কোথায় সাইকেল চালাচ্ছে?
নরসিংদি। ছোট খালুর কি পড়া শেষ হয়েছে খবরের কাগজ?
জানি না, দেখ গিয়ে।
সাথে সাথে আমি শোওয়ার ঘরে ঢুকে গেলাম, ছোট খালু নিশ্চয়ই বাথরুমে, ঘরঘর শব্দ করে গলা পরিষ্কার করছেন। বিছানার উপর খবরের কাগজটা পড়ে আছে, সেটা তুলে নেবার আগে ড্রেসিং টেবিলের উপর তাকালাম, কী কপাল! সত্যি সত্যি ছোট খালার সোনার আংটি দুইটা। চট করে একটা তুলে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম, আগে এরকম বড় জিনিস কখনো চুরি করি নি, বুকটা ধকধক্ করে শব্দ করতে থাকল।
খাবার টেবিলে বসে মিছেই খবরের কাগজটা দেখার ভান করতে থাকলাম। বল্টু জিজ্ঞেস করল, উঠেছে খবরটা?
নাহ্।
আমি তখনই বুঝেছিলাম গুলপট্টি। তিন দিন কোনো মানুষ একটানা সাইকেল চালাতে পারে? পিশাব-পাইখানা?
আমার ঘরে এসে আমি ফিসফিস করে ডাকলাম, টুকুনজিল—
সোনা এনেছ?
হ্যাঁ। চুরি করে এনেছি, ধরা পড়লে একেবারে জান শেষ হয়ে যাবে।
জান শেষ হয়ে যাবে? মেরে ফেলবে তোমাকে? হৃৎস্পন্দন থেমে রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাবে? স্নায়ু—
ওটা একটা কথার কথা। জান শেষ হবে মানে মহা বিপদ। এই আংটিটা আমি ঘুলঘুলির উপর লুকিয়ে রাখি। তুমি যেটুকু ব্যবহার করতে চাও ব্যবহার কর, তারপর ফিরিয়ে দিতে হবে ধরা পড়ার আগে।
ফিরিয়ে দিতে হবে কেন?
সোনার আংটি ফিরিয়ে দিতে হবে না? কতক্ষণ লাগবে তোমার?
তিন ঘন্টা তেত্রিশ মিনিট বারো সেকেন্ড।
এতক্ষণ লাগবে? খামচি মেরে একটু সোনা নিয়ে আংটিটা ফেরত দিতে পারবে না?
না। আমার মহাকাশযানের বৈদ্যুতিক যোগাযোগে অনেক বড় সমস্যা। এই জন্যে স্বর্ণ প্রয়োজন। বৈদ্যুতিক সুপরিবাহী মৌলিক পদার্থ। তিন ঘন্টা তেত্রিশ মিনিট বারো সেকেন্ড।
বল্ট বাইরে থেকে ডাকে, বিল, ড্রাইভার এসে গেছে।
আমি চেয়ারে পা দিয়ে ঘুলঘুলির উপর সোনার আংটিটা রেখে বের হয়ে এলাম।
গাড়িতে ওঠার সময় শুনলাম ছোট খালা বলছেন, ড্রেসিং টেবিলের উপর আংটিটা রেখেছিলাম, কোথায় গেল?
