আমার ঘরে? আমি খুব অবাক হবার ভান করলাম, কোথায়?
ছোট খালা বললেন, তোর বিছানার নিচে।
বিছানার নিচে? কী আশ্চর্য! আমি তখনো অবাক হবার ভান করতে থাকি। জিনিসটা খুব সোজা নয়।
খালু আবার মেঘস্বরে বললেন, আংটিটা কেমন করে তোমার ঘরে গেল বোঝাতে পারবে?
আমি কী আর বলব? টুকুনজিল থাকলে পারতাম, কিন্তু সে চলে গেছে, এখন আমি কেমন করে বোঝাব? আমি মাথা নাড়লাম, পারব না।
ছোট খালা সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবারে হঠাৎ একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, তোকে এখানে আনাই ভুল হয়েছে। ছোটলোকের জাত। প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে গুণ্ডার মতো মারপিট করে এসেছিস। এই বয়সে সিগারেট খাওয়া শিখছিস। এতেই শেষ হয় নি, এখন চুরি করা শিখেছিস। কতদিন থেকে চুরি করছিস কে জানে। ছোটলোকের জাত, কোনদিন বাসায় কার গলায় ছুরি চালিয়ে দিবি–
ছোট খালার কথা শুনে আমার মাথায় একেবারে আগুন ধরে গেল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম। খালু বললেন, আহ্ শানু, তুমি কী বলছ এইসব?
ছোট খালা চেয়ার থেকে স্নাফিয়ে উঠে এক পাক ঘুরে আঙুল থেকে আংটিটা খুলে খাবার টেবিলের উপর ছুড়ে দিয়ে বললেন, এই আংটিটার কি পা আছে? নিজে নিজে হেঁটে গেছে বিলুর ঘরে হেঁটে হেঁটে গেছে?
এরপর যে জিনিসটা ঘটল তার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ করে আংটিটা ছোট একটা লাফ দিল টেবিলের উপর। তারপর ঠিক মানুষের হাঁটার ভঙ্গিতে টেবিলের উপর হেঁটে বেড়াতে শুরু করল। ছোট খালার কাছাকাছি এসে আবার ছোট ছোট দু’টি লাফ দিল আংটিটা।
ছোট খালা একটা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে পিছনে সরে এলেন। খালু দাঁড়াতে গিয়ে তাল হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনোমতে টেবিল ধরে সামলে নিলেন। আমিও একটা চিৎকার দিচ্ছিলাম, হঠাৎ বুঝে গেলাম কী হয়েছে। টুকুনজিল এসেছে। টুকুনজিল!!
ছোট খালা ঢোক গিলে বললেন, কী হচ্ছে এটা? কী হচ্ছে?
তার কথা শুনেই কি না জানি না, আংটিটা আবার হেঁটে বেড়াতে শুরু করল। আমি অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে বললাম, দেখেছ ছোট খালা? দেখেছ? এই আংটিটা নিজে নিজে হেঁটে যেখানে খুশি চলে যায়!
কেন? কেন যাচ্ছে? হায় আল্লাহ!
খালু আংটিটা ধরার চেষ্টা করলেন, ধরতে পারলেন না, হাত ফসকে আংটিটা একটা লাফ দিয়ে ডালের বাটিতে ড়ুবে গেল।
ঠিক তখন একটা আলোর ঝলকানি দেখলাম, সাথে সাথে ছোট খালা একটা ভয়ঙ্কর চিৎকার দিলেন।
খালু ছোট খালার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে, শানু? কি হয়েছে?
