আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম লোকটার উপর, সাথে সাথে পন্টু, মাহবুব, সুব্রত, নান্টু–সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল একসাথে। লোকটা ভাবাচ্যাকা খেয়ে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, দমাদম কিল-ঘুসি-লাথি পড়তে থাকে, পাথরের মতো শরীর লোকটার, কিছু হয় না, কেমন যেন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। টুকুনজিল এখনো হাত দেয় নি, যখন দেবে তখন আর বাছাধনকে দেখতে হবে না।
গা-ঝাড়া দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল লোকটা। হাতের মেশিনগানটা তুলে নিয়ে ট্রিগারটা টেনে দেয় হঠাৎ। ক্যাটক্যাট করে ভয়ঙ্কর শব্দ করে গুলি বের হয়ে আসে, ঝনঝন করে জানালার কাচ ভেঙে পড়ে, ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে যায় এক মুহূর্তে। কাউকে কি মেরে ফেলেছে?
তাকালাম চারদিকে, না, কারো কিছু হয় নি, ভয় পেয়ে সবাই পিছনে সরে গেছে সময়মতো। পিশাচের মতো লোকটা হলুদ দাঁত বের করে ভয়ঙ্কর একটা মুখ করে তাকাল সবার দিকে।
কার্লোস বলল, কুইক। কুইক। তাড়াতাড়ি।
মেশিনগান হাতে লোক দু’টি আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি একটু অপেক্ষা করি, আরেকটু কাছে আসতেই লাফিয়ে ঘুরে একটা লাথি মেরে দিলাম বদমাইশটাকে।
টুকুনজিল হাত লাগাল আমার সাথে। লাথি খেয়ে লোকটা ছিটকে উপরে উঠে গেল গুলির মতো। ছাদে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে লোকটা ঘুরতে ঘুরতে সিলিং ফামের মাঝে বেধে গেল। সেখান থেকে কী ভাবে জানি আবার ছিটকে উপরে উঠে যায়, ছাদে আবার ভয়ঙ্করভাবে ঠুকে গিয়ে পাইপই করে ঘুরতে ঘুরতে নিচে পড়তে থাকে। ক্লাসের পিছনে বেঞ্চটাতে আছাড় খেয়ে পড়ে বদমাইশটা। টুকুনজিল কোনো মায়া দেখায় নি, এত জোরে নিচে আছড়ে পড়ল যে বেঞ্চটা ভেঙে গেল মাঝখানে। লোকটার নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসে, আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না এখনো।
আমি এবার মেশিনগান হাতে দুই নম্বর লোকটার দিকে তাকালাম। সে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি যখন হ্যাচকা টান দিয়ে তার কাছ থেকে মেশিনগানটা কেড়ে নিলাম, সে বাধা দেয়ার সাহসও পেল না। মানুষ যেভাবে পাটখড়ি ভেঙে ফেলে, হাঁটুতে চাপ দিয়ে আমি মেশিনগানটা ভাঙার চেষ্টা করলাম। টুকুনজিল নিশ্চয়ই বুঝতে পারে নি আমি কী করতে চাইছি, প্রথমবার তাই ভাঙতে পারলাম না। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতেই সেটা মট করে ভেঙে দু টুকরা হয়ে গেল পাটখড়ির মতো। ঘরে টু শব্দ নেই, সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি লোকটার কুলার চেপে ধরার চেষ্টা করলাম, অনেক লম্বা, ভালো করে ধরা গেল না। কিছু আসে-যায় না তাতে, আমি হাত ঘুরিয়ে একটা ঘুসি চালালাম। লোকটা পাঁইপাঁই করে ঘুরতে ঘুরতে ছিটকে উপরে উঠে গেল, ছাদে ঠোকা খেয়ে ধড়াম করে নিচে পড়ল কাটা কলাগাছের মতো। এই লোকটা বেশি কিছু করে নি বলে তার শান্তিও হল কম।
এবারে আমরা সবাই ছুটে গেলাম তারিকের কাছে। তাকে টেনে সোজা করলাম সাবধানে, মেরেই ফেলেছে নাকি কে জানে! তারিক চোখ পিটপিট করে তাকাল, কপালের কাছে কেটে গেছে খানিকটা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারিক-কেমন আছিস
তুই? কেমন আছিস?
তারিক জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল। শুনলাম টুকুনজিল বলছে, ভালোই আছে এখন।
সত্যি?
হ্যাঁ, একটা ধমনী ছিঁড়ে গিয়েছিল ভেতরে, ঠিক করে দিয়েছি।
তুমি ঠিক করে দিয়েছ? তুমি?
হ্যাঁ। চামড়া ফুটো করে শরীরের ভেতর ঢুকে গেলাম—
শরীরের ভেতর ঢুকে গেলে?
তারিক ফিসফিস করে বলল, কার সাথে কথা বলছিস তুই?
আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, বলব তোদের। আগে এদের টাইট করে নিই।
আমি এবারে বব কার্লোসের মুখের দিকে তাকালাম। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, এবারে তুমি।
বব কার্লোসের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল সাথে সাথে, মাথা নেড়ে বলল, নো, ননা, প্লিজ।
আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী, সাইন্টিস্ট। তুমি এক শ’ এগারো বিলিওন ডলার খরচ করে এসেছ এখানে, তোমার কাছে মানুষের জানের কোনো দাম নেই–
আমার বাংলা কথা বুঝতে পারছে না সে, মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে সে এদিকেসেদিকে। আমি হুঙ্কার দিয়ে বললাম, এমন শাস্তি দেব আমি, যে, তুমি জনের মতো সিধে হয়ে যাবে।
পল্টু অনুবাদ করার চেষ্টা করল, স্ট্রেট ফর দা হোল লাইফ।
আমি কার্লোসের দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করতেই সে মাটি থেকে উপরে উঠতে থাকে, ফুট খানেক উপরে উঠে সে স্থির হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কি, তাকে দেখাতে থাকে বোকার মতো। কোনো মানুষ যদি শূন্যে ঝুলতে থাকে তার পক্ষে কোনোরকম গাম্ভীর্য দেখানো খুব শক্ত।
ক্লাসঘরের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে কার্লোসের দিকে। নিজের চোখকে কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, কিন্তু চোখের সামনে দেখে অবিশ্বাস করবে কেমন করে? আমি সবার দিকে তাকালাম, জিজ্ঞেস করলাম, কি শাস্তি দেয়া যায় বল তো?
তারিক বলল, সারা জীবনের জন্যে ঝুলিয়ে রেখে দে।
পন্টু মাথা নাড়ল, না, না, ক্লাসের ভেতরে না। বাইরে, বাইরে—
সুব্রত বলল, চেহারাটা বাঁদরের মতো করে দে।
নাকটা ঘুরিয়ে দে, নাকের গর্তগুলো উপরে! প্রত্যেক বার নাকঝাড়ার সময় রুমাল দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখতে হবে—
খারাপ না আইডিয়াটা। হাত আর পাগুলো পাল্টে দে৷ যেখানে হাত সেখানে পা, যেখানে পা সেখানে হাত—
বাইরে হঠাৎ অনেক লোকজনের গোলমাল শোনা গেল। গুলির শব্দ শুনে সবাই ছুটে আসছে। আমাদের পালাতে হবে এক্ষুণি, নাহয় ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। আমি বব কার্লোসের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি বড় বিজ্ঞানী, কিন্তু তুমি বড় খারাপ মানুষ।