বল।
আরো খানিকক্ষণ উড়ে বেড়ালে কেমন হয়?
না।
কেন?
তোমার ঘুম প্রয়োজন। অবশ্যি অবশ্যি প্রয়োজন। শরীরের সব ক্ষতিকর প্রভাব দূর হবে তা হলে।
একটু দেরি হলে কোনো ক্ষতি নেই।
আছে। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
টুকুনজিলের কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে ঘুমে। কোনোমতে বললাম, কোথায় নিয়ে রাখবে আমাকে?
তোমার বাসায়?
না না না।
তোমার স্কুলে?
স্কুলে? হ্যাঁ, স্কুলের রাখতে পার।
ঠিক আছে, এখন তুমি ঘুমাও। তোমার আর কোনো ভয় নেই।
আমার মনে হল সত্যি আমার আর কোনো ভয় নেই।
১৩. ব্ল্যাক মার্ডার
আমার খুব আরামের একটা ঘুম হল। এরকম আরামের ঘুম আমার অনেক দিন হয় নি। সেই যখন ছোট ছিলাম, তখন একপাশে মা আর অন্যপাশে বাবার সাথে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাতাম, তখন মনে হয় আমার এরকম আরামের ঘুম হত। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা নেই, শুধু আরাম আর শান্তি আর সুখ। এত আরামে যে ঘুমিয়েছি আজ, কে জানে। এর মাঝে হয়তো টুকুনজিলের হাত ছিল, মাথার মাঝে নিখুত সুষম কোনো কম্পন তৈরি করে দিয়েছে।
আমার ঘুম ভাঙল মানুষজনের কথার স্বরে। এক জন বলল, নিশ্চয়ই মরে গেছে।
আমাকে দেখেই নিশ্চয়ই বলছে। আমি চোখ খুলে ওঠার চেষ্টা করলাম। তখনো আমার হাত-পা-শরীর বাঁধা, উঠতে পারলাম না।
আরেকজন বলল, মরে নি, মরে নি। এখনো নড়ছে। কিন্তু মরে যাবে।
অনেক বেলা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। চারদিকে বেশ আলো, গাছপালার নিচে আমি শুয়ে আছি। আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম। পাশে স্কুল বিল্ডিং, তার জানালা থেকে কথা বলছে সবাই।
এক জন চেচিয়ে বলল, আরে! এটা তো বিলু।
আমি গলার স্বরটা চিনতে পারলাম, তারিক কথা বলছে।
বিলু। বিলু! বিলু! বলে সবাই চেঁচামেচি করে দুপদাপ করে ছুটে আসতে থাকে। আমি টুকুনজিলকে ডাকলাম, টুকুনজিল।
বল।
আমার বন্ধুদের কি আমি তোমার কথা বলতে পারি?
তোমার ইচ্ছে। কিন্তু–
টুকুনজিলের কথা শেষ হবার আগেই দুপদাপ করে দৌড়ে সবাই হাজির হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এখানে কে বিলুকে বেঁধে ফেলে রেখে গেছে? কী সর্বনাশ! বিলু, তুই কেমন আছিস?
আমি বললাম, ভালো আছি আমি। কোনো চিন্তা নেই। আগে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দে।
সবাই টানাটানি করে আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে থাকে। সুব্রত বলল, সাবধান। এই জায়গাটা কিন্তু খুব খারাপ। অনেক সাপ আছে এখানে। তোর কপাল ভালো লোকে সাপে কামড়ায় নি।
শুনতে পেলাম টুকুনজিল বলল, দুইটা পুরুষ কেউটে, একটা মেয়ে কেউটে, চারটা দাঁড়াস। আমি না করে দিয়েছি—কেউ কাছে আসে নি। পশুপাখির বুদ্ধিবৃত্তি খুব সহজ, নিচু স্তরের। ওদেরকে কিছু বলা খুব সোজা।
টুকুনজিল সোজাসুজি আমার মাথার ভেতরে কথা বলছে, অন্যেরা তাই কিছু শুনতে পেল না, তাদের কাছে মনে হল একটা ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। পন্টু বলল, তোকে এখানে কে ফেলেছে? দিনের বেলাতেই ঝিঁঝি পোকা ডাকে। আর কত মশা দেখেছিস?
