হাসিখুশি? সেটা কি?
তুমি হাসিও জান না? আমি খুকখুক করে হেসে ফেললাম শুনে।
তুমি কী করলে এটা?
আমি একটু হাসলাম।
হাসলে এরকম শব্দ করতে হয়?
হ্যাঁ, একেকজন মানুষ একেক রকমভাবে হাসে। কেউ হাঃ হাঃ করে শব্দ করে, কেউ হোঃ হোঃ করে শব্দ করে, কেউ খিকখিক শব্দ করে–
সম্পূর্ণ যুক্তিবহির্ভুত ব্যাপার। তুমি আবার হাস দেখি।
এমনি, এমনি কেমন করে হাসব, একটা হাসির ব্যাপার হলেই শুধু হাসা যায়।
অত্যন্ত কৌতূহল-উদ্দীপক ব্যাপার। মানুষের মাঝে অনেক কিছু শেখার আছে। হাসি। মন খারাপ। আর কী আছে তোমাদের?
আমি মাথা চুলকালাম, বললাম, তয় বলে আরেকটা জিনিস আছে।
ভয়?
হ্যাঁ ভয়। একটু ভয় পাও দেখি।
আমি আবার খুকখুক করে হেসে বললাম, খামোক আমি ভয় পাব কেমন করে? একটা ভয়ের জিনিস হোক, তখন–
সেটা কী রকম?
আমি আবার মাথা চুলকালাম, অনেক যখন বিপদ হয় তখন ভয় পায় মানুষ।
সত্যি?
হ্যাঁ। তোমার যখন বিপদ হয়েছিল, তুমি ভয় পেয়েছিলে না?
না। আমাদের কোনো অনুভূতি নেই। আমাদের হচ্ছে যুক্তি-তর্ক আর হিসেব। চুলচেরা হিসেব।
তোমাদের কোনো অনুভূতি নেই? রাগ-দুঃখ, ভয়-ভালবাসা কিছু নেই?
না।
ভারি আশ্চর্য! টুকুনজিল বলল, তুমি আমাকে শেখাবে?
তুমি যদি শিখতে চাও, শেখাব। আগে থেকে বলে রাখি, তোমার কিন্তু লাভ থেকে ক্ষতিই বেশি হবে।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাসার সামনে দুটি মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে দেখা যায় না, কিন্তু মনে হয় ভিতরে কেউ বসে আছে। শুধু মনে হয় বসে বসে এদিকে তাকিয়ে আছে। কিছু-একটা ব্যাপার আছে এর ভিতরে। সবাইকে এখন বলে দেয়ার সময় হয়েছে, তাহলে আর আমার কোনো দায়িত্ব থাকবে না। আমি ডাকলাম, টুকুনজিল।
বল।
আমি কি এখন তোমার কথা সবাইকে বলতে পারি?
পার। কাকে বলবে তুমি?
আমার ডাক্তার চাচাকে বলেছিলাম, বিশ্বাস করেন নি। মনে করেছিলেন, আমি পাগল। আমি একটু হাসলাম—
টুকুনজিল বলল, তুমি হাসলে এখন, তার মানে এটা হাসির ব্যাপার?
হ্যাঁ। বুঝতে পারলে, কেন এটা হাসির ব্যাপার?
এখনো বুঝি নি। ঠিক আছে বল, কাকে বলবে?
আমার স্যারকে। স্যার আমার কথা বিশ্বাস করবেন। তুমি কি সেই আংটির খেলাটা দেখাতে পারবে? ক্লাসের সবাইকে।
পারব। তুমি যদি চাও, তা হলে তোমাকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখব সবার সামনে।
পারবে তুমি? পারবে?
পারব। খুব সহজ। আমার ইঞ্জিনের এখন অনেক শক্তি।
আমি খুশিতে একেবারে হেসে ফেললাম।
টুকুনজিল বলল, আবার হাসলে তুমি। এটা হাসির ব্যাপার? এটা হাসির ব্যাপার?
