পরশুদিন ব্ল্যাক মার্ডারের মিটিং কোথায়?
স্কুলে।
স্কুলে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পরশুদিন ছুটি না?
তারিক গম্ভীর হয়ে হাসে। সার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, মিটিং করার জন্যে ক্লাসঘর খুলে দেয় কালীপদ। স্যার আর কালীপদ তাই আমাদের ব্ল্যাক মার্ডার দলের বিশেষ সদস্য।
শুনে আমি চমৎকৃত হলাম।
দুপুরে সুব্রত জানাল, তার কাছে “চকিত হিয়া” নামে একটা বড়দের উপন্যাস আছে, আমি পড়তে চাইলে নিতে পারি। বড়দের উপন্যাস পড়তে আমার খুব ভালো লাগে, খুশি হয়ে নিলাম আমি। নান্টু জিজ্ঞেস করল, তার জুপিটার ফুটবল ক্লাবে সেন্টার ফরোয়ার্ডের একটা জায়গা খালি আছে, আমি খেলতে চাই কি না—আমি খুব খুশি হয়ে রাজি হলাম। মাহবুব জিজ্ঞেস করল, সে একটা টেলিস্কোপ তৈরি করছে, আমি তার সাথে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে চাই কি না। আমি আগে কখনো গবেষণা করি নি, কিন্তু মাহবুব যদি করতে পারে আমিও নিশ্চয়ই পারব, তাই রাজি হয়ে গেলাম। মোট কথা, হঠাৎ করে ক্লাসে আমার অনেক বন্ধু হয়ে গেল।
১০. বিপদ বাসায়
এসে দেখি সারা বাসা থমথম করছে। বল্টু আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, আজ তোমাকে ধোলাই দেয়া হবে।
আমাকে? আমি ঢোক গিলে বললাম, কেন?
তুমি আমার আংটি চুরি করেছ।
আমি চমকে উঠলাম। কী সর্বনাশ! রা পড়ে গেছি? জোর করে অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, আমি!
হ্যাঁ। চুরি করে তোমার বিছানার নিচে রেখেছ।
বিছানার নিচে? আমি একটু অবাক হলাম, ঘুলঘুলির উপর রেখে গিয়েছিলাম, বিছানার নিচে কেমন করে এল?
বল্টু হাতে কিল দিয়ে বলল, আজকে তোমাকে রাম-ধোলাই দেবে। আম্মা বলেছে, তোমরা চোরের গুষ্টি।
ইচ্ছে হল বল্টুর মাথাটা ধড় থেকে ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলি, কিন্তু সেটা তো ইচ্ছে করলেই করা যায় না। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আমি ডাকলাম, টুকুনজিল।
কোনো সাড়া নেই। আমি আবার ডাকলাম টুকুনজিল–তুমি কোথায়?
তবু কোনো সাড়া নেই। তাহলে কি চলে গেছে? কিন্তু একবার আমাকে বলে যাবে না? সোনা দিয়ে বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ঠিক করার পর তার মহাকাশযান গতিবেগ ফিরে পেয়েছে, আর কোনো সমস্যা নেই, তাই আর দেরি করে নি। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আমার বিশ্বাস হতে চাইল না, আবার ডাকলাম, টুকুনজিল।
তবু কোনো সাড়া নেই।
টুকুনজিল থাকলে আর কোনো সমস্যা ছিল না—এত বড় একটা ব্যাপারের সামনে সোনার আংটি একটা তুচ্ছ জিনিস। কিন্তু টুকুনজিল যদি ফিরে চলে গিয়ে থাকে, তা হলে টুকুনজিলের কথা মুখে আনা মানে নিজেকে পাগল প্রমাণ করা। আগেরবার তো শুধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন—এবারে নিশ্চয়ই ধরে একেবারে পাগলাগারদে দিয়ে আসবেন।
বিছানার নিচে সোনার আংটিটা পাওয়া গেছে। এখন সবাইকে বোঝাব কেমন
করে? যদি টুকুনজিল ফিরে না আসে তাহলে বলা যায় ছোট খালার বাসায় থাকা আমার শেষ হয়ে গেল! ভালোই হল হয়তো, খামোকা মা-বাবা ভাই-বোন সবাইকে ছেড়ে এখানে পড়ে আছি। এখানে আসার পর থেকে কতরকম যন্ত্রণা! কিন্তু মা মনে বড় কষ্ট পাবেন। ভিন্ন গ্রহের এক প্রাণী যেন তার মহাকাশযান সারাতে পারে, সেজন্যে মোনার আংটি চুরি করেছি কথাটা কাউকেই বিশ্বাস করানো সম্ভব না। বাবা হয়তো বিশ্বাস কবেন, কিন্তু বাবা বিশ্বাস করলেই কী আর না করলেই কী?