শুনলাম টুকুনজিল বলল, নয় হাজার সাত শ চল্লিশটা মশা ছিল কাল রাতে। কেউ তোমার কাছে আসে নি। চার হাজার পাঁচ শ তিরাশিটা পিঁপড়া। এক হাজার এগারোটা মাকড়শা, সাত শ’ তেরোটা চিনে জোক, নয় শ” উনিশটা গুবরে পোকা—
খুলে দেয়ার পর আমি জায়গাটা চিনতে পারলাম। স্কুলের পিছনে গাছপালা ঢাকা জঙ্গলের মতো জায়গাটা। সাপখোপের ভয়ে কেউ কখনো এখানে আসে না, টুকুনজিল যে কী ভাবে এখানে আমাকে রেখেছে কে জানে।
তারিক বলল, তোকে কে এখানে এনে ফেলে রেখে গেছে?
আমি বললাম, সব বলব তোদের, চল। তোরা আজকে এখানে কী করছিস?
ব্ল্যাক মার্ডারের মিটিং না?
ও, আচ্ছা। আমার উপর দিয়ে কত রকম ঝড় বয়ে গেছে যে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আজকে স্কুলে ব্ল্যাক মার্ডারের গোপন মিটিং; আমার রক্ত-শপথ করে ব্ল্যাক মার্ডারের মেম্বার হওয়ার কথা। আমরা তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে আসছিলাম, নান্টু দাঁড়িয়ে বলল, চেয়ারটা দেখেছিস? ইস! কী দারুণ চেয়ার!
হ্যাঁ। একেবারে রকেটের চেয়ার।
আয় চেয়ারটা নিয়ে যাই।
আমি বললাম, এখন চল্। পরে নিলেই হবে।
কেউ যদি নিয়ে যায়?
কে নেবে এখান থেকে? তোর মাথা খারাপ হয়েছে?
নান্টু তবু খুঁতখুঁত করতে থাকে।
আমরা জঙ্গলের মতো জায়গাটা থেকে বের হয়ে আসি। সবাই এখনো একটা ঘোরের মতো অবস্থায় আছে, একটু পরপর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মাহবুব বলল, খালিপায়ে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না তো, বিলু?
আমি হেসে বললাম, আমি সারাজীবন খালিপায়ে হেঁটেছি, আমার কোনো অসুবিধে হয় না।
সুব্রত জিজ্ঞেস করল, তোর কি খিদে পেয়েছে?
আমার হঠাৎ খিদে চাগিয়ে উঠল। সত্যি খিদে পেয়েছে ভীষণ। বললাম, হ্যাঁ, খুব খিদে পেয়েছে।
তারিক বলল, তুই চিন্তা করিস না, আমরা খাবার নিয়ে আসব তোর জন্যে।
সুব্রত বলল, হ্যাঁ, তুই কোনো চিন্তা করিস না। তোকে আমরা এখন থেকে রক্ষা করব। আর কেউ তাকে কিছু করতে পারবে না।
আমার শুনে বড় ভালো লাগল।
ব্ল্যাক মার্ডারের গোপন মিটিং আধা ঘন্টার জন্যে পিছিয়ে দেয়া হল। পন্টু গেল আমার জন্যে কিছু খাবার কিনে আনতে। সে সম্ভবত ব্ল্যাক মার্ডারের ক্যাশিয়ার। মাহবুব গেল তার বাসা থেকে আমার জন্যে এক জোড়া জুতা আনতে। আমি কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে আমি খালিপায়ে যতক্ষণ খুশি হাঁটাহাঁটি করতে পারি, আমার কোনো অসুবিধে হয় না। সুব্রত আর তারিক গেল অন্য মেম্বারদের ডেকে আনতে।