টুকুনজিল আর যাই হোক, বোকা নয়। আমাকে অনেকবার বলেছে যে বিজ্ঞানীদের থেকে সে দূরে দূরে থাকতে চায়, কেন সেটা সে কখনো ঠিক করে বলে নি। এখন খানিকটা বুঝতে পারছি, সে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল। টুকুনজিল নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে যে, এটা তাকে ধরার একটা কৌশল, তাহলে কেন সে জেনেশুনে এই ফাঁদে পা দিতে আসবে আমি বুঝতে পারছিলাম না। যখন পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয়া হল, তখন হঠাৎ করে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
দৈত্যের মতো এক জন মানুষ ছোট একটা সিরিঞ্জ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল, শার্টের হাতাটা একটু গুটিয়ে কিছু বোঝার আগে ঘঁাচ করে আমার হাতে সিরিঞ্জটা বসিয়ে লাল রঙের ওষুধটা শরীরে ঢুকিয়ে দিল। সেই ওষুধটায় কী ছিল জানি না, কিন্তু হঠাৎ করে মনে হল কেউ যেন গনগনে জ্বলন্ত সীসা আমার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, সমস্ত শরীরে যেন আগুন ধরে গেছে। সমস্ত শরীর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে আমার মনে হতে থাকে, কেউ যেন আমার শরীরের চামড়া ছিলে নিচ্ছে টেনে টেনে। আমি ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় অমানুষের মতো চিৎকার করতে থাকি, মনে হতে থাকে আমার গলা দিয়ে বুঝি রক্ত বের হয়ে আসবে সেই চিৎকারে। লোকগুলো আমার চিৎকারে এতটুকু কান না দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করতে থাকে। আমার মনে হতে থাকে সমস্ত শরীর যেন আগুনে ঝলসে দিচ্ছে কেউ, মনে হতে থাকে শরীরের এক-একটি অংশ যেন টেনে টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে শরীর থেকে।
প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমি প্রায় অচেতন হয়ে যাচ্ছিলাম, তার মাঝে শুনলাম বব কার্লোস বলল, ভেরি গুড! ভেরি ভেরি গুড!
এর পর ইংরেজিতে কী বলল আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মনে হল আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণার ব্যাপারটি ঠিক তাদের মনের মতো হয়েছে, এবং সেই সংকেত নিখুঁতভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। লোকগুলো খুব খুশিতে কথা বলতে থাকে, একজন কী-একটা বলল, অন্য সবাই তখন হো হো করে হেসে উঠল খুশিতে।
অসহায়ভাবে শুয়ে আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি। আমার চোখের কোনা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে, আমি তখন ভাঙা গলায় বাবাকে ডাকতে থাকি। বাবা–বাবা গো, তুমি কোথায়—
দ্বিতীয়বার ইনজেকশানটি দিল প্রায় আধা ঘন্টা পর। আবার আমি পাগলের মতো, চিৎকার করতে থাকি। মনে হতে থাকে যে মাথার মাঝে কিছু-একটা গোলমাল হয়ে গেছে, কিছুতেই আর চিৎকার থামাতে পারি না। সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। যন্ত্রণা যেন শরীরের মাঝে সাপের মতো কিলবিল করে ছুটতে থাকে, উপর থেকে নিচে, নিচে থেকে উপরে–মনে হতে থাকে বিষাক্ত ছুরি দিয়ে কেউ যেন গেঁথে ফেলছে আমাকে। আমার চোখের সামনে লাল রঙের আলো খেলা করতে থাকে, আমি পাগলের মতো ভাবতে থাকি, হায় খোদা, আমি এখনো মরে যাচ্ছি না কেন? কেন মরে যাচ্ছি না? কেন মরে যাচ্ছি না?
হঠাৎ কে যেন আমার ভেতরে বলে উঠল, কিলু! কি হয়েছে তোমার বিলু?
কে? টুকুনজিল? তুমি এসেছ।
ঘরের মাঝে সব কয়জন মানুষ তখন মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। বব কার্লোস চিৎকার করে কী-একটা বলল, ঘরে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল হঠাৎ, ঘড়ঘড় করে কোথায় একটা শব্দ হল। বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে আর বিচিত্র শব্দে যন্ত্রপাতিগুলো আর্তনাদ করতে থাকে। তীব্র একটা লাল আলো একপাশে একটা জায়গা আলোকিত করে দেয়। ঝাঁঝালো একটা গন্ধ পেলাম আমি। লোকজনের উত্তেজিত কথাবার্তা আর যন্ত্রপাতির গুঞ্জনে কানে তালা লেগে যায় হঠাৎ।
টুকুনজিল আবার বলল, বিলু, তোমার কী হয়েছে? তুমি এরকম করছ কেন?
কষ্ট। বড় কষ্ট টুকুনজিল।
কষ্ট? সেটা কি?
আমি কোনোমতে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ফেললাম। হঠাৎ করে আমার কপালে একটু গরম লাগতে থাকে, নিশ্চয়ই টুকুনজিল নামার চেষ্টা করছে। শুনলাম সে বলল, চার শ’ তেরো মেগাসাইকেল। তিন মিলি সেকেন্ড পরপর। দুই তরঙ্গের অপবর্তন। অসম বন্টন। তোমার মস্তিষ্কের তরঙ্গে দেখি অনেক গোলমাল। দাঁড়াও, ঠিক করে দিই।
আমার কপালে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করলাম, তারপর হঠাৎ করে একেবারে ম্যাজিকের মতো সমস্ত যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল। আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল একটু নড়লেই আবার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবে, কিন্তু শুরু হল না। সমস্ত শরীর তখনো একটু একটু কাঁপছে, ঘামে ভিজে গেছে জামা-কাপড়। শরীরটা হালকা লাগছে হঠাৎ করে মনে হতে থাকে যে বাতাসে ভেসে যাব আমি। বুকের ভেতর কেমন যেন আনন্দ এসে ভর করে।
আমি কিন্তু তখন ভেউ ভেউ করে কেঁদে বললাম, টুকুনজিল, ভুমি না এলে এই রাক্ষসগুলো আমাকে মেরে ফেলত।
কেউ তোমাকে মারতে পারবে না, বিলু। আমি তোমাকে বাঁচাব।
এরা তোমাকে ধরতে চায়, টুকুনজিল।
আমাকে কেউ ধরতে পারবে না।
হঠাৎ বব কার্লোসের গলা শুনতে পেলাম আমি, ইংরেজিতে কী বলেছে ঠিক বুঝতে পারলাম না, এক মিনিট কথাটা শুধু ধরতে পারলাম। আমি টুকুনজিলকে জিজ্ঞেস করলাম, কি বলছে তুমি বুঝতে পারছ, টুকুনজিল?
হ্যাঁ। বলেছে এক মিনিটের মাঝে আমি যদি লেজার শিল্ডের মাঝে না ঢুকে যাই তাহলে তোমাকে মেরে ফেলবে। অত্যন্ত অর্থহীন অযৌক্তিক একটা কথা।
কেন?
লেজার শিল্ডটা তৈরি করেছে মেগাওয়াট পাওয়ার দিয়ে, ছোট একটা ফুটো রেখেছে ঢোকার জন্য, ঢোকার পর ফুটোটা বন্ধ করে দেবে। আমি লেজারলাইটের মাঝে আটকা পড়ে যাব। বের হতে চেষ্টা করলেই আমার মহাকাশযান মেগাওয়াট পাওয়ারে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি কেন সেখানে ঢুকব? কখনো ঢুকব না।