দেখা গেল সবাই জানে না। স্যার তখন বেশ সময় নিয়ে আমাদের আর্কিমিডিসের সূত্রটা বুঝিয়ে দিলেন। আর্কিমিডিস প্রথম যখন সূত্রটা ভেবে বের করেছিলেন, তখন যে ন্যাংটো হয়ে রাস্তায় ছুটতে শুরু করেছিলেন, সেই গল্পটাও বললেন। গল্পটা আগেই জানতাম, কিন্তু ন্যাংটো হয়ে গোসল করার দরকারটা কী ছিল, সেটা কখনোই আমি বুঝতে পারি নি।
আর্কিমিডিসের সূত্রটা বুঝিয়ে দিয়ে স্যার বললেন, এবার তাহলে তোদর একটা প্রশ্ন করি, তোরা তার ঠিক উত্তর ভেবে বের করতে পারিস কি না দেখি। এক সপ্তাহ সময় দেব। একটা বড় চৌবাচ্চার মাঝে একটা নৌকা ভাসছে, সেই নৌকায় তুই বসে আছিস। নৌকায় তোর সাথে আছে একটা বড় পাথর। চৌবাচ্চাটা একেবারে কানায় কানায় ভরা। এখন তুই পাথরটা নৌকা থেকে তুলে চৌবাচ্চার মাঝে ছেড়ে দিলি। পানি কি চৌবাচ্চা থেকে উপচে পড়বে? একই থাকবে? নাকি পানির লেভেল একটু কমে যাবে?
স্যার একটু হেসে বললেন, যদি উত্তরটা ভেবে বের করতে না পারিস, মনখারাপ করিস না, অনেক বাঘা-বাঘা প্রফেসরও পারে নি।
উত্তরটা ভেবে বের করার জন্যে স্যার এক সপ্তাহ সময় দিয়েছেন, কিন্তু আমি ভুখন তখনই ভুরু কুঁচকে ভাবতে শুরু করলাম। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে ভাবতে আমার খুব ভালো লাগে। স্যার ক্লাসে আবার পড়ানো শুরু করেছেন, কিন্তু আমি আর মন দিতে পারছি না। ঘুরেফিরে শুধু মনে পড়ছে একটা ভরা চৌবাচ্চায় একটা নৌকা—নৌকার মাঝে আমি বসে আছি পাথরটা নিয়ে।
উত্তরটা কি হবে আমি প্রায় সাথে সাথেই বের করে ফেললাম। আর্কিমিডিস যখন তাঁর সূত্র বের করেছিলেন তখন তার যেরকম আনন্দ হয়েছিল, আমার প্রায় ঠিক সেরকম আনন্দ হল, লাফিয়ে উঠে হাত তুলে বললাম, আমি বলব স্যার, আমি বলব–
স্যার অবাক হয়ে বললেন, কি বলবি?
চৌবাচ্চার পানির লেভেল বাড়বে না, কমবে–
স্যার চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন, তুই উত্তরটা বের করে ফেলেছিস!
জ্বি স্যার আমি উত্তেজনায় ঠিক করে কথা বলতে পারছিলাম না, হড়বড় করে কোনোমতে উত্তরটা বললাম।
স্যার অবাক হয়ে আমার উত্তরটা শুনলেন, তার মুখে একটা আশ্চর্য হাসি ফুটে উঠল, তারপর হেঁটে এসে আমার পিঠে থাবা দিয়ে বললেন, ভেরি গুড। ভেরি ভেরি গুঙ। ভেরি ভেরি ভেরি গুড। আমার একজন প্রফেসর বন্ধু আছে, কলেজে ফিজিক্স পড়ায়, সেও পর্যন্ত এর ঠিক উত্তর দিতে পারে নি। তাই দিয়ে দিলি—
খুশিতে আমার চোখে একেবারে পানি এসে গেল। স্যার বললেন, বিলু, আজ থেকে তুই হলি ক্লাস ক্যাপ্টেন। আমি লিটনের দিকে তাকালাম, তার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা, মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। হিংসে কার না হয়? সবারই হয়, কিন্তু সেটা চেহারায় প্রকাশ করে সবাইকে জানিয়ে দেয়াটা তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। লিটন ক্লাসের ফার্স্ট বয় এবং ক্লাস ক্যাপ্টেন। সে দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক এবং ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন। সবকিছুতেই সে আছে, ফাস্ট বয়রা যেটা খুশি সেটা করতে পারে। কিন্তু আজ তার ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্বটা নিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে আমাকে, ক্লাসে সবার সামনে, আনন্দে আমার বুকটা ভরে গেল। কিন্তু আমি লিটনের মতো এত বোকা নই, তাই মহানুভব মানুষের মতো বললাম, স্যার, আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন হতে চাই না, স্যার।
কেন?
ক্লাস ক্যাপ্টেনদের সবার উপর সর্দারি করতে হয় বলে কেউ তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না।
সর্দারি?
জ্বি স্যার, ক্লাসে দুষ্টুমি করলে নাম লিখে স্যারদের কাছে নালিশ করতে হয় খু্–খারাপ কাজ স্যার।
স্যার মনে হয় খুব অবাক হলেন শুনে, ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, বিলু কি ঠিক বলছে?
সবাই মাথা নাড়ল, ঠিক স্যার, একেবারে ঠিক।
আমি বললাম, স্যার, নিয়ম করে দেন একেক সপ্তাহে একেকজন ক্লাস ক্যাপ্টেন হবে। তাহলে ক্যাপ্টেন আর মিছেমিছি নাম লিখবে না, কারণ যার নাম মিছেমিছি লিখবে, সে যখন ক্যাপ্টেন হবে সে শোধ নেবে—
মিছেমিছি? মিছেমিছি কি নাম লেখা হয়?
সবসময় হয় না স্যার, মাঝে মাঝে হয়। কারো কারো নাম বেশি লেখা হয়, কারো কারো নাম কম লেখা হয়–
সত্যি?
পুরো ক্লাস আবার মাথা নাড়ল, লিটন ছাড়া। সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
স্যার খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্লাসের মাঝখানে, তারপর বললেন, ঠিক আছে আজ থেকে তাই নিয়ম। একেক সপ্তাহে একেকজন ক্লাস ক্যাপ্টেন।
ক্লাসের সবাই একটা আনন্দের মতো শব্দ করল। আমার বুকটা মনে হল দশ হাত ফুলে গেল সাথে সাথে।
ঘন্টা পড়ার পর স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে যাবার পর ভেবেছিলাম লিটন চোখ লাল করে আমার কাছে ছুটে আসবে। কিন্তু সে মুখ গোঁজ করে নিজের জায়গায় বসে রইল। তারিক আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, তুই মহা ফিঞ্চুরাস মানুষ।
ফিঞ্চুরাস? সেটা মানে কি?
যার মাথায় ফিচলে বুদ্ধি এবং যে হচ্ছে ডেঞ্জারাস, সে হচ্ছে ফিঞ্চল্লাস। কী সুন্দর লিটনের মাথাটা ক্লাসের সামনে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলি।
পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলাম?
হ্যাঁ, যখন চৌবাচ্চার উত্তরটা দিলি, মনে হল হিংসায় লিটনের একেবারে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।
তারিককে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খুব খুশি দেখা গেল। গলা নামিয়ে বলল, আমাদের ব্ল্যাক মার্ডার দলের মেম্বার হবি?
কী করতে হবে?
আঙুল থেকে এক ফোঁটা রক্ত দিয়ে রক্ত শপথ করতে হবে।
ঠিক আছে। কখন?