের আয়োজন শুরু করছিল, টুকি তার মাঝে বলল, আমাদের খুবই ভাল লাগছে এখানে এসে কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী হাতে মোটে সময় নেই।
ঝা বলল, তাছাড়া এরকম ঘুটঘুটে অন্ধকার চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি, কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
বয়স্ক গলার মানুষটি বলল, কথাটি সত্যি। পুরোপুরি অন্ধকার থাকলে স্নায়ুর উপর খুব চাপ পড়ে।
রিনরিনে গলার একজন মেয়ে বলল, কী করা যায়?
তাদেরকে দেখানোর একটা ব্যবস্থা করা যায় না?
কিভাবে দেখাবে?
মাথার পিছনে আচমকা লাঠি দিয়ে মারলে চোখের সামনে লাল নীল। তারা দেখা যায়।
সত্যি?
সত্যি।
দেখব নাকি মেরে। লাঠি আছে কারো কাছে?
টুকি এবং ঝা একসাথে চিৎকার করে জানাল তাদের কিছু না দেখেই বেশ চলে যচ্ছে।
টুকি এবং ঝায়ের কাকুতি মিনতি শুনে শেষ পর্যন্ত গ্রহের অধিবাসীরা তাদের দুজনকে যেতে দিতে রাজী হল। এখন হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখার সেই বিশাল কাজটি শুরু হবে। শুকনো মুখে তারা মাত্র শুরু করেছে তখন রিনরিনে গলার একজন মেয়ে বলল, আমাদের এই গ্রহে বেড়াতে এসেছেন, তাদেরকে কী কোন। উপহার দেয়া যায় না?
একসাথে বেশ কয়েকজন বলল, সত্যিই তো!
কী উপহার দেয়া যায়?
সোনা?
হ্যাঁ। তাদেরকে দশ কেজি সোনা দেয়া যাক।
এই প্রথমবার টুকি এবং ঝায়ের বুকের মাঝে রক্ত ছলাৎ করে উঠে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই গ্রহটিতে একটা ডাকাতি করার। ডাকাতি করে সোনা দানা নেবার কথা ছিল, যদি এমনিতেই সেই সোনা দানা পাওয়া যায় তাহলে মন্দ কী?
যখন দশ কে.জি. সোনা দেয়া নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে তখন আরেকজন বলল, সোনার চাইতে ভাল হবে প্রাটিনাম।
সোনা ভাল না প্লাটিনাম ভাল যখন সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তখন আরেকজন বলল, রুবি পাথরের কথা। অন্যান্য মূল্যবান পাথর নিয়েও আলোচনা শুরু হল। যখন নানারকম মূল্যবান পাথর বা ধাতু নিয়ে বাদানুবাদ হতে থাকে তখন বয়স্ক ব্যক্তিটি বলল, একজনকে উপহার দিতে হলে সবসময় সবচাইতে মূল্যবান জিনিসটি উপহার দিতে হয়।
আমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী?
নানা জনে নানা কথা বলতে থাকে এবং সেই আলোচনা শুনে প্রথমবার টুকি এবং ঝা এক ধরনের আনন্দ অনুভব করতে থাকে। অস্ত্র দেখিয়ে ডাকাতী করে তারা যে পরিমাণ সোনাদানা নিতে পারত এই গ্রহের মানুষগুলো উপহার হিসেবে তার চাইতে অনেক বেশি জিনিস দিয়ে দিচ্ছে। তাদের এই ভ্রমণটি শেষ পর্যন্ত বৃথা হয় নি তাহলে।
ভ্রমণটি বৃথা না হলেও খুব কষ্টকর হল। ঘাড়ের মাঝে দশ কেজি, উপহারের বাক্স এবং অস্ত্রগুলো নিয়ে গ্রহের বিপজ্জনক ঘূর্ণায়মান পার্কে হাত বুলিয়ে সেন্ট্রাল অফিসঘর এবং রি-এক্টর ভবনের রাস্তার উপর দিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত গ্রহের বাইরে স্কাউটশীপে তারা ফিরে এল তখন তাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে গেছে। বাইরে এসে প্রথমবার আলো দেখতে পেয়ে তারা হাঁপ চেড়ে বাঁচল। দীর্ঘ সময় এক বিন্দু আলো না দেখে কেন জানি তাদের মনে। হচ্ছিল যে আর বুঝি কোনদিন তারা আলো দেখতে পারবে না।
রোবি তাদের দুজনকে স্কাউটশীপে তুলে নেয়, সাথে উপহারের বাক্স এবং ভারী অস্ত্রসস্ত্র। সবকিছু তুলে নিয়ে স্কাউটশীপটা নিয়ে উড়তে শুরু করার আগে রোবি জিজ্ঞেস করল, আপনাদের ভ্রমণ কী সফল হয়েছে মহামান্য টুকি এবং ঝা?
