আমি ঢোক গিলে বললাম, বলছে, তুমি না ঢুকলে আমাকে মেরে ফেলবে!
অত্যন্ত অযৌক্তিক ব্যাপার। দুটোর মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। আর মরে গেলে ঠিক কী হয়, বিলু?
আমি ছটফট করে বললাম, মরে গেলে সব শেষ।
কেন, শেষ কেন? আবার ঠিক করা যায় না?
না। মরে গেলে কেউ বেঁচে আসে না।
এটা হতেই পারে না।
আমি ঢোক গিলে বললাম, পারে টুকুনজিল, পারে। আমি জানি। তুমি কিছু-একটা কর তাড়াতাড়ি, কতক্ষণ হয়েছে?
ত্রিশ সেকেন্ড।
সর্বনাশ টুকুনজিল, একেবারে তত সময় নেই!
মরে গেলে শেষ কেন হবে? আমি দেখতে চাই কেমন করে শেষ হয়।
আমি চিৎকার করে বললাম, না, তুমি দেখতে চেয়ো না, টুকুনজিল। দেখতে চেয়ো না। কিছু-একটা কর।
হা হা হা। টুকুনজিল হঠাৎ হাসির মতো শব্দ করে বলল, এটা কি হাসির ব্যাপার?
না, এটা হাসির ব্যাপার না। ভয়ের ব্যাপার। ভয়ানক ভয়ের ব্যাপার। কিছু-একটা কর।
ঠিক আছে, তাহলে তোমাকে নিয়ে যাই এখান থেকে। হা হা হা।
পর মুহূর্তে কী হল ঠিক বুঝতে পারলাম না। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হল, আগুনের একটা হলকা ছুটে এল আমার দিকে, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করলাম আমি, আর হঠাৎ মনে হল আমি প্রচণ্ড বেগে আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছি। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না আমি, হঠাৎ মনে হল আমি বুঝি মরে যাচ্ছি তারপর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান হবার পর আমার বেশ কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে আমি কোথায়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি সাদা ধোঁয়ার মতো। সামনে-পিছনে উপরে-নিচে চারদিকে হালকা সাদা ধোঁয়া। আমার মনে হতে থাকে, সাদা ধোঁয়ার মাঝে শূন্যে ঝুলে আছি আমি। একবার মনে হল আমি বোধহয় মরে গেছি। বেশি পাপও করি নি, বেশি পুণ্যও করি নি, তাই মনে হয় দোজখ আর বেহেশতের মাঝখানে ঝুলে আছি আমি।
আমার হাত-পা সারা শরীর তখনো চেয়ারের সাথে বাঁধা। ভালো করে নড়তে পারছি না, ভয়ে ভয়ে ডাকলাম, টুকুনজিল। তুমি কোথায়?
এই যে এখানে।
এখানে কোথায়?
তোমার চেয়ারের নিচে।
কেন? নিচে কেন?
তোমাকে ধরে রেখেছি।
ধরে রাখার দরকার কী?
মাধ্যাকর্ষণ বল। ধরে না রাখলে তুমি পড়ে যাবে।
কোথায় পড়ে যাব?
নিচে।
নিচে কোথায়?
নিচে মাটিতে। প্রায় সাত হাজার ফুট নিচে।
আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ভয়ে, ঢোক গিলে বললাম, আমি কোথায় টুকুনজিল?
আকাশে।
আকাশে? কী সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি নিচে নামাও।
কেন?
আকাশে ঝুলে থাকবে কেমন করে? আকাশে কখনো কেউ ঝুলে থাকে নাকি?
তোমার শরীরে খুব ক্ষতিকর জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শরীর সেগুলো এখন পরিষ্কার করছে। সে জন্যে তোমার এখন ঘুমানো দরকার, মস্তিষ্কে এখন যেন কোনো অসম কম্পন না হয়, সেই জন্যে তোমাকে এখানে রেখেছি।
কোনোদিন শুনেছ কেউ আকাশে ঝুলে ঝুলে ঘুমায়?
