হ্যাঁ। কার্লোস তোমাকে এভাবে ধরতে চেয়েছিল। ধরে বুঝতে চেয়েছিল তুমি কী ভাবে সেটা কর।
হ্যাঁ। কিন্তু জ্ঞানের মাঝে কোনো শর্টকাট নেই! আমি যদি পৃথিবীর মানুষকে তাদের অজানা কিছু বলে দিই, তাহলে সেটা তো আর জ্ঞান হল না, সেটা হল ম্যাজিক। সেই ম্যাজিক পৃথিবীর মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে কেমন করে? অনেকটা হবে তোমাদের গল্পের দৈত্যকে বশ করার মতো। একটু যদি ভুল হয়, তাহলে উল্টো সেই দৈত্য তোমাকে ধ্বংস করে ফলবে।
তা ঠিক।
আমি একটা মেঘের মাঝে ঢুকে যাচ্ছিলাম, ভিজে কুয়াশার মতো মেঘ। মেঘ থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা টুকুনজিল, আমি এইভাবে উড়ছি কেমন করে? তুমি ঠিক কী ভাবে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছ?
তোমার ভাষায় বলা যায় আমি তোমাকে ঘাড়ে করে নিয়ে উড়ে যাচ্ছি। কিন্তু যেহেতু আমি খুব ছোট, তাই তোমার শরীরের এক জায়গায় ধরে না রেখে শরীরের তিন হাজার দু’ শ’ নয়টি ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুতে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। আমি খুব দ্রুত যেতে পারি, কাজেই সেটা কোনো সমস্যা নয়। নিচে থেকে তোমাকে উপরে ধরে রেখেছি, তুমি টের পাচ্ছ না, কারণ এক-একটা বিন্দুতে আমি এক আউন্স থেকেও কম চাপ দিচ্ছি।
টুকুনজিল একটু থেমে বলল, একটা প্লেন আসছে।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, আমাকে ধরতে?
না। যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে চাও?
কোনো ভয় নেই?
না। অনেক নিচে দিয়ে যাচ্ছে, তোমার নিঃশ্বাস নিতেও কোনো অসুবিধে হবে না। গতিবেগ একটু বেশি, তাই তোমাকে ঘিরে কোনো ধরনের একটা বলয় তৈরি করে দিতে হবে।
পারবে করতে?
পারব। হ্যাঁ, চল যাই।
আমি হাত দুটি উঁচু করলাম, মানুষ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেভাবে। সোজা উপরে উঠে ডান দিকে ঘুরে গেলাম পাখির মতো।
প্লেনটা বেশি বড় না। পাখার দু’পাশে দুটি প্রপেলার প্রচণ্ড শব্দ করে ঘুরছে। প্লেন যে এত শব্দ করে আমি জানতাম না, প্রথমে খানিকক্ষণ কানে হাত দিয়ে থাকতে হল, একটু পর অবশ্যি শব্দটা অভ্যেস হয়ে গেল, হতে পারে টুকুনজিল কিছু-একটা করে দিল যেন শব্দটা শুনতে না হয়। টুকুনজিলের অসাধ্য কিছু নেই। আমি প্লেনের পাশে পাশে উড়তে উড়তে সাবধানে একটা পাখার উপর দাঁড়ালাম। বাতাসে আমার চুল উড়ছে, মেঘের মাঝে উড়ে যাচ্ছি আমি, কী যে চমৎকার লাগছে তা আর বলার নয়।
প্লেনের গোল গোল জানালা দিয়ে মানুষজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, চোখ বিস্ফারিত, মুখ হাঁ করে খুলে আছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লাম, সবাই এত হতবাক হয়ে গেছে যে, কেউ হাত নেড়ে আমাকে উত্তর দিল না। শুধু একটা ছোট বাচ্চা খুশিতে। হেসে আমার দিকে হাত নাড়তে শুরু করল। আমি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, তারপর আবার হাত নাড়লাম, বাচ্চাটা আরো জোরে হাত নেড়ে লাফাতে শুরু করল। এবারে বাচ্চাটার দেখাদেখি আরো কয়েকজন হাত নাড়ল আমার দিকে।
টুকুনজিল বলল, চল ফিরে যাই!