ছোট খালা কাঁপতে কাঁপতে তাঁর হাতটি মেলে ধরলেন, বল্টু আর মিলিও ছুটে এসেছে তাদের ঘর থেকে। সবাই মিলে দেখল হাতের উল্টো পিঠে ছোট গোল পোড়া দাগ।
বল্টু শুকনো মুখে বলল, সিগারেটের ছ্যাকা। ঠিক বিলুর মতো।
ছোট খালা প্রায় কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, এক্ষুণি হল। এইমাত্র—এইমাত্র কে জানি ছ্যাঁকা দিল।
হঠাৎ করে ছোট খালা আমার দিকে ঘুরে তাকালেন, আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এই বিলু—বিলু সব জানে। জিনের আছর আছে। আমি শুনেছি সারা রাত জিনের সাথে কথা বলে।
খালু ছোট খালার হাত ধরে বললেন, আহ! কী আজেবাজে কথা বলছ।
ছোট খালার হিস্টিরিয়ার মতো হয়ে গেল, চিৎকার করে বললেন, বাজে কথা বলছি আমি? বাজে কথা? ওর চোখের দিকে তাকাও, দেখেছ কী রকম দৃষ্টি? এটা কি মানুষের দৃষ্টি? হায় আল্লাহ, আমি কী সর্বনাশ করেছি। নিজের ঘরে শয়তান ডেকে এনেছি। বাণ মেরে দিচ্ছে, যাদু করে দিচ্ছে সবাইকে ছেলেপুলের সংসার আমার তছনছ করে দিচ্ছে—
আমি কিছু-একটা বলার চেষ্টা করলাম, খালু ধমক দিয়ে বললেন, যাও, তোমার ঘরে যাও!
আমি আমার ঘরে বসে শুনতে পেলাম ছোট খালা হাউ হাউ করে কাঁদছেন। কী যন্ত্রণা!
ফিসফিস করে বললাম, টুকুনজিল।
কি হল?
তুমি কোথায় গিয়েছিলে? ডেকে পাচ্ছিলাম না!
ইঞ্জিনটা ঠিক হয়েছে কি না পরীক্ষা করে দেখলাম।
ঠিক হয়েছে?
নিরানব্বই দশমিক নয় নয় নয় নয় নয় নয় নয় ভাগ।
তা হলে তো ঠিকই হয়ে গেছে।
সোনাতে ভেজাল মিশানো ছিল, আলাদা করি নি। তাই অল্পকিছু গোলমাল আছে।
কোথায় গিয়েছিলে? চতুর্থ গ্রহ। দ্বিতীয় চন্দ্র।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মঙ্গল গ্রহে? মঙ্গল গ্রহের চাঁদে?
হ্যাঁ।
এত তাড়াতাড়ি আবার ঘুরে চলে এসেছ। এত তাড়াতাড়ি?
আমি খুব তাড়াতাড়ি যেতে পারি।
কী মজা! তুমি এখন তোমার দেশে ফিরে যেতে পারবে?
পারব।
কবে যাবে?
সময় সংকোচনের প্রথম প্রবাহের দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল তরঙ্গের পর।
সেটা কবে?
শুরু হয়ে গেছে। আমি চমকে উঠে বললাম, তার মানে তুমি চলে যাবে?
হ্যাঁ। কালকে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধে। পরশুদিন বেশ কষ্ট হবে। তার পরের দিন খুব কঠিন, সাফল্যের সম্ভাবনা চার দশমিক তিন। তার পরের দিন সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি।
তুমি চলে যাবে।
টুকুনজিল কোনো উত্তর দিল না। একটু পরে বলল, তোমার মস্তিষ্কে অবতরঙ্গ তৈরি হচ্ছে, মূল তরঙ্গের পাশে দুটি ছোট তরঙ্গ—কেন এটা হচ্ছে?
তুমি চলে যাবে, তাই আমার মন খারাপ হচ্ছে।
মন খারাপ? মন খারাপ মানে কি?
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি মন খারাপ মানে জান না? তোমার কখনো মন খারাপ হয় না?
না। সেটা কেমন করে হয়?
আমি একটু মাথা চুলকালাম, যার কখনো মন খারাপ হয় না, তাকে কেমন করে বোঝাব মন খারাপ কী জিনিস? একটু ভেবে বললাম, মন খারাপ হচ্ছে মন ভালো হওয়ার উল্টোটা। হাসিখুশির উল্টো হচ্ছে মন খারাপ।