কেউ কি আছে বাবার আশেপাশে?
না, নেই।
তাহলে আমাকে বাবার কাছে নামাও। ঠিক আছে।
আমি এবারে শোঁ শোঁ করে নিচে নেমে আসি। স্কুলঘরের পাশে দিয়ে উড়ে নারকেলগাছের পাশে মাদারগাছের কাছাকাছি নেমে হঠাৎ বাবাকে দেখতে পেলাম। গালে হাত দিয়ে মাদারগাছের সামনে উবু হয়ে বসে আছেন। আমি কাছাকাছি আসতেই বাবা হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেলেন। আমি উড়ে এসে খুব ধীরে ধীরে বাবার সামনে নামলাম।
বাবা একটু হেসে বললেন, বিলু, বাবা তুই এসেছিস?
আমি যে আকাশে উড়ে এসেছি, সেটা দেখে বাবা একটুও অবাক হলেন না, মনে হল ধরেই নিয়েছেন আমি উড়ে আসব।
আমি বাবার হাত ধরে বললাম, বাবা, তোমার শরীরটা নাকি ভালো না?
কে বলেছে?
রাঙাবুবু।
রাণু? রাণুটা একেবারে বোকা। আমি একটা হাঁচি দিলেই মনে করে অনেক অসুখ!
বাবা মাদারগাছটার দিকে তাকিয়ে বললেন, যেতে হয় এখন, জনাব। ছেলেটা এসেছে এতদিন পরে, মায়ের কাছে নিয়ে যাই। বড় খুশি হবে।
আমি বাবার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, রাঙাবুবু লিখেছিল তুমি একেবারে বিছানায়, তুমি তো বেশ হাঁটছ, বাবা।
আমি একেবারে বিছানাতেই ছিলাম। মনে হচ্ছিল আর বুঝি বাঁচবই না। এই ঘন্টাখানেক আগে কী হল, হঠাৎ শুনি ঝিঁঝিপোকার ডাক, মনে হল যেন বুকের মাঝে কে জানি চিমটি কাটল। তারপর তুই বিশ্বাস করবি না, হঠাৎ মনে হল শরীরটা অনেক ঝরঝরে হয়ে গেছে। তুই আসবি বলেই মনে হয়!
টুকুনজিল। আমি বুঝে গেলাম বাবা কেমন করে হঠাৎ ভালো হয়ে গেছেন। টুকুনজিল বাবাকে ভালো করে দিয়েছে। নিশ্চয়ই তাই। সে জন্যে আমার সাথে রহস্য করছিল, বাবার কথা বলছিল না। আমি টুকুনজিলকে ডাকলাম কয়েকবার, নেই ধারেকাছে। কে জানে আবার চট করে মঙ্গল গ্রহটা দেখতে গেছে কি না?
বাড়ির উঠানে আসতেই লাবু আমাদের দেখে ফেলল, তারপর চিৎকার করতে করতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। এক সেকেন্ডের মাঝে বাড়ির ভেতর থেকে সবাই বের হয়ে এল, মা, রাঙাবৰ, বড়, বড়বুবুর ছোট ছেলেটা সবাই। মা ছুটে এসে আমাকে একেবারে বুকে চেপে ধরলেন, বললেন, ইস, শরীরটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।
রাঙাবুবু বলল, বিলু, তুই এখন কেমন করে এলি? ট্রেন তো আসবে সন্ধ্যেবেলা! বাবা বললেন, উড়ে এসেছে। রাঙাবুবু চোখ পাকিয়ে বলল, উড়ে এসেছে?
হ্যাঁ। কী সুন্দর উড়তে শিখেছে বিলু! একেবারে পাখির মতো দেখলে অবাক হয়ে যাবি।
পাখির মতো?
হ্যাঁ, একেবারে পাখির মতো উড়তে পারে। বাবা ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিলু, একটু উড়ে দেখাবি এখন?