চল।
আমি দুই হাত উপরে তুলে একটা ডিগবাজি দিলাম বাতাসে। তারপর দু হাত দু পাশে ছড়িয়ে প্লেনের মতো উড়ে গেলাম ডানদিকে। ঘুরে একবার পিছনে তাকালাম আমি, প্লেনের সব মানুষ এবারে পাগলের মতো হাত নাড়ছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি শেষবারের মতো হাত নেড়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। অনেক দিন মনে রাখবে সবাই পুরো ব্যাপারটা।
নিচে নামাতে নামাতে টুকুনজিল আমাকে একেবারে মাটির কাছাকাছি নামিয়ে আনল। ধানক্ষেত, নদী, নৌকা, ছোট ঘোট বন-জঙ্গল, কী চমৎকার দেখায় উপর থেকে। আমি পাখির মতো উড়ে যাচ্ছি বাতাসে, আর নিচে মাঝিরা নৌকা বেয়ে যাচ্ছে, চাষীরা কাজ করছে মাঠে, বৌ-ঝিরা কলসি নিয়ে পানি আনছে পুকুর থেকে, মাঠে খেলছে বাচ্চারা।
মজার ব্যাপার হল, কেউ আমাকে খেয়াল করে দেখছে না। মানুষের মনে হয় দরকার না হলে উপরের দিকে তাকায় না। কেন তাকাবে, যা কিছু দরকার সবই তা নিচে মাটির সাথে। আমি এবারে আরো নিচে নেমে এলাম।
মাঠে গোল্লাছুট খেলছে বাচ্চারা, আমি একেবারে নিচে নেমে তাদের মাথার কাছ দিয়ে উড়ে আবার আকাশে উঠে গেলাম। বাচ্চাগুলো একেবারে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি হাত নাড়লাম, সবাই হাত নাড়ল আমার দিকে। ছোট একটা বাচ্চা শুধু পিছনে পিছনে দুই হাত উপরে তুলে ছুটে আসতে থাকে, আমি উড়ব—আমি উড়ব–
আমার কী মনে হল জানি না, নিচে নেমে এসে বাচ্চাটার দুই হাত ধরে তাকে উপরে নিয়ে আসি। সেও ভাসতে থাকে আমার মতো, তখন সাবধানে ছেড়ে দিই তাকে। বাচ্চাটি ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে যায়, আমি উড়ে যাই সামনে। টুকুনজিলের অসাধ্য কোনো কাজ নেই।
এবারে সব বাচ্চা হাত তুলে পিছনে পিছনে ছুটতে থাকে, আমি উড়ব আমি উড়ব আমি উড়ব।
কিন্তু আমার সময় নেই, দেরি হয়ে যাচ্ছে বাড়ি পৌঁছাতে। হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় নিয়ে উড়ে উড়ে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেলাম।
টুকুনজিল বলল, আমরা প্রায় এসে গেছি।
সত্যি? হ্যাঁ, চিনতে পারছ না?
আমি নিচে তাকালাম, ঐ তো নীল গাঙ, ঐ তো নীল গাঙের পাশে স্কুলঘর, নীলাঞ্জনা হাই স্কুল। ঐ তত বড় সড়ক। ঐ তো দূরে আমাদের বাড়ি। বাড়ির পিছনে “জঙ্গল। ঐ তো জঙ্গলের পিছনে জোড়া নারকেল গাছ। কখনো উপর থেকে দেখি নি, তাই প্রথমে চিনতে পারি নি।
আমি বললাম, টুকুনজিল, বাবাকে দেখতে পাও?
হ্যাঁ।
কোথায়?
একটা মাদারগাছের সামনে চুপ করে বসে আছেন।