অনেক কথা হল আমার টুকুনজিলের সাথে। প্রথম যখন দেখা হয়েছিল, একেবারে ভালো করে কথা বলতে পারত না, একটা কথা বলত এক শ’ বার, এখন প্রায় মানুষের মতো কথা বলতে শিখে গিয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, তার হাসতে শেখার চেষ্টা। মাঝে-মাঝেই হাসার মতো শব্দ করে বেশির ভাগ সময়েই ভুল জায়গায়। আমি তাকে শুধরে দিচ্ছি, কে জানে, তার গ্রহে ফিরে যাবার আগে সে হয়তো হাসতে শিখে যাবে।
১১. ছিনতাই
আজকেও আমি বল্টুর স্কুলে নেমে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম। ক্লাসে আজকে কী মজা। হবে চিন্তা করে আমার মুখের হাসি বন্ধ হচ্ছিল না। ক্লাস শুরু হওয়ার পরই আমি হাত তুলে বলব, স্যার, একটা কথা বলতে পারি?
স্যার বলবেন, কি কথা?
আমি বলব, খুব জরুরী কথা।
স্যার বলবেন, বল।
ঠিক তখন টুকুনজিল আমাকে বেঞ্চের উপর দিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে আসবে, স্যারের সামনে এনে মেঝে থেকে এক হাত উপরে ঝুলিয়ে রাখবে। স্যার নিশ্চয়ই এত অবাক হবেন যে কথা পর্যন্ত বলতে পারবেন না! আমি তখন বলব, স্যার, আপনার সাথে আমার বন্ধু টুকুনজিলের পরিচয় করিয়ে দিই।
স্যার বলবেন, টুকুনজিল?
আমি তখন বলব, জ্বি স্যার, মহাকাশের প্রাণী টুকুনজিল। তাকে দেখা খুব শক্ত, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছাড়া দেখা যায় না–
ঠিক এরকম সময়ে কে যেন আমার ঘাড়ে টোকা দিল। আমি চমকে পিছনে তাকালাম। খুব ভালো কাপড় পরা একজন মানুষ। সামনে চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে, চোখে চশমা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে, খোকা, শোন–
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ, তুমি একটু এদিকে আসবে?
এখন তো আমার স্কুলে যাবার সময়।
এক মিনিট–
আমি হঠাৎ টের পেলাম, আমার দুই পাশে আরো দুইজন মানুষ আমার দুই হাত শক্ত করে ধরেছে। মানুষগুলো ভালো কাপড় পরা, মুখ কেমন যেন হাসি হাসি, কেউ দেখলে ভাববে আমার পরিচিত কোনো মানুষ কিছু-একটা মজার কথা বলবে আমার সাথে। কিন্তু আমার বুঝতে বাকি থাকে না, এর মাঝে মজার কিছু নেই। লোক দু’জন আমাকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে নিয়ে যায়। কাছেই সেই মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে, কাছাকাছি আসতেই দরজাটা খুলে গেল আর দুই জোড়া শক্ত হাত আমাকে ভিতরে টেনে নিল। পুরো ব্যাপারটা ঘটল চোখের পলকে, আমি কিছু বোঝার আগে।
মাইক্রোবাসের জানালা টেনে তুলে রাখা, বাইরে থেকে দেখার উপায় নেই। ভিতরে সব কয়জন বিদেশি, লাল রঙের চেহারা দেখলেই পিলে চমকে যায়। একজন হলুদ দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করে বলল, কুকা, টোমাড় কুনু বয় নায়–যার অর্থ নিশ্চয়ই খোকা, তোমার কোনো ভয় নেই।
আমি গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন হাতের কনুইয়ের কাছে একটা খোঁচা লাগল, হাতটা সরানোর চেষ্টা করতেই দেখলাম কেউ-একজন শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাথা ঘোরাতেই দেখলাম, একটা সিরিঞ্জে করে কী-একটা ইনজেকশান দিচ্ছে আমাকে।