আমি না শোনার ভান করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। মনে হয় আমার কপালে বড় দুঃখ আছে আজ।
বল্টু আর মিলিকে স্কুলে নামিয়ে দেবার পর ড্রাইভার আমাকে আমার স্কুলে নামিয়ে দেয়। আজকাল প্রায়ই আমি বল্টুর স্কুলে নেমে পড়ি, সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে আমার স্কুলে আসি। ড্রাইভার বেশ খুশি হয়েই আমাকে নামিয়ে দেয়, সকালের ভিড় ঠেলে গাড়ি চালাতে আরও বেশি ভালো লাগে না মনে হয়। তা ছাড়া আমাকে নামিয়ে দিয়ে সে রাস্তা থেকে কিছু লোক তুলে একটা খেপ দিয়ে কিছু বাড়তি পয়সা বানিয়ে নেয়। হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে আমার বেশ লাগে। কত রকম মানুষজন, কত রকম দোকানপাট দেখা যায়।
স্কুলে যাবার সময় কয়দিন থেকে আমার একটা আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছে। শুধু মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। টুকুনজিলের সাথে ভাব হবার পর আজকাল অবশ্যি আর কিছুতেই বেশি অবাক হই না। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে মহাকাশের এক আগন্তুক এই পৃথিবীতে এসে শুধু আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, জিনিসটা চিন্তা করতেই আমার বুকের ভিতর কেমন জানি শিরশির করতে থাকে। ইস! কাউকে যদি বলা যেত, কী মজাটাই-না হত!
কিন্তু এই অনুসরণের ব্যাপারটা অন্যরকম। সাদা রঙের একটা মাইক্রোবাস আমি প্রায়ই দেখি। ড্রাইভারের পাশে একজন লাল রঙের বিদেশি বসে থাকে। আমার কেন জানি মনে হয় মাইক্রোবাসটা আমার পিছু পিছু যেতে থাকে। হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমি যদি পিছনে ঘুরে তাকাই, মনে হয় মাইক্রোবাসটা থেমে যায় আর লাল রঙের মানুষটা চট করে আমার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। আমি কেমন জানি নিঃসন্দেহ হয়ে যাই যে টুকুনজিলের সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে, কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে কী করা যায় সেটা শুধু বুঝতে পারছিলাম না।
ক্লাসে এসে দেখি দেয়ালে একটা নূতন দেয়াল পত্রিকা লাগানো হয়েছে। বিশেষ মহাকাশের প্রাণীসংখ্যা। বড় বড় করে লেখা “সম্পাদক ও মুস্তাফিজুর রহমান লিটন।” সেখানে মহাকাশের প্রাণী সম্পর্কে ভয়াবহ সমস্ত তথ্য দেয়া হয়েছে। বিদেশি ম্যাগাজিন থেকে মহাকাশের প্রাণীর কাল্পনিক ছবি কেটে লাগানো হয়েছে, সেইসব ছবি দেখলে পিলে চমকে যায়। একটা প্রাণীর তিনটে চোখ, আরেকটা প্রাণীর লকলকে লাল জিব, একজন মানুষকে ধরে চিবিয়ে খাচ্ছে, আরেকটা মাকড়সার মতো দুইটা পা দিয়ে ভয়ানক একটা অস্ত্র ধরে রেখেছে। সেখানেই শেষ হয় নি, মহাকাশের প্রাণী পৃথিবীতে এসে কীরকম ভয়ানক তাণ্ডবলীলা শুরু করবে, সেটার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে। সেই প্রাণী থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে কি কি সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে, সেটাও লিটন অনেক খেটেখুটে লিখেছে।
স্যার ক্লাসে এসে দেয়াল পত্রিকা দেখে চুপ মেরে গেলেন। লিটন খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে, স্যার?
স্যার অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ভালো হয়েছে।
আমেরিকায় তয়ের একটি পত্রিকা বের হয়, সেখান থেকে ছবিগুলো নিয়েছি।
বেশ বেশ।
সম্পাদকীয়টা পড়েছেন, স্যার?
পড়েছি।
কেমন হয়েছে, স্যার?
ভালোই হয়েছে–তবে তুই ধরে নিয়েছিস মহাকাশের প্রাণী হবে খুব ভয়ঙ্কর। সেটা তো না-ও হতে পারে।
কিন্তু স্যার, আমি একটা সিনেমা দেখেছি, সেখানে দেখিয়েছে—
ধুর। সিনেমা তো সবসময়ে গাঁজাখুরি হয়।
স্যার ক্লাসে পড়ানো শুরু করলেন। পড়াতে পড়াতে হঠাৎ থেমে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা সবাই আর্কিমিডিসের সূত্র জানিস?