না, থাক। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোট খালার বকুনি শুনতে থাকি।
ঘন্টাখানেক পর বল্টু আমাকে একটা চিঠি দিয়ে গেল। বাড়ি থেকে এসেছে। চিঠিটা নিশ্চয়ই খুলে পড়ে আবার আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে। আঠাটা এখনো শুকায় নি। আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। ভিতরে রাঙাবুবুর একটা চিঠি। রাঙাবুবু লিখেছেঃ
বিলু
ভেবেছিলাম তোকে লিখব না। কিন্তু না লিখেই থাকি কেমন করে? বাবার খুব শরীর খারাপ, গত এক সপ্তাহ থেকে বিছানায়। তোক দেখার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়েছেন। মাঝরাতে উঠে বসে থাকেন, বলেন, দরজা খোল, বিলু এসেছে।
তুই চলে আয়, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাবা আর বাঁচবেন না। বাড়িতে তুই ছাড়া পুরুষমানুষ নাই। মনে হয় এখন তোকে দায়িত্ব নিতে হবে। বাবার পাগলামিটাও খুব বেড়েছে। বড় কষ্ট হয় দেখলে।
রাঙাবুবু।
আমি চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল, সবকিছু অর্থহীন হয়ে গেল হঠাৎ। বাবা মারা যাবেন? তাহলে আমার আর থাকবে কে? বিছানায় মাথাওঁজে আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম।
টুকুনজিল আমাকে ডাকল, বিলু।
কি?
তোমার কী হয়েছে, বিলু?
মন-খারাপ?
হ্যাঁ। অনেক মন-খারাপ?
হ্যাঁ টুকুনজিল, আমার অনেক মন-খারাপ। আমার বাবার নাকি অনেক শরীর খারাপ। রাঙাবুবু লিখেছে, বাবা নাকি মরে যাবেন।
আমি আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। টুকুনজিল বলল, তুমি কেঁদো না বিলু, তুমি যখন অনেক মন-খারাপ করে কাঁদতে শুরু কর, তখন তোমার মস্তিষ্কের কম্পনে চতুর্থ মাত্রার একটা অপবর্তন শুরু হয়; সেটা ভালো না। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় তখন।
আমি চোখ মুছে বললাম, ঠিক আছে, আমি আর কাঁদব না।
এখন তুমি কী করবে?
আমি বাড়ি যাব এক্ষুণি। ট্রেন ছাড়বে কখন কে জানে। ট্রেন না থাকলে বাসে যাব।
তোমাকে আমি তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাব?
পারবে নিতে? পারবে?
কেন পারব না।
কেমন করে নেবে?
আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাব।
সত্যি? কতক্ষণ লাগবে যেতে?
দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবে তুমি।
চল তাহলে যাই। চল। চল এক্ষুণি চল।
যাওয়ার আগে ছোট খালাকে বলে যেতে হবে। রান্নাঘরে কী কাজ করছিলেন, গিয়ে বললাম, ছোট খালা, আমার বাবার খুব অসুখ। আমি বাড়ি যাব।
ছোট খালা অবাক হওয়ার ভান করলেন, বললেন, কি অসুখ?
