- বইয়ের নামঃ টুকি ও ঝায়ের (প্রায়) দুঃসাহসিক অভিযান
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. টুকি এবং ঝা দুজনকে মিলিয়ে
নিবেদন
আমার মাঝে মাঝেই সায়েন্স ফিকশান নিয়ে কৌতুক করে কিছু একটা লেখার ইচ্ছে করে, টুকি এবং ঝায়ের (প্রায়) দুঃসাহসিক অভিযান বইটি সেরকম একটা ইচ্ছে থেকে লেখা। যারা গোড়া সায়েন্স ফিকশান ভক্ত তারা আমার এরকম লেখা দেখে খুব বিরক্ত হন। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। অনুপম প্রকাশনী থেকে এই বইটি নূতন করে প্রকাশ করা উপলক্ষে অনেকদিন পর আবার পড়ার সুযোগ হলো–এরকম কাহিনী যে আরো অনেকবার লিখতে হবে সেই ব্যাপারটি আবারো নিশ্চিত হলো।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১০/৮/০৪
———–
পূর্ব কথা
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে দুজন মানুষ অন্ধকারে উবু হয়ে বসে আছে। একজনের নাম টুকি। অন্যজনের নাম ঝা। তাদের সামনে আবছা অন্ধকারে উঁচু মতন কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। উপরে হঠাৎ একটা আলো জ্বলে উঠে নিভে যেতেই দুজনেই চমকে উঠল। টুকির মনে হল ঘটনাটা আগে ঘটেছে, কিন্তু কবে ঘটেছে কোথায় ঘটেছে কিছুতেই সে মনে করতে পারল না। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওটা কী?
———–
০১.
টুকি এবং ঝা দুজনকে মিলিয়ে মোটামুটিভাবে একজন পুরো মানুষ তৈরি করা যায়। টুকি শুকনো কাঠির মতন, তার শরীরে মেদ বা চর্বি দূরে থাকুক প্রয়োজনীয় মাংসটুকুও নেই, যেটুকু থাকা প্রয়োজন ছিল সেটা জমা হয়েছে ঝায়ের শরীরে—সে দেখতে একটা ছোটখাট পাহাড়ের মতন। টুকির নাকের নিচে বিশাল গোফ সেটাও খুব সহজে ঝায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়া যেতো। বুদ্ধি শুদ্ধির ব্যাপারগুলোও দুজনের মাঝে ঠিক করে ভাগাভাগি করা হয় নি, ঝায়ের ভাগে বেশ কম পড়েছে এবং সেটুকু মনে হয় টুকি পুষিয়ে নিয়েছে। কোন একটা কিছু বুঝতে যখন ঝায়ের অনেক সময় লেগে যায় সেটা টুকি চোখের পলকে বুঝে নেয়। শুধু তাই নয়, যেটুকু না বুঝলেও ক্ষতি নেই কিংবা যেটুকু বোঝা উচিত নয় সেটাও সে বুঝে ফেলে পুরো জিনিসটাতেই একটা বিদঘুটে ঘোট পাকিয়ে ফেলে। চরিত্রের অন্যান্য দিকগুলোতেও তাই—টুকি হাসি তামাশার মাঝে নেই, কোন একটি হাসির দৃশ্য দেখেও সে এর মাঝে হাসার কোন কিছু খুঁজে পায় না। রসিকতার পুরো ব্যাপারটি পেয়েছে ঝা, অত্যন্ত কাঠখোট্টা একটা দৃশ্য দেখেও ঝা তার সমস্ত শরীর দুলিয়ে হা হা করে হাসতে শুরু করে। টুকি সন্দেহপ্রবণ মানুষ কোন কিছুকেই সে বিশ্বাস করে না, ঝা সাদাসিধে সহজ সরল, তাকে দশবার বিক্রি করে দিলেও সেটা নিয়ে কোন রকম আপত্তি করবে না। টুকি বদরাগী—চট করে ক্ষেপে গিয়ে হঠাৎ হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসে, ঝা মোটামুটি মাটির মানুষ, প্রয়োজনের সময়েও সে রেগে উঠতে পারে না।