এখানে কোনো শব্দ নেই, ধৈর্যচ্যুতি নেই, অসঙ্গতি নেই।
না থাকুক। আমাকে নিচে নামাও।
ঠিক আছে।
আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি চেয়ারটা ভাসতে-ভাসতে নিচে নামতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসে শরীরটা মাঝে মাঝে শিউরে উঠছিল। চারদিকে তখনো সাদা। ধোঁয়ার মতো মেঘ। হঠাৎ করে মেঘ কেটে গেল, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নিচে রাস্তাঘাট বাড়িঘর গাছপালা পুকুর। মেঘের ফাঁকে আকাশে বড় চাঁদ, তার আলোতে সবকিছু কেমন যেন অবাস্তব মনে হতে থাকে। নিচে তাকিয়ে আমার হঠাৎ ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। যদি টুকুনজিল হঠাৎ ছেড়ে দেয় আমাকে? ভয়ে ভয়ে ডাকলাম আবার, টুকুনজিল।
বল।
তুমি এত ছোট একটা প্রাণী, আমাকে উপরে ধরে রেখেছ, কষ্ট হচ্ছে না তো?
আমি ধরে রাখি নি। আমার মহাকাশযান ধরে রেখেছে।
তোমার মহাকাশযানের যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে তো?
আছে।
হঠাৎ করে ছেড়ে দিলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে। নিচে পড়লে আমি কিন্তু একেবারে চ্যাপ্টা হয়ে যাব। আমাকে ছেড়ে দিও না।
আমি তোমাকে বেশি সময়ের জন্যে কখনো ছাড়ি নি।
আমি চমকে উঠে বললাম, বেশি সময়ের জন্যে হাড় নি মানে? কম সময়ের জন্যে ছেড়েছ কখনো?
হ্যাঁ। মাঝে মাঝে নিচে গিয়ে দেখে আসছি কি হচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বললাম, সর্বনাশ! মাথা খারাপ হয়েছে তোমার?
টুকুনজিল কোনো কথা বলল না। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম, টুকুনজিল।
তবু কোনো সাড়া নেই। আমি নিচে পড়ে যাচ্ছি মার্বেলের মতো। গলা ছেড়ে ডাকলাম আমি, টু-কু-ন-জি-ল।
কি হল?
কোনোমতে নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, কোথায় ছিলে তুমি?
নিচে গিয়েছিলাম দেখতে। ভারি মজা হচ্ছে নিচে। হা হা হা।
আমি ঢোক গিলে বললাম, আমাকে এভাবে ফেলে রেখে তুমি চলে যেও না আর, খবরদার! ফিরে আসতে একটু দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
দেরি হবে না।
তবু তুমি যেয়ো না।
অনেক মজা হচ্ছে নিচে। হা হা হা। কেউ বুঝতে পারছে না কি হয়েছে।
হ্যাঁ, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমিও তো বুঝতে পারছি না কি হয়েছে।
খুব সোজা। প্রথমে তোমার সাথে লাগানো সব ইলেকট্রিক তারগুলো কেটে দিলাম। তারপর তোমাকে তুলে নিয়ে এলাম ঘরের মাঝখানে, সেখান থেকে দেয়ালে আঘাত করলাম আমার ব্লাস্টার দিয়ে, তারপর ফুটো দিয়ে তোমাকে বের করে আনলাম। বেশি তাড়াতাড়ি বের করেছিলাম বলে তুমি সহ্য করতে পার নি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে—
কী আশ্চর্য। আশ্চর্য কেন হবে? আমার ইঞ্জিনগুলো ফিউসান দিয়ে কাজ করে, অনেক শক্তি ইঞ্জিনে।
কথা বলতে বলতে আমরা ধীরে ধীরে নিচে নামছি। আস্তে আস্তে টুকুনজিলের উপর আমার বিশ্বাস ফিরে এসেছে। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার কোনো ভয় নেই, আমাকে সে কখনোই ভুল করে ফেলে দেবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আকাশে উড়ে বেড়াতে আমার বেশ মজা লাগতে শুরু করেছে। বললাম, টুকুনজিল।