টুকি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম সেটা সফল হয়েছে, তবে যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে হয় নি।
উদ্দেশ্য সফল হওয়াই বড় কথা। আপনারা কী সোনা-দানা কিছু আনতে পেরেছেন?
ঝা উৎফুল্ল গলায় বলল, পেরেছি। দশ কে. জি. একটা বাক্স বোঝাই মূল্যবান জিনিস এনেছি। তারা উপহার দিয়েছে।
জিনিসটা কী?
সোনা হতে পারে, প্লাটিনাম হতে পারে, রুবি বা মুক্তো হতে পারে—ঠিক কী দিয়েছে জানি না। সবচেয়ে মূল্যবান যেটা সেটাই দিয়েছে।
রোবি গলার স্বর উঁচু করে বলল, আপনি কী বলেছেন সবচেয়ে মূল্যবান?
হ্যাঁ। সবচেয়ে মূল্যবান।
ব্যাপারটা মনে হয় ভাল হল না।
ঝা শংকিত গলায় বলল, কেন?
আপনারা যখন গ্রহটিতে গিয়েছিলেন আমি তখন স্কাউটশীপে বসে এই গ্রহটি সম্পর্কে পড়াশোনা করেছি। জানতে পেরেছি তাদের চোখের রেটিনা অবলাল সংবেদী। আর–
আর কী?।
এই গ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিষ হচ্ছে গরু নামের চতুষ্পদ এক ধরনের প্রাণীর বিষ্ঠা। এক কথায় যাকে বলে গোবর।
ঝা চোখ কপালে তোলে বলল, সে কী! এই জিনিস মূল্যবান হয় কেমন করে?
রোবি স্কাউটশীপের গতিবেগ এবং দিক নিশ্চিত করতে করতে বলল, এই গ্রহটিতে প্রাকৃতিক খাদ্য খুব মূল্যবান। সেখানে প্রাকৃতিক সার দেওয়ার কথা। গোবর নামক এই বিশেষ জিনিসটি নাকি এক ধরনের সার–
টুকি থমথমে মুখে উঠে গিয়ে বাক্সটা খুলতে চেষ্টা করে হঠাৎ লাফিয়ে পিছনে সরে এল। রোবির আশংকা সত্য এই গ্রহ থেকে ঘাড়ে করে দশ কেজি ওজনের যে বাক্সটি তারা এনেছে তার ভিতরে রয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত কালচে থিকথিকে পাংশুটে এক ধরনের জিনিস। সেটা তারা আগে কখনো দেখেনি কিন্তু জিনিসটা কী হতে পারে সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ নেই।
স্কাউটশীপ থেকে ছুঁড়ে ফেলা গোবরের বাক্সটি ছোট গ্রহটিকে প্রায় দুইশত বছর ধরে ঘুরপাক খাওয়ার কথা। সম্ভবত এটি মানুষের সৃষ্টি একমাত্র কৃত্রিম উপগ্রহ যেটির জন্ম হয়েছে এক ধরনের ঘৃণা এবং আক্রোশের কারণে।
» ১২. মহাকাশযানটি ছোট নক্ষত্রের কাছাকাছি
মহাকাশযানটি ছোট নক্ষত্রের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নক্ষত্রটির আকর্ষণে মহাকাশযানের গতিবেগ যে ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, টুকি এবং ঝা সেটা গত কয়েকদিন থেকে বেশ অনুভব করতে পারছে। বিশাল মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপতে থাকে, মাঝে মাঝেই বিচিত্র ধরনের শব্দ করতে থাকে। মহাকাশযান থেকে বের হয়ে আসা নানা ধরনের এন্টেনাকে গুটিয়ে আনা হয়েছে। মহাকাশযানের সূচালো অগ্রভাগে তাপ নিরোধক বিশেষ আস্তরণে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মূল ইঞ্জিনটিকে চালু করার জন্যে বড় বড় ট্যাংক থেকে জ্বালানীর সরবরাহ শুরু হয়েছে। সহায়ক ইঞ্জিনগুলো এর মাঝে চালু করা হয়েছে, ভয়ংকর। শব্দ করে সেগুলো গর্জন করছে।
