হ্যাঁ, আছে।
কি নাম?
মন-খারাপ। দুঃখ।
দুঃখ। আমার খুব দুঃখ হচ্ছে , বিলু।
আমি কোনো কথা না বলে হঠাৎ হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলাম।
টুকুনজিল বলল, তুমি কেঁদো না বিলু। কেঁদো না। কেউ কাঁদলে কী করতে হয় আমি জানি না।
আমি শার্টের হাতা দিয়ে আমার চোখ মোছার চেষ্টা করলাম। টুকুনজিল আবার বলল, আমি যখন ফিরে যাব তখন আমার গ্রহের সবাইকে বলব, ছায়াপথে ছোট্ট একটা নক্ষত্র আছে তার নাম সূর্য। সেই নক্ষত্রে ছোট্ট একটা গ্রহ আছে তার নাম পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে ছোট্ট একটা মানুষ আছে, তার নাম বিলু। সেই বিলুর সাথে আমার ভাব হয়েছিল। সেই বিলু আমাকে খুব আশ্চর্য একটা জিনিস শিখিয়েছে, সেটার নাম ভালবাসা। আমাকে সে এত ভালবেসেছে যে হঠাৎ করে আমার বুকের ভেতরেও সেই আশ্চর্য অনুভূতির জন্ম হয়েছে। আমি একটা আশ্চর্য জিনিস বুকে করে নিয়ে যাচ্ছি বিলু। আমি তোমাকে কোনো দিন ভুলব না।
আমিও ভুলব না, টুকুনজিল।
আবার যখন আসব, আমি তখন তোমাকে খুঁজে বের করব।
কখন আসবে তুমি?
সময় সংকোচনের পঞ্চম পর্যায়ের তৃতীয় তরঙ্গে।
সেটা কবে?
এক শ তিরিশ বছর পরে।
এক শ’ তিরিশ। আমি ততদিনে মরে ভূত হয়ে যাব।
তোমার সন্তানেরা থাকবে। কিংবা তাদের সন্তানেরা। আমি তাদের খুঁজে বের করে তোমার কথা বলব।
ঠিক আছে টুকুনজিল।
আমার যাবার সময় হয়েছে বিলু। যাবার আগে তুমি কি আমার কাছে কিছু জানতে চাও?
কি জানতে চাইব?
কোনো পরম জ্ঞান? মহাকর্ষ ও নিউক্লিয়ার বলের সংমিশ্রণ? সর্বশেষ প্রাইম সংখ্যা? আলোর প্রকৃত বেগ? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সীমা? কোনো মহাসত্য?
না টুকুনজিল, জানতে চাই না। তুমি তো বলেছ জ্ঞানে কোনো শর্টকাট নেই।
তাহলে কি তোমাকে বলে যাব কেমন করে সমুদ্রের পানি থেকে সোনা বের করতে হয়? বালু থেকে কেমন করে ইউরেনিয়াম বের করতে হয়? বলব?
টুকুনজিল। আমি কিছু চাই না।
কিছু চাও না?
না, শুধু চাই তুমি যেন ভালো থাক। যেখানে থাক ভালো থেকো।
বিলু।
আমাকে বিদায় দাও, বিলু।
তুমি কোথায়?
এই যে আমি, তোমার হাতের উপর বসে আছি।
আমার হাতের উপর হালকা নীল আলোর একটা বিন্দু। আমি আলতোভাবে স্পর্শ করে বললাম, বিদায়।
টুকুনজিলের মহাকাশযান থেকে নীল বিদ্যুৎচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ে। আমার হাত থেকে সেটা উপরে উঠে আসে, তারপর আমাকে ঘিরে সেটা ঘুরতে শুরু করে। প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর দ্রুত, দ্রুত থেকে দ্রুততর। ঝিঁঝিপোকার মতো একটা শব্দ হয়, তারপর হঠাৎ করে নীরব হয়ে যায় চারদিকে।
টুকুনজিল চলে গেছে। বুকের ভেতর কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে আমার।
দরজা খুলে হঠাৎ বাবা বের হয়ে আসেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকালেন, তারপর দু হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন। আমাকে দেখতে পান নি বাবা, হঠাৎ দেখলেন, দেখে চমকে উঠে বললেন, কে? কে ওটা?