জানি না।
ঠিক আছে, বাড়ি যেতে চাইলে যাবি। তোর খালু আসুক।
আমি এখনই বাড়ি যাব।
এখন কেমন করে যাবি? ট্রেনের সময় দেখতে হবে না? ছোট খালা আমাকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলেন। ছোট খালার সাথে আর কথা বলার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি আমার ঘরে এসে একটা কাগজে একটা ছোট চিঠি লিখলাম।
ছোট খালা ও খালু :
রাঙাবুবু লিখেছে, বাবার খুব শরীর খারাপ। আমি তাই বাড়ি চলে গেলাম। আমার জন্যে আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকভাবে বাড়ি পৌঁছে যাব।
ইতি বিলু।
একটু ভেবে নিচে লিখলাম,
পুনঃ আমি এখন থেকে বাড়ি থেকেই পড়াশোনা করব। আমার জন্যে আপনাদের অনেক ঝামেলা হল।
চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে আমি চুপি চুপি ছাদে চলে এলাম।
ভরা-দুপুর এখন। রাস্তায় রিকশা যাচ্ছে, মানুষজন হাঁটাহাঁটি করছে। পাশের ছাদে এক জন কাপড় নেড়ে দিচ্ছে। কার্নিশে দুটো শালিখ প্রচও ঝগড়া করছে কী-একটা নিয়ে। আমি তার মাঝে টুকুনজিলকে বললাম, টুকুনজিল।
বল।
চল যাই। কোথায় যেতে হবে তোমাকে বলে দিই।
আমি জানি।
জান! আমি অবাক হয়ে বললাম, কেমন করে জান?
তুমি যা জান আমি তাই জানি। আমি তোমার মস্তিষ্কের মাঝে দু’বেলা ঘুরে বেড়াই। হা হা হা।
তুমি আমার বাড়ি গিয়েছ?
হ্যাঁ।
বাবাকে দেখেছ?
কেমন আছে বাবা? কেমন আছে?
টুকুনজিল রহস্য করে বলল, চল, গেলেই দেখবে।
বল না, এখন বল।
উঁহু। তুমি প্রস্তুত?
হ্যাঁ।
চল আমরা আকাশে উড়ে যাই!
পরমুহূর্তে আমি বাতাসে ভেসে উপরে উঠে গেলাম। আমার সমস্ত শরীর যেন পাখির পালকের মতো হালকা। প্রথম কয়েক মুহূর্ত ভয়ের চোটে আমি প্রায় নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম, মনে হতে থাকল এই বুঝি পড়ে গেলাম আকাশ থেকে, হাড়গোড় ভেঙে ছাতু হয়ে গেলাম জনের মতো।
কিন্তু আমি পড়ে গেলাম না, বাতাসে ভেসে আরো উপরে উঠে গেলাম। ভেবেছিলাম নিচে থেকে একটা রৈরৈ রব উঠবে, লোকজন চিৎকার করে কেলেঙ্কারি শুরু করে দেবে, কিন্তু কী আশ্চর্য, একটি মানুষও লক্ষ করল না। কেউ যেটা কখনো আশা করে না, সেটা দেখার চেষ্টাও করে না, তাই খোলা আকাশে আমি নির্বিঘ্নে পাখির মতো উড়ে গেলাম।
আমার মিনিটখানেক লাগল ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হতে। তখন আমি আস্তে আস্তে একটু একটু হাত-পা নাড়তে শুরু করলাম। পানিতে মানুষ যেরকম করে সাঁতার কাটে অনেকটা সেভাবে। আমার মনে হতে লাগল আমি নীল গাঙে সাঁতার কেটে যাচ্ছি। একটু অভ্যাস হবার পর আমি একটা ডিগবাজি দিলাম বাতাসে, ঘুরপাক খেলাম কয়েকবার, তারপর চিলের মতো দু’হাত মেলে উড়ে যেতে থাকলাম আকাশে।
কী মজা উড়তে, টুকুনজিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, তুমি তো জান। তুমি তো উড়ে বেড়াও।
হ্যাঁ, আমি নিজে তো উড়তে পারি না, আমার মহাকাশযানে করে আমি উড়ে বেড়াই।
প্লেনের মতন?
অনেকটা সেরকম, কিন্তু তার থেকে অনেক সাবলীল। প্লেনের আকাশে ওড়ার জন্যে রানওয়ে লাগে, নামার জন্যেও রানওয়ে লাগে। তা ছাড়া যখন যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে যেতে পারে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না। আমার মহাকাশযান তা পারে। তা ছাড়া আমি অসম্ভব দ্রুত যেতে পারি। এত দ্রুত যে ভূমি চিন্তাও করতে পারবে না।