টুকি এবং ঝা বিশেষ মহাকাশচারীর পোশাক পরে তাদের জন্যে আলাদা করে রাখা চেয়ারে বসে আছে। রোবি তাদের জীবন ধারণের সহায়ক যন্ত্রপাতিগুলো তাদের পোশাকের সাথে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের শরীরে সমস্ত তথ্য মূল কম্পিউটারের ডাটাবেসে সংগৃহীত হচ্ছে। মহাকাশযানটির ভিতরে একটা লাল আলো একটু পর পর জ্বলে উঠছে। উপরে একটা বড় ঘড়িতে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে, যে সংখ্যাটি দেখানো হচ্ছে সেটি কমতে কমতে যখন শূন্য হয়ে যাবে সেই মুহূর্তে মহাকাশযানটি হাইপার ডাইভ দিয়ে বিশাল দূরত্ব পার হয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। প্রচলিত বিজ্ঞান ব্যাপারটিকে এখনো সত্যিকার অর্থে আয়ত্ত করতে পারে নি, দুর্ঘটনা প্রায় নিত্যনৈমত্তিক। হাইপার ডাইভ দিয়ে যেখানে পৌঁছানোর কথা সেখানে না পৌঁছে বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও পৌঁছে যাওয়া অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। আরো একটি ব্যাপার ঘটে যায় মাঝে মাঝে, সময় নিয়ে গোলমাল হয়ে যায়—একদিন রওনা দিয়ে আগের দিন পৌঁছে যাবার মত।
শেষ মুহূর্তে রোবি সমস্ত মহাকাশযানে ছোটাছুটি করতে লাগল। মূল ইঞ্জিন চালু করে কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুকে পড়ে চিৎকার করে বলল, হাইপার ডাইভের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান মহামান্য টুকি এবং মহামান্য ঝা!
টুকি এবং ঝা শক্ত করে তাদের চেয়ারে হাতল চেপে ধরল, মহাকাশযানের গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে, বড় বড় ইঞ্জিনগুলো প্রচণ্ড শব্দে গর্জন করতে শুরু করেছে, মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপছে মনে হচ্ছে বুঝি ভেঙে পড়বে যে কোন মুহূর্তে। টুকি এবং ঝা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেয়ালে লাগানো বড় ঘড়িতে সংখ্যাটি কমে আসছে দ্রুত। কমতে কমতে সংখ্যাটি শূন্যে এসে স্থির হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল সাথে সাথে পুরো মহাকাশযানটি দুলে উঠল একবার, টুকি
এবং ঝা জ্ঞান হারালো সাথে সাথে।
টুকি এবং ঝায়ের যখন জ্ঞান হল তারা তখন সৌরজগতের মাঝে ঢুকে পড়েছে, মহাকাশযানটি মঙ্গল গ্রহের পাশে দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের উপর ঝুকে আছে, কোন একটা কিছু দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে। টুকি চেয়ারের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, সবকিছু ঠিক আছে রোবি?
বুঝতে পারছি না।
কী বুঝতে পারছ না?
সৌরজগতে আমরা ঢুকে গেছি, মঙ্গল গ্রহের পাশে দিয়ে ছুটে যাচ্ছি কিন্তু তবুও হিসেব মিলছে না।
কী হিসেব মিলছে না?
গ্রহগুলো যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই।
কোথায় আছে?
অন্য জায়গায়।
ঝা শুকনো মুখে বলল, তার মানে কী?
