প্রচণ্ড ভয়ে আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, কিন্তু তার আগেই হলুদ-দাঁতের লোকটা আমার মুখ চেপে ধরে বলল, কুকা, কুনু বয় নায়।
আমার গলা দিয়ে বিশেষ শব্দ বের হল না, যেটুকু বের হল, মাইক্রোবাসের ইঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে গেল তার বেশির ভাগ। আরেকটা চিৎকার দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু শরীরে জোর পাই না আমি, হঠাৎ করে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। নিশ্চয়ই আমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। চোখ বন্ধ করার আগে দেখতে পেলাম, হলুদ-দাঁতের লালমুখো বিদেশিটা আমার উপর ঝুকে মুখে হাসির ভঙ্গি করে রেখেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি অনেক রকম স্বপ্ন দেখলাম। ছাড়া-ছাড়া আজগুবি সব স্বপ্ন। এক সময় স্বপ্নে দেখলাম আমি বাড়ি ফিরে গেছি, বাবা একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে এমন একটা ভঙ্গি করলেন, যেন আমাকে দেখতেই পান নি। আমি ডাকলাম, বাবা।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, কে কথা বলে?
আমি বললাম, আমি।
আমি কে?
আমি বিলু।
বিলু?
হ্যাঁ।
বাবা আকুল হয়ে বললেন, তুই কোথায় বাবা বিলু?
আমি বললাম, এই তো, বাবা।
বাবা মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন কিন্তু তবু আমাকে দেখতে পেলেন না। বললেন, কোথায় তুই? কোথায়? তোকে দেখতে পাই না কেন?
আমি বললাম, এই তো বাবা,আমি এখানে।
কোথায়?
এই তো! বাবা, বাবা—
বিলু বিলু বিলু—
আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, কেউ-একজন সত্যি আমাকে ডাকছে। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুললাম, উজ্জ্বল আলো ঘরে, তার মাঝে একজন আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে! আগে কোথায় জানি দেখেছি লোকটাকে, কিন্তু মনে করতে পারলাম না।
আমার হঠাৎ করে সব মনে পড়ে গেল। স্কুলে যাচ্ছিলাম আমি, তখন রাস্তা থেকে ধরে এনেছে আমাকে, আমি উঠে বসার যে করলাম। মাখার কোথায় জানি প্রচণ্ড যন্ত্রণা করে উঠল হঠাৎ। মনে হচ্ছে ভিতরে একটা শিরা ছিঁড়ে গেছে বা অন্য কিছু। আমার সামনে দাঁড়ানো লোকটা অন্তরঙ্গ সুরে বলল, কেমন লাগছে বিলু তোমার?
কথা শুনে মনে হল যেন আমার কতদিনের পরিচিত। আমি জিব দিয়ে আমার শুকনো ঠেটি ভিজিয়ে বললাম, খারাপ। খুব খারাপ।
এই তো এক্ষুণি ভালো লাগবে তোমার।
আপনি কে? আমি কোথায়?
এক্ষুণি জানবে তুমি, আমি কে। নাও, এই ওষুধটা খেয়ে নাও।
ছোট একটা গ্লাসে করে লাল রঙের একটা ওষুধ আমার মুখের কাছে ধরল মানুষটা। আমি মাথা নাড়লাম, কি-না-কি খাইয়ে দিচ্ছে কে জানে।
খেয়ে নওি, খেয়ে নাও, ভালো লাগবে বলে প্রায় জোর করে ওষুধটা আমার মুখের মাঝে ঢেলে দিল। ওষুধটা মিষ্টি এবং চমৎকার একটা সুগন্ধ, তবু আমি খেলাম না, মুখে রেখে দিলাম। লোকটা আবার কাছে আসতেই আমি পিচকারির মতো তার মুখে ওষুধটা কুলি করে দিলাম মানুষটাকে চিনতে পেরেছি, আজ সকালে সে আমাকে ধরে এনেছে।
লাল ওষুধটা তার চশমা বেয়ে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে তার চমৎকার কাপড়ে লাল লাল ছোপ হয়ে যায়।
ঠা ঠা করে কে যেন হেসে উঠল হঠাৎ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম লালমখৈর আরেকজন বিদেশি মানুষ। আগে একে দেখেছি বলে মনে পড়ল না। কে জানে, হয়তো দেখেছি, এদের সবগুলোকে একই রকম দেখায়।
ভালো কাপড়-পরা মানুষটি তার লাল লাল ছোপ কাপড় নিয়ে আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকাল। আমি একেবারে লিখে দিতে পারি, ঘরে আর কেউ না থাকলে আমাকে মেরে বসত। কিন্তু আমি জানি আমার গায়ে কেউ হাত দেবে না। সারা পৃথিবীতে শুধু আমিই টুকুনজিলের খোঁজ জানি, এই লোকগুলো সে জনোই আমাকে ধরে এনেছে।
বিদেশি লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে কী যেন বলল, আমি তার একটা অক্ষরও বুঝতে পারলাম না। নিশ্চয়ই ইংরেজিই হবে, কিন্তু এটা কী রকম ইংরেজি।
একটা রুমাল দিয়ে মুখ কপাল এবং ঘাড় মুছতে মুছতে ভালো কাপড় পরা মানুষটি বলল, এই সাহেব বলছেন যে তোমার অনেক বড় বিপদ ছিল, সেটা কি তুমি জানতে?
কি বিপদ।
একটা প্রাণী তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, অনেক কষ্ট করে তোমাকে রক্ষা করা হয়েছে।
কোন প্রাণী?
মহাকাশের প্রাণী।
আমাকে ধরে নিতে এসেছিল?
হ্যাঁ।
রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল, বললাম, মিথ্যুক আপনার লজ্জা করে না এরকম মিথ্যা কথা বলতে? আমাকে মহাকাশের প্রাণী ধরে আনে নি, আপনারা ধরে এনেছেন। বিদেশি দালাল।
বিদেশি লোকটা তখন ভালো কাপড়-পরা মানুষটির সাথে খানিকক্ষণ কথা বলল। আমি ইংরেজি একটু একটু বুঝতে পারি, কিন্তু বিদেশিদের উচ্চারণ বড় খটমটে। দু’জনে কী কথা হল আমি পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝতে পারলাম, বিদেশি লোকটি এই মানুষটিকে চলে গিয়ে অন্য একজনকে আসতে চলছে। এই বিদেশি মানুষটি নিশ্চয়ই কোনো বড় মানুষ, কারণ সে যখনই কথা বলে, ভালো কাপড়-পরা মানুষটি মাথা নেড়ে নেড়ে বলে, জ্বি স্যার, জ্বি স্যার, অবশ্যি স্যার-–
মানুষটি বের হওয়ার পর ঘরে শুধু আমি আর বিদেশি মানুষটা। সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার মতো ভঙ্গি করল, আমার ইচ্ছে করল জিব বের করে একটা ভেংচি কেটে দিই। কিন্তু দিলাম না, হাজার হলেও একজন বিদেশি মানুষ। আমি মনে মনে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোন দেশের মানুষ?
বেশ কয়েকবার বলার পর বিদেশিটা বুঝতে পারল আমি কী জিজ্ঞেস করছি। উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?
আমি আবার মনে মনে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বললাম, দেখতে চাই কোন দেশের মানুষ এত বদমাইশ।