আমি, বাবা।
বিলু তুই?
হ্যাঁ বাবা।
বাইরে বসে আছিস কেন?
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তাই।
বাবা এসে আমার পাশে বসলেন। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, কী সুন্দর ফুলের গন্ধ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, তোমার শরীরটা কেমন লাগছে এখন?
শরীর? কেমন জানি হালকা হালকা লাগছে, মনে হচ্ছে বয়স কুড়ি বছর কমে গেছে হঠাৎ। একেবারে অন্যরকম লাগছে। খুব ভালো লাগছে শরীরটা। খুব ভালো। তুই এসেছিস বলেই মনে হয়।
রাতজাগা একটা পাখি হঠাৎ কঁককঁক করে ডেকে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। আমি চমকে উঠে বললাম, বাবা, শুনলে?
হ্যাঁ। ওটা কিছু না। পাখি।
পাখিটা কি বলছে, বাবা?
বাবা শব্দ করে হাসলেন। বললেন, ধূর বোকা। মানুষ কি কখনো পাখির কথা বুঝতে পারে?
আমি শক্ত করে বাবাকে আঁকড়ে ধরে সাবধানে চোখের পানি মুছে নিলাম। টুকুনজিল আমার বাবাকে ভালো করে দিয়ে গেছে।
টুকুনজিল! তুমি যেখানেই থাক, ভালো থেকো।
শেষ কথা
আমি নীলাঞ্জনা হাই স্কুলেই আছি। বেশ ভালোই আছি। সারা দিন স্কুল করে বিকেলে কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে ফুটবল খেলি। তারপর দলবেঁধে বড় দিঘিতে লাফিয়ে পড়ি। হৈচৈ করে সাঁতার কেটে গোসল করি, ড়ুব-সাঁতার দিয়ে এক জন আরেকজনের পা ধরে টানাটানি করি, ভারি মজা হয় তখন।
ছুটির দিনে আমি আর দুলাল হেঁটে হেঁটে সদরের বড় লাইব্রেরিতে যাই, এই লাইব্রেরিটা অনেক বড় আর কত যে মজার মজার বই! লাইব্রেরিয়ানের সাথে আমার খুব ভালো পরিচয় হয়ে গেছে, আমি তাই একবারে অনেকগুলো করে বই নিতে পারি। বইগুলো বুকে চেপে ধরে আমি আর দুলাল বড় সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরে আসি। দু’পাশে ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায়, ধানের শিষ ঢেউয়ের মতো নাচতে থাকে, তখন কী যে ভালো লাগে আমার। আমি আর দুলাল সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত রকম গল্প করি, বড় হয়ে কি করব এইসব।
ব্ল্যাক মার্ডারের দলবল একবার আমার কাছে বেড়াতে এসেছিল টুকুনজিলের গল্প শুনতে। স্যার নিয়ে এসেছিলেন, সবাই মিলে কী যে মজা হল তখন। আমি আর দুলাল ব্ল্যাক মার্ডারের দলকে সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম, কেমন করে জাল দিয়ে মাছ ধরতে হয়, কেমন করে গরুর দুধ দেয়াতে হয়, কেমন করে নৌকা বাইতে হয়, কেমন করে ক্ষেতে মই দিতে হয়। বিকেলে রাঙাবুবু সবাইকে খই ভেজে দিল দেখে সবাই এত অবাক হয়ে গেল যে বলার নয়। নান্ট তো ফিরে যেতেই চাইছিল না, তারিক বলল, সে তার বাবাকে বলবে নীলাঞ্জনা হাই স্কুলে বদলি হয়ে আসতে চায়। আমাদের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করবে।