মা ধমক দিলেন বাবাকে, চুপ করেন তো আপনি।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হেসে বললেন, দেখলি বিলু, আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। তুই চলে যাবার পর আমার আর কথা বলার মানুষ নেই।
মা বললেন, বিলু বাবা যা, হাত-পা ধুয়ে আয়, খাবি।
আমি একটা গামছা নিয়ে বের হয়ে গেলাম, কে জানে কলতলায় দুলালকে পেয়ে যাব কি না, আমাকে দেখে কী অবাক হয়ে যাবে! হঠাৎ টুকুনজিলের কথা শুনতে পেলাম, বিলু? তুমি এখান থেকে চলে গিয়েছিলে কেন? এরা সবাই তোমাকে কী অসম্ভব ভালবাসে। তরঙ্গ কম্পন চার দশমিক সাতের মাঝে–
ভালবাসবে না কেন? আমার মা-বাবা ভাই-বোন—
তাহলে তুমি চলে গেলে কেন?
এই তো ফিরে এসেছি, আর যাব না।
হ্যাঁ, যেও না।
টুকুনজিল, আমি একটু আগে তোমাকে ডেকে পাই নি।
আমার মহাকাশযানটার কিছু জিনিস ঠিক করতে হল।
ঠিক হয়েছে?
হ্যাঁ।
টুকুনজিল, তুমি বাবার শরীর ঠিক করে দিয়েছ, তাই না?
পুরোপুরি ঠিক করি নি, হৃৎপিণ্ডের একটা ধমনীতে কিছু সমস্যা ছিল, সেটা ঠিক করে দিয়েছি। তুমি কি চাও অনা সমস্যাগুলোও সারিয়ে দিই?
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, পারবে তুমি? মাথা-খারাপটা সারিয়ে দিতে পারবে?
মাথা-খারাপ? তোমার বাবার মাথা খারাপ?
হ্যাঁ। দেখ না, গাছপালা, পশুপাখির সাথে কথা বলেন?
সেটা কি মাথা-খারাপ? পশুপাখিরা তো খুব নিম্ন বুদ্ধিবৃত্তির প্রাণী, কিন্তু তারাও তো চিন্তা করে, নিজেদের নিম্ন বুদ্ধিবৃত্তির চিন্তা। তোমার বাবা সেটা হয়তো অনুভব করতে পারেন। আমি যেরকম করি। এটা একটা ক্ষমতা–
কচু ক্ষমতা। দরকার নেই এই ক্ষমতার। তুমি বাবাকে ভালো করে দাও।
ঠিক আছে, যাবার আগে তোমার বাবাকে ভালো করে দেব।
যাবার আগে? কোথায় যাবার আগে?
আজকে আমার ফিরে যেতে হবে, মনে নেই?
তাই তো! টুকুনজিল, তুমি চলে যাবে?
হ্যাঁ, বিলু।
আমার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল।
১৬. বিদায়
গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, টুকুনজিল আমাকে ডাকছে। আমি উঠে বসি বিছানায়। রাঙাবুবু ঘুমিয়ে আছে বিছানায় ক্লান্ত হয়ে, অন্যপাশে লাবু। সাবধানে বিছানা থেকে নেমে আমি দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আকাশে মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে তার নরম জোছনায় চারদিকে কী সুন্দর কোমল একটা ভাব। বারান্দায় জলচৌকিতে আমি চুপচাপ বসে রইলাম। টুকুনজিল ডাকল আমাকে, বিলু।
বল।
আমার কেন জানি যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে এখানে থেকে যাই।
টুকুনজিল, আমারও তাই ইচ্ছে করছে।
কিন্তু আমার তো যেতে হবে জান। এখানে থেকে যাওয়া তো খুব অযৌক্তিক ব্যাপার। তাই না?
হ্যাঁ।
তবু মনে হচ্ছে থেকে যাই। মনে হচ্ছে তোমাকে নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াই।
আমি চুপ করে রইলাম।
কিন্তু আমার যেতে হবে। যেতে ইচ্ছে করছে না, তবু যেতে হবে। খুব বিচিত্র একটা অনুভূতি। খুব বিচিত্র। এর কি কোনো নাম আছে বিলু?