চেহারা ছবি চালচলন বা চরিত্রের কোন দিক দিয়ে তাদের কোন মিল না থাকলেও একটা ব্যাপারে দুজনের মিল রয়েছে, তারা দুজনেই চোর। ছোটখাট ছিচকে চোর নয় রীতিমতো চোরের বিশেষ কলেজ থেকে পাস করা ডিপ্লোমাধারী পেশাদার চোর। ইন্টার গ্যালাক্টিক বুলেটিন বোর্ডে তাদের নাম পরিচয় প্রায়ই ছাপা হয়। পুলিশ সব সময়েই হন্যে হয়ে তাদের খোঁজাখুঁজি করছে এবং তারা দুজনেই সব সময় পুলিশ থেকে এক ধাপ এগিয়ে থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলেছে। শৈশবে টুকি এবং ঝা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের প্রটোনিয়াম বা প্রতিরক্ষা দফতরের সফটওয়ার চুরি করে হাত পাকিয়েছে। যৌবনে আন্তঃগ্যালাক্টিক সন্ত্রাসী দলের জন্যে পারমাণবিক বোমা চুরি করেছে। এখন দুজনেরই মধ্যবয়স, উত্তেজক জিনিসপত্রে উৎসাহ নেই, ইদানীং মূল্যবান রত্নের দিকে ঝুকে পড়েছে। সত্যি কথা বলতে কী বড় একটা দাও মেরে চুরি-চামারী ছেড়ে দিয়ে নিরিবিলি কোন একটা গ্রহে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার জন্যে আজকাল মাঝে মাঝেই দুজনের মন উসখুস করে।
সেই অর্থে আজকের চুরির প্রজেক্টটা টুকি এবং ঝা দুজনের জন্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেন্ট্রাল ব্যাংকের ভল্টে দুইশ চব্বিশ ক্যারটের হীরা এসেছে খবরটা সোলার-নেটে দেখার পর থেকে দুজনেই সেটা গাপ করে দেবার তালে ছিল। খোঁজ-খবর নিয়ে টুকি আর ঝা বসে বসে নিখুঁত পরিকল্পনা করেছে। জেট চালিত জুতো পরে দেওয়াল বেয়ে উঠে গেছে, মাইক্রো-এক্সপ্লোসিভ দিয়ে দেওয়াল ফুটো করেছে, এক্স-রে লেজার দিয়ে ভল্ট কেটেছে, রিকিভ সিস্টেমে লেখা কম্পিউটার ভাইরাস দিয়ে সিকিউরিটি সিস্টেম নষ্ট করেছে, তারপর দুইশ চব্বিশ ক্যারটের বিশাল হীরাগুলো নিয়ে সরে এসেছে। পুরো ব্যাপারটা একেবারে নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছিল কিন্তু একেবারে শেষ। মুহূর্তে একটা ঝামেলা হয়ে গেল। দুশো চুরানব্বই তালা দালানের একশ বিরাশি তালায় এসে ঝায়ের বাথরুম পেয়ে গেল। সেখানে বাথরুম খুঁজে বের করে কাজ সেরে নিচে নেমে আসতে আসতে দেখে ততক্ষণে সিকিউরিটি সিস্টেম খবর। পেয়ে গেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংকটা ঘিরে প্রায় এক ডজন পুলিশের গাড়ি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
টুকি এবং ঝা তখন জেট চালিত জুতা ব্যবহার করে লাফিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পালানোর চেষ্টা করেছে। পুলিশকে ধোকা দেওয়ার তাদের আধ ডজন। প্রোগ্রাম রেডী করা থাকে। দেখতে নিরীহ দর্শন গাড়িটি আসলে একটা ভাসমান। গাড়ি, নিচু হয়ে উড়তে পারে। সেটায় চড়ে তারা তাদের আধডজন প্রোগ্রাম ব্যবহার করেও পুলিশকে কোনভাবে খসাতে পারল না। তখন আর কোন উপায় না দেখে তাদের শেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করতে হল, তাদের ভাসমান গাড়িটিকে একসিডেন্টের ভান করে ধ্বংস করে দেওয়া হল। আগে থেকেই সেখানে তাদের জামা কাপড় পরানো সত্যিকার টিস্যু দিয়ে তৈরি তাদের চেহারার এক জোড়া রবোট বসানো আছে, পুলিশ এই মুহূর্তে সেগুলোকে ধরে নানাভাবে জেরা করছে আর সেই ফাকে তারা সরে এসেছে।