আমরা তাকে একটা নাম দিয়েছিলাম। এন্ড্রোসিলিকান। এন্ড্রোমিডা থেকে এসেছে, তাই এক্সো, শরীরটা কার্বনভিত্তিক না হয়ে সিলিকনভিত্তিক বলে সিলিকান। দুই মিলে এন্ড্রোসিলিকান। আর এই প্রাণী নিজেকে কী বলে ডাকে? টুকুনজিল। টুকুনজিল একটা নাম হল! নাম হল? দুই বেলা নিজের জগতে খবর পাঠাচ্ছে, আমার নাম টুকুনজিল আমার নাম টুকুনজিল। কী প্রচণ্ড ছেলেমানুষি। কী প্রচও নির্বুদ্ধিতা। কিন্তু কেন এটা করছে। কারণ তুমি তাকে এই নাম দিয়েছ। তুমি।
কী করছে এই হতভাগা প্রাণী? দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা তোমার পিছনে পিছনে ঘুরঘুর করছে। তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে সত্যি। বোঝার চেষ্টা করছে তুমি কেমন করে হাস! তুমি কেমন করে কথা বল। কেমন করে রাগ হও। হতভাগা টুকুনজিল! এক শ’ এগারো বিলিওন ডলার খরচ করা হয়েছে এর পিছনে, আর এই প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার মতো একজন নির্বোধ ছেলের পিছনে। তুমি ভাবছ আমরা এটা মেনে নেব?
না। তুমি সাহায্য কর ভালো। যদি না কর কিছু আসে যায় না। তোমাকে আমরা ধরে এনেছি, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। এখন তোমাকে ব্যবহার করব। তার কারণে তোমার যদি কোনো ক্ষতি হয়, কিছু করার নেই। তুমি যদি মরে যাও, কেউ যদি আর তোমাকে খুঁজে না পায়, কিছু করার নেই। এতে পৃথিবীর কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। পৃথিবীতে তোমার জন্যে কেউ ব্যস্ত নয়, তোমার পাগল বাবা কিছু করতে পারবে না। কেউ তার কথা শুনবে না।
বব কার্লোস কথা বন্ধ করে আমার চোখের দিকে তাকাল। মনে হল কেমন যেন বিষণ্ণ চোখের দৃষ্টি। মানুষের চোখের রং যদি নীল হয় তাকে দেখতে কেমন জানি অদ্ভুত দেখায়, মনে হয় যেন মানুষ নয়, যেন অশরীরী কোনো প্রাণী। খুব আস্তে আস্তে আমাকে জিজ্ঞেস করল, মহাকাশের প্রাণীকে ধরতে তুমি আমাদের সাহায্য করবে?
টুকুনজিলকে এরা আটকে ফেলবে? ফিরে যেতে দেবে না তার দেশে? কেটে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করবে? আমি কেমন করে সেটা করতে দিই তাদের? আমি মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বললাম, তুমি আর তোমার চৌদ্দ গুষ্টি জাহান্নামে যাও। আমি টুকুনজিলকে ধরিয়ে দেব না।
১২. কালরাত
খুব সুন্দর একটা ঘরে আমাকে আটকে রেখেছে। রাতে বিস্বাদ কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজানো খাবার খেতে দিয়েছে! ঘরে কোনো জানালা নেই। ধবধবে সাদা দেয়াল, উপরে উজ্জ্বল আলো। ঘরে আর একটি জিনিসও নেই, আমি চুপচাপ বসে থেকেছি। আমাকে দিয়ে কী করবে জানি না। বুকের ভেতর চাপা কেমন জানি একটা ভয়। বসে থেকে অপেক্ষা করতে-করতে আমি একসময় নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কারণ যখন ঘুম ভাঙল আমি একেবারে চমকে জেগে উঠলাম।
বেশ কয়েকজন মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই বিদেশি। আমাকে ধরে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। চেয়ারটা খুব চমৎকার, মহাকাশচারীরা যেরকম চেয়ারে বসে রকেটে করে যায়, অনেকটা সেরকম। লোকগুলো চেয়ারের হাতলে আমার হাত দু’টি লাল রঙের নাইলনের ফিতা দিয়ে বেঁধে ফেলল। চেয়ার থেকে দুটি বড় বড় বেল্ট বের হয়ে এসেছে, সেটা বুকের উপর দিয়ে নিয়ে আমাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। পা দুটি খোলা ছিল, এক জন সেগুলোও চেয়ারের নিচে। কোথায় জানি আটকে দিল। চেয়ারটাতে মাখা রাখারও একটা জায়গা আছে সেখানে মাথাটা রেখে কপালের উপর দিয়ে একটা বেস্ট টেনে এনে মাথাটাও আটকে ফেলল।