আমার মনটা এত খারাপ হল যে বলার নয়, ইচ্ছে হল ডাক ছেড়ে কাঁদি, কিন্তু কেঁদে লাভ কি?
খাবার টেবিলে কেউ কোনো কথা বলল না। খালু অবশ্যি এমনিতেই বেশি কথা বলেন না, ছোট খালা সেটা পুষিয়ে নেন। আজ ছোট খালা একটিবার মুখ খুললেন না। সাধারণত বল্টু আর মিলি বেশ বকরবকর করে, আজ মনে হয় ভয়ের চোটে তারাও বেশি কথা বলছে না। বর মুখে অবশ্যি সারাক্ষণই একটা আনন্দের হাসি লেগে রইল, ‘আমাকে ধোলাই দেয়া হবে, এর মাঝে বল্টু যদি আনন্দ না পায়, তাহলে কে আনন্দ পাবে?
পুরো খাওয়াটা কোনো রকম কথাবার্তা ছাড়াই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু এর মাঝে টেলিফোন এল। ছোট খালু টেলিফোনে খানিকক্ষণ কথা বলে আবার খেতে বসলেন, টেলিফোন করেছেন ডাক্তার চাচা, কিছু-একটা অস্বাভাবিক জিনিস ঘটেছে তাঁর চেম্বারে। ছোট খালু নিজে থেকে না বললে জানার উপায় নেই, আমার আজকে জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না। ছোট খালা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে কামরুলের চেম্বারে।
চুরি।
কী চুরি হয়েছে?
এখনো ধরতে পারছে না। কিছু ফাইল। বিলুর ফাইলটাও।
ফাইল দিয়ে কী করবে চোর?
সেটাই তো কথা।
কেমন করে চুরি হল?
বুঝতে পারছে না, দরজা-জানালা কিছু ভাঙে নি, কী ভাবে ভিতরে ঢুকে গেছে।
আশ্চর্য ব্যাপার!
এইটুকু কথা বলার পর আবার সবাই চুপ করে গেল। ইলিশ মাছের ডিম রান্না হয়েছে আজকে, আমার খুব ভালো লাগে ইলিশ মাছের ডিম খেতে, কিন্তু আজ আর খাওয়ায় কোনো আনন্দ নেই।
খাওয়া শেষ হবার পর খালু বললেন, বল্টু আর মিলি, তোমরা তোমাদের ঘরে যাও।
বল্টু বলল, আমরা থাকি, আব্বা?
ছোট খালু গম্ভীর গলায় বললেন, না।
বল্টু আর মিলি উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারার চেষ্টা করতে লাগল। খালু চেয়ারে হেলান দিয়ে মেঘস্বরে বললেন, বিলু, তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।
কথাটা কি আমার আর বুঝতে বাকি থাকে না, তবু আমি মুখে একটা কৌতূহলের ভাব ফোটানোর চেষ্টা করি, কি কথা, খালু?
তোমার ছোট খালার একটা আংটি আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটা তোমার ঘরে পাওয়া গেছে।