মনে হচ্ছে সময় নিয়ে গোলমাল হয়ে গেছে। আমরা আগে চলে এসেছি।
কিসের আগে?
সময়ের আগে।
টুকি চিন্তিত মুখে বলল, পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পার না? জিজ্ঞেস করতে পার না আজকে কত তারিখ, কি বৃত্তান্ত?
সেটাই চেষ্টা করছি মহামান্য টুকি কিন্তু কাজ হচ্ছে না। কিছুতেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে–
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দেখতে পারছে না। পৃথিবীর চোখে আমরা অদৃশ্য।
টুকি নিজের চেয়ার থেকে উঠে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, কী বলছ তুমি?
আপনি নিজেই দেখুন মহামান্য টুকি। আমরা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষ বলের কারণে আমাদের গতিপথ বামদিকে বেঁকে যাবার কথা কিন্তু সেটা বেঁকে যাচ্ছে না। আমরা সোজাসুজি এগিয়ে যাচ্ছি।
টুকি ব্যাপারটা বুঝতে পারল না কিন্তু তবু জিজ্ঞেস করল, এরকম হওয়ার মানে কী?
মানে আমরা এখনো প্রকৃত জগতে প্রবেশ করি নি। অতিপ্রাকৃত জগতে আছি।
প্রকৃত জগতে কখন ঢুকব?
আমি জানি না মহামান্য টুকি। এ ধরনের ব্যাপার খুব বেশি ঘটে নি। তাই কেউ ঠিক জানে না।
ঝা-ও নিজের চেয়ারে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এসে বলল, এখন কী হবে রোবি? আমরা কী মরে যাব?
রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মরে যাওয়ার ব্যাপারটি আমি ভাল বুঝি না। তবে বাস্তব এবং অবাস্তব জগৎ বলে একটা ব্যাপার আছে। আমরা এখন অবাস্তব জগতে আছি—এক অর্থে বলতে পারেন। আমরা মরে আছি।
মরে আছি? ঝা আর্তনাদ করে বলল, মরে আছি মানে আবার কী?
আমরা যদি বাস্তব জগতে ফিরে না আসি তাহলে বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
টুকি এবং ঝা মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইল। মহাকাশযানটি তীব্র গতিতে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের কোন উপায় নেই। রোবির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এই অবাস্তব অতিপ্রাকৃত জগত থেকে মহাকাশযানটি পৃথিবী ভেদ করে কোন অচেনা জগতে চলে যাবে। টুকি রোবির দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি বলেছ আমরা সময়ের আগে চলে এসেছি?
মনে হচ্ছে তাই।
কত আগে?
রোবি হিসেব করে তারিখটি বলতেই ঝা চমকে উঠে বলল, অসম্ভব।
কী অসম্ভব?
ঐ তারিখে আমরা পৃথিবীতে ছিলাম, চুরি করতে গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল ব্যাংকে।
কিন্তু গ্রহের অবস্থান দেখুন। পৃথিবীর সাথে মঙ্গল গ্রহের আনুপাতিক অবস্থান। বুধ গ্রহ শুক্র গ্রহকে দেখুন–
রোবির কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ মহাকাশযানটি প্রচণ্ড শব্দ করে কাঁপতে শুরু করে, মনে হচ্ছে সেটি বুঝি তার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। রোবি মনিটরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, বাস্তব জগতে ঢুকে যাচ্ছি–
টুকি এবং ঝা প্রচণ্ড আঘাতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। কোনমতে নিজেদের সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল কিন্তু মহাকাশযানটি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনমতেই আর তাল সামলানো যাচ্ছে না। কন্ট্রোল প্যানেলটা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে দেখতে পেল মহাকাশযানটির দেয়ালে দেয়ালে আগুনের শিখা জ্বলে উঠছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল তারা তারপর হঠাৎ করে গাঢ় নিঃশব্দ অন্ধকারে ড়ুবে গেল চারিদিক।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, নাক মুখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচে। টুকি চোখ খুলে তাকাল, লম্বা ঘাসের মাঝে উপুর হয়ে পড়ে আছে সে, পাশে ঝা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে দেখে মনে হয় বুঝি প্রাণহীন। টুকি বুকের উপর ঝুকে পড়ে দেখল বুক ধুকপুক করছে, মরে যায়নি তাহলে। টুকি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঝাকে ধাক্কা দিল, সাথে সাথে ঝা চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, আমরা কোথায়?