আমি প্রথমে একটা বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু মানুষগুলো দৈত্যের মতো, তাদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই, আমি কিছুক্ষণের মাঝে হাল ছেড়ে দিলাম। প্রচণ্ড আতঙ্কে আমি সেই আশ্চর্য চেয়ারে শক্ত হয়ে শুয়ে রইলাম।
চেয়ারটাতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়ার পর এক জন কোথায় একটা সুইচ টিপে দিতেই চেয়ারটা আস্তে আস্তে উপরে উঠতে থাকে। আরেকটা সুইচ টিপে দিতেই চেয়ারটা কাত হয়ে লম্বা একটা বিছানার মতো হয়ে গেল। তখন আরেকজন লোক কপালের চারপাশে চুষনির মতো কী-একটা জিনিস লাগিয়ে দিতে থাকে, সেখান থেকে লম্বা ইলেকট্রিক তার বের হয়ে এসেছে। সেগুলো গিয়েছে পাশে রাখা নানারকম যন্ত্রপাতিতে কিছুক্ষণের মাঝে ঘরটা যন্ত্রপাতিতে বোঝাই হয়ে গেছে। সেগুলো থেকে নানারকম আলো বের হচ্ছে, নানারকম শব্দ। লোকগুলো গভীর মুখে যাওয়া-আসা করছে, যন্ত্রপাতি টানাটানি করছে, কথাবার্তা বলতে গেলে নেই, যেটুকু হচ্ছে খুব নিচু গলায়।
আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম, কী করছ তোমরা? কী করছ?
কেউ আমার কথায় কোনো গুরুত্ব দিল না, এক জন শুধু দৈত্যের মতো হলুদ। দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করে বলল, কুন বয় নায়।
কথাটির অর্থ নিশ্চয়ই কোনো ভয় নেই, কিন্তু ভয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হল। আমি কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছি, বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ড ঢাকের মতো শব্দ করছে। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি, কিন্তু দৈত্যের মতো লোকগুলোর মুখে মায়াদয়ার কোনো চিহ্ন নেই। দেখে মনে হয় দরকার হলে খুব ঠাণ্ডা মাথায় হাসিমুখে আমাকে মেরে ফেলবে।
কিন্তু আমাকে নিশ্চয়ই মারবে না। টুকুনজিলের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে না। প্রচণ্ড আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে আমি অসহায়ভাবে শুয়ে কী হয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি।
বব কার্লোস এল একটু পরে, আমি তাকে কয়েকবার ডাকলাম, কিন্তু আমাকে সে পুরোপুরি উপেক্ষা করে যন্ত্রপাতির সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সুইচ টিপে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। আমি কান পেতে লোকগুলোর কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম, কি বলাবলি করছে বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হল আমার মস্তিষ্কের নানারকম তরঙ্গ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে। সেগুলোকে একটা খুব শক্তিশালী এমপ্লিফায়ার দিয়ে বাড়িয়ে নিয়ে বাসায় ছাদে লাগানো এস্টেনা দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেবে। বব কার্লোসের দলবল আশা করছে টুকুনজিল আমার মস্তিষ্কের তরঙ্গের সাথে পরিচিত, কাজেই এই সংকেত পেয়ে বুঝতে পারবে আমি কোথায়, তখন ছুটে আমার সাথে দেখা করতে আসবে। এই ঘরে নানারকম যন্ত্রপাতি রাখা আছে, টুকুনজিল আসামাত্র তাকে ধরে ফেলা হবে।