একা স্কুলের বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে থাকলাম। গত চব্বিশ ঘন্টায় এত কিছু ঘটেছে যে মনে হচ্ছে অনেক দিন হয়ে গেছে। এই স্কুলে সবসময় এত ছাত্র গমগম করতে থাকে যে এখন কেউ কোথাও নেই দেখে কেমন জানি লাগে। আমি টুকনজিলকে ডাকলাম কয়েকবার সাড়া পেলাম না। কোথায় গেছে কে জানে হয়তো। আবার চট করে মঙ্গল গ্রহ থেকে ঘুরে আসতে গেছে। কী বিচিত্র একটা ব্যাপার! কে জানে কখনো আমাকে নিয়ে যেতে পারবে কি না?
নানান কথা ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, হঠাৎ দেখি স্কুলের গেট খুলে লিটন এসে ঢুকল, তার সাথে আরো তিনজন ছেলে। এই তিনজনের একজনকেও আমি চিনি না, লিটনের বন্ধু। আমাকে দেখেই লিটনের মুখে কেমন—একটা হাসি ফুটে উঠল, খারাপ রকমের হাসি, এরকম হাসিকে আমি খুব ভয় পাই। কাছে এগিয়ে এসে তার বন্ধুদের বলল, বলেছিলাম না আজকে পেয়ে যাব?
আমি জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে রাখলাম। বললাম, আমাকে খুঁজছ তুমি?
লিটন আমার কথার উত্তর দিল না, বন্ধুদের বলল, একটা দল আছে ওদের, নাম দিয়েছে ব্ল্যাক মার্ডার। হাঃ—ব্ল্যাক মার্ডার। হেসে মরে যাই। আজকে নাকি মিটিং।
লিটন এবার আমার দিকে ঘুরে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, তোর আর সাগরেদরা কই?
ক্লাসের অনেকের সাথে আজকাল আমি তুই তুই করে বলি। ভালো বন্ধু, তাই। লিটনের সাথে বলতে গেলে আমার কথাই হয় না, তার সাথে তুই তুই করে কথা বলার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমাকে তুই তুই করে বলছে বদমাইশি করে। আমি বেশি গা করলাম না, বললাম, এখানে কেউ কারো সাগরেদ না।
লিটন মুখ বাঁকা করে বলল, ভালোই হল, তোকে একা পেলাম।
কেন?
তোকে একটা জিনিস বলতে এসেছি।
কি জিনিস?
তুই যে-জঙ্গল থেকে এসেছিস সেই জঙ্গলে ফিরে যা।
কি বলতে চাইছে বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না, কিন্তু আমি তবু না বোঝার ভান করে বললাম, মানে?
বলছি, তুই তোর নীলাঞ্জনা স্কুলে ফিরে যা।
কেন?
বলেছি ফিরে যেতে ফিরে যা বাজে তর্ক করিস না।
আস্তে আস্তে আমার মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেল, বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম, আমি থাকলে ফাস্ট হতে পারবি না?
মুহূর্তে লিটনের মুখ লাল হয়ে যায়। কিছু বোঝার আগে ধাক্কা মেরে আমাকে ফেলে দিল নিচে। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম, প্রথম দিন স্কুলে আমাকে অসম্ভব মেরেছিল লিটন। আজকেও মারবে?
লিটনের তিনজন বন্ধু এবারে হাত গুটিয়ে এগিয়ে এল। লিটন একগাল হেসে বলল, এরা আমার কারাটে স্কুলের বন্ধু। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ব্ল্যাক বেল্ট—ব্লাক বেল্ট আর রেড বেল্ট।
মারামারি করবি?
তুই করবি?
তোরা চারজন আর আমি একা?
কেন, ভয় করে? কাপড়ে পেচ্ছাব হয়ে যাবে?
আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল, বললাম, লিটন, চারজন মিলে এক জনকে মারতে এসেছিস, লজ্জা করে না? বাপের ব্যাটা হলে একা আয়।
একা তো তোকে কিমা বানিয়েছিলাম। আজকে কিমা না, একেবারে কাবাব বানিয়ে ছেড়ে দেব। জনের মতো সিধে হয়ে যাবি। এই বলে রাখলাম। স্কুল ছেড়ে যদি না যাস তোর জান শেষ।
আগেরবার লক্ষ করেছি, মারপিট করার সময় লিটন হাত ব্যবহার না করে পা ব্যবহার করে, কে জানে কারাটের সেটাই হয়তো নিয়ম। পা দিয়ে দুর থেকে মারা যায়, জোরে মারা যায় নানারকম সুবিধে। আমি সতর্ক থাকলাম, হঠাৎ করে মারতে দেব না।
লিটনের তিন বন্ধুর এক জন প্রথমে পা চালাল, ঘুরে লাফিয়ে উঠে উল্টো দিকে। আমি সতর্ক ছিলাম, সময়মতো লাফিয়ে সরে গেলাম বলে মারতে পারল না, উল্টো আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মুখে একটা ঘুসি মেরে দিলাম, গায়ের জোরে।
তারপর যেটা হল সেটা বিস্ময়কর। ছেলেটা ঘুসি খেয়ে ডিগবাজি খেয়ে উল্টে গেল, তারপর শূন্যে উড়ে গেল পাখির পালকের মতো। স্কুলের শিউলি গাছটার উপর দিয়ে উড়ে গেল ছেলেটা, দেয়াল পার হয়ে বাইরে গিয়ে পড়ল আছাড় খেয়ে! এত উপর থেকে যত জোরে পড়ার কথা তত জোরে পড়ল না, পড়ল অনেক আস্তে, না হলে আর বেঁচে থাকতে হত না বাছাধনের।
টুকুনজিল এসে গেছে আমার পাশে! আমার আর ভয় কি?
লিটন এবং তার বাকি দুজন বন্ধুর চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেছে। ফ্যাকাসে মুখে মাছের মধ্যে ঢোক গিলল কয়েকবার, একবার আমার দিকে তাকাল, তারপর শিউলি গাছটার দিকে তাকাল, তারপর তাকাল দেয়ালের ওপাশে যেখানে তখনো তাদের বন্ধু উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আমি একগাল হেসে বললাম, এবারে কে আসবি?
আর কেউ কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না। কাজেই আমি এগিয়ে গেলাম, লাফিয়ে উঠে নেচে কুদে মাথা ঝাঁকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ভয়ঙ্কর একটা ভঙ্গি করে লিটনের পেটে একটা ঘুসি হাঁকালাম, সাথে সাথে লিটন উড়ে গেল বাতাসে। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে লিটন উড়ে যাচ্ছে, দৃশ্যটি বড় মজার, যে না দেখেছে তাকে বোঝানো যাবে না। টুকুনজিল তাকে নিয়ে ফেলল আরো দূরে মাঠের মাঝখানে। যত উপর দিয়ে গিয়েছে সত্যি সত্যি সেখান থেকে পড়লে শরীরের একটা হাড়ও আস্ত থাকত না, কিন্তু টুকুনজিল মোটামুটি যত্ন করেই তাকে আছাড় দিয়ে ফেলল।
অন্য দু’জন অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটা ছোট লাফ দিয়ে হাত-পা ছুড়ে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে সামনে লাফিয়ে পড়তেই দু’জন একেবারে চোঁচা দৌড়। কোনো মানুষকে আমি আমার জীবনে এত জোরে দৌড়াতে দেখি নি।
লিটন স্কুলের মাঠ থেকে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকে প্রাণপণে ছুটতে থাকে।আমি খানিকক্ষণ তার পিছু পিছু ধাওয়া করি, স্কুলের দেয়ালের কাছে পৌঁছে একবার পিছন ফিরে তাকাল, তারপর প্রাণের ভয়ে খামচে খামচে এই ছয়ফুট দেয়ালটা টিকটিকির মতো উঠে গেল। অন্য পাশে কাঁচা নর্দমা, কিন্তু লিটনের তখন এত কিছু ভাবার সময় নেই। সে চিৎকার করে লাফিয়ে পড়ল সেখানে। ঝপাং করে একটা শব্দ হল, পড়ে ড়ুবে গেল কি না দেখতে পারলাম না।