স্যার আমার সাথে পড়াশোনা নিয়ে অনেক কথা বললেন। আমার বইপত্র বাড়ির কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। সাথে অনেকগুলো বই এনেছিলেন, গল্পের বই নয়, পড়ার বই, সেগুলো বুঝিয়ে দিলেন। ঘরে বসে নিজে নিজে কেমন করে পড়তে হয় তার উপর বই।
রাতে উঠানে বড় আগুন জ্বালিয়ে সবাই গোল হয়ে বসেছিলাম, আমি তখন টুকুনজিলের গল্প করছি সবাইকে। কেমন করে টুকুনজিলের দেখা পেলাম, কেমন করে না বুঝে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশিতে তাকে আটকে রাখলাম, কেমন করে পিঁপড়ারা তাকে ঠিক করে দিল, কেমন করে সোনার আংটি চুরি করে আমি কী বিপদে পড়লাম। তারপর বব কার্লোসের কথা বললাম, তারা বিষাক্ত ওষুধ দিয়ে আমাকে কেমন কষ্ট দিল শুনে রাঙাবুবু আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে থাকে। তারপর যখন টুকুনজিল কী ভাবে ঘর ভেঙে আমাকে উদ্ধার করে আনল সেটা বললাম, সবাই। আনন্দে চিৎকার করে উঠল। এর পরের অংশটা ব্লাক মার্ডারের দলের সবাই জানে, তবুও আবার বললাম, সবাই যোগ দিল আমার সাথে। নান্টু আর তারিক অভিনয় করে দেখাল কেমন করে ভয়ঙ্কর মারপিট হল মেশিনগান হাতে সেই লোকের সাথে। সেই লোক কী ভাবে আছাড় খেয়ে পড়ল তার অভিনয়টা এত ভালো হল যে সেটা নান্টু আর তারিককে দু’বার করতে হল। সবাই হেসে কুটিকুটি হল তখন। তারপর বব কার্লোসকে ঝুলিয়ে রেখে আমরা কেমন করে পালিয়ে এলাম সেটা বললাম আমি। খালার বাসায় এসে বাঙাবুবর চিঠি পড়ে আমার কী মন-খারাপ হল, তখন টুকুনজিল। কেমন করে আমাকে আকাশে উড়িয়ে আনল সেটা বললাম। টুকুনজিল কেমন করে। বিদায় নিল, সেটা বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে এল, সবার চোখে পানি এসে গেল তখন।
গল্প শেষ হবার পর অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। অনেকক্ষণ পর স্যার বললেন, বিলু, এত বড় একটা ব্যাপার, কিন্তু তুই যে কী ভালোভাবে এটা সামলেছিস, তার কোনো তুলনা নেই। মহাকাশের সেই প্রাণী পৃথিবী সম্পর্কে কী ভালো একটা ধারণা নিয়ে গেল, বুকে করে কত ভালবাসা নিয়ে ফিরে গেল! আহা!
বাবা শুধু মাথা নেড়ে বললেন, এটা কি কখনো হতে পারে যে কেউ মহাকাশের একটা প্রাণীকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশির মাঝে আটকে রাখবে? হতে পারে? বিলুটা যা গুল মারতে পারে।
নান্টু, তারিক, সুব্রত সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, কী বলছেন চাচা আপনি? আমরা নিজের চোখে দেখেছি।
তারপর অনেক দিন হয়ে গেছে। এখনো মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ কোনো মানুষ আমার খোঁজে আসে। কেউ এদেশের, কেউ বিদেশের। তারা আমার কাছে টুকুনজিলের কথা শুনতে চায়। নানারকম প্রশ্ন করে। ঘুরেফির সবাই শুধু একটা জিনিস জানতে চায়, ফিরে যাবার আগে টুকুনজিল কি কোনো প্রমাণ রেখে গেছে? কোনো চিহ্ন? কোনো তথ্য? কোনো অজানা সত্য? কোনো ভবিষ্যদ্বাণী?
আমি যখন বলি রেখে যায় নি, তখন সবাই আমার দিকে কেমন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। আমি বুঝতে পারি, আমার কথা তারা ঠিক বিশ্বাস করছে না।
আমি কিছু মনে করি না। বিশ্বাস না করলে নাই। আমি জানি, টুকুনজিল আছে। কেউ বিশ্বাস করলেও আছে, না করলেও আছে।
রাতে যখন আকাশভরা নক্ষত্র ওঠে, আমি তখন এন্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জকে খুঁজে বেড়াই, আমি জানি সেই নক্ষত্রপুঞ্জের কোনো একটি নক্ষত্রের কোনো একটি গ্রহে আছে আমার এক বন্ধু। আমি জানি যখন তার আকাশ ভরে নক্ষত্র উঁকি দেয়, সেও ছায়াপথের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
তাকিয়ে সে আমার কথা ভাবে।
আমি যেরকম করে তার কথা ভাবি।