রাতে একা-একা বিছানায় শুয়ে রইলাম। বাড়িতে আমি আর লাবু রাঙাবুবুর সাথে ঘুমাই। ঘুমানোর আগে লাবু বলে, রাঙাবুবু, একটা গল্প বল।
আমি কিছু বলি না, এত বড় হয়ে গেছি, গল্প বলার কথা বলি কেমন করে? রাঙাবুবু প্রথমে বলে, ঘুমা ঘুমা, কত রাত হয়েছে দেখেছিস?
লাবু তখন ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে, তখন আমিও বলি, বল্-না একটা গল্প, রাঙাবুবু।
আমি শুনতে চাইলে রাঙাবুবু খুব খুশি হয়, তখন বলে, কোনটা শুনবি?
আমি কোনোদিন বলি রবিনসন ক্রুসো, কোনোদিন বুলি যখের ধন। সব বই আমিও পড়েছি, রাঙাবুবুর জন্যে বই তো আমিই আনি লাইব্রেরি থেকে! সব আমার জানা গল্প, তবু রাঙাবুবুর মুখ থেকে শুনতে এত ভালো লাগে! সব যেন একেবারে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে যায়!
রাঙাবুবু যখন গল্প শুরু করে, কী ভালোই না তখন লাগে।
আজকে আমি একা। ঘরে কি সুন্দর একটা নীল বাতি জ্বলছে, সবকিছু আবছা আবছা দেখা যায়, মনে হয় ঘরের ভিতর যেন জোছনা হয়েছে। কেমন জানি অবাস্তব মনে হয় সবকিছু। ঘুমের মাঝে বল্টু নড়াচড়া করছে, শুনলাম দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে বলছে, ফাটিয়ে ফেলব, একেবারে ফাটিয়ে ফেলব।
কে জানে আমাকে লক্ষ করেই বলছে কি না!
০৩. নূতন স্কুল
বল্টুর স্কুলে সিট পাওয়া গেল না বলে আমাকে অন্য একটা স্কুলে ভর্তি করা হল, স্কুলটা বাসা থেকে বেশ দূরে। নূতন স্কুলে আমাদের ক্লাস-টিচারের বেশ বয়স। চোখে চশমা, মুখে গোঁফ এবং কেমন জানি একটু রাগী রাগী চেহারা। প্রথম দিন আমাকে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত একনজর দেখে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, নাম কি?
বিলু বলতে গিয়ে সামলে নিয়ে ভালো নামটি বললাম, নাজমুল করিম।
বাসায় কী ডাকে? নাজমুল, না করিম?
বাসায় ডাকে বিলু।
বিলু? স্যার হাত নেড়ে বললেন, মাথায় কি আছে ঘিলু?
ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠল, তখন আমিও একটু সহজ হলাম। স্যারের চেহারাটা রাগী রাগী, কিন্তু মানুষটা মনে হয় খুব ভালো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কোন স্কুল থেকে এসেছিস?
নীলাঞ্জনা হাই স্কুল।
নীলাঞ্জনা? বাহ্, কী সুন্দর নাম। কোথায় স্কুলটা?
আমাদের গ্রামে। রতনপুর স্টেশন থেকে চার মাইল পুব দিকে।
রতনপুর? সেটা কোথায়?
আমার খানিকক্ষণ লাগল স্যারকে বোঝাতে জায়গাটা কোথায়। ভেবেছিলাম চিনবেন না, কিন্তু অবাক ব্যাপার, স্যার ঠিকই চিনলেন। মাথা নেড়ে বললেন, তুই তো তাহলে একেবারে একটা গ্রামের স্কুল থেকে এসেছিস! ভেরি ইন্টারেস্টিং। কী রকম পড়াশোনা হয় আজকাল বল দেখি?
ভালোই হয়।
ছাত্র কয়জন?
আমি মাথা চুলকালাম, স্কুলে ছাত্র কয়জন কখনো তো বের করার চেষ্টা করি নি। অ্যাসেমব্লির সময় মাঠের আধাআধি প্রায় ভরে যায় কিন্তু সেটা তো উত্তর হতে পারে না। ইতস্তত করে বললাম, অনেক।
অনেক? এটা আবার কী রকম উত্তর হল? একটা নাম্বার বল।
জানি না সার।
তোর ক্লাসে কয়জন ছাত্র?
এখন তিরিশ জন। বর্ষার সময় কমে যায়, যাতায়াতের অসুবিধে, তাই।
কী রকম অসুবিধে?
পানি উঠে যায়। রাস্তাঘাট ড়ুবে যায়। অনেক ঘুরে বড় সড়ক দিয়ে যেতে হয়। কাদাপানিতে হাঁটা খুব শক্ত।
ক্লাসের একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করল, তখন কি তোমরা বুট পরে যাও?
স্যার হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, ধুর বোকা। গ্রামের ছেলেদের বুটফুট লাগে না, তারা খালি পায়েই হেঁটে যেতে পারে।
স্যার ঠিকই বলেছেন, জুতা আমি বলতে গেলে কখনই পরি নি। এখন পরে আছি, কিন্তু সেটা তো স্কুলের পোশাক, সাদা শার্ট, নীল প্যান্ট আর কালো জুতা।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন, গ্রাম থেকে হঠাৎ চলে এলি যে?
আমার ছোট খালার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে এসেছি, স্যার।
ও। তাহলে তোর আব্বা-আম্মা কোথায় আছেন?
বাড়িতে।
ও ও। স্যার মাথা নেড়ে চুপ করে গেলেন। একটু পরে বললেন, যা গিয়ে বস৷ নূতন নূতন তোর একটু অসুবিধে হতে পারে, আমাকে বলিস।
আমি পিছনের দিকে গিয়ে একটা খালি সিটে বসলাম, একজন একটু সরে আমাকে জায়গা করে দিল। আমাকে খুব ভালো করে লক্ষ করল ছেলেটা। ক্লাসে নূতন ছেলে এলে মনে হয় এভাবে লক্ষ করতে হয়।
ঘন্টা পড়ার পর স্যার চলে যেতেই দু’জন ছেলে আমার দিকে এগিয়ে এল। একজন ফর্সা মতো শুকননা, অন্যজন বেশ গাট্টাগোট্টা। ফর্সা মতন ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, বর্ষাকালে তুমি কি লুঙ্গি পরে স্কুলে যেতে?
ছেলেটা কেন এটা জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করার ধরনটা বেশি ভালো না, কিন্তু তবু আমি উত্তর দিলাম। বললাম, হ্যাঁ। লুঙ্গি না পরে যাওয়া কঠিন। কখনো হাঁটু পানি, কখনো আরো বেশি
ফর্সা ছেলেটা তার সঙ্গীর পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, দ্যাখ–আমি বলেছি না?
গাট্টাগোট্টা সঙ্গীটি বলল, বাতাসে যখন তোমার লুঙ্গি উড়ে পাছা বের হয়ে যায় তখন তুমি কী কর?
আমি টের পেলাম, আমার মাথার ভিতরে আগুন ধরে গেছে। বাবা পাগল বলে সারা জীবন শুধু লোকজনের টিটকারি শুনে এসেছি, এটা আমার কাছে নূতন কিছু না। টিটকারি কেমন করে শুনতে হয় আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না। টিটকারি শুনে কী করতে হয়, সেটাও আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না।
আমি খপ করে ছেলেটার শার্টের কলারটা ধরে বললাম, আমি তোমার মশকরার মানুষ না। আমার সাথে মশকরা কোরো না, দাঁত ভেঙে ফেলে দেব।
ছেলেটা আর যাই করুক, আমার কাছে এই রকম ব্যবহার আশা করে নি–একেবারে থতমত খেয়ে গেল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন স্যার এসে গেলেন, কিছু বলতে পারল না। নিজের জায়গায় বসে একটু পরে পরে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতে লাগল। কে জানে ব্যাপারটি ভালো হল কি না কিন্তু আমি দেখেছি ফিলে বদমাইশগুলোকে এই ওষুধ দিয়ে খুব সহজে সিধে করে দেয়া যায়।