পৃথিবীতে। বেঁচে গেছি মনে হয়।
ঝা উঠে বসে চারিদিকে তাকাল, বহুদূরে কোথায় আগুন জ্বলছে, কালো ধোঁয়া উড়ছে সেখান থেকে। অন্ধকার হয়ে আসেছ, কী চমৎকার লাগছে এই পৃথিবীটা। চারিদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কেমন করে বেঁচে গেলাম? কী হয়েছিল মহাকাশযানটিতে? রোবি কোথায়?
জানি না। টুকি মাথা নেড়ে বলল, কিছুই জানি না।
দুজনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিজেদের টেনে-ছেচড়ে সামনে নিতে থাকে, ঝা বলল, একটা জিনিস জান?
কী?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটা আগে ঘটেছে।
কোন ব্যাপারটা?
এই যে আমরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিজেদেরকে টেনে-ছেচড়ে নিচ্ছি। সেটা। আচ্ছা আমরা হাঁটছি না কেন?
টুকি বলল, আমরা হাঁটছি না, কারণ হাঁটলে পুলিশ আমাদের দেখে ফেলবে।
কিন্তু আমরা তো মহাকাশযান থেকে এসেছি। মনে নেই আমরা এম সেভেন্টি-ওয়ানে গেলাম?
টুকি ভুরু কুচকে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। মহাকাশযানের বিস্ফোরণে মাথায় চোট খেয়েছে। কী হয়েছে মনে করতে পারছে না ঠিক করে। মাথাটা ঝাকিয়ে বলল, হ্যাঁ! মনে পড়ছে আবছা আবছা। কোথায় জানি গেলাম?
ঝা মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল, ঠিক ভাল করে মনে পড়ছে না এখন। একটা মহাকাশযানে উঠে পড়েছিলাম ভুলে। হীরা চুরি করে–
মনে পড়েছে। টুকি মাথা নেড়ে বল, হীরা চুরি করে পালাবার জন্যে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ঐ দেখ আগুন জ্বলছে।
হ্যাঁ! তাড়াতাড়ি সরে পড়ি এখান থেকে।
টুকি আর ঝা দ্রুত গড়াতে গড়াতে সামনে এগুতে থাকে। প্যাচপ্যাচে কাদায় গড়াতে গড়াতে সামনে আকাশের দিকে মুখ করে টুকি বলল, কী বাজে বৃষ্টি!
ঝা হাসি হাসি মুখে বলল, মৌসুমী বৃষ্টি। একেবারে সময়মত এসেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিউশান একেবারে ধুয়ে নিয়ে যাবে।
টুকি রেগে মেগে বলল, তোমার বৃষ্টির চৌদ্দগুষ্ঠির লিভারে ক্যান্সার হোক।
ঝা মুখের হাসিকে আরো বিস্তৃত করে বলল, এতো রেগে যাচ্ছ কেন? কী চমৎকার বৃষ্টি, দেখ না একবার। তিন চার ঘণ্টার মাঝে থেমে যাবে।
তিন চার ঘণ্টা? টুকি মুখ খিচিয়ে বলল, ততক্ষণ আমরা কী করব?
ভিজব। মঙ্গল গ্রহে বৃষ্টিতে ভেজার একটা টুর আছে। সাড়ে সাতশ ইউনিট দিলে দশ মিনিট ভিজতে দেয়। সিনথেটিক বৃষ্টি। আর এইটা হল একেবারে খাঁটি প্রাকৃতিক বৃষ্টি।
টুকি রেগেমেগে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। সামনে আবছা অন্ধকারে উঁচু মতন কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। উপরে হঠাৎ একটা আলো জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। টুকির হঠাৎ মনে হল সে আগে কোথাও ওটা দেখেছে, কিন্তু কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারল না। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওটা কী—
(উৎসাহী পাঠকেরা ইচ্ছে করলে আবার বইয়ের গোড়া থেকে শুরু